মানুষ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ০৯/১১/২০১১ - ১০:৫৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গুহার ভেতর দিয়ে পথ। ঘুটঘুটে অন্ধকার। ওপাশে এক চিলতে মিটমিটে আলো। যতো আগাই, আলো যেন ততোই পিছায়। ধাক্কা খেয়ে কয়েকবার পড়েও গেছি। রক্ত-টক্ত কিছু দেখতে পাইনি। অনেকক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে গুহা শেষ। এবার আলোর ঝলকানি!

এপাশে পরিষ্কার চকচকে দিন। চারিদিকে গাছ আর গাছ। ফলের ভারে যেন ভেঙে পড়ছে। পাকা পাকা ফল দেখে খুব লোভ হল। ইচ্ছে হল ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাই। কে যেন ভেতর থেকে বলল, খবরদার! নিজের লোভ সংবরণ কর।

ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। আচমকা এক অমায়িক সুন্দরী অষ্টাদশী আমার হাত ধরে বলল, আমার সাথে চল।
- কোথায়?
- যেখানে গেলে তোমার মন আনন্দে ভরে উঠবে!
- আমার মনে তো কোন দুঃখ নেই?
- তাই কখনও হয়?
- সত্যি বলছি। কিন্তু, তুমি কে?
- আমি? আমি তোমার সব!

কথাটা বলেই ও আমাকে জড়িয়ে ধরতে চাইল। চিনি না, জানি না; কী অদ্ভূত! আমারও ভালো লাগতে শুরু করল। আমি যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ কী যেন একটা শব্দ শুনলাম। ঘোর কেটে গেল। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। চোখ খুলে দেখি, কোথাও কেউ নেই। তবে কী আমি যাদুর দেশে এসে পড়লাম?

জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখি একটা পায়ে হাঁটা পথ। নিশ্চয়ই এদিকে বাড়িঘর আছে। কিন্তু, কোথায় যাচ্ছি আমি?

পথ ধরে এগিয়ে চললাম। কে যেন আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। পথটা আস্তে আস্তে নিচু হয়ে নেমে অনেক গভীরে চলে গেছে। নিচে নামতে নামতে মনে হল, একটা সুড়ঙ্গ দিয়ে নামছি। আলো ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

নিচে এসে পড়লাম। আলো ভেদ করে সামনে এগিয়ে দেখি একটা পুকুর। ঘাট-টাট কিছু নেই। পাশে প্রকাণ্ড একটা বটগাছ। গাছের নিচে অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে। আমার কিন্তু একটুও ভয় করছে না।

গাছের গোড়ায় এক বৃদ্ধ ধ্যানের ভঙ্গিতে বসে আছেন। মাথা ভর্তি সাদা চুল। দাড়ি-গোঁফ সব সাদা। পড়নেও একটা সাদা কাপড়। গায়ে আরেকটা কাপড় জড়ানো। সেটাও সাদা। গম্ভীর স্বরে আমাকে বললেন, সামনে এসে বয়!

সামনে বসতেই কয়েক টুকরো কাগজ আমার হাতে দিলেন। ভাঁজ খুলতে বললেন। একে একে সবগুলো খুললাম। প্রত্যেকটাতে একটি করে শব্দ লেখা। বামপন্থী-ডানপন্থী-মধ্যপন্থী-বাঙালি-হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃষ্টান-বিপ্লবী-নাস্তিক-মানুষ-আধুনিক-প্রাচীনপন্থী-শিক্ষক-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ী। এবার বললেন, তোর পছন্দমতো শব্দটা তোল। নিজের সাথে প্রতারণা করবি না। মিথ্যেটা তুললে আমি ঠিক ধরে ফেলব।

সবগুলোতে চোখ বুলিয়ে কোন ভাবনা-চিন্তা না করে তুলে নিলাম, "মানুষ!”

বৃদ্ধ আমাকে বুকে টেনে নিলেন। অনেকক্ষণ কাঁদলেন। তারপর বললেন, সামনে যাদের দেখছিস, ওরা কেউ মানুষ নয়। সবাই বাকিগুলোর কোন একটা। হিন্দু যদি মানুষ না হয়ে শুধু হিন্দুই হয়, তাহলে তো বাকিদের হিংসে করবে। বাকিরাও তাই করবে। সবাই বলে, আমিই বড়! ওরা সবাই অবুঝের মতো কোন একটা পথ বেছে নিয়েছে। নিজেদের পথে সবাই বড় হতে চায়। নাম কিনতে চায়। তার জন্যে মানুষ মারতেও রাজী আছে। ওরা কেউ মানুষ হতে চায় না।
- আপনি ওদের মানুষ করে দিন।
- কেউ কাউকে কিছু করে দিতে পারে না। ওদের নিজেদেরই সেটা বুঝতে হবে।
- কিন্তু, আমি এখানে কী করে এলাম?
- তুই তো নিজে থেকেই এসেছিস।
- আমি কী আর ফিরে যেতে পারব না?
- কেন পারবি না? তুই ফিরে না গেলে কি চলে?

কথাটা বলেই আমার মাথায় হাত রাখলেন। সমস্ত শরীর ঠাণ্ডা হয়ে এল। কী অদ্ভূত শান্তি! আহ! আহ! আহ!

হঠাৎ একটা ধাক্কা খেলাম। আমি এখনও ঘোরের মধ্যে। পাশ থেকে আমার স্ত্রী বলল, কী হল, স্বপ্ন-টপ্ন দেখলে নাকি?
...........................................................................................................................................................
দেবানন্দ ভূমিপুত্র


মন্তব্য

মূর্তালা রামাত এর ছবি

ভাল লাগল। মরাল থিমটা দারুণ!

মূর্তালা রামাত

দেবানন্দ ভূমিপুত্র এর ছবি

শুনে খুশি হলাম। ভালো থাকুন।

তাপস শর্মা  এর ছবি

চলুক

দেবানন্দ ভূমিপুত্র এর ছবি

ধন্যবাদ, দাদা। সতত শুভকামনা।

সাইফ জুয়েল এর ছবি

গল্পটা গতকালই পড়েছিলাম। তাড়াহুড়ার কারনে মন্তব্য করা হয়নি। আপনার গল্পের ক্ষমতা আছে শেষ পর্যন্ত পাঠককে ধরে রাখার। আমার মনে হয় এটাই একজন লেখকের সার্থকতা।

দেবানন্দ ভূমিপুত্র এর ছবি

শুনে মন ভরে গেল। লিখতে বসলে ওটা মাথায় রাখার চেষ্টা করি। সবসময় অবশ্য পারি না। অনেক ধন্যবাদ উৎসাহিত করার জন্যে।

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

মানুষ খুঁজি। কোথায় মানুষ?
সবাই মানুষ সাজে।
সেই তো মানুষ, যে রয় লুকিয়ে
সবার হৃদয় মাঝে।

কমরেড রতন সেন (আমাদের রতনদা) নিহত হলে কবি বন্ধু প্রবীর সরদার এটা লিখেছিলো।

মুসলিম-হিন্দু-খ্রীষ্টান-বৌদ্ধ হওয়া সহজ। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারও হওয়া যায় সহজে। কিন্তু মানুষ হওয়া বড়োই কঠিন।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

দেবানন্দ ভূমিপুত্র এর ছবি

ঠিক তাই। কেউ যদি হিন্দু বা মুসলিম হওয়ার আগে মানুষ হওয়ার শিক্ষা নেয়, তাহলে সে আরও ভালো করে হিন্দু বা মুসলিম হতে পারে। নইলে সাম্প্রদায়িক মনোভাব তৈরি হতে বাধ্য, সম্প্রীতি তো সুদূর পরাহত। ভাইজান, অনেক ভালো লাগলো আপনার মন্তব্য। ভালো থাকুন।

অতিথি অন্যকেউ এর ছবি

সরল থিম, সাধারণভাবে হৃদয়গ্রাহী। তবে একই কারণে একটু পুরনো সময়ের ঘ্রাণ লেগে রয়েছে।

আপনার লেখা ভালো লাগে।

দেবানন্দ ভূমিপুত্র এর ছবি

পুরনোতে যাওয়া কিন্তু ইচ্ছাকৃত। অনুভবের সরলতায় গভীরে ঢোকার ইচ্ছে থেকেই। আমার লেখা ভালো লাগে জেনে আনন্দিত হলাম। খুব ভালো থাকুন।

সাফি এর ছবি

ভাল লেগেছে, লিখতে থাকুন।

দেবানন্দ ভূমিপুত্র এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ। ভালো কিছু লেখার চেষ্টায় আছি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।