স্বপ্নবন্ধুতা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ১৫/১১/২০১১ - ১০:৪০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

'দোস্ত, সুস্মিতার নাম্বার দে তো'- তৌহিদ বলে।
'কি রে, তোর না রাত্রি আছে, ওইটার কি হবে?' সিগারেটের ছাই ফেলতে ফেলতে হাসিব জিজ্ঞেস করল।
'ধুর, বেশীদিন কিছু ভাল্লাগে না।'- তৌহিদের উত্তর।

আমার খুব বিশ্রী লাগে। আসলে, এভাবে এরা পারে কি করে? নদীর ঘাটে বসে আছি আমরা তিনজন। আরও তিনজন আসছে। একজন এর মায়ের সাথে মার্কেটে যাওয়ার কথা, আসতে দেরি হবে আগেই বলেছে। আরেকজন, সৈকত, বিশাল ব্যস্ত মানুষ, রাজনীতি করে বেড়ায়। আরেকজন এর ডেট আছে, গার্লফ্রেন্ড এর সাথে। ফোন দিলে রিসিভ করে না!
যাই হোক, মেয়ে বিষয়ে কথাবার্তা চরম বিশ্রী লাগে আমার কাছে। তোরা প্রেম করবি, কর, কিন্তু সবজায়গায় ঐসব নিয়ে কথাবার্তা ভাল্লাগে না।

আরেকটা সিগারেট ধরাই। 'কি রে, তুই তো চেইন স্মকার হয়ে গেলি।' হাসিব বলে। আসলে সেও জানে, আমরা সবাইই জানি, আমরা কেউ রেগুলার স্মোক করি না। বন্ধুরা একসাথে মিললেই কেবল সিগারেট খাওয়া হয়, আর একসাথে মেলার সুযোগ হয় খুব কম, ছুটিছাটা বাদে স্কুলের পুরনো বন্ধুরা একে অন্যের দেখা পাই না বললেই চলে!
'ঐ তো, নেতাজী এসে গেছে।' তৌহিদ বলে। বুঝতে পারি সৈকত এসেছে। সৈকত এর নিকনেম নেতাজী, প্রথম দিকে খুব মাইন্ড করত, এখন করে না।'

'কি রে অনিক, কবে এলি?' সৈকত আমায় বলে। আসলে ওর সাথে আমার অনেকদিন পর দেখা। 'এইতো দোস্ত, দুতিনদিন।' 'তো, চলছে কেমন?''চলে আর কিভাবে? তেলের দাম যা বাড়িয়েছে তোর সরকার।' আমার নিরাসক্ত জবাব পেয়ে সৈকত দমে যায়। 'দোস্ত, সারা বিশ্বেই তো দাম বাড়ছে, আমরা কি করব বল? এছাড়া তো উপায় নেই।' 'দোস্ত, ঢাকা থেকে আসতে কত নিল রে?' হাসিব জিজ্ঞেস করে। 'পাঁচশ, চেয়ার কোচ।' 'পাঁচশ!' তৌহিদ আর হাসিবের মিলিত কণ্ঠ, বিস্ময় ভরা। 'গত মাসেই চারশ টাকা দিয়ে এলাম' তৌহিদ বলে। আমি হাসি। 'চান্দু, তেলের দাম দুদফা বেড়েছে, তাই বাস ভাড়াও দুদফা, পঞ্চাশ করে বেড়ে একশ টাকা।' আমি বলি। সৈকত সিগারেট ধরায়, বলে, 'বুঝলি, দোস্ত, রাজনীতির চেয়ে খারাপ জিনিস আর নেই। নিজের বাপ রাজনীতি করত, সুবাদে আকর্ষণ ছিল,তাই শুরু করলাম, কিন্তু এখন বুঝি, কি ভুল করেছি।' 'নেড়া বেলতলায় যাওয়ার পরেই নিজের ভুল বুঝতে পারে।' হাসিব বলে। আমরা হাসি।

এর মধ্যে আমাদের লাভার বয় মেহেদী এসে হাজির। 'কি রে মামা, হেভি ডেট দিলা তো' সৈকত বলে। 'অহন খাওয়াবা কি কও।' 'কিছু না, এক প্যাকেট বেন্সন কেন।' আমি বলি। 'দেখ, আর যা খাইতে চাস, খাওয়ামু, সিগারেট না।' মেহেদীর জবাব। মেহেদী আবার নীতিবাগীশ। গার্লফ্রেন্ড সিগারেট পছন্দ করে না, তাই ও সিগারেট খায় না, আমরা খেলেও গাইগুই করে।
পড়ন্ত বিকেল, নদীর ধারে বসে সিগারেট খাওয়ার মজাই আলাদা। 'আশিক হারামজাদা কই রে?' মেহেদী বলে। 'উনি আম্মার আঁচল ধরে মার্কেটে গেছেন' তৌহিদ বলে। 'দে, সিগারেট দে' আমি সৈকতের কাছ থেকে সিগারেট নিয়ে লম্বা টান দিয়ে বলি, 'বাদ দে তো, এসে যাবে।'

'তো মামা, পলিটিক্স কেমন চলে?' সৈকতকে মেহেদীর প্রশ্ন। 'আর বলিস না, আজকেও দুইটা মেয়েকে ভর্তি করলাম, ভর্তির ডেট শেষ, এখন ভর্তি হতে চায়। কলেজে এইবার যা চাপ গেলো!' 'দেখতে কেমন রে?' হাসিবের প্রশ্ন। 'একটা খুব সুন্দর, আরেকটা মোটামুটি।' সৈকত বলে। এইতো, এরা আবার মেয়ের ভিতরে ঢুকে গেলো!
'বাদ দে তো, মেয়ে সুন্দর হলে কি প্রেম করবি?' আমি জিজ্ঞেস করি।
'হ্যা মামা, মেলাদিন খালি যাচ্ছে।' হাসিবের জবাব।
'শোন ভাই, প্রেম- ট্রেম বাদ দে, নতুন কিছু ভাব।''কি ভাবব? সেক্স? ওইটা তো প্রেম এর পর।' হাসিবের হয়ে জবাবটা তৌহিদ ই দেয়। আমি বুঝি, এদের মাথায় কিছু ঢুকানোর চেষ্টা করা বৃথা!

এর মধ্যে আশিক সাহেব এসে হাজির। তাড়াতাড়ি একটা সিগারেট ধরিয়েই বলে, 'কোথায় যাওয়ার প্ল্যান, বল। দেরি হয়ে গেলো।'
'সব ব্যস্ততা যেন একা উনার!' তৌহিদ বলে। 'তা কিনলি কি?' মেহেদী জিজ্ঞেস করে। 'এইতো, একটা শার্ট।' 'এতেই এতক্ষণ?' 'আরে না রে, আম্মারও কিছু কেনাকাটা ছিল।' আশিক যেন আত্মপক্ষ সমর্থন করল!

এর মাঝে সূর্য ডুবতে থাকলো। 'চল, নদী পার হই।' আমি বলি। 'সাঁতার জানিস?' সৈকত বলে। 'আমি জানি।' তৌহিদ বলে। 'আমিও জানি' হাসিব হাত তোলে। নেমে যাওয়া নরম আলোয় ওকে বড় অদ্ভুত লাগে। আর কেউ সাঁতার জানি না। 'আচ্ছা চল, দেখা যাবে। ডুবে গেলে মরে যাবো, সমস্যা কি?' আমি বলি। ' মরে গেলে তো সমস্যা নেই, বেঁচে গেলে সমস্যা।' আশিক বলে। ' বাপ বাড়ি ঢুকতে দেবে না।' আমরা হোহো করে হেসে উঠি। কথা বলতে বলতেই ভটভটি নৌকায় চড়ে বসি। নদীর বুকে শেষ বিকেলের ম্লান আলো, ভটভটির ভটভট শব্দ, আকাশের হালকা মেঘ, সবকিছু বড় মায়াময় লাগে। আমি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে দেখি, অন্যরা কি করে, জানা নেই!

নদীর ওপারে নামি, সূর্য ততক্ষণে বিদায় নিয়েছে। এদিকে আমরা অনেকবার এসেছি। জানা আছে, ঘাটের বাজারটা পেরিয়ে গেলেই সুন্দর একটি মাঠ। বাজার থেকে সিগারেট কিনে সেদিকেই হাঁটতে থাকি। হঠাৎ আবিষ্কার করি, মাঠটা খুজে পাচ্ছি না! সেখানে বড় বড় বিল্ডিং উঠছে! ' ধুর শালা। একটা মাঠ ছিল, সেইটাও গায়েব!' হাসিব বলে। ' দোস্ত, দুঃখ করিস না, তোর তো খুশি হওয়া উচিৎ!' তৌহিদের উক্তি। হাসিব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, তাই তাঁকে পরোক্ষ খোঁচা!

'চল, আরেকটু হাঁটি, ওদিকে আরও সুন্দর জায়গা আছে।' সৈকত বলে। আমি হাতে সিগারেট নিয়ে চুপচাপ হাঁটি। এদিকটা আগে বড্ড নির্জন ছিল, এখন মানুষ ভরে যাচ্ছে।

অবশেষে আমরা একটা বসার জায়গা খুঁজে পাই। একটু নির্জন, পাশে কয়েকজন গল্প করছে। আকাশে মেঘ, বেশ অন্ধকার, স্ট্রীটলাইট এখনও এখানে আসেনি।

'দোস্ত, আমরা সবাই এখন যেখানে আছি, এখানে কি কেউ আসতে চেয়েছিলাম?' মেহেদী বলে। আমরা সবাই ওর দিকে তাকাই। 'কি বলতে চাচ্ছিস তুই?' তৌহিদ বলে। 'আমি আমার ব্যাপারটা বলতে পারি,' মেহেদী বলে। 'ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হব, দুবছর চেষ্টা করলাম, পারলাম না। বাপের অত টাকা নেই, প্রাইভেটে পড়াবে। এখন? ছোটো একটা ভার্সিটিতে, অনার্স পড়ছি! এদেশে থাকলে চাকরি হবে কিনা তাও জানি না।'

আমরা সবাই মেহেদীর দিকে তাকাই। আসলেই তাই। আমরা সবাই আবিষ্কার করি, জীবন নিয়ে দেখা আমাদের সবার স্বপ্নই ভেঙ্গে গেছে! ' হাহ! তুই মেডিকেলে পড়তে চাইতিস, তুই অনার্স পড়ছিস! আর আমি? জ্ঞান হওয়ার পর থেকে চাইলাম, ইঞ্জিনিয়ার হব।' বলে চলে তৌহিদ। 'বাপ-মার ইচ্ছা ছিল, ডাক্তারি পড়াবে। বাসায় যুদ্ধ করে ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হওয়ার চেষ্টা শুরু করলাম। ইন্টারমিডিয়েট এর রেজাল্ট খারাপ হল, বিশ্বাস কর, আমি অত খারাপ পরীক্ষা দিই নি! ব্যস, আর কি? বাপ জোর করে প্রাইভেট মেডিকেল এ ভর্তি করে দিল!'সত্যি কথা, বিশ্বাস কর, এ জীবন আমি চাইনি!' তৌহিদ এর মুখটা অন্ধকারেও আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে ওঠে!

'আর আমি?' এবার আশিক শুরু করল। 'সারাজীবন স্বপ্ন দেখলাম, ফিজিক্স পড়ব,ঢাকা ভার্সিটিতে! ফিজিক্স বইটা পড়তে এতো ভালো লাগত! ঢাকা ভার্সিটি পরীক্ষায় ফিজিক্স এ খুব ভালো করলাম, কিন্তু বাইওলজি খারাপ করায় চান্স পেলাম না। তখন এতো মন খারাপ হল, চিন্তা করলাম সায়েন্স আর পড়ব না! বিবিএ এর জন্য চেষ্টা করলাম, হয়েও গেলো, এখন বিবিএ পড়ছি! কিন্তু কোনও মজা পাইনা রে দোস্ত! জীবনে আর কোনও রস নাই, সব পানসে!'

সৈকত সিগারেট ধরায়। বলে, 'তোদের সবার চেয়ে আমার অবস্থা খারাপ।' আমরা ওর দিকে তাকাই। সিগারেটের জ্বলে ওঠা আলোতে ওকে কেমন যেন ঋষি ঋষি লাগে! 'কলেজে ঢুকে ঝোঁকের মাথায় পলিটিক্স জয়েন করলাম। তখনও বুঝি নাই, কিসে পড়তে যাচ্ছি! পুরো দুবছর লেখাপড়া করলাম না। স্বপ্ন ছিল, বড় জায়গায় গিয়ে পলিটিক্স করব, আমার কোনও খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না, পলিটিক্স করব, দেশ নিয়ে ভাবব, এই ছিল ইচ্ছা। পলিটিকাল পাওয়ারের একটা কি যেন আছে, বুঝলি! তোদের সবাইকে ভুলে গেলাম, তোরাও ব্যস্ত ছিলি। রেজাল্ট খারাপ হল, আব্বা প্রচন্ড রেগে কলেজেই ডিগ্রিতে ভর্তি করে দিল। দেশের জন্য একসময় কিছু করতে মন চাইত, কিন্তু এখন সবকিছতেই ঘেন্না ধরে গেছে, বুঝলি! দেশ, সমাজ আমাদের কি দিল? এখন বাঁচি, রাজনীতি করি নিজের জন্য!'

সৈকতের কথাগুলো কেমন যেন বুকে লাগে। সত্যিই তো! দেশ আমাদের কি দেয়? আমাদের মৌলিক অধিকার, আমরা কেউ অধিকারবঞ্চিত নই! কিন্তু আরও কিছু মনে হয় পাওয়ার কথা, যা আমরা পাইনি! তবুও বলি, 'দোস্ত, একটু মনে হয় বেশী বললি। দেশ তো আমাদের অনেক কিছুই দিয়েছে, অনেকে তো এটুকুও পায় না। আমরা তো মনে হয় অনেকের চেয়ে ভালো আছি...' 'ধুর, কিসের ভালো থাকা?' হাসিব বলে।'আমি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছি, এদেশে থাকলে আমার ফিউচার কি? আব্বা বলে সরকারি চাকরি করতে, সেখানে ঢুকলে ঘুষ খেতে হবে! এর চেয়ে রেজাল্ট ভালো করে বিদেশে চলে যাবো, আর আসব না।'

'এদেশে আসলেই কিসসু হবে না আমাদের।' তৌহিদ বলে। 'এদেশে থাকলে হয় ডিগ্রি নিয়ে বেকার বসে থাক, অথবা কেরানীগিরি করো, ঘুষ খাও। ধুর! এই জীবনের মুখে লাথি মারি!'
'না রে।' আমি বলি। 'সৎভাবেও এদেশে অনেকে বেঁচে আছে।'
'নিজের স্বপ্ন যখন সাথে থাকে না, তখন কিছুতেই আসলে কিছু যায় আসে না।' আশিক বলে।'আমরা যদি যা করতে চাই, যা হতে চাই, তা হতে পারতাম, তাহলে নির্ঘাত কেউ দুর্নীতি করতাম না, এখন ব্যক্তিগতভাবে আমার আর কিছুতেই কিছু যাবে আসবে না, কারণ আমি স্বপ্ন থেকে অনেক দূরে।'

'বাংলাদেশের সমস্যা কি জানিস?' সৈকত বলে। 'এদেশে যার যেখানে থাকার কথা, সে সেখানে থাকে না। যার কেরানি হওয়ার কথা, সে হয় ক্রিকেটার! আর যার ক্রিকেটার হওয়ার কথা,সে ব্যাংকার! এইতো, দেখ, তৌহিদের হওয়ার কথা ইঞ্জিনিয়ার, ও পড়ছে ডাক্তারি! আর মেহেদী? ডাক্তার হতে চাইলো, হচ্ছে কেরানি!' সৈকত বলে চলে। 'এজন্যই এদেশে কিছু হয় না। বাঘের জায়গায় থাকে বিড়াল, বিড়ালের জায়গায় ইঁদুর! তাই কেউ ঠিকমত কাজ করতে পারে না, উন্নতি কোনদিক দিয়ে আসবে? আমারও এখন মনে হয়, পলিটিক্স আমার জন্য না। এর চেয়ে তুই পলিটিক্স করলে ভালো করতিস।' আমার দিকে তাকিয়ে সৈকত কথা শেষ করে।

আমিও জীবনটা মেলাতে থাকি। তাইতো। ইচ্ছা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার, রাজনীতি করব, সমাজের জন্য কাজ করবো। তা না, পড়তে হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারিং! এ জীবন ভালো লাগে? আকাশের দিকে তাকাই। শুভ্র চাঁদের উপর এখন পাতলা পর্দার মত মেঘের আচ্ছাদন, বড় সুন্দর লাগে কেন জানি। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে একমনে সিগারেট খাই, ওরা আরও অনেক গল্প করে। আমিও মাঝেমধ্যে কথা বলি, কিন্তু ভেতর থেকে কে যেন বারবার বলে ওঠে, চুপ, চুপ করে তাকিয়ে শুধু দেখো! আঁধার আজ তোমার জন্য সুন্দরের পসরা সাজিয়েছে!

আমরা উঠে পড়ি। নদীর ঘাটের দিকে যেতে থাকি। বেশ রাত, ঘড়ি দেখি না কেউই, ইচ্ছে করে না। 'জানিস, সেদিন নতুন একটা গান ডাউনলোড করলাম।' মেহেদী বলে। 'কার গান, হাবিব না আরেফিন রুমির?' 'আরে না, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান। আপেল মাহমুদের মনে হয়!' মেহেদী বলে।
'আরে, আমার কাছে বাংলাদেশ আছে।' তৌহিদ বলে ওঠে। 'কার বাংলাদেশ? জেমস, আজম খান, না আইয়ুব বাচ্চুর?' হাসিবের প্রশ্ন। 'আরে না বেটা! হ্যারিসনের বাংলাদেশ।'
'ও, জর্জ হ্যারিসনের? ওইটা তো বাংলাদেশ না, ব্যাংলা ডেশ।' আমি বলি। 'ধুর, চুপ কর তো! চিন্তা কর, এক বিদেশি লোক, আমাদের দেশরে নিয়ে কি সুন্দর গান গাইল!' সৈকত বলে। আমি চুপ করি। আসলেও।
'দোস্ত তোর সাউন্ড কোয়ালিটি কেমন? ব্লুটুথে সেন্ড কর তো!' হাসিব বলে, তৌহিদকে। তৌহিদ মোবাইলে গানটা বাজায়। আমরা শুনি।
when my friend came to me, with sadness in his eyes
and told me that he wanted help, to try to save some lives
before a country dies.........
bangladesh, bangladesh....where so many people, are dying fast......
আমরা তন্ময় হয়ে শুনি, কি অসাধারণ সুর, কথা! মাঝেমধ্যে ঠোট মিলাই। হঠাৎ আশিক বলে ওঠে,'দোস্ত, এই গানটা শুনলে মন খারাপ লাগে। মনে হয়, ঐসময় দেশের মানুষ কত কষ্ট করেছিল! এর চেয়ে, মেহেদী, তুই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান বাজা।'

আমরা নদীর ঘাটে পৌঁছাই। ভটভটি পাই না, তাই বইঠা বাওয়া নৌকায় চড়ে বসি। মেহেদী গান বাজায়-
'মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি
মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি...'
আমরা চুপচাপ শুনি। শান্ত নদীর বুকে আমাদের নৌকা ভেসে চলে। নদীর বুকে কিসের যেন আলো খেলা করে। মেহেদী বারবার গানটা বাজায়, আমরা মানা করি না। কি অসাধারণ কথা! বুকের মাঝ থেকে যেন রক্ত ঝলকে ওঠে!

আমরা নদীর পারে পৌঁছাই। এবার যে যার বাসায় যাওয়ার পালা। হঠাৎ আশিক বলে ওঠে, 'দোস্ত, আমি যদি একাত্তর সালে থাকতাম, তাহলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান শুনেই যুদ্ধে চলে যেতাম, কেউ আটকাতে পারত না।' 'আমিও।' সৈকত বলে। 'দেখেছিস, গানগুলো শুনলে কেমন যেন রক্ত গরম হয়ে যায়, এদিকে মারতে মন চায়, ওদিকে মরতে।'

'আসলে একাত্তর সালে জন্মালেই ভালো হত।' আমি বলি। সবাই যেন কেমন তন্ময় হয়ে নদীর ঘাটে দাড়িয়ে থাকি। 'দেশের জন্য মরতে পারলে কতই না ভালো হত!' কে যেন বলে ওঠে! আমি চমকে তাকাই। দেখি, সবাই আকাশের দিকে তাকানো। হাসিব, তৌহিদ, মেহেদী, সৈকত, আশিক সবাই। আমিও আকাশের দিকে তাকাই। মেঘ ফুড়ে বেরিয়ে এসেছে একফালি রূপোলী চাঁদ! আজ কি পূর্ণিমা? কি সুন্দর লাগছে চাঁদটাকে! চোখ ফেরাতে পারি না।

সেসময়, সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়, আমরা বেঁচে থাকব! যেটুকু ভালবাসা মানুষকে মানুষের মত বাঁচতে শেখায়, সেটুকু এখনও আমাদের মাঝে বেঁচে আছে! এখনও আমরা জোনাক জ্বলা রাত, বৃষ্টিদুপুর বা সোনালি বিকেলে অভিভুত হই, কারণে, অকারণে! এখনও ভোরের মিষ্টি রোদ এসে আমাদের চোখে স্বপ্ন একে দিয়ে যায়! হঠাৎ মনে হয়, এদেশ ছেড়ে কোথাও যাবো না। তাহলে এই অবাক রাত্রিটুকুও হারিয়ে ফেলব।

আমরা, ছয় তরুণ হাঁটতে থাকি। আমি পরিষ্কার বুঝতে পারি, আমার মত অন্যরাও এখনও আচ্ছন্ন। কেউ কোনও কথা বলি না। শুধু হাঁটি, হাঁটতেই থাকি। এক ফাঁকে আকাশের দিকে আরেকবার তাকাই। ঘন কালোর বুকে একটুকরো সাদা আলো হয়ে চাঁদ জেগে থাকে।
আমরা আবার অভিভুত হই!

আশফিক অনিক।
Ashfique Aunik


মন্তব্য

মাহফুজ খান এর ছবি

ভালো লাগলো। স্বাধীন বাঙলা বেতারকেন্দ্রের গানগুলোর ব্যপারে আমারো একই অনুভুতি, শুনলেই কেমন গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠে, মনে হয় দেশের কাজেই যদি না লাগে তবে এ জীবন তুচ্ছ। এই আবেগ বেঁচে থাকুক আমাদের সবার প্রাণে।

শিশিরকণা এর ছবি

ভালো লেগেছে। হতাশার মাঝেও এক বিন্দু আশার আলো সঙ্গোপনে জ্বালিয়ে দিলেন।

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

পথিক পরাণ এর ছবি

পুরো লেখাটাই নতুন প্রজন্মের বেড়ে উঠার সময়ের তুখোড় ব্যাবচ্ছেদ। ভালো লাগলো।
মানুষ বাঁচে আশায়, দেশ বাঁচে ভালবাসায়---

নিটোল এর ছবি

চলুক

_________________
[খোমাখাতা]

বন্দনা এর ছবি

এখনও আমরা জোনাক জ্বলা রাত, বৃষ্টিদুপুর বা সোনালি বিকেলে অভিভুত হই, কারণে, অকারণে! এখনও ভোরের মিষ্টি রোদ এসে আমাদের চোখে স্বপ্ন একে দিয়ে যায়! হঠাৎ মনে হয়, এদেশ ছেড়ে কোথাও যাবো না। তাহলে এই অবাক রাত্রিটুকুও হারিয়ে ফেলব

চলুক লাইনগুলো কেমন যেন ঘোর লাগিয়ে দেয় চোখে।
ভালো লেগেছে লেখাটা।

আশফিক অনিক এর ছবি

আপনাদের ভালো লাগাতেই আমার সার্থকতা ও লেখার অনুপ্রেরণা!!

তাপস শর্মা এর ছবি

বিষণ্ণতা। সত্যিই কি করে এই প্রজন্ম দেশকে ভালোবাসবে ?

লেখাটা ভাল লাগলো। আরও লিখুন

আশফিক অনিক এর ছবি

ধন্যবাদ,তাপসদা!নতুন প্রজন্ম আসলে দেশকে ভালবাসে,কিন্তু সে ভালবাসা হাজারো স্বপ্নের ধ্বংসস্তূপের মধ্য চাপা পড়ে থাকে বলে আমার মনে হয়...
আরও লেখার চেষ্টা করব,সাথে থাকবেন!

মিলু এর ছবি

চলুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।