বিতর্ক

দীপ্ত এর ছবি
লিখেছেন দীপ্ত [অতিথি] (তারিখ: রবি, ২০/১১/২০১১ - ২:৩৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রুমি আর সুবর্ণার সম্পর্কটা ভালো ছিল, বেশ পোক্ত। ওদের দুজনের বন্ধুমহলের কেউই ভাবেনি সম্পর্কের শেষটা এভাবে ঘটবে। কিন্তু কত কিছুই তো আমরা ভাবি না, কিন্তু এমনি এমনি ঘটে। তাই ওদের গল্পটাও মিলনাত্মক হোল না।

রুমি আর সুবর্ণার পরিচয়টা অদ্ভুত কিছু না। দুজনই বিতর্ক করত, প্রতিপক্ষ দলে ছিল একসময়। হেরে যাওয়াটা ভীষণ অপছন্দ করত রুমি। তাই একবার হেরে গিয়ে পণ করে বসে যে আর একবার কথার লড়াইয়ে প্রতিপক্ষকে না হারালেই না, বিশেষত ওই পিচ্চি চশমা পড়া মেয়েটাকে, আজকে রুমির বক্তব্যকে তুলোধুনো করেছে সে।
এই হারকে অপছন্দ করা রুমিই যে কদিনের মধ্যে ওই পিচ্চি চশমা পরা মেয়েটার কাছে শুধু হারতেই চাইবে তা কে জানত। কে জানত যে রাতের পর রাত মেয়েটা কথার তুবড়ি ছোটাতে থাকবে আর রুমিকে খালি হু-হা করেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। মেয়েটার অনর্গল কথা শুনেও রুমির সেই শোধ তুলতে চাওয়া মনটাতেই অকারণ এক আনন্দ হবে, মনে হতে থাকবে এই হারের মুহূর্তগুলো দীর্ঘ হোক। আসলে কি আজবই না আমরা মানুষেরা, আর যখন ভালবাসি তখন আরও কি ভীষণ দুর্বোধ্য হয়ে উঠি, নিজের কাছেই।

ওদের সম্পর্কটাও বেশ দুর্বোধ্য ছিল আমাদের কাছে। ওদেরকে আমরা বলতাম ইন্টেলেকচুয়াল কাপল। আর আদতেও ওরা ছিলও তাই। কথায় কথায় বিতর্ক করবে, আর বিতর্কের সময় হেন বিষয় নেই যা নিয়ে তর্ক উঠবে না। মজার বিষয় ছিল, প্রায় কোন কিছুতেই ওদের মতের মিল হত না। কি করে কিউপিডের তীর এসে দুই বিপরীত মেরুর মানুষের হৃদয় ভেদ করল, তা ভেবে কূল কিনারা পেতাম না আমরা।

ওরা তর্ক শুরু করলে আমরা গোল হয়ে বসে দেখতাম আর আবহনী-মোহামেডান ম্যাচের মত দুই ভাগে ভাগ হয়ে সমর্থন দিতাম। অবধারিতভাবে কোন তর্কই কারও হারজিতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হত না, একটাই উপায় ছিল- যদি কোন একজনের ক্লাস পড়ে যায়। আমরা দর্শককূল তো এই বিমল আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতে রাজি নই, তাই পরের বার দুজনের সাথে দেখা হলে মনে করিয়ে দিতে ভুলতাম না।

কথাচ্ছলে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম রুমিকে সুবর্ণার সাথে ওর মতের মিল-অমিল নিয়ে। তাতে রুমি যা বলেছিল তাতে তাজ্জব বনে গেলাম। ও বলেছিল যে সুবর্ণার সাথে নাকি ওর বেশির ভাগ বিষয়েই মতের অমিলের চেয়ে মিলই বেশি হয়, কিন্তু তর্ক করার সময় সুবর্ণার মুখে যে গনগনে লাল আঁচ পড়ে, হড়বড় করে একগাদা কথা বলে শেষে নিঃশ্বাস নিতে থাকে, অস্থির ভাবে কথা কেড়ে নেয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠে, আর কখনও কখনও রাগে তুইতোকারি করতে থাকে এইসব ছেলেমানুষি নাকি ওর ভীষণ পছন্দ। “এইটা না থাকলে ওকে মানায় না, বুঝলি?” বলে একটা বজ্জাতি চোখ টিপি দেয় ও আর আমি বুঝে ফেলি যে কি কারণে ওদের এত মতের অমিল হয়।

এইদুজন যে শেষ পর্যন্ত একসাথে থাকতে যাচ্ছে এ নিয়ে বাজি ধরার লোক আমাদের বন্ধুমহলে কম ছিল না, আশেপাশে যাদের সম্পর্ককে পূর্ণতা পেতে দেখেছি তাদের অনেকের চেয়েই যে এরা দুজন বুদ্ধিমান আর সম্পর্কের বেলায় অনেক ম্যাচিউর, কিন্তু হঠাৎ শুনলাম সুবর্ণার নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে অন্য জায়াগায়।
বিস্মিত হলাম। শুধু বিস্মিত বললেও কম বলা হয়। গোটা বন্ধুমহলে বেশ বড়সড় আঘাতের মত আসলো খবরটা। কদিন ধরেই ওদের একসাথে দেখছি কম, কিন্তু নিশ্চয়ই কারো পরীক্ষা চলছে বলে ভেবেছি আমারা। রুমিকে ফোন দেই, ও কিছুই খোলসা করে বলেনা, খালি বলে যা শুনেছিস ভুল শুনিসনি। সুবর্ণাকে ফোন দিলে ধরে না। শুনলাম খুব কাছের বন্ধুরা শুনতে গেলে ও নাকি বলে দিয়েছে মুখের ওপরে, এইটা নিয়ে না ঘাটালেই কি তোদের হয় না?

এই কথার পরে কথা চলে না, কথা চললে আর বন্ধুত্ব চলে না, তাই সুবর্ণার হঠাৎ বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের জল্পনাকল্পনাটাও আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হয়ে আসে। আমরা নিজেরা নিজেরা বলাবলি করি যে এই যুগে আর ভালবাসা নামে কিছুর অস্তিত্ব আশা করাটা বোধহয় বাতুলতা মাত্র। প্রতিদিনের এত শত ঘটনার ভিড়ে এই ঘটনাও আস্তে আস্তে মিলিয়ে আসে।

এর কদিনের মাঝেই সুবর্ণার বিয়ে হয়ে যায়, ওই সময় কেউ যদি ওকে জিজ্ঞাসা করত তাহলে হয়তো জানতে পারত যে তখন কেবলমাত্র পড়াশোনা শেষ করা রুমির চেয়ে প্রতিষ্ঠিত, স্বপ্নের দেশের ভিসাওয়ালা ছেলের কদরই ছিল সুবর্ণার বাবার কাছে বেশি। আজীবন বাবামার আদেশের বাইরে না যাওয়া সুবর্ণার প্রতিবাদ আর ঘরের দরজা বন্ধ করে কান্নাকাটি করা বা ভাত না খাওয়া বা এমনকি আত্মহত্যার হুমকিও গুরুজনের সিদ্ধান্তের কাছে অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। আর শেষাবধি সুবর্ণা নিজেও সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে এই আপ্তবাক্যে সান্ত্বনা লাভ করে (বা করার চেষ্টা করে) এবং পাত্রপক্ষের সামনে এসে মুখে কষ্টের এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে সালাম দেয়।

এত ঘটনা যখন ঘটতে লাগল তাহলে কেন রুমি সুবর্ণাকে নিয়ে পালালো না আর সুবর্ণাই বা কেন শেষ চেষ্টা হিসেবে বাসা ছাড়ল না? হ্যাঁ, সেটা যদি আসলেই ঘটত তাহলে আমরা কেইবা অখুশি হতাম। কিন্তু অনেক সময় জীবন গল্প সিনেমার চেয়েও নাট্যময়, আবার কখনো একেবারেই সাধারণ, ম্যাড়মেড়ে। রুমি সুবর্ণার কাহিনীও এপর্যন্ত সেরকম ম্যাড়মেড়ে একটা গল্প। এখানে নায়ক নায়িকা কেউই পালালো না ।

তবে নিশ্চয়ই যখন এত কিছু ঘটেছে, তখন রুমি-সুবর্ণার মধ্যে সম্পর্কটা একটা বিক্ষুদ্ধ সময় পার করেছে। হয়তো রুমি বলেছে যে আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য আর বছর দুয়েক সময় তো দাও, সুবর্ণা বলেছে তাহলে তুমি তোমার অ্যাম্বিশন নিয়েই থাকো আর বছর দুয়েক পরে আমার স্বামীর বাড়ি বেড়াতে যেয়ো। কিংবা কে জানে হয়তো এত কিছু না বলেই সুবর্ণা হঠাৎ করে বলে বসেছে চল পালিয়ে যাই কোথাও, আর ওটা সুবর্ণার আরেকটা পাগলামি ভেবে রুমি হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে। কিংবা রুমি যখন শেষ মুহূর্তে ওর যাবতীয় ভালোমানুষি আর মধ্যবিত্ততার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে সুবর্ণাকে নিয়ে পালানোর চিন্তা করেছে তখন সুবর্ণার সায় পায়নি, অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে বলে। এগুলোরই কোন একটা ঘটেছে, বা অন্য কিছু যা আমরা কেউই জানি না, কিন্তু এটুকু জানি যে সুবর্ণার বিয়েটা নির্বিঘ্নেই হয়, রুমি বিয়ের আসর থেকে বউকে তুলে নিয়ে আসেনি বলিউডি সিনেমার স্টাইলে। সেটা পারলে হাততালি দেয়ার লোকের অভাব হত না, কিন্তু না, রুমি বড়ই ভালো ছেলে। এমন ধরনের ছেলে যাদের পরিবার ভালো ছেলে বলে, সহপাঠীরা বলে, শিক্ষকরা বলে, প্রতিবেশীরা বলে, সমাজ বলে কিন্তু যাদের ভালবাসা জোটেনা বা জুটলেও যারা শক্ত করে ধরে রাখতে পারে না। এমন ছেলের জন্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিইবা করার আছে ওর বন্ধুদের।

এর পরে সুবর্ণা বন্ধুমহলের দৃশ্যপট থেকে উধাও হয়ে যায়। কারণ যে স্বপ্নের দেশে চলে যায় তাকে আমাদের অতটা মনে থাকে না। ওই দেশটা নিশ্চয়ই স্বপ্নে ভরা, স্বপ্নে আমরা যা দেখি আর যা দেখি না সবই ওখানে পাওয়া যায়- এটা ভেবে আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলি, কেউ কেউ মাঝেমাঝে সুবর্ণাকে হিংসাও করি, কিন্তু সুবর্ণা নামের কেউ আস্তে আস্তে আমাদের স্মৃতি থেকে ফিকে হতে থাকে। আর তা হবেই না বা কেন, এর মধ্যেই জীবনের আঁচ লাগতে শুরু করেছে আমাদের গায়ে, রাতের বেলা গিটার বাজিয়ে ভার্সিটি চত্বরে গান গাওয়ার সময়টাও ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে, বাস্তবতা আমাদের গিলতে শুরু করেছে কেবলই, যেমন অজগর তার শিকারকে গিলতে থাকে, ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে।

রুমির ব্যাপারটা আলাদা, ও তো আর স্বপ্নের দেশে যায়নি, বরং স্বপ্নভঙ্গই হয়েছে ওর বলা যায়। তাহলে ওকে কেন আমরা ভুলে যাই? কারণ এই সময়ে রুমি গুটিয়ে যায়, নিজের মধ্যে, ওর গুটিয়ে যাওয়াটা সবার চোখে পড়ে না, কিন্তু আমরা বুঝতে পারি যে ও গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। ওর খোমাখাতার পৃষ্ঠাটা দীর্ঘদিন একই রকম অবস্থায় পড়ে থাকে, ওকে আমরা জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানালেও মেসেজের উত্তর আসে না, কোথাও ঘুরতে বের হলে ওকেও ইনভাইট করি ইভেন্ট খুলে কিন্তু ওর কোন সাড়া পাই না, ওর ফোনে ফোন দেই, রিনরিনে মিষ্টি কণ্ঠে এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না শুনে হতাশ হয়ে ফোন রেখে দিই। আমরা যারা ওর ঘনিষ্ঠ ছিলাম বেশি তারা একদিন ওর বাসায় যাই, গিয়ে দেখি এই কদিনেই কি ভীষণ পরিবর্তনই না হয়েছে ওর, না খুব শুকিয়ে যায় নি ও, চোখের কোণে কোন কালিও পড়েনি, তারপরও আমরা বুঝি ও আর আগের রুমি নেই। আমার মনে হয় হ্যারি পটারে আত্মাখেকো যে ডিমেন্টরগুলো ছিল, তাদেরই কেউ একজন বোধহয় রুমিকে ছুঁয়ে গেছে।

অথচ আগে কি মাতিয়েই না রাখত আমাদের বন্ধুমহলকে ও আর সুবর্ণা মিলে। সেই রুমির সাথে এখন আমাদের কথার টপিক খুঁজে পেতে সমস্যা হয়, ভার্সিটির বন্ধুরা কে কোথায় আছে নিয়ে কথা বলার পর আমাদের মাঝে দীর্ঘ নীরবতা নেমে আসে। আমি জানি যে ভার্সিটি থেকে বের হয়ে আমরা যখন কেউ কেউ বিসিএস এর জন্য চোখ কান বন্ধ করে পড়া শুরু করেছি, কেউ যখন একের পর এক কোম্পানিতে সিভি জমা দিচ্ছি বা কপাল ভালো থাকলে কোন একটা চাকরি গুছিয়ে নিয়ে জাঁকিয়ে বসেছি বা অন্যরা বাইরে যাওয়ার জন্য ঘরের দেয়াল জিআরই এর ভোকাবুলারি দিয়ে ভরিয়ে ফেলেছি, তখন রুমি কিছুই করেনি। সুবর্ণা যে ওর জন্য কি ছিল তা আমরা জানতাম, কিন্তু ভেবেছি যে জীবন তো থেমে থাকে না, আর ওর মত জীবনবাদী ছেলেও নিশ্চয়ই এই ঘটনাকে আঁকড়ে ধরে বাকি জীবন পার করবে না। আসলে চারপাশে এত ব্রেকআপ দেখেছি আর দেখেছি যে ব্রেকআপের এক মাসের মধ্যে কেমন করে নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে, নতুন কাউকে ভালবেসে আগের জনের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ ভুলে যেতে পেরেছে আমারই কিছু কিছু বন্ধু, যে বুঝতে পারিনি ওরা দুজন একটু আলাদা। সুবর্ণার চলে যাওয়াটা যেন রুমির মধ্যে থেকে সব কর্মোদ্যম শুষে নিয়েছে। রুমির চোখে তাকালে যেন একটা অসীম বিস্তৃত, দিকচিহ্নহীন পথের দিকে তাকিয়ে আছি মনে হয়। জীবনকে নতুন করে গোছাতে পারবে এমন কোন আশাই আমি খুঁজে পাইনা ওর চোখে।

এত কিছুর পরেও রুমি কিন্তু অন্ধকার জগতে যায়নি, নেশার রাজ্যে বুঁদ হয়ে থেকে নিজেকে ভুলে থাকতে চায়নি, প্রবল ভাঙচুর করে শোধ তুলতে চায়নি। শুধু কেমন জানি বদলে গেছে, সারাদিন নিজের ঘরে পড়ে থাকে, বাইরে যেতে চায় না, মানুষের সাথে মিশতে চায় না, কিছু জানতে চাইলে হু-হা উত্তর দিয়ে পাশ কাটিয়ে যায়। সামনে কি করবে জানতে চাইলে মাথা নিচু করে থাকে, মনে হয় এই ঘরটাতে ও নেই, এই বাসাটাতে নেই, এই পৃথিবী থেকে বহুদূরে কোন একখানে ও চলে গেছে। অথচ ছাত্রজীবনে কি উজ্জ্বলই না ছিল আমাদের এই বন্ধু, রেজাল্ট ছিল প্রথম সারির, ছবি আঁকত, বক্তৃতা করত, আবৃত্তিও- আমাদের যেকোনো আড্ডার মধ্যমণি ছিল, হেন বিষয় নেই যা নিয়ে ওর জানা ছিল না। আর মিথ্যা বলব না, বার কয়েক ওকে ঈর্ষা না করেও পারিনি, বলতাম “যা যা সব বিষয়ে জ্ঞান ফলাসনে দিনি।" সেই রুমি আর এই রুমি- এ যেন চোখের সামনে একটা ঘনসবুজ লতা লকলক করে উপরে উঠছিল, হঠাৎই কোন সূর্যগ্রহণের প্রভাবে শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

রুমির আম্মা মাঝে মাঝে ফোন দেন। ফোন দিয়েই কান্নায় ভেঙে পড়েন। একটা মাত্র ছেলে, কি ছিল আর কি হয়েছে। সুবর্ণার কথাও জানতেন বোধহয়। আমাদের বলেন রুমি যদি আগে থেকে বলত তাহলে তো তিনি প্রস্তাবটা অন্তত পাঠিয়ে দেখতে পারতেন। বলেন, আত্মীয়স্বজনের চাপে একবার মানসিক ডাক্তারের কাছেও নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু ও তো অসুস্থ না, ডাক্তারের রিপোর্টও একই কথা বলেছে। ওর এই উপসর্গগুলো কাটানোর জন্যে মানুষের সাথে মেলামেশা করা, কথা বলা এছাড়া উপায় নেই। আমি চুপ করে থাকি, ছেলেকে ফিরিয়ে আনার অনুরোধে আমি কি বলব বুঝে উঠতে পারি না।

এর মাঝেই আসে সংবাদটা। পাই সুবর্ণার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মাধ্যমে। স্বপ্নের দেশে জীবন গোছাতে না গোছাতেই এক ঝড়ে এলোমেলো হয়ে গেছে ওর ঘর, বনেনি বাবামার পছন্দের ছেলের সাথে। তাই দেশে ফিরে এসেছে দুবছর যেতে না যেতেই। একদিন দেখতে যাই সুবর্ণাকে। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ, কেমন বিষণ্ণতার ছায়া। কিছু জিজ্ঞেস করি না, ও খালি বলে, মনের মিল হওয়া সহজ নারে।

এর পড়ে বেশ কমাস কেটে যায়। একদিন আন্টির ফোন পাই। খোঁজখবর জানতে চান আর বলেন, রুমির সাথে যে মেয়েটার সম্পর্ক ছিল সুবর্ণা না কি যেন নাম, ও নাকি দেশে এসেছে? আমি বলি, জি, কিন্তু আপনি জানলেন কি করে? বলেন, বাসায় ফোন দিয়েছিল মাঝে একবার কিন্তু রুমি নাকি কোন কথাই বলেনি। আর এরপরে নাকি আরও খোলসে ঢুকে যাচ্ছে রুমি। এখন নাকি কিছু জিজ্ঞাসা করলেও অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে, রাতের বেলায় ঘুম থেকে উঠে সাদা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে চুপ করে। আন্টি বলেন, সামনের শুক্রবার রাতের বেলা ফ্রি আছো? একটু আসতে পারবে। ওর বন্ধুদের বলেছি, সুবর্ণাকেও। তোমরা বন্ধুরা এক হয়ে ওকে একটু কথাটথা বলাও তো বাবা। আমি হ্যাঁ বলি আর ভাবি আগে কতবারই না আমরা গেছি রুমির ওখানে, কত রাত আড্ডা দিয়ে কেটেছে ওদের ছাদে, আর রুমির রুমে বসে ফুটবল দেখে। প্রিয় দল নিয়ে যুক্তিতর্ক, রাগারাগি, মন কষাকষি করেছি কত, আর আজ।

শুক্রবার রাতে রুমির বাসায় গিয়ে দেখি আন্টি খাওয়া দাওয়ার বিশাল আয়োজন করেছেন। অনেক পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা হয়, সুবর্ণাকেও দেখি। সবাই ড্রয়িং রুমে বসেছে। তবে ঠিক আগের পরিবেশটা পাই না, কি বদলেই না গেছে আমাদের আড্ডার টপিকগুলা। আগের রাজনীতি-দর্শন-খেলাধুলা-মুভির জায়গা গ্রহণ করেছে গাড়ি- স্ট্যাটাস- চাকরি- বোনাস এইসব। রুমিকে দেখি এক কোনার সোফায় বসে আছে চুপ করে। মনে হচ্ছে এই আড্ডায় থেকেও যেন নেই, চারপাশে এতকথার মাঝেও খুব নিঃসঙ্গ নিজের একটা জগতে ডুব দিয়ে আছে, তাকাচ্ছে পর্যন্ত না কারও দিকে। বন্ধুদের কেউ কেউ রুমির সাথে কথা বলতে গিয়ে তেমন কোন সাড়া না পেয়ে ফিরে এসেছে। সুবর্ণার দিকে তাকাই, দেখি কি অসহায়ের মত, যন্ত্রণাকাতর দৃষ্টিতে ও রুমির দিকে তাকিয়ে আছে।

খাবারের ডাক পড়ে। অনেকে খাবার হাতে নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসে, আন্টি সুবর্ণাকে, আমাকে আর আরও দুচারজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে রুমির সাথে টেবিলে বসান। খাবার পরিবেশনের ফাঁকে ফাঁকে জিজ্ঞাসা করেন আমরা কে কি করছি। সুবর্ণার জানায়, ও নিউট্রিশনের উপর কাজ করছে একটা কোম্পানিতে, বাইরে এক বছর কাজ করেছে সেই অভিজ্ঞতাও বলে। সবাই বলে কিন্তু রুমি মাথা নিচু করে খেতে থাকে। কথা ঘুরে ফিরে রাজনীতির দিকে যায়, দেশের কিছুই হবে না এই নিয়ে সবাই মোটামুটি নিঃসন্দেহ হয়ে ওঠে, সবাই নিজের দুঃসহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে থাকে একের পর এক। কেউ বলে, আমাদের মত দেশে আর্মি আসলেই ভালো। আমি বলি সবচেয়ে ভালো ডিক্টেটরের চেয়েও সবচেয়ে খারাপ গণতন্ত্র ভালো। এই নিয়ে আলোচনা তুমুলে ওঠে। সুবর্ণা বলে, গণতন্ত্র না থাকলে উন্নয়নের সুফল জনগন পায় না, বিশ্বের উন্নত দেশের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এতক্ষণ চুপ করে থাকা রুমি হঠাৎই যেন বলে ওঠে, কিন্তু তুমি যে বললা গণতন্ত্র ভালো, ওইসব তত্ত্বীয় জিনিস শিক্ষিতদের দেশে ভালো হইতে পারে, আমাদের এখানে অচল- বলে ওঠে ঠিক আগে যেভাবে তর্ক করত সুবর্ণার সাথে সেভাবেই। আমি অবাক বিস্ময়ে ভাবি, সারাজীবন সব আড্ডায় গণতন্ত্রের পক্ষে যুক্তির পর যুক্তি দিয়ে যাওয়া ছেলেটা কেমন করে স্বৈরতন্ত্রের পক্ষ নিতে পারে। খেয়াল করে তাকাতেই আমার ভুল ভাঙে। রুমির ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসির সেই পুরনো ঝিলিক, ইচ্ছা করে সুবর্ণার সাথে তর্ক বাঁধানোর সময় আগে যেই হাসিটা ঝুলে থাকত ঠোঁটের কোণে, সেই হাসিটাই।

দীপ্ত।


মন্তব্য

নিটোল এর ছবি

অনেক অনেক ভালো লাগল গল্পটা। পড়া শেষ করে আমার ঠোঁটের কোণায়ও একটা হাসি চলে এলো। তৃপ্তির।

সচলে স্বাগতম। আগেও কি লিখেছেন নাকি এখানে? নাকি আমিই খেয়াল করিনি?

_________________
[খোমাখাতা]

দীপ্ত এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ, নিটোল। সচলে প্রথম লেখার প্রথম মন্তব্যকারী আপনি, তাই বিশেষ আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- আপনার প্রাপ্য।

অমিত এর ছবি

তারপর?? ছোট বাচ্চাদের মত হয়ে যাচ্ছে তাও জানতে চাই যে নায়ক নাইকার কি মিল হল??

দীপ্ত এর ছবি

নায়ক নায়িকার বিচ্ছেদ আমার কখনই খুব পছন্দ হয় না, দুইদিনের দুনিয়া কান্নাকাটি করায়ে লাভ কি, কিন্তু সরাসরি মিল করাইতে চাইনাই, যদি পাঠক বলে এহ, মিল হইলে আর হইল কি? তাই পাঠকের উপর রাখতে চেয়েছিলাম।

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

ভাল লাগল ... সচলে স্বাগতম।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

দীপ্ত এর ছবি

ধন্যবাদ অনেক।

তিথীডোর এর ছবি

চমৎকার! চলুক
লিখুন আরো।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

দীপ্ত এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

রূপক জুলকারনাইন এর ছবি

লেখাটা পড়ে অনেক ভালো লাগলো।

আমি রুমির মতো ভালো ছেলে কীনা জানিনা, তবে আমিও বলিউডি কায়দায় আমার ভালোবাসাকে বিয়ের আসর থেকে তুলে নিয়ে আসিনি। পরাজিত সৈন্যের মতো কাচ্চি বিরিয়ানী খেয়ে চলে এসেছিলাম।

বিরিয়ানীটা অনেক সুস্বাদু হয়েছিলো।

দীপ্ত এর ছবি

সাধারণত আমরা কেউই সেটা পারি না ভাই, বলিউডি কায়দা বলি আর যাই বলে, জীবনে ঘটে কমই।

ভালো লাগা জানানোতে ধন্যবাদ।

অচেনা আগুন্তুক এর ছবি

দীপ্তঃ

ভাল লেগেছে। খুব সহজ কিন্তু সুন্দর। আর গল্পের শেষ টা অসাধারণ। লিখতে থাকুন। এমন আরও ভালবাসার গল্পের অপেক্ষায় রইলাম।

অচেনা আগুন্তুক
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে

দীপ্ত এর ছবি

কঠিন করে লেখা আমার পোষায় না (বা সৎভাবে বললে পারি না।)
পড়ার এবং কমেন্টের জন্য ধন্যবাদ।

আয়ন এর ছবি

অনুভূতি গুলো ভোতা হয়ে গিয়েছিল,গল্পটা পড়ে হঠাত এক শূন্য অনুভূতিহীন হৃদয়ে উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করলাম

দীপ্ত এর ছবি

আয়ন আপনাকে ধন্যবাদ, আনন্দ অনুভব করছি যে লেখাটা কিছুটা হলেও উষ্ণ অনুভুতি দিতে পেরেছে কাউকে।

সুলতান এর ছবি

অসাধারন...!!

দীপ্ত এর ছবি

ধন্যবাদ, প্রশংসা প্রেরণা দিলো।

সপ্তর্ষি এর ছবি

চলুক

দীপ্ত এর ছবি

ধন্যবাদ।

মেঘা এর ছবি

চমৎকার লাগলো গল্পটা। সত্যি মনের মিল হওয়াটা সহজ না। কারো কারো সাথে যত ঝগড়াই হোক না কেন তবুও চমৎকার বোঝা পড়া থাকে।

ভালো লাগলো লেখাটা। সচলে স্বাগতম।

দীপ্ত এর ছবি

লেখা ভালো লাগায় আনন্দিত অনুভব করছি। পড়ে কমেন্ট করায় ধন্যবাদ।

কিষান এর ছবি

"রাজনীতি-দর্শন-খেলাধুলা-মুভির জায়গা দখল করেছে গাড়ি-স্ট্যাটাস-বেতন-বোনাস এসব"

চিন্তাটা বড়ই ডিস্টার্বিং

দীপ্ত এর ছবি

কি আর করা? যেই বয়সে যেইটা নিয়ে কথা বলা নর্ম, ওইটাই বলতে হয়। (স্বেচ্ছায় বা আশেপাশের সবাই বলে দেখেই।)

কালো কাক এর ছবি

আমি জানতাম জানতাম শেষে এটাই হবে দেঁতো হাসি

দীপ্ত এর ছবি

হ্যাঁ, ভালবাসার গল্পে চমক দেয়াটা কঠিন, আর চমকটা না থাকলে ক্লিশে হয়ে যায়, কারণ ভালবাসা নিয়ে এত লেখা হয়েছে।
আপনি মনোযোগী পাঠক, বুঝলাম, আগেই ধরে ফেলেছেন।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

অন্যকেউ এর ছবি

সুন্দর গল্প। চলুক

_____________________________________________________________________

বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।

আশালতা এর ছবি

ভালো লাগলো। হাসি

----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি

তাপস শর্মা এর ছবি

খুব ভালো লাগলো ...... হাসি

frdayeen (দায়ীন) এর ছবি

ভালো লাগলো হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।