জীবনের প্রথম কয়েকটি গ্রীষ্ম কেটেছে আমাদের বাগানে; রুক্ষ ধূসর কাঠের বেড়ায় গাল ঠেকিয়ে সতর্কভাবে মাথাটা নামিয়ে উপভোগ করতাম প্রতিবেশি'র বাগানের মাধুর্য্য।
এ এক বেহেশত! আলতো ছাঁটের মনোরম ঘাস; পৃথিবীর তামাম রং নিয়ে প্রস্ফুটিত ফুল;রৌদ্রস্নাত শুভ্র মূর্তি; চকমকে পাথর বিছানো বক্রাকার পথের শেষে ঝলমলে সাদা বেন্চি; যেখানটায় বসে তুমি মনোমুগ্ধকর প্রকৃতির আবেশে মোহাবিষ্ট হতে পারো।
ছবির ন্যায় সেই সুন্দর দৃশ্য শেষে এক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আমি ফিরে আসি আমাদের ছন্নছাড়া বাগিচা'য়।হতাশ আমি,
আমার উত্তর মিলে না। আমার কুর্দি বাগানকে কেন এমন দেখায়? সে কি ঈশ্বরের অভিশাপ! যদিও জানি কুর্দিস্তান এক স্বর্গ।
কুর্দি শশ্মান
কিসে তৈরি তাইগ্রীস ও ইউফ্রেতিস?
পানি স্বভাবতই,
পানির তো কোন বর্ণ নেই কিন্তু তারা সর্বদাই রক্তাভ।
পানির তো কোন স্বাদ নেই কিন্তু তাদের আছে কটু স্বাদ
যেন তা ইতিহাসের বারুদ।
পানির কোন গন্ধ নেই তবু তাদের আছে ঘ্রান
এ ঘ্রান ভেসে আসে খুন হয়ে যাওয়া আমাদের কন্যা ও পুত্রদের চুল থেকে।
ইউফ্রেতিস-তাইগ্রিস নদীযুগল পর্বতের মতোই কুর্দি মানুষদের অতি আপনজন।তারা কুর্দি ভুমির বুক চিরে
কুর্দি হৃদয়কে আবেশিত করে, বিকশিত করে, বয়ে চলে; ফোপানো জলে প্রকৃতির মাঝে বেঁচে আবার তাকেই সমৃদ্ধ করে।
কিন্তু যদি তুমি নিকটে গিয়ে দেখো, যদি মাথাটাকে নামিয়ে আরেকটু কাছ থেকে দেখো, তবে তুমি দেখবে ইউফ্রেতিস-তাইগ্রিস আজ পরাজিত।
কবি সেরকো বেকেস ইউফ্রেতিস-তাইগ্রিসের রক্তিম ঢেউ দেখেছিলেন: যে ঢেউ হাজারো কুর্দির খুনে লাল।
আমি যা দেখি তুমিও তাই দেখবে: এই নদীযুগল কুর্দিস্তানের বধ্যভুমি।যদি কখনো হাঁটু ভেংগে তাইগ্রিস ইউফ্রেতিসের দিকে তাকাও, উপরিতলের ঠিক নিচেই দেখতে পাবে কুর্দি শিশু, নারি ও পুরুষের মৃত মুখ।
তবু মনে রেখো শহীদের মৃত্য নেই, তেমনি নেই ইউফ্রেতিস-তাইগ্রিসের।তারা বেঁচে আছে এবং থাকবে।তাদের কুর্দি সন্তানদের মাঝে: যাদের নাম "ফিরাত" ও "দিশলে"।
পুরাণে বলে ইউফ্রেতিস-তাইগ্রিস স্বর্গের নদী আর কুর্দি আরারাত পর্বতে ভীড়েছিলো নূহের নৌকা সেই মহাপ্লাবনের কালে।সেই লোকগাথা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলে; অধিষ্ঠিত হয় এক রোমান্টিক ধারণা "কুর্দিভুমি স্বর্গেরই একাংশ"।
কোন কুর্দি ছেলে কিংবা মেয়েকে শুধাও; কুর্দিস্তানের বর্ণনায় তুমি সন্ধান পাবে এক স্বর্গের।
স্বর্গের সীমানা আছে, কিন্তু কুর্দিস্তানের নেই।
কুর্দিস্তানের সংজ্ঞা........
কুর্দিস্থান এক সুমিষ্ট ভুমি ; আমাদের পুর্বপুরুষের আরাধ্য আমেদ, মেহাবাদ, হেউলার ও কামোশলো'র চেয়েও।
কুর্দিভুমি কিংবা কুর্দি সন্তানদের সীমারেখা দিয়ে চেনা যাবেনা; যে মাটিতে একজন কুর্দির অস্তিত্ত্ব বর্তমান, সেটাই কুর্দিস্তান।
কুর্দি মানেই শুধুই নৃতাত্ত্বিক কোন গোষ্ঠি নয়।সীমানাবিহীন কুর্দিস্তান স্বাধিণতার অন্য নাম আর যারা মুক্তির দাবীতে লড়ে তারাই কুর্দি।
শুধু মুক্তিযোদ্ধারা'ই বেঁচে থাকে।সার্বক্ষণিক মৃত্যভয় তোমাকে আলতো করে মাটিকে চুমু খেতে শেখাবে, কন্টকিত গাছের বাকলে গাল ঠেকিয়ে ,মাথাটাকে রেখে তুমি নেবে রসের সুমিষ্ট ঘ্রান।আরাম-আয়েশে ডুবে থাকা পৃথিবীর বাকী মানুষরা বেঁচে থাকার চেষ্টা করে ব্যর্থ; তারা বরং মৃত। তুমি মৃত যদি তোমার জীবনের মানে হয় শুশি, বিয়ার আর তার্কি।
তুমি তখনই ভীষনভাবে জীবন্ত, যখন তোমার শরীরের লবণাক্ত ঘাম বাষ্প হয়ে নি:সরিত হয়; যখন তুমি আপাত নরকে লড়তে থাকো।
কোন এক'কালে কুর্দিস্তানের হৃৎপিন্ড প্রোত্থিত ছিলো ইউফ্রেতিস ও তাইগ্রিস নদীর মাঝখানে।কিন্তু কিয়ৎকাল পূর্বে একদিন, এক মুক্তিযোদ্ধা সেই হৃৎপিন্ডকে মাটি খুড়ে তুলে পকেটে পোড়ো এবং সংগে করে পর্বতে নিয়ে যায়।
সেখানে এক উপত্যাকায় লুকিয়ে রাখে যেখানে প্রতিনিয়তই তৈরি হয় অসংখ্যা প্রতিধ্ধনি; সে এবং আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা সবর্দাই শোনে, অনুভব করে সেই হৃৎস্পন্দন।
যদি তুমি বেঁচে থাকো, তুমি অবশ্যই তা শুনতে পাবে ।শোনো, মাটিতে কান লাগিয়ে শোনো।যদি বেঁচে থাকো, তবে কুর্দি হৃদয়ের সেই কম্পন তুমি অনুভব করবে।
কুর্দি এক অগ্নিশিখা,
কুর্দি পরিবার এক আগুন,
কুর্দি জনগণ এক বন্য অগ্নিকান্ড।
কুর্দি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া অসংখ্যা আগুন কিন্তু যদি তারা পরস্পরের নিকটবর্তি হয়, তবে তারা সুর্যের মতো করে জ্বলবে, ঠিক কুর্দিস্তানের পতাকার সুর্যটার মতো।
আমি জীবিত, আমি এক মুক্তিযোদ্ধা এইং আমি'ই কুর্দিস্তান।
[আর সবকিছুর মতো পরাধীনতা, নির্যাতন'কে প্রচারের পাদ-প্রদীপে আসতে হয়, নইলে তারপক্ষে মানুষ দাঁড়ায় না।ইরান-ইরাক-সিরিয়া-তুরস্কের মাঝে ভাগাভাগি হয়ে যাওয়া কুর্দিদের কান্না-আর্তনাদ খুব বেশি দূর পৌছায় না।কুর্দি বন্ধুটি যখন বলে আমি এখনও তুরস্কে কুর্দিতে কথা বলতে পারিনা, তখন মনে পড়ে শুধু নিজের ভাষায় কথা বলার জন্য আমরাও রক্ত দিয়েছি।]
লেখাটি অনুমতি-সাপেক্ষে এক কুর্দি ব্লগ থেকে ভাষান্তরিত। অনিচ্ছাকৃত বানান-ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।
ফিয়র্ডম্যান
মন্তব্য
তৃতীয় ক্রুসেডের সর্বাধিনায়ক ব্রিটিশ রাজ রিচার্ড দি লায়ন হার্ট যে সুলতান সালাহউদ্দিনের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন, সেই সুলতান সালাউদ্দিন ছিলেন কুর্দী। শোনা যায়; ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের গোধূলীলগ্নে নিতান্ত ভাসাভাসা অবিকশিত জাতীসত্বার ভিত্তিতে arbitrarily আরব ভূখন্ড/মধ্যপ্রাচ্যকে ভাগাভাগি করা হলেও সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও পূর্ণ বিকশিত জাতীসত্বার অধিকারী কুর্দীদেরকে এমনভাবে চারটি দেশের মধ্যে ভাগাভাগি করে দেয়া হয় যাতে তারা কোনদিনও স্বাধীনতার স্বাদ পেতে না পারে। এভাবে ব্রিটিশরা ক্রুসেডে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়। এটার সপক্ষে কোন তথ্যসূত্র দিতে পারবনা; কোথাও শুনেছি বা পড়েছি- ঠিক মনে নেই।
কুর্দীদের মনে হয় চার নয়, আরো বেশি ভাগে ভাগ করা হয়েছে - ইরান, ইরাক, তুরস্ক, রাশিয়া, আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, জর্জিয়া। মাইগ্রেশন করা আরো অনেক কুর্দী আছেন সিরিয়া, জর্ডানে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ভালো লাগল। আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন কুর্দি, অনেক গল্প শোনা হয় কুর্দিস্তান নিয়ে। তারা বহু ভাবে অত্যাচারিত আজও।
facebook
একেবারেই ভিন্ন ধরনের লেখা। কুর্দিদের নিয়ে আমাদের বেশীরভাগেরই ধারণা নেই। একটা চমৎকার অনুভুতি প্রকাশ হয়েছে এটিতে।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
তৌফিক জোয়ার্দার, আপনার তথ্যটি সঠিক কিন্তু তত্ত্বখানি কতটুকু সঠিক হলফ করে বলা কঠিন।
আমি বলছিনা, আপনি যা বলছেন সেটা ঠি নয়, তবে সবকিছুতেই সাদাদের ঘাড়ে চাপিয়ে নিজেরা ভারমুক্ত হবার যে প্রবণতা আমাদের মাঝে আছে, সেটাও এমন তত্ত্বের পিছনে কাজ করতে পারে।
উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনে মধ্যপ্রাচ্যে যে দেশগুলো জন্ম নেয়, তাতে সিরিয়া, ইরাক ও তুরস্কের মাঝে উসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত কুর্দিস্থান'কে ভাগ হয়ে যায়।ইরাক ও সিরিয়া ব্রিটিশ ও ফরাসি ম্যান্ডেটেড অংশ পায় আর কামাল আতার্তুকের নেতৃতে সেলজুক তার্ক'রা বাকি অংশ দখল করে নেয়।এর আগেই কুর্দি অধ্যুষিত এলাকা ১৬শ শতকে উসমানিয় ও সালাফিদ(পারসিয়ান) সাম্রাজ্যের মধ্যে ভাগাভাগি হয় ব্যাটল অফ শালদিরান-এ।
১২ শতকে তৃতীয় ক্রুসেডে সুলতান সালাউদ্দিনের হাতে নির্মম পরাজয়ের পরে বশ্যতে স্বীকার করা কিং অফ ইংল্যান্ড রিচার্ড দ্যা লায়ন হার্ট উত্তরপুরুষ কতটুকু সেই পরাজয় মাথায় রেখে কুর্দিস্তান'কে ছিন্নভিন্ন করেছিল বলা মুশকিল।
ধন্যবাদ। তত্বটির ব্যাপারে আমি নিজেও নি:সন্দেহ নই। আলোচনার জন্য তুললাম, যদি আরো কিছু জানা যায়।
অনেক কিছু জানতে পারলাম। ধন্যবাদ। আমি শুধু তৌফিক জোয়ার্দার যেমন শুনেছিলেন ঐটুকুই জানতাম। অনেক ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন