মাঝখানে নিষ্ঠুর জীবনের উথাল পাথাল নানান টানাপোড়নে ধারাবাহিক এই লেখায় লম্বা একটা বিরতি পরে গেলো। তাই হয়তো কিছুটা খেই হারিয়ে ফেলেছি। সে যাই হোক, আগের পর্বে ‘চলবে’ লিখে ফেলেছি বলে কথা। এখন না লিখলে পরে মুখ দেখানো বন্ধ হয়ে যাবে।
পর্ব এক , পর্ব দুই , পর্ব তিন ,
আমরা ছিলাম প্যারিসের হোটেল রুমে। সকালে চোখ মেলে দেখি বাকি সবাই গোসল করে রেডি। ভেবেছিলাম বিদেশি মেয়েরা আমাদের মত না; টাইম মত ঝটপট রেডি হয়ে যাবে। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম তাহারা পাক্কা এক ঘণ্টা পর বের হয়ে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে সাতখুন মাফ করিয়ে নিলো। নাস্তা হোটেলের রুমে বসেই সেরে ফেলেছি। বের হয়ে সোজা মেট্রোতে চলে গেলাম। ট্রেন এসে কয়েক সেকেন্ডর জন্য থামে। দরজা খোলা মাত্রই এত লোক উঠা নামা করে যে রীতিমতো ভয় লাগে যে সবাই একসাথে উঠে সারতে পারবো কিনা। এই সাত সকালে সেই ভয় সত্যি হয়ে গেলো। দৌরে এসে উঠে গেলাম আমি কিন্তু বাকিরা কেউই উঠতে পারলো না। মেট্রোর দরজা বন্ধ হয়ে গেলো। আমি ভ্যাবলা কান্তের মত খাঁচায় আটকে পরা প্রাণী; জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম। যে যায়গায় ট্রেন পালটে অন্যটাতে উঠতে হয় সে জায়গার নামটা সহজেই মনে রাখার মত ছিল। তাই এ যাত্রায় কোন অসুবিধা হল না। আমি আগে পৌঁছে বাকিদের জন্য অপেক্ষা করলাম। সবাই আসার পর একসাথে ল্যুভর মিউজিয়ামের উদ্দেশ্য রওনা হলাম।
২৫ বছরের নিচের ইউরোপিয়ান নাগরিকদের জন্য মিউজিয়ামে টিকেট লাগে না। এলনাজের তাই ১0 ইউরো বেচে গেলো। ভালো করে নিয়মাবলী পড়ে দেখালাম বেকারদেরও লাগে না। এ তো ব্যাপক অবস্থা! আমরা তো বেকারই। কিন্তু মুস্কিল হল আমাদের বেকারত্বের প্রমাণ পত্র নাই। তাই টিকেট কিনতে হল।
ভেতরে ঢোকার আগেই ঝটপট কিছু ছবি তুলে নিলাম। সবাই কে দেখাতে হবে না, - ‘আমি কি হনু রে ল্যুভর মিউজিয়ামে যাই রে...’
ঢোকার মুখটা আধুনিক শপিং মলের মত। যদিও মিউজিয়ামটা পুরনো রাজপ্রাসাদের ভেতরে। পুরনো আর নতুনের মেল বন্ধন বলা হয় রাজপ্রাসাদের সামনে কাচের তৈরি পিরামিডটাকে। ভেতরে ঢুকে ভাস্কর্য আর সেই যুগের পাথরের তৈরি বিভিন্ন নিদর্শন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে ঢুকতে না ঢুকতেই আমি দলছুট হয়ে গেলাম। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি বন্ধুদের কেউই দৃষ্টিসীমায় নেই। একটা কথা আছে না, মর্নিং সৌউস দা ডে। আমার বেলায় আজ তার প্রমাণ পেলাম। আমি একা একা ঘুরে ঘুরে হাটতে লাগলাম। দুই একবার ওদেরকে আমার সুইডেনের ফোন দিয়েই কল দেয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু ফোনটা রোমিং করা কিনা তাও জানি না। রিং হচ্ছিলো না। ফ্রেঞ্চ ভাষায় কিছু একটা বলছিল যা আমার বোধগম্য না।
এত বড় মিউজিয়ামে আমি এখন অপরিচিত মানুষদের সাথে দলছুট হয়ে ঘুরছি আর ভাবছি কিভাবে ওদেরকে পাওয়া যায়। তখন মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো। বিশাল এই যাদুঘরের আর যাই দেখুক আর না দেখুক মোনালিসা না দেখে কেউ যাবে না। তাই আমি তাড়াতাড়ি মোনালিসা খুঁজে বের করে সেটার সামনে গিয়ে দাড়িয়ে রইলাম। পুরো যাদুঘরের এত এত জিনিষের মাঝে এই একটা ছবির প্রতি সবার কমন আগ্রহ। তাই এখানে অনেক দর্শনার্থীদের জটলা। ভীর ঠেলে সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম মোনালিসার সেই বিখ্যাত হাসি। কেউ বলে তার চোখ হাসে, কেউ বলে তার ঠোট হাসে। আমিও ঠিকই হাসির একটি আভাস পাই এই ছবিতে। কিন্তু সেই হাসির নাম তাচ্ছিল্য না আস্কারা তা ঠাওর করে উঠতে পারি না। ছবিটা আকারেও তেমন বড় না। মোনালিসা যে দেয়ালে তার ঠিক বিপরীত দিকের সম্পূর্ণ দেয়ালে জুড়ে মস্ত বড় একটা ছবি। যেটার কারণে মোনালিসার ছবিটা যতনা ছোট তার চেয়েও বেশি ছোট লাগছে। যারা অনেক ভেবে চিনতে এই ছবি গুলো পুরো যাদুঘর জুড়ে বিন্যাস করেছে তাদের সাজানোর ইফিসিয়েন্সি নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন সৃষ্টি হল।
শিল্পকলার এই ছবি আঁকা-আঁকির শাখাটি আমার কাছে খুব রহস্যময় মনে হয়। বারবার মনে মধ্যে একটি প্রশ্ন আসে, কোন চিত্রকর্ম কি তার শিল্পীর খ্যাতিতে বিখ্যাত নাকি শিল্পী তার চিত্রকর্মের জন্য বিখ্যাত। এটাকে ভাইস ভার্সা বলে একটা উপসংহার টেনে ফেলা যায়। কিন্তু অনেকদিন ধরে ভাবতে ভাবতে আমার যেটা মনে হয়েছে। মানুষের কাছে বেশিরভাগ জিনিসই তার উৎসের জন্য বিখ্যাত। ছবির বেলায় এই কথাটি বেশি সত্য। এই যে মোনালিসা আমার চোখের সামনে। সেটা মাস্টারপিস। আমার বাসায় যেটা আম্মু নিউ মার্কেট থেকে কিনে এনে বাধিয়ে রেখেছিলো। সেটাও দেখতে একি রকম ছিল কিন্তু আসল ছিল না। মিউজিয়ামের এই ছবিটাই যদি হঠাৎ করে নকল বলে ধরা পড়ে আর জানা যায় যে অরিজিনালটা আছে ইতালিতে তাহলে আমরা সবাই দল বেধে ইতালিতেই যাবো এই শিল্পকর্ম দেখতে। ছবি নকল না আসল আমরা তার কিছুই নিজে থেকে বুঝতে পারবো না, কিন্তু উহা দেখে আমাদের মন ভরবে, চোখ জুড়াবে।
আমি যে জিনিস নিজে বুঝতে পারি না সে জিনিস আমাকে টানে কম। তবুও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিটি দেখলাম এবং প্রথম বারের মত আবিষ্কার করলাম এই ভ্রুহীন মহিলাটা একটি হাতল আলা কাঠের চেয়ারে বসে আছে। তার কোন গয়না নাই। পাতলা জর্জেটের ওড়নার মত একটি স্কার্ফ মাথার উপর দেয়া। এতবার দেখা এই ছবির ভেতর থেকে নতুন কিছু বের করতে পারার আনন্দে গদগদ হয়ে আশেপাশের ছবি গুলোও মনযোগ দিয়ে দেখলাম।
আমি আশা করেছিলাম এখানেই কোথাও লিওনার্দোর আঁকা অন্য ছবি গুলোও থাকবে। বিশেষ করে তার করা হেলিকপ্টারের ডিজাইন, রোবটের স্কেচ, আর বিভিন্ন এনাটমিকাল স্ট্রাকচারের ছবি গুলো দেখার সখ ছিল। দুঃখের বিষয় সেগুলোর একটিও পেলাম না। লিওনার্দো মানুষটা কি অদ্ভুত ছিল। তার আকার বিষয়ের বৈচিত্র্যের কথা ভাবলেই তো কেমন যেন লাগে।
এসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে বন্ধুরা চলে এলো। এবার আর হারানো যাবে না। তাই এক সাথে দল বেধে হাঁটছি। এত কিছু চারিদিকে যে সব দেখতে গেলে কয়েকদিন লেগে যাবে শেষ করতে। তাই হেটে যেতে যেতে যেখানেই একটু ভীর আর দর্শনার্থীদের জটলা দেখছিলাম সেখানেই থামছিলাম। কোনটা গুরুত্বপূর্ণ দেখার জিনিষ কিছুই তো জানি না। পাছে ভীর ঠেলে না দেখলে ইন্টারেস্টিং কিছু মিস করে ফেলি!
প্রায় সবগুলো ছবির উপর চোখ বুলানোর পর একটা জিনিষ মাথায় ঢুকে গেলো সেটা হচ্ছে, ছবির মানুষ গুলো সব কেমন যেন শূন্যে ভাসছে বলে মনে হয়। ছবির পুরুষ গুলো পেশী বহুল কিন্তু পুরুষালী না। শরীরে একটাও লোম নাই, বেশির ভাগেরই দাড়ি নাই। সবার চেহারায় একটা মোলায়েম মেয়েলি ভাব। আর নারী গুলো সব গোলগাল নাদুস নুদুস। কারো মুখে হাসি নাই। বেশির ভাগ ছবিই আনন্দহীন ছবি। ভাস্কর্য গুলো তাই। উচ্ছলতার কোন চিহ্নই খুঁজে পেলাম না। সব কিছুতেই শুধু গাম্ভীর্যের ছাপ। ছবিতে দুই তিনজনের বেশি মানুষ থাকলেই তারা হয় জরাজরি, কারাকারি, নয় মারামারি করছে। খুব বেশি জেনারেলাসেশন হয়ে গেলেও মিউজিয়াম থেকে বের হবার পর এই ইম্প্রেশনটাই আমার মাথায় রয়ে গেলো।
মিউজিয়ামে শুধু ছবি না। আছে প্রত্নতত্ত্ব, প্রাচীন শিলালিপি, মিশরের পিরামিডের পাথর দিয়ে ঠিক ওরকম আবহ তৈরি করে পিরামিডের একাংশ, নেপোলিয়নের মুকুট, তলোয়ার, মমি রাখার কফিন, নানা রকম গয়না, ভাস্কর্য, আরও কত কিছু। খুব বেশি পরিচিত কিছু ছাড়া কোনটা যে কি তা নিজেও জানিনা। সব শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। তখন ফ্রান্সের মানুষদের প্রতি একটা অভিযোগ তৈরি হল মনের মাঝে। এই যে এত মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে এত বড় যাদুঘরের আতিপাতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা বেশির ভাগই ফ্রেঞ্চ জানে না। দর্শক ছাড়া দর্শনীয় জিনিষের কতটুকু মূল্য থাকে। তাদের জন্য হলেও তো প্রতিটা জিনিষের সামনে ফ্রেঞ্চের পাশাপাশি ইংলিশেও একটা ছোট বর্ণনা লিখে দিতে পারতো। তাহলে তো আমার মত অভাজনরাও চোখে দেখার পাশাপাশি একটু ইতিহাসের শিহরনও পেতো।
দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়ে যাচ্ছে। এখনো আমাদের দুপুরের খাওয়া হয়নি। আমরা আজ কোন একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে খাবো। তাতে করে বাঙালি খাবার পাওয়া যাবে, পেটও ভরবে টাকাও হয়তো কম লাগবে। ল্যুভর থেকে বের হয়ে আবার হাটা। হাটতে হাটতে ভাবছি। আমার কিছুই মনে ধরে না কেন? এতসব কিছু দেখে ওয়ান্ডারফুল, অসাধারন, জীবন সার্থক হয়ে গেলো টাইপ বোধ আসছে না কেন! রসকষহীন মানুষ হয়ে যাচ্ছি বোধহয়। সুকুমার-বোধ পুরাই লোপ পাচ্ছে। তবে রাস্তায় হাটতে ভালো লাগছে। নতুন শহরের রাস্তায় মানুষের আলাদা রকম চলন বলন দেখতে ভালো লাগে। দুষ্প্রাপ্য নিষ্প্রাণ জিনিস পত্রে ঠাসা জাদুঘরের চেয়ে আমার কাছে খোলা আকাশের নিচে হাঁটাটাই বেশি আনন্দের। চোখ ধাঁধানো রোদে পাতাল ট্রেনে উঠার পথ খুঁজছি। এই সময় ঢাকা থেকে এলো একটি মুঠোফোন বার্তা ‘এই তুমি কি করো। আমাদের এখানে বৃষ্টি হচ্ছে।' আমার মোবাইল থেকে ইউরোতে চার্জ কাটছে বলে ম্যাসজের কোন রিপ্লাই দিলাম না। কানে হেড ফোন দিয়ে একটি গান ছেরে দিলাম।’
আমার শহর খুব সহজে একলা পাখির মত ভিজতে থাকে
কেউ জানে না কোন তীব্র স্লোগান মুখোর হতে এই শহরে
সেটা কোন সময়ে হঠাৎ চোখে বিজলী ঝলক মুখোর স্লোগান,
এই শহরে............
- ছাইপাঁশ
মন্তব্য
আমাকেও কেন যেন কোনো যাদুঘরই তেমন টানেনা
লেখায় কিছু ড় র'র গন্ডোগোল ছাড়া চমতকার লাগলো ভ্রমন বর্ননা।
আপনি তাইলে দলছুট হয়ে গেছিলেন?
ইউরোপে কি ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত নাবালক?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
হা হা হা! এইটা তো নির্দোষ দলছুট। প্যারিসের সব যায়গা তো আর দলবাঁইধা দেখার জন্য না। একলা একলা দেখারও আছে। সেই সব রাস্তায় হারাইয়া যাইতে পারলে না কাজের কাজ হইতো।
হ্যাঁ, যে আমাদের সাথে টিকেট ছাড়া ঢুকল, সে ২৪ বছরের ইউরোপিয়ান 'না'বালিকা।
ধন্যবাদ। আরও সতর্ক হবার চেষ্টা করবো।
ল্যুভর দ্য গ্রেট !!!
facebook
আরো কিছু ছবি দিলে কি ক্ষতি হতো ভাই? শুধু মোনালিসা দেখে বা বর্ণনা পড়ে মন ভরলোনা। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম। চলুক
ইশশশ ল্যুভর দেখার ইচ্ছে আমার অনেকদিনের! ভালো লাগলো লেখাটা অনেক শুভকামনা।
ধন্যবাদ আয়নামতি। নিশ্চয়ই একদিন আপনার ইচ্ছা পূরণ হবে।
চমৎকার, চমৎকার!
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
ধন্যবাদ, ধন্যবাদ।
এই পর্বটা ভালো হয়েছে। আরো কিছু ছবি দিতে পারতেন।
আমি অনেকদিন পর হঠাৎ লেখাটায় ঢুকে আপনার কমেন্ট পেলাম। ভেবেছিলাম এই পর্বটা বুঝি আপনার চোখে পড়ে নি বা কমেন্ট করার মত ততটা ভালো লাগেনি।
প্রতিটি পর্ব আপনি মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন বলে ভালো লাগছে।
নতুন মন্তব্য করুন