পুরাণকথা, পর্ব-১
http://www.sachalayatan.com/node/41739
পুরাণকথা, পর্ব-২
http://www.sachalayatan.com/node/41779
পুরাণকথা, পর্ব-৩
http://www.sachalayatan.com/node/41822
পুরাণের প্রাজ্ঞ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যাখ্যাকারগণ বলেছেন, আমরা ইতিহাসের পাতায় দেখতে পাই, দেবতারা দানবদের জয় করছেন আবার কখনও দানবেরা দেবতাদের জয় করছেন।
যে ভূখণ্ড নিয়ে এত যুদ্ধ বিগ্রহ সেই স্বর্গেই বা নিরবিচ্ছিন্ন সুখের অস্তিত্ব কোথায়! নসুহাদির মত মহারাজাও স্বর্গে গতায়ু হয়েছেন। স্বর্গে সুখাভিলাসী দেবগণেরও সমপ্লবে সহসা দুঃখ উপস্থিত হয়। স্বর্গেও বস্তুতপক্ষে দেবগণের সুখ নেই।
বিবিধাকার ব্যাধি দেবলোকেও বিরাজমান। যজ্ঞের শিরোরোগ সর্বদাই বিদ্যমান। ভানুর কুষ্ঠ, বরুণের জলোদর, পূষার দন্তবৈকল্য, ইন্দ্রের ভূজস্তম্ভন, চন্দ্রের প্রবল ক্ষয়রোগ, এসবই দেবতাদের রোগনির্দেশ।
ব্যাসদেব যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন, `দেব, দানব, গন্ধর্বদিগকেও মৃত্যু হরণ করে থাকে। মৃত্যুকে অতিক্রম করা নিতান্তই দুঃসাধ্য।'
বহু প্রাচীনকালের মানব জাতির ইতিহাসে যে দেবতাগণকে পাওয়া যায় তাঁরাও যে কাল প্রভাবে চালিত ছিলেন স্বয়ং ব্যাসদেব তারই ব্যাখ্যা করেছেন, `পৃথিবীতে এমন কোন শক্তি নেই যে যুগধর্মের প্রভাব প্রতিরোধ করতে পারে। ভাব, অভাব, সুখ, দুঃখ সকলই কাল সহকারে ঘটে থাকে। কাল প্রজাসকলকে দগ্ধ করছেন, আবার কালই তাদের শান্ত করছেন। নিখিল ভূমণ্ডলস্থ শুভাশুভ সমূদয় পদার্থ কাল হতে সৃষ্ট হচ্ছে, কালেতেই লোকসকল লয়প্রাপ্ত হচ্ছে এবং আবার কাল হতেই উৎপন্ন হচ্ছে। সকল জীব নিদ্রিত হলেও কাল জাগরিত থাকেন। কালকে কেউ অতিক্রম করতে পারেনা। কাল অপ্রতিহত রূপে সর্বভূতেই সমভাবে বিচরণ করেন। বর্তমান, ভূত, ভবিষ্যৎ সকল বস্তুই কাল নির্মিত।
ক্ষয়, লয়, মৃত্যু অনিবার্য
বিষ্ণু পুরাণের ধরণীগীতায় পরাশর মুনি উক্তি করেছেন,
"তপ্তং তপো যৈঃ পরুষপ্রবীরৈ
রুধ্বাহু ভিব্বর্ষগণান নেকান্।
ইষ্টাচ যজ্ঞা বলিনোহতিবীর্যাঃ
কৃতাস্তু কালেন কথাবশেষাঃ।।"
অর্থাৎ, যে পুরুষপ্রধাণগণ উর্ধবাহু হয়ে অনেক বর্ষ যাবৎ তপ আচরণ করেছিলেন, অতি বীর্যশালী যে বলবান ব্যক্তিগণ যজ্ঞানুষ্ঠান করেছিলেন, কাল তাঁদের সকলকেই কথাবশেষ করেছেন।
অথর্ববেদ সংহিতায় আমরা `কাল'কেই দেখি পরমাত্মা রূপে বন্দিত হতে। এই `কাল'কেই জগতের কারন পরমাত্মা রূপে বন্দনা করা হয়েছে। ঋষি বলছেন,"কাল রূপ পরমাত্মা এই দ্যুলোক ও দৃশ্যমান পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। কালই ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান কালাবিচ্ছিন্ন জগৎ আশ্রয় করে আছে। কাল রূপ পরমাত্মা এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন। কালের প্রেরণাতেই সূর্যের আলোতে এই জগৎ প্রকাশিত হয়। কালের আশ্রয়েই সমস্ত বিশ্ব অবস্থান করছে। কালের নির্দেশেই চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয় দর্শনাদি কাজ করে।"
কিন্তু অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে, সেই প্রাচীনকালে এতদঞ্চলের ঋষিরা `কাল'কে পরমাত্মা রূপে, পৃথিবীর আশ্রয়স্থল রূপে, সমস্ত সৃষ্টির উৎস রূপে, সমস্ত শক্তির আধার রূপে কি ভাবে কল্পনা করলেন! শুধু কল্পনাই বা বলি কেন, সত্য বলে বিশ্বাসও করলেন। এই জ্ঞান তাঁরা পেলেন কোথায়?
এই `কাল' সম্বন্ধে এইতো মাত্র সেদিন বৈজ্ঞানিক আইনষ্টাইন আমাদের বর্তমান বিশ্বকে কিছু জ্ঞান দান করলেন। কালের রূপকে, তার ধারন ক্ষমতাকে বিশ্ববাসীর গোচরে আনলেন। তাওতো তিনি প্রাচীণ ঋষিদের মত অত কথা বলেননি। হয়ত বলেননি প্রমানের অভাবে।
অথর্ববেদে আছে, সবিতা সত্যধর্মা। সবিতা যদি সূর্য হয়তো তার নিয়মানুবর্তিতার জন্যই তাকে যে সত্যধর্মা বলা হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। সত্যই তার ধর্ম, অর্থাৎ যা সত্য তাই ধর্ম।
অথর্ববেদের পৃথিবী সূক্তের প্রথম মন্ত্রে যা বলা হয়েছে তার সহজ অর্থ হল, পৃথিবীকে ধারন করে আছে এক বৃহৎ সত্য। এই সূক্তেই আবার বলা হয়েছে যে ধর্মই পৃথিবীর ধারক। তা হলে এ কথাই মেনে নিতে হয় যে ঋত, সত্য, দীক্ষা, তপ, ব্রহ্ম বা প্রার্থনা এবং যজ্ঞ এই ছয়টি গুনই হল ধর্ম যা পৃথিবীকে ধারন করে আছে।
এবার আসা যাক এই ছয়টি গুনের আলোচনায়। সাধারনভাবে ঋত শব্দের অর্থ সত্য। এই ঋত শব্দের অর্থে যে সত্য বোঝায় তা হল একটি গতিশীল বিবর্তমান অনন্ত পরিব্যাপ্ত সত্য। সৃষ্টির মূলে একটি নিয়মধর্মী সত্য অস্ফুট অবস্থায় রয়েছে, ঋত সেই সত্যেরই সক্রিয় ও স্পন্দিত রূপ।
ইংরেজীতে ঋত হল `order' বা `eternal law' এবং সত্য হল `truth'। সৃষ্টির আদিতে তপস্যার মধ্যে এই দুই গুনের জন্ম। এই হল ঋত ও সত্য সম্বন্ধে ঋষিদের প্রথম ধারনা।
এরপর দীক্ষা। গুরুর কাছে শিষ্য দীক্ষা নেবে, তারপর তার ব্রক্ষচর্য বা তপস্যার শুরু। সে মানসিক উৎকর্ষ লাভ করবে। তপস্যায় মানুষের অলভ্য কিছু নেই, ঈশ্বর লাভের একমাত্র পথই হল তপস্যা। তার পরে যজ্ঞ - জ্ঞানযজ্ঞ বা তপযজ্ঞ, যাগযজ্ঞ দিয়ে আত্মার উন্নতি ও ঈশ্বর লাভের প্রয়াস।
"ঝাঁপি খুলে একটি অতি পুরাতন নোটবই পেলাম। তখনকারদিনে আমাদের দেশে ইন্টারনেটের সুবিধা ছিলনা। বই-পুস্তক ঘেঁটেই যা কিছু পাওয়া। কখন কোথায় কিভাবে এসব পেয়েছিলাম আজ আর তা মনে করতে পারিনা। কেউ সূত্র চাইলে তাই দিতে পারবনা, ক্ষমা করবেন।"
চলবে?
প্রৌঢ়ভাবনা
মন্তব্য
"এই `কাল' সম্বন্ধে এইতো মাত্র সেদিন বৈজ্ঞানিক আইনষ্টাইন আমাদের বর্তমান বিশ্বকে কিছু জ্ঞান দান করলেন। কালের রূপকে, তার ধারন ক্ষমতাকে বিশ্ববাসীর গোচরে আনলেন। তাওতো তিনি প্রাচীণ ঋষিদের মত অত কথা বলেননি। হয়ত বলেননি প্রমানের অভাবে।"
আইন্স্টাইনের কাল আর পোঊরানিক কাল (অবশ্য়্ম্ভাবী, অদ্ররিষ্ট) এর মধ্য়ে বিস্তর ফারাক আছে। আইন্স্টাইন ও তারো পরে আরো বিজণানিরা যে কথা বলেছে, সেটা নিতান্তই নতুন। পোঊরানিক 'কাল' যেখানে একাধারে (দেবতা, দেবী, অবশ্য়্ম্ভাবী, অদ্ররিষ্ট, অবিনশ্বর, সররবভূক)- সেখানে আইন্স্টাইন বা আধুনিক বিজণানে সময়ের একটাই অররথ।
সচরাচর বইগ্ণানিক তত্বএ কোরান বা অন্য় ধররম্গ্রন্থের ছায়া খুঁজতে চাওয়ার মধ্য়ে ছাগলের ম্য়াতকার শোনা যায়। ভাবতে চাই যে, আপনার ওপরের কথায় সেরকম কিছু লুকিয়ে নেই।
ধন্য়বাদ।
দুঃখিত, আমি হয়ত আমার ধাবনাকে ঠিক মত প্রকাশ করতে পারিনি। আমি ধর্মকে ধারন করে কিছু বলতে চাইনি। তাছাড়া আমার ধারনা বেদ, পুরাণ যতটা না ধর্মগ্রন্থ তার চেয়ে বেশী ইতিহাস, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান বিষয়ক পুস্তক। পুস্তকগুলো সমসাময়িক চিন্তা ও সমাজ ব্যবস্থাকেই ধারন করে।
আর ছাগলের ম্যাৎকারকে আমি ঘৃণা করি।
আমার অক্ষমতার জন্য আবারও দুঃখ প্রকাশ করছি।
এটা পড়েও মজা পেয়েছি। পৃথিবীকে ধারন করে থাকা ছয়টি গুন সম্পর্কে জেনে খুব ভাল লাগল।
দারুন অন্যরকম এই সিরিজটি থামাবেন না, প্লীজ।
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
ইয়ে, এটা পুরোটা তো বিষ্ণুপুরাণ বলে মনে হচ্ছে না| এটা কোন পুরাণ থেকে বলছেন মূলত?
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
শুধুমাত্র পরাশর মুনির উক্তিটিই বিষ্ণুপুরাণের। প্রাসঙ্গিকতার কারনে নিচের অংশ অথর্ব বেদ থেকে ।
নতুন মন্তব্য করুন