এইতো জীবন। পর্ব – ০৫

তাপস শর্মা এর ছবি
লিখেছেন তাপস শর্মা [অতিথি] (তারিখ: শনি, ১২/১১/২০১১ - ২:৪৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জল পথে ভেসে যাচ্ছি। আধ ঘণ্টা শুটিং সারলাম। ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যেই। বোটের ভেতর থেকে কিছু শট নিলাম। বৃষ্টির গতি ধীরে ধীরে কমে আসছিল। ডুম্বুর ভ্যালীর সব আজব কাণ্ডকারখানাই বটে। হঠাত সব কিছু বন্ধ। আকাশ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, সাথে রৌদ্র। মনটা ভালো হয়ে গেলো। বৃষ্টি মনের আনন্দ দিলেও আমার শুটিং এবং কাজের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। যাই হোক আমি শুটিং এর কাজে মন দিলাম। এর আগে দুটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের ডকুমেন্ট্রিতে আমি কাজ করেছি। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ অভিজ্ঞতা বলতে যা বোঝায় তার বিন্দু মাত্রও আমার নেই। আগের কাজ গুলি ভার্সিটিতে পড়ার সময় বন্ধুবান্ধবরা মিলেমিশে শেয়ার করে করেছিলাম। ওখানে অবশ্য ‘করার’ জন্যই করা – এই প্রবৃত্তিটা ছিল। মানে বন্ধুরা আছে – চল সবাই মিলে কিছু একটা বানাই। সবাই মিলে পিকনিক ধাঁচে শুটিং করেছিলাম ঐ সময়। আমার এক বন্ধু ভালো এডিটিং জানত সে এডিট করে দিল, ব্যাস এর কি চাই, বানিয়ে ফেললাম ডকুফিল্ম। কিন্তু আজ এখানে আমি যে শুট করতে এসেছি তা সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে। যদিও আমার কাছে পর্যাপ্ত উপকরণ কিছুই নেই। ক্যামেরাটাও সস্তা। রাতে শুটিং করার জন্য কোনো ইকুইপমেন্ট আমার হাতে নেই। তবুও এইবার অন্ততঃ কিছু করার জন্য করতে আসিনি, এসেছি......... থাক। এটা আপাতত আমার মনেই থাক।

IMG_88

গোমতী হাইড্রো প্রকল্পের এক ঝলক

IMG_10071108

IMG_1008

তবে এই পর্বে আমি শুটিং এর কথা আর বেশী বলব না। বলব কিছু মানুষের কথা। যাদের দেখে আমার জীবন সম্পর্কে সব ধারণাটাই বদলে গিয়েছিল। হ্যাঁ। তাদের কথা যারা আমাদের তথাকথিত সভ্যতা থেকে অনেক দূরে থাকেন। তাদের কথা যারা পাহাড়ের কোলে মানুষ। তাদের সন্তানেরা দু’বেলা দুমুঠো ভাত খেতে পায়না। অথচ তারাই আমাদের মুখে খাবার জোটায়। কতদিন সকাল সকাল খাবারের থালায় গোমতীর তরতাজা মাছ দিয়ে তৃপ্তির আহার সেরেছি। কিন্তু কোনো দিনও ভাবার অবকাশ পাইনি যে যারা এই মাছ গুলো আমাদের জন্য পাঠাচ্ছেন তাদের কথা। আসলে সাধারণ ভাবে ভাবার কথাও নয়। আর হয়তো ভাবতেও পারতাম না যদিনা আমি ডুম্বুর ভ্যালীতে যেতাম। তারা বেশির ভাগই ত্রিপুরার জনজাতি। আমাদের সমাজে তাদের উপজাতি বলা হয়। ‘উপ’ – ‘জাতি’। এর মানে মেইন স্ট্রিম থেকে বাইরে যাদের অবস্থান ! আমরাই শুধু জাতি! আর ওরা উপজাতি ! শব্ধটা যে এত মারাত্মক ভাবে আঘাত করতে পারে তা আমি কোনো দিনও রিয়েলাইজ করতে পারিনি। পেরেছি ডুম্বুরে গিয়ে। গোমতী হাইড্রো প্রোজেক্টের তলে তলিয়ে গেছে হাজার হাজার মানুষের ধানের জমি। কোটি কোটি টাকা খরচ করে চলছে এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। অথচ এই প্রান্তিক মানুষ গুলির জীবনে অন্ধকার আর অন্ধকার।

IMG_1001

IMG_100222

IMG_10906

IMG_10099

IMG_0333330

IMG_908

IMG_1005988

IMG_100587011

IMG_1009

এই অভিজ্ঞতাও আমার হতো না। যদিনা আমার বন্ধু বিমল আমাকে বোট থেকে পাশের একটি ক্ষুদ্র গ্রাম না দেখাতো। পাহাড়ের খোপে খোপে ছোট্ট গ্রাম গড়ে উঠেছে। দেখতে এতটাই ভালো লাগে যে মুগ্ধ না হয়ে থাকা যায়না। আমি আমাদের বোট চালককে বললাম ঐ পাশের একটি ছোট্ট গ্রামে নিয়ে যেতে। গেলাম, দেখলাম, বুঝলাম, কথা বললাম – আর আমার মুগ্ধতা হারিয়ে গেল ক্রমশঃ। কারণ প্রকৃতির এই বিপুল মনোরাজ্যে যারা বসবাস করছেন তারা প্রকৃতির স্নিগ্ধতায় মোটেই আপ্লুত নন। ঠিক ভাবে বলতে গেলে প্রকৃতি তাদের কাছে অভিশাপ।

১৯৭৫ সাল। আর এখন ২০১১। মাঝখানে পেরিয়ে গেছে অনেক সময়। সময় থমকে থাকেনা। বয়ে চলে আপন ধারায়। বয়ে চলছে গোমতী। কিন্তু ডুম্বুর ভ্যালীর অন্তর্গত মন্দিরঘাট কিংবা নারিকেলকুঞ্জের জনজাতির দল থমকে আছে। প্রায় পাঁচ সাতটি গোষ্ঠীর জনজাতির বাস এখানে। চাকমা, জমাতিয়া, দেববর্মা, রিয়াং, নোয়াতিয়া – এই সব। তাছাড়া রয়েছে কিছু বিহারি এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু উদ্বাস্তু বাঙালি। বেশির ভাগ মানুষের পেশা তথা জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন মাছ ব্যবসা। ডুম্বুরের উপকন্ঠের এক গ্রাম্য যুবক সুবলহরি জমাতিয়া। স্কুলে যায়নি কোনদিন। ছোলেবেলা থেকেই বাবার সাথে মাছ ধরতে নামে গোমতীর বুকে। তার কথাগুলি সরাসরি এই রকম – যত জমি আছিল সব নদীর মইদ্যে এছেগা। ধান করার লাইগ্যা জমি কই পাইব। মাছ ধরে আমরা। আমার বাবা ধরত। আমিও ধরে। মাছ বেইচ্যা যা টাকা পায় তা দিয়া কোনো রকমে খায় আরকি। এই কথা শোনার পর আর কিছু বলতে পারিনি। বলার মতো ভাষাও খোঁজে পাইনি। মানুষটি ঠিকঠাক বাংলা বলতেও পারেনা। পারার কথাও নয়। সমতলে কবে গিয়েছিল সে নিজেই ভুলে গেছে। ওপাশ থেকে সুবলহরির সাত বছরের ছেলে বিরজিৎ খালি গায়ে মায়ের আচলের নিচে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে ছিল। খুব ইচ্ছে করছিল তাকে ডেকে এনে কিছু একটা দেই। আসলে আমার বাচ্চাদের দেখলে খুব মায়া হয়। কিন্তু আমার কাছে আছে, পকেটে তিনটি ক্লোরমেণ্ট ( চকলেট কাম বাবুলগাম)। আর সুবলহরির পরিবারে বাচ্চার সংখ্যা পাঁচ। শুধু বিরজিৎ’ই নয়। সুবলের আরও চারটি সন্তান রয়েছে। এর মধ্যে দুটি কন্যা সন্তান। বাচ্চা গুলির বয়স তিন থেকে শুরু হয়েছে। বড়টার বয়স নাকি দশ বছর। সবটাই বুঝলাম। অশিক্ষা, কুসংস্কার আর অভাবের জঞ্জালে মানুষগুলি কি করে বেঁচে আছে। এমন করেই চলছে।

একেকটি মানুষের সংসারে পাঁচ সাতটি করে সন্তান। তাদের প্রতিপালনের দায়িত্ব কে নেবে? প্রকৃতি? বেঁচে থাকলে থাকবে – না না থাকলে, মরে যাবে। তাতে কারও কিচ্ছু যায় আসেনা। এইভাবেই বছরের পর বছর বেঁচে আছে রতনবিকাশ চাকমা, ভক্তিকর চাকমা, মন্দারানী রিয়াং, সদ্রাই নোয়াতিয়া, কুঞ্জলাল চাকমারা। ধানের জমি প্রায় নেই বললেই চলে। জুম চাষ এখন প্রায় অচল। রেশনিং ব্যবস্থা আছে, কিন্তু তা নাম কে ওয়াস্তে। রাস্তাঘাট বিপর্যস্ত। যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে নারিকেলকুঞ্জের(আইল্যান্ড) মানুষের অবলম্বন জলপথ, বাহন নৌকা। প্রাথমিক শিক্ষার জন্য স্কুল আছে, কিন্তু সেটার অবস্থা আর বলার মতো নয়। প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের অবস্থা খুবই খারাপ। সামান্য জ্বর, সর্দি হলেও চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। বছরে কত মানুষ বিনা চিকিৎসায়, ভুল চিকিৎসায় ( গ্রাম্য বুজরুকি ) মারা যায় তার খতিয়ান কোনো সরকারি কিংবা বেসরকারি খাতা রাখেনা। তার উপর আছে এক্সট্রিমিস্ট এর উৎপাত। স্বাধীন ত্রিপুরার ডাক। পাহাড় কান্নায় ভেঙে পড়ে। উগ্রপন্থী নামধারীরা স্বাধীন ত্রিপুরার নামে আসলে জনজাতির উপরেই অত্যাচার চালায়। যদিও আগের তুলনায় এখন অনেকটা উপদ্রব কমেছে। কিন্তু একেবারেই থেমে যায়নি। কিছু দিন পরেই ওরা আসে। এসে চাঁদা চায়। অতএব নুন আনতে পান্থা ফুরায় মানুষদের চাঁদা দিতে হয় বাঁচার তাগিদে। তার উপর অত্যাচারের কথা আর বলার মতো নয়।

অত মনমাতানো প্রকৃতির খেলা। গহীন অরন্যভুমি ও জলরাশির কলকল শব্দ। কোথাও কৃত্তিমতা নেই। তবে ‘অভাব’ আছে। সেই অভাব জনজাতির জীবন গাঁথায় লেখা আছে। আমাদের শহুরে সভ্যতা এবং যান্ত্রিকতার রঙ ফিকে হয়ে যায়...

---------------*----------------

এবং আমিঃ এইতো জীবন। পর্ব – ১

এবং আমিঃ এইতো জীবন। পর্ব – ২

এবং আমিঃ এইতো জীবন। পর্ব – ৩

এবং আমিঃ এইতো জীবন। পর্ব – ৪

=========================

আমার শহর
নভেম্বর . ১২ . ২০১১ .


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

গোমতী হাইড্রো প্রকল্পের এরকম বিস্তারিত ছবি দিয়েছেন যেটা আইনতঃ নিষিদ্ধ হতে পারে। খোঁজ নিয়ে পোস্ট দিয়েছেন তো? ছবি সরাতে চাইলে contact এট সচল বরাবর ইমেইল করে জানান।

তাপস শর্মা  এর ছবি

আমি যখন ছবি তুলেছিলাম, তখন প্রশাসনিক ভাবে কেউ কিছু বলেনি যে ছবি ব্যাবহার করা যাবেনা। তবে আপনি যেহেতু বলছেন সমস্যা হতে পারে তাহলে আমি ইমেল দিচ্ছি। কোন কোন ছবি বাদ দিতে হবে।

আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ মুর্শেদ ভাই।

কল্যাণF এর ছবি

চলুক

তাপস শর্মা  এর ছবি

(বাংলায়)

কল্যাণF এর ছবি

ওই মিয়া নিজেই নিজেরে বাংলায় লেখতে কন কেলা? খাইছে

তাপস শর্মা  এর ছবি

আপনাকে বলেছিলাম কল্যাণ ভাই।

সচল জাহিদ এর ছবি

বাংলাদেশ ভারতের মত ঘনবসতি দেশে প্রতিটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের গল্প মনে হয় একই। একই ভাবে পার্বত্য চট্ট্রগ্রামে আমরা ধ্বংস করেছি আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষদের ঐতিহ্য, তাদের কৃষ্টি, তাদের গর্ব। ঐ অঞ্চলের রাজাদের বাড়িঘর আর সেই সাথে তাদের নৃতাত্বিক নিদর্শনের শলিল সমাধি ঘটেছে কাপ্তাই হ্রদের বিপুল জলরাশির নিচে।

লেখাতে চলুক


এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।

তাপস শর্মা  এর ছবি

পার্বত্য চট্ট্রগ্রামের কথা আমিও শুনেছি জাহিদ ভাই। এখানেও একই অবস্থা। আসলে আপনি ঠিকই বলেছেন সব জায়গার গল্পগুলি একই রকম। আমরা সভ্যতা গড়ার জন্য উন্নত হতে চাই। কিন্তু সেই উন্নতির জন্য কিছু মানুষকে কিন্তু বিরাট মূল্য দিতে হয়।

তারেক অণু এর ছবি

হুমম, দাঁড়ান আসিতেছি !

তাপস শর্মা  এর ছবি

হাসি জলদি আহেন

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

আম্মো আসব তারেক অণুর পিছু পিছু। আমার গ্রামের নাম গোমনাতী। আহা, সেটি যদি গোমতীর তীরে হত!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

তাপস শর্মা  এর ছবি

হাসি । চইলা আসেন শিগগির

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

চলুক

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

তাপস শর্মা এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

মৃত্যুময় ঈষৎ এর ছবি

যথারীতি দারুণ।


_____________________
Give Her Freedom!

তাপস শর্মা এর ছবি

ধন্যবাদ অলি

উচ্ছলা এর ছবি

শেষের ছবিটা অসাধারণ!

তাপস শর্মা এর ছবি

ধন্যবাদ ম্যাডামজী হাসি

বন্দনা এর ছবি

বাহ ছবিগুলা বেশ নেচারাল লাগলো তাপসদা। আর আপনি ও কি তারেক অনুর মত শুরু করলেন নাকি, আপ্নেগো যন্ত্রনায় ল্যাবে থাকা দায় হয়ে গেসে মন খারাপ

তাপস শর্মা এর ছবি

ধন্যবাদ। বন্দনা হাসি


আরে করছেন কি অনু তো পরমাণু। আমি অইলাম মশা খাইছে


আর আপনার যন্ত্রণার দায় আমি মাথা পেতে নিলাম দেঁতো হাসি

বন্দনা কবীর এর ছবি

দারুন লাগলো আঁকা আর লেখা।

ছবিগুলো অসম্ভব জীবন্ত লাগলো। চলুক... চলুক

তাপস শর্মা এর ছবি

বন্দনা কবীর আপনাদের ভালো লাগাই আমার প্রাপ্তি। ধন্যবাদ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।