প্লিজ প্রধানমন্ত্রী, আমার মাকে বাঁচান…

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ০৬/০৮/২০১১ - ৮:৩২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

**কখনো ভাবিনি যেই সচলায়তনে আমি অনুকাব্য, কবিতা, ছড়া লিখেছি; সেই সচলায়তনে আমাকে এক অসহায় সন্তান হয়ে দুঃখগাঁথা লিখতে হবে। বড় বিক্ষিপ্ত, হতাশা-ভারাক্রান্ত মন নিয়েই আজ লিখছি। তাই অনুরোধ জানাই ভুলভ্রান্তিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্যে…**

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জানি আপনি অনেক ব্যস্ত। রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে আপনি সর্বদা ব্যস্তই থাকেন। হয়তো আমার কথাগুলো আপনার নজরেই আসবে না। তবু এই আশাবাদ থেকেই লিখছি যে, এক মৃত্যুপথযাত্রীমায়ের শয্যাপাশে বসে থাকা অসহায় সন্তানের করুণার্তি আপনার হৃদয়কে নিশ্চয়ই স্পর্শ করবে।

অনেকদিন আগের কথা। বাংলায় তখন পাল শাসনামল চলছে। রাজা রামপাল তার বহু অনুচরসহযোগে নৌ-ভ্রমণে বের হয়ে ঘুরতে ঘুরতে একসময়ে বঙ্গোপসাগরে এসে উপস্থিত হন এবং গতিপথের দিশা হারিয়ে ফেলেন। অতঃপর দিকভ্রান্ত হয়ে ভাসতে ভাসতে যে স্থানটিতে এসে তিনি তার গতিপথ খুঁজে পান, তাই পরবর্তীতে রামগতি নামে পরিচিত হয়। প্রচলিত উপকথায় এভাবেই উঠে আসে রামগতির নামকরণের পটভূমি। বর্তমানে এটি লক্ষ্মীপুর জেলার অন্তর্গত সর্বদক্ষিণের উপজেলা।

রাজা রামপালকে পথের দিশা দেওয়া সেই রামগতি নিজেই আজ মেঘনা নদীর ভয়ালরূপে দিশেহারা। সেইসাথে দিশেহারা রামগতির যুগযুগ ধরে লড়াই করে আসা নদীপীড়িত মানুষগুলো। তাদের চোখেমুখে আজ পিতৃপুরুষের ভিটে-মাটি ছাড়া হয়ে পথে বসার আতঙ্ক।

নদীবিধৌত বাংলাদেশের একটি উপকূলীয় উপজেলা হিসেবে রামগতির সাথে মেঘনা’র সম্পর্কটা অনেকটা অম্ল-মধুর ধরণের। কখনও বন্যার প্রবলতোড়ে ভেসে যায় কৃষকের ফসল, কখনও নদীভাঙ্গনে জর্জরিত হয় নদীতীরবর্তী মানুষগুলো, আবার কখনো বা নদীজুড়ে ঝাঁকেঝাঁকে ইলিশের আভাস জেলেদের মুখে হাসি ফোটায়। আর তাই শত প্রাকৃতিক দুর্যোগকে মোকাবিলা করে আজও এ অঞ্চলের মানুষ স্বপ্ন দেখে বাঁচার। কিন্তু ভাঙ্গনের তীব্রতায় বিশাল রামগতি ক্রমেই ক্ষীণকায় হয়ে আসছে। ইতিমধ্যে গ্রামের পর গ্রাম আর বহু বাজার-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভেঙ্গে সর্বনাশা নদীটি এখন রামগতির প্রাণকেন্দ্র বলে পরিচিত আলেকজাণ্ডার বাজার ছুঁইছুঁই করছে।

২০০০-২০০১ সালে প্রবলভাঙ্গনের পর নদী কিছুটা শান্ত হয়ে এলে রামগতির মানুষ নিজেদের গুছিয়ে নিতে শুরু করে এবং সেটা অনেকটা সম্ভবপরও হয়ে উঠে। নতুন পৌরসভা হওয়ার ফলে শিক্ষায়, ব্যবসা-বাণিজ্যে রামগতি অত্র অঞ্চলে ভালো অবস্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়। কিন্তু মাত্র বছর দশেকের ব্যবধানে আবারো নদীভাঙ্গনের ভয়াবহতায় সে উন্নতি মুখথুবড়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে বেশকয়েকটি স্কুল ভেঙ্গে গেছে, যার ফলে একই স্কুলে বর্তমানে দু’তিনটা স্কুলের পাঠকার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে। তাই অতিদ্রুত ব্যবস্থা নিতে না পারলে হয়তো রামগতিকে এ যাত্রা আর বাঁচানো যাবে না।

এমনি সময় সবচেয়ে বেশি করে চোখে পড়ছে রামগতির রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নিষ্ক্রিয়তা। আওয়ামী লীগ, বি এন পি, জাসদ(জে এস ডি), জামায়াতে ইসলামী, বিকল্পধারাসহ সকল দলের শীর্ষনেতৃত্বই আশ্চর্যরকমের নিষ্ক্রিয়তা প্রদর্শন করেছে। এলাকাবাসীর মতে, ইতিমধ্যে উপরমহলে যোগাযোগ করা হলেও মূলতঃ স্থানীয় সংসদ সদস্য বিরোধীদলের হওয়াতেই নদীভাঙ্গন প্রতিরোধে যথাযথ পদক্ষেপ আসছে না। উল্লেখ্য, বিগত ২০০৮-২০০৯ এর নির্বাচনে রামগতি-কমলনগর আসনে মহাজোটপ্রার্থী আব্দুর রব চৌধুরী, বি,এন,পি প্রার্থী এবিএম আশ্রাফ উদ্দিন নিজানের কাছে পরাজিত হন। তবে শুধু রামগতি উপজেলার ভোটে মহাজোটপ্রার্থী এগিয়েই ছিলেন। এটা কি মহাজোট সরকারের নীতিনির্ধারকদের বোঝা উচিত নয়, যে রামগতিতে বিগত ’৯৬ এর নির্বাচনেও আওয়ামীলীগ মাত্র ২০,০০০ এর মত ভোট পেয়েছিলো, সেখান থেকে তারা ’০৮ এর নির্বাচনে প্রায় ৬০,০০০ হাজার ভোট পেয়েছে। আজ যদি তারা এ অঞ্চলের মানুষের পাশে দাঁড়ায় তাহলে তাদের ভোট বাড়বে বৈ কমবে না। আর তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী তো একটি জাতির নেতা। তিনি পুরো জাতির ভালোর জন্য কাজ করবেন, এটাই জাতি আশা করে। সেখানে এ ধরনের আঞ্চলিক বিবেচনা কতটুকু গ্রহণযোগ্য?

আবার কারো কারো মতে, রামগতিতে নদীভাঙ্গন প্রতিরোধে সরকার যে টাকা খরচ করবে তা হবে ‘উলুবনে মুক্ত ছড়ানো’র মত। কেননা, অনুন্নত রামগতি থেকে সে টাকা কখনোই সরকারের কোষাগারে উঠে আসবে না। একথার জবাবে বলতে চাই, রামগতি এখন মোটেই অনুন্নত কোনো জনপদ নয়, সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে সঙ্গী করে এর বর্তমানও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। জাতীয়ভাবে বিভিন্নক্ষেত্রে রামগতি তার অবদান রেখে চলছে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্নপ্রান্তে মেঘনার মিঠে ইলিশের ঝাঁক সরবরাহ করছে এই রামগতির নদীপাড়ের জেলেরা। যে চিংড়ি কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রার যোগান দেয়, সেই চিংড়ির রেণু সারাদেশে সরবরাহ করে এই রামগতি। উপাদেয় সবজি ঢেঁড়সের(ভেণ্ডি) শতকরা ৭৫ভাগ আসে এই রামগতি থেকে। এছাড়াও নারিকেল, সুপারিসহ আরও নানান ফল-ফলাদি, সবজি ও নদীর মাছের যোগান দেয় রামগতি। সোনালী মাছ, সোনার ফসলের মতো রামগতি অনেক সোনার ছেলের প্রসূতিও। তাই, দয়া করে রামগতিকে অবহেলা না করে একে বাঁচাতে এগিয়ে আসুন।

এদিকে, শীর্ষনেতৃবৃন্দের নিষ্ক্রিয়তায় রামগতিবাসী চুপ করে থাকে নি। তারা নিজেরাই রাস্তায় নেমে এসেছে। জনে জনে টাকা তুলে দলমত নির্বিশেষে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় তা মিডিয়ায় উঠে আসছে না। আশাকরি টেলিভিশন, বেতার ও প্রিন্টমিডিয়াগুলো শীঘ্রই যথাযথ গুরুত্বের সহিত তা তুলে ধরবেন।

গত ৩১শে জুলাই,২০১১ রামগতিতে প্রায় ২০হাজার লোকের উপস্থিতিতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। আমার সুযোগ হয়েছিলো ওই দিনের মানববন্ধনে এবং তার আগেরদিন সন্ধ্যার পথসভায় থাকার। সেইসূত্রে খুব কাছ থেকে অনুভব করেছি মানুষগুলোর আকুলতাকে। সেদিনের পথসভায় কোনো আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী বলে নি, “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু”; কোনো বি,এন,পি নেতাকর্মী বলে নি, “বাংলাদেশ জিন্দাবাদ”; কোনো জাসদ নেতাকর্মী বলে নি, “সমাজতন্ত্র চিরজীবী হোক”; কোনো জামাত শিবির নেতাকর্মী বলে নি, “ইসলামী শাসন কায়েম হোক”; সবার অন্তরে ও মুখে কেবল একটি কথাই ধ্বনিত হয়েছে, “নদীভাঙ্গন প্রতিরোধ হোক, রামগতি চিরজীবী হোক”। পথসভার কোনো এক বক্তা বলছিলেন, “একাত্তরে যখন এদেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো তখন এদেশেরই কিছুলোক তার বিরুদ্ধে কাজ করেছিলো, যাদেরকে আমরা রাজাকার বলি। কিন্তু আজ রামগতিতে কোনো রাজাকার নেই; আজ রামগতির প্রতিটি মানুষই মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিটি মানুষই নদীভাঙ্গন থেকে রামগতির মুক্তি চায়।” এতজন ‘মুক্তিযোদ্ধা’র আর্তি আপনি কিভাবে ফেরাবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী??

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রামগতিতে একটি স্মৃতিটিলা স্থাপন করেছিলেন। কালের সাক্ষী হয়ে সেই স্মৃতিটিলা আজও এক মহামানবের স্মৃতিচিণ্‌হ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রামগতির বুকে। কিন্তু নদীভাঙ্গনে তাও আজ বিলীন হওয়ার সম্মুখীন। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা কি তাঁর বাবার স্মৃতিরক্ষার্থে হলেও রামগতিকে বাঁচাতে এগিয়ে আসবেন???

একটা সময় পর্যন্ত নদীভাঙ্গন ছিলো পুরোই প্রকৃতির হাতে। মানুষের কিছুই করার ছিলো না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির সহায়তায় মানুষ এখন নদীশাসনে অনেকখানিই সক্ষম। তাই রামগতবাসীর এখন একটাই চাওয়া, তাদের জন্য যত থোক-বরাদ্দ আছে, যত রিলিফ-রেশন আছে, সব দিয়ে হলেও সরকার যেন রামগতিকে বাঁচাতে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়।

--বাংলামায়ের ছেলে


মন্তব্য

জহির  আহমাদ এর ছবি

আপনার লেখাটা যাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন তিনি এখন আর এসব বিষয়ে খোঁজ রাখার সময় পান বলে মনে হয় না ।

বানিজ্যমন্ত্রী যেরকম কম খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন, পানিমন্ত্রী হয়ত বলবেন পানিতে বসবাস করা শিখে নিতে !

রামগতির যতজন সরকারি কর্মকর্তা আছে তাগো ঘাড়ধাক্কা মেরে ঢাকা পাঠিয়ে দেন ! কোনোদিন যদি টাকাপয়সা / সরকারি ফান্ড নিয়া ফিরতে পারে তাইলে ঢুকতে দিবেন । নয়তো এগুলার দরকার কী ? আর আলটিমেটাম দিয়া দেন, ৩ দিনের মইধ্যে যদি বাঁধের কাজ না শুরু করা হয় তাইলে রামগতিবাসী স্বাধীনতা ঘোষনা করতে বাধ্য হবে । পতাকার ডিজাইন কইরা ফালান ! বিদেশী এমব্যাসী আর হাইকমিশনগুলায় চিঠি দেন, প্রয়োজনে রামগতিবাসীর গনস্বাক্ষর নেন ॥ মধ্যপ্রাচ্যের এমব্যাসীগুলায় রামগতির বড় মসজিদগুলার হুজুরদের পাঠানোর ব্যবস্থা করেন !! বাকীটা আল্লাহ ভরসা !!!

এত কথা কইলাম বলে মনে কিছু নিয়েন না, আমার বাড়ীও লক্ষ্মীপুর সদর ! লক্ষ্মীপুর নিয়া দুয়েকটা কথা বলার হক আছে !! আমাদের সমস্যা সমাধানের ক্ষমতাও আল্লাহপাক রাব্বুল আলামিন আমাদের দিছে বলে মনে করি !!!

বাংলামায়েরছেলে এর ছবি

না ভাই, কিছু মনে নেই নাই ...শুধু অনুরোধ পাশে থাইকেন...নাইলে আমাগো বাড়ি ভাইঙ্গা গেলে আম্নেগো বাড়িত গিয়া ভীড় করমু কইলাম...

জহির  আহমাদ এর ছবি

আমরাও তো ভাই বাংলা মায়ের ছেলে,,,, আন্নের বাড়ি আর আঙো বাড়ি তো তাইলে আলিদা ন ! আঙো বাড়ি আইজ্জা কয়েক দশক অইল খালি হড়ি রইছে, থাইকতে অইলে উলির বাসা আর মেটকুলির বাসা ভাঙ্গি ভালা করি ঝাড়ি হুছি লওন লাইগবো আরি এক্কানা, তয় নো ফ্রবলেম, বাড়ির খু্ন্ডি, বেড়া, দরমা, হালা মাশাআল্লায় দিলে এবোতালিকও শক্ত আছে । আইয়োনের আগে খালি এক্কানা গলায় খাঁইক মারি আওয়াজ দিয়েন !
আর কোনো কিছু করার থাইকলে শরমাইয়েন না, কই হালাইয়েন, আমরা আছি আন্নেগো লগে !

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

সরকার পুনোপুনিতে ব্যস্ত, সরকারের এত সময় নাই রে ভায়া।

বাংলামায়েরছেলে এর ছবি

সংবাদপত্র এবং টিভির সাংবাদিক ভাইদের প্রতি রামগতির মানুষের দুর্দশার কথা, আন্দোলন-সংগ্রামের কথা সারাদেশের মানুষের সামনে তুলে ধরার অনুরোধ জানাচ্ছি...

Sajib Kundu এর ছবি

বাংলাদেশে উত্‍পাদিত সয়াবিন বীজের ৬০% উত্‍পন্ন হয় লক্ষ্মীপুর জেলায়, তাই এ জেলাকে সয়াবিন এর রাজধানী বলাহয়। সয়াবিন উত্‍পাদনে রামগতি হচ্ছে এই রাজধানীর নিউক্লিয়াস। রামগতি-কমলনগরের অব্যাহত নদীভাঙ্গনে বাংলাদেশের সয়াবিন উত্‍পাদন হুমকিতে পড়বে।এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা রামগতির কৃষকরা দেশের শ্রেষ্ঠ সয়াবিন চাষী। সয়াবিন একটি রবি শস্য। প্রতি বছরই নদী ভাঙ্গনের কারণে বিভিন্ন স্থানে বেড়ীবাঁধ বিলীন হয়ে যায়। গত রবি মৌসুমের শেষ দিকে (এপ্রিল-মে ২০১১) এসব স্থান দিয়ে অতিরিক্ত জোয়ারের লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ে এবং প্লাবনের ফলে প্রায় ৩০০কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়। নদী বাঁধ প্রকল্পে কত কোটি টাকার বরাদ্দ প্রয়োজন?

বাংলামায়ের ছেলে এর ছবি

সহমত।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।