দৌড়াচ্ছে লালী। তার পিছে পিছে দৌড়াচ্ছে শত শত হাজার হাজার মানুষ, পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর প্রানী। প্রানপন দৌড়ে যাচ্ছে লালী কিছুতেই এই হিংস্র পশুগুলোর হাতে ধরা পড়া যাবে না। দৌড়াতে থাকে লালী বিস্তীর্ন প্রান্তর পেরিয়ে। দৌড়াতে দৌড়াতে দেখতে থাকে হাজার হাজার লাখ লাখ মৃত দেহ ভাসছে রক্তে স্রোতে। আরো জোড়ে দৌড়াতে থাকে রক্তে বন্যা মাড়িয়ে। লালী যতটা রান্তা পার হয় হিংস্র মানুষের স্রোত তত বড় হতে থাকে তার পিছু পিছু। এদের হাতে কিছুতেই ধরা পড়া যাবেনা। এরা আজ আর মানুষ নেই। কিন্তু কত দুর পর্যন্ত দৌড়াতে পারবে লালী? কোথায় যাবে? আজ যে সব মানুষই হয়ে গেছে রক্ত পিপাসু আর মাংস খেকো হিংস্র প্রানী!
দৌড়াতে দৌড়াতে লালীর মনে পড়ে যায় রহমত আলীর কথা। রহমতই লালীকে পেলে-পুষে বড় করেছে। কত আদর করত সে লালীকে। নিজে না খেয়ে লালীকে খাইয়েছে। গায়ে একটা মশাও বসতে দেই কোন দিন। সেই রহমত আলীই লালীকে তুলে দিল কতগুলো লোভী মানষের হাতে টাকার বিনিময়ে। দৌড়ায় লালী, সাথে সাথে রহমতের প্রতি অভিমানটা আরো গাঢ় কান্নার ধারা হয়ে গড়িয়ে পড়ে। আরো জোড়ে দৌড়ায় সে, অভিমানটা এক সময় ক্ষোভ হয়, তারপর ঘৃনা হয়।
লালী আজ কিছুতেই আর রহমতের বাড়ীতে ফিরে যাবে না। যদি এক সময় বাড়ীটা চিনতেও পারে তাও না। তাহলে কোথায় যাবে লালী? এ পৃথিবীতে তো রহমত, তার ছেলে ঝন্টু আর রহমতের বউটা ছাড়া আর আপন কেউ নেই লালীর। মনে পড়ে যায় ঝন্টু কথা। বুকটাতে কেমন একটা হাহাকার আর শূন্যতা তৈরী হয় তার। আহারে! বেচারা কত কাঁদল তাও রহমতের মনটা একটুও গলল না। শেষ পর্যন্ত বেচেই দিল লালীকে। ঝন্টু আর লালী প্রতিদিন এক সাথে মাঠে যেত। কত কথা হত দুজনের। সেই ছোট থেকে ঝন্টু তার খেলার সাথী। মাঠে অবাক হয়ে ঝন্টুর লাল ঘুড়িটার দিকে মাথা তুলে তুলে দেখত লালী। লালীও খুব কেঁদেছিল সেদিন যখন সে ঝন্টুকে ছেড়ে আসছিল। রহমতের বউটাও খুব কাঁদছিল। লালী আসতে চায়নি। আপনজনদের ফেলে কোথায় যেতে চায়নি সে। কিন্তু যখন রহমত চোখের কোনে জল নিয়ে বলল ”যা, তুই না গেলে যে না খেয়ে মরব!” তখন লালী আর বাধা দেয়নি। চির অনুগত থেকে নতুন মালিকের হাত ধরে চলে এলো। রহমত না খেয়ে থাকার চেয়ে নতুন মালিকের কাছে যাওয়ই যে ছিল তখন তার কাছে শ্রেয়তর।
লালী ধরা পড়েছে। মানুষের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারেনি লালী। তার পা গুলো বাঁধা হল। তারপর মাটিতে পড়ে গেল লালী। একটা টুপি পড়া মানুষের মত দেখতে একটা জন্তু তার গলায় ছুড়ি চালাল। লাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে রাস্তাটা। লালীর শরীর আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে আসছে। কেন যেন এখন আর কোন ঘৃনা বোধ নেই তার রহমতের প্রতি। বরং মায়া হচ্ছে তার খুব। ‘আমি তো চলে যাচ্ছি। ভালই। অন্তত মানুষের হিংস্রতা তো দেখতে হবে না আর,’ শেষ মুহুর্তে ভাবে লালী। রহমতের কথা মনে পড়তে পড়তে শরীরটা নিস্তেজ হয়ে আসছে তার। রহমত, তার বউ আর ঝন্টু তো প্রতিদিন মরে মরে বেঁচে থাকবে এই হিংস্র পশুদের ভীড়ে। তারপর একদিন সত্যিকারভাবে মরে যাবে। নিরর্থক জীবনটা নিয়ে। এই মানুষ রুপী জানোয়াদের ভীড়ে লালী, রহমত, ঝন্টু আর রহমতের বউ সবাই যে একই মর্যাদাসম্পন্ন জীব। লালী মরে যাচ্ছে কিন্তু কি আশ্চর্য কোন যন্ত্রনা নেই। লালী মরে গেছে। যন্ত্রনাহীন মাংসে আর হাঁড়ে পরিনত হয়ে মরে গেছে লালী। এখন তার মাংস খাবলে খাবলে খাবে কতগুলো বর্বর মানুষ।
সাইফ জুয়েল
মন্তব্য
সত্যিই সাহসী লেখা। লালীর নিজের সাথে কথা বলার মধ্য দিয়ে অনেক বাস্তবতা উঠে এল। ধর্ম-টর্ম বাদ দিলাম। আমি মানুষ, সৃষ্টির সেরা জীব! এই গর্বে আমি পাগলপ্রায়। সেরা জীব, তবু পশুত্ব রয়ে গেল। সে দোষ কার? নিশ্চয়ই আমার। আর তার মূল্য দিতে হয় এক নিরীহ পশুকে। নিজের পশুত্ব দূর করতে আরেক জীবকে নির্দয়ভাবে মারতে হবে? এটা কি ধর্ম, নাকি অধর্ম?
ধন্যবাদ ছড়াকার আর গল্পকার দেবানন্দ ভূমিপুত্রকে। যা বিশ্বাস করি তাই লিখতে চেষ্টা করি। নিজের উপলব্ধিগুলো ভেতর ও বাহিরে একই থাকুক সবার।
_________________
[খোমাখাতা]
নিটোল আপনাকে ধন্যবাদ।
_____________________
Give Her Freedom!
কবিকে অনেক ধন্যবাদ।
মানুষ মারা গেলেও এই কষট টা দেখাবেন না। এমন ভনডামির মানে কি? কোরবানির মূল কথা টাই বাদ দিলেন। রকত বা মাংস কোনোটাই চাওয়া না।
মানুষ মারা গেলে উনি কষ্ট পাবেন কি না সেটা তো আপনি জানেন না। একদিনে ২০ লাখ মানুষকে মারা হলে আপনার অনুভূতি কেমন হবে? কোরবানির মূল কথাটা আসলে কি ? নিচের লিস্ট থেকে বেছে নিন
ক) নিজের সবচে প্রিয় জিনিস কোরবানি দেয়া, যেমন নিজের সন্তান
খ) নিজের মনের পশুত্ব কোরবানি দেওয়া (পশু হত্যার মাধ্যমে)
গ) আল্লাহকে তুষ্ট করা ( প্রানী হত্যার মাধ্যমে)
ঘ) কোরবানীর মাধ্যমে গরীব দুঃখীকে একটু মাংস খাওয়ার ব্যাবস্থা করে দেয়া ( বাকি সারা বছর লাথি দিয়ে খেদানোতে সমস্যা নাই)
যদি আপনাকে একের অধিক কারণ বেছে নিতে হয়, তবে কোরবানির কোন মূল কথা থাকলো কিভাবে? মূল কথা হবে একটা, যেটা সমস্ত কারনকে জাস্টিফাই করতে পারবে। কোরবানি একটা কনফিউজিং কনসেপ্ট, এর কারন জাস্টিফাই করতে যাওয়া আর পাছার কাপড় মাথায় তুলে ঘোমটা দেবার চেষ্টা করা একই কথা।
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
ধন্যবাদ শিশিরকনা আমার জবাবটা দিয়ে দেবার জন্য। আমি বুঝি না, টাকা দিয়ে হাট থেকে কিনে আনা নিরিহ গবাদিপশু কিভাবে মানুষের এতটা প্রিয় কিছু হয়ে ওঠে যে তাকেই কোরবানি দিতে হবে। কোরবানী যদি প্রতিকীই হয়ে থাকে, তাহলে লক্ষ লক্ষ গবাদী পশুকে অপ্রয়োজনীভাবে হত্যা না করে প্রতিকীভাবে সারা পৃথিবীতে সেটা কেন করা হয় না। যতসব ভন্ডামী। যুক্তি দিয়ে খন্ডাতে না পারলে ধর্ম হয়ে যায় প্রতিকী আর অন্য সময় ফরজ, সুন্নত, ওয়াজিব ইত্যাদি। হাস্যকর।
আহারে আমাদের লেখক কখনোই kfc, mcdonalds, pizzahut, meatloaf, bacon এই শব্দগুলো জানতেও পারবে না।
ভাই আজাইরা, আমি kfc, mcdonalds, pizzahut, meatloaf, bacon এই শব্দগুলো চিনি। র্দূভাগ্যবশত আমার বাসার আশপাশেই দু'একটা আছে এগুলো। কিন্তু এগুলোতে তো কখনও মানুষকে খেতে দেখি না। যারা খায় তারা এমন এক প্রজাতি যে এদের দিকে তাকালে মানুষ হিসেবে বেশ লজ্জা পাই।
ইন্টারেস্টিং মন্তব্য।
এসব জায়গায় "মানুষ" খায়না !! আজব ব্যাপার ! মানুষ কি vegetarian হয়ে যাবে নাকি তাহলে !!
অতিথি।
সবাই vegetarian হলে তো ভালই ছিল। সবাই প্রাথমিক উৎপাদকের কাছ থেকেই প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহন করতে পারত। যা হোক আমি সবাইকে vegetarian হয়ে যেতে বলিনি। যে দেশে ৩১% (জাতিসংঘের সর্বশেষ মানব উন্নয়ন সূচক অনুসারে) দ্রারিদ্রসীমার নীচে বাস করে সেখানে kfc, mcdonalds, pizzahut, meatloaf, bacon এই শব্দগুলো চেনা বা এদের জানা অথবা এসব চেইন শপে খাওয়ার পর যারা বুক ফুলিয়ে গর্ব করে বলে তারা আমার বিবেচনায় আর যাই হোক মানুষ নয়। এদের দেখলে মনে হয়, দেশে কোন অভাব নাই, দেশটা কত সুখী আর উন্নত! এসব খাবারের দোকানে কিছু অদ্ভুত প্রজাতির প্রানী দেখা যায় যাদের গঠন, চলন ও বলন অনেকটা ফার্মের মুরগীর মত।
বর্ণনা ভাল। তবে কাহিনী প্রথমেই আমরা বুঝে ফেলি।আমার মতে অণুগল্পে টুইস্ট গল্পের মজা বাড়িয়ে দেয়।আশা করি লেখক তা ভাববেন।
মূর্তালা রামাত
ধন্যবাদ গল্পকারকে। আপনার উপদেশ গুরুত্ব সহকারে ভাবব।
ভালো লাগলো।
সুপ্রিয় দেব শান্তকে ধন্যবাদ ভাল লাগার জন্য।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ অরিত্র অরিত্র।
প্রতিদিন পৃথিবীতে লাখে লাখে গরু, ছাগু, মুরগি, শুয়োর জবাই হয়। উৎপাদন ও হয় একই হারে। তাই একা কোরবানির উপর দোষ চাপিয়ে লাভ নাই।
কোরবানি বা পশু হত্যায় আমার সমস্যা নাই। পশুর প্রতি দয়া দেখাতে গেলে উদ্ভিদের প্রতিও দয়া দেখানোর যুক্তিটা চলে আসে। দয়া জিনিসটার উপর নির্ভর করে প্রাকৃতির ভারসাম্য গড়ে উঠে নাই। তাই দয়া দেখাতে গেলে বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য খুব দ্রুত ধ্বসে পড়বে।
আমার আপত্তিটা রাস্তাঘাটে, চোখের সামনে জবাই করাতে। পৃথিবীতে মুসলিম দেশও মাত্র একটা না, কোরবানি সবদেশেই হয়। কিন্তু রাস্তায় ফেলে মানুষ/পশু জবাই করা দেখা একটু কষ্টকর। বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন মুসলিম দেশে কি এত ব্যাপক হারে মানুষের চোখের সামনে রক্তারক্তি হয়?
একমত, আমার বাসাতেই একাধিক মানুষে অসুস্থ হয়ে যাবার ইতিহাস আছে
খাদ্য তালিকায় প্রাণিজ প্রোটিন তো লাগবে। প্রাণি হত্যা অমানবিক হলেও তো হবে। কিন্তু উৎসব করে সর্বসম্মুখে জবেহ-কাণ্ড গ্রহণযোগ্য নয়।
_____________________
Give Her Freedom!
গল্পটা ভালো লেগেছে। তবে কোরবানির নামে নিজের প্রিয় জিনিষের বিসর্জনকে কোনো দিনই সমর্থন করা যায়না।
মনে পড়ে রবি ঠাকুরের 'রাজর্ষি' উপন্যাসের সেই কথা - এত রক্ত কেন ?
নতুন মন্তব্য করুন