নীলচে-সবুজ জলের দেশে...

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ২৯/১১/২০১১ - ২:০২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

একটু পর ইনকোর্স পরীক্ষা। সারা মাস লবডঙ্কা করে বেড়ালেও পরীক্ষার খাতায় লবডঙ্কা পাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিলোনা দেঁতো হাসি । তাই স্যারের লেকচারটুকু শেষ সম্বল করে ভিষন সিরিয়াসভাবে পায়চারী করছিলাম। হঠাৎই পকেটে মোবাইল ফোনটা কেঁপে উঠল। বের করে দেখি আমার স্কুল এর বন্ধুর ফোন এসেছে।

কিছুটা বিষ্ময় নিয়ে ফোনটা রিসিভ করলাম, কারন আজকাল ঈদ বা কোন বিশেষ কারন ছাড়া আসলে স্কুলের বন্ধুদের ফোন করা হয়না। কুশল জিজ্ঞাস করার জন্যতো ফেসবুক রয়েছেই। ফোন রিসিভ করতেই অত্যন্ত পরিচিত একটি কণ্ঠ ভেসে এলো- "দোস্ত, কয়েকদিনের ছুটি পেয়ে গেলাম। কোথাও যাবি?"

ওর একথা শুনে কিছুক্ষনের জন্য পরীক্ষার টেনশন ভুলে গেলাম। বললাম,"ঢাকার বাইরে অনেক দিন যাওয়া হয়না, অবশ্যই যাবো। "

বেশ খানিক্ষন আলোচনা করে ঠিক করলাম একটা ছোট-খাট সিলেট-ট্যুর দেয়া যেতে পারে। সিলেটে সারিঘাট নামক জায়গায় 'লালাখাল' নামে নাকি চমৎকার একটি জায়গা আছে, যেটা নাকি সিলেটের জাফলং বা তামাবিলের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।

পরীক্ষা শেষ করে ছুটে গেলাম বাস স্ট্যান্ডে- কবে, কোথায়, কখন, কোন বাস সিলেট যাবে সেটার কুষ্ঠি-ঠিকুজি নিয়ে মোটামুটি ট্যুরের প্ল্যান ঠিক করে ফেললাম।

সিলেট নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। বাস থেকে কদমতলীতে নেমে রিকশা নিয়ে কিছুটা আসতেই চোখে পড়লো সেই উল্টো 'U' আকৃতির মত বাঁকা কীন ব্রিজ, আর ব্রিজের উল্টা পাশে 'আলী আমজাদের ঘড়িঘর' ।

রিকশা করে দরগা গেটে নেমে মাথা গোঁজার জন্য হোটেল খুজতে শুরু করে দিলাম। কম বাজেটের মধ্যে মোটামুটি একটা হোটেল দেখে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। রিসিপশনে গিয়ে যখন কাউকে না পেয়ে ইতি-উতি খুঁজছিলাম , তখনই এক খোঁচা দাড়িওয়ালা লোক রিসিপশনের ভিতরের এক রুম থেকে গলা বের করে হুঙ্কার দিয়ে বললো- "কি চাই??"

বাজখাই গলার ধমক শুনে কোন মতে বললাম, -"ইয়ে, মানে হোটেল খুজছিলাম, রুম দেখানো যাবে?"
রিসিপশনের ভদ্রলোক বেশ খানিক্ষন সন্দেহ নিয়ে কুতকুতে চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন-"সম্পর্ক?" (খাইসে!! ব্যাটা আমাদেরকে 'Homo' টাইপ কিছু মনে করলো নাতো!!! ইয়ে, মানে...) মুখে বললাম-" হে হে , বন্ধু, বন্ধু, আমরা দুইজন বন্ধু।!! দেঁতো হাসি উনি এবার পিচ্চিকে ডেকে চাবি ধরিয়ে দিয়ে বল্লেন, রুম দেখিয়ে নিয়ে আয়।"

রুমখানার হাল বেশ দশাসই বলা ভুল হবে। বিছানায় কোন আদ্দিকালের চাদর দেয়া, বালিশের কভারে কালচে দাগ (পরে দেখেছিলাম একটা বালিশ ফাটাও আছে)! যাই হোক, বাজেট কম। কোন মতে রাতটুকু পার করে দিতে পারলেই হবে, তাই ভেবে চিন্তে রাজি হয়ে গেলাম।

রিসিপশনের ভদ্রলোক এবার বিশাল একখাতা বের করে দিয়ে হুঙ্কার বললেন এটা পূরন করতে হবে! ইয়ে, মানে... বিশাল খাতার ১০-১২ টা ঘরের তথ্য পূরন করা পর, এবার একটা ফর্ম বের করে দিয়ে বললেন-"এটাও পূরন করতে হবে।" ফর্ম পূরন করার পর ডেস্কের নিচ থেকে একটা ডিজিটাল ক্যামেরা বের করে কুটুস করে আমাদের দুইজনের ফটো তুলে নিয়ে বললেন- "রেকর্ড রাখালাম, বড় খাতাটা পুলিশের জন্য, ফর্মটা র‍্যাবের জন্য, ফটোটাও রেখে দিলাম। তিনমাস এই রেকর্ড থাকবে। ইয়ে, মানে... " এই বলে সে বিশাল এক হাসি দিয়ে চাবিটা আমাদের হাতে ধরিয়ে দিলেন।

পরদিন সকালে উঠে নাস্তা সেরে ছুটলাম সারিঘাটের দিকে। জাফলংগামী বাসে করেই সারিঘাটে নামা যায়। বাস থেকে নেমে উল্টা পাশেই হলো লালাখাল। খালটি দেখে আমাদের মুখ থেকে শুধু একটি কথাই বের হলো-"অসাধারন!" অ্যাঁ

একটু নিচে নেমে ইঞ্জিনওয়ালা নৌকা ভাড়া করলাম। এটি আমাদেরকে একদম বাংলাদেশ-ভারতের সীমানায় জিরো-পয়েন্টে নিয়ে যাবে আবার আসবে। ঠিক করলাম ১২-১২:৩০ এর মধ্যেই ফেরত এসে আবার জাফলং এর দিকে যাত্রা করবো।

উঠে পড়লাম নৌকায়, শুরু হলো 'লালাখাল' যাত্রা। বাংলাদেশ এতো সুন্দর হতে পারে না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না। পুরো নৌ-যাত্রায় মাথার উপর ছিলো ঘন নীল আকাশ আর পানি ছিলো নীলচে সবুজ।

বিশ্বাস করুন একটি ছবিও ফটোশপের গুঁতায় পরিবর্তন করা হয়নি (খালি নেম-ট্যাগ লাগাইসি দেঁতো হাসি )। আর নিচের পানি এতটাই পরিস্কার যে জলের তলা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিলাম আমরা। কিছুদূর গিয়ে আকাশের উপর চিল উড়তে দেখলাম। উড়তে উড়তে হঠাৎ করেই ডানা গুটিয়ে পানিতে থাবা দিয়ে মাছা শিকার করে আবার উপরে চলে যাচ্ছিল । অ্যাঁ

বাংলাদেশের প্রায় শেষ সীমানায় একপাশে রয়েছে চা-বাগান, আরেক পাশে বি.জি.বি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) এর ক্যাম্প। নৌকা নিয়ে দুই পাশেই উকি-ঝুকি মেরে, ঘুরে-টুরে দেখে আবার ফেরত আসা শুরু করলাম।

পাড়ে নেমে একটু আগাতেই দেখলাম জাফলংগামী একটা বাস দাড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে বাসে উঠে ঝুলতে ঝুলতে জাফলং গিয়ে পৌছালাম। জাফলং এ নেমেই পেয়ে গেলো প্রচন্ড খিদে। একটা হোটেলে ঢুকে খেয়ে নিয়ে, জাফলং এ একটু ঘুরাঘুরি করে একটা বাসে করে ফিরে আসলাম সিলেট শহরে। জাফলং এর একটা ছবি না দেখালে কেমন হয়? তাই ওখানকার একটা ছবিও শেয়ার করি-

সারিঘাটে থেকে ঘুরে এসে আমার শুধু একটি কথাই বারবার মনে হচ্ছে , শুধু সুন্দরবন বা কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতই নয়, সপ্তাশ্চর্যের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করার জন্য এখনও অনেক অপরূপ স্থান এই বাংলায় লুকিয়ে রয়েছে। সব জায়গার খোঁজ আমরা হয়তো জানিওনা।

মৌসুমি ভৌমিকের 'সপ্ন দেখবো বলে' গানের কথার মতো, আমার বলতে ইচ্ছে করছে-' আমি নীল-জল দিগন্ত ছুয়ে এসেছি।' হাসি

দায়ীন (frdayeen)
-----------------------------
আমার অন্য লেখাগুলিঃ
সময়কালের ক্যাঁচক্যাঁচানি (!)
একটি বজ্জাত নিউট্রিনো এবং...
আজব সব জীবগুলি-৪
আজব সব জীবগুলি-৩
আজব সব জীবগুলি-২
আজব সব জীবগুলি-১


মন্তব্য

তাপস শর্মা  এর ছবি

চমৎকার। তবে ছবিগুলো ছোট করে দিলে আরও সুন্দর লাগে। আর তাছাড়া পেইজ লোড হতেও অনেক সময় নেয় হাসিচলুক

দায়ীন (frdayeen) এর ছবি

সেটাই। যেগুলি flickr থেকে পোস্টে দিয়েছি সেগুলো অটোমেটিক ছোট হয়ে গেছে। আর অন্যগুলির ক্ষেত্রে খেয়াল করা হয়নি। মন খারাপ

আকাশ এর ছবি

আসলেই দূর্দান্ত একটা জায়গা। তবে এটি কোন খাল নয়, নদী। সারি নদী। আর লালাখাল হলো সারি নদীর পাড়ে ভারত সীমান্তে বাংলাদেশের এলাকাটার নাম। মানে চা বাগান যে এলাকাটায় আছে সেটি।

দায়ীন (frdayeen) এর ছবি

ওহ! ধন্যবাদ! হাসি

তিথীডোর এর ছবি

শেষ ছবিটায় চলুক

ঠিক করে রেখেছি, ব্যাগপ্যাক ঝুলিয়ে বাড়ি থেকে দুদিনের কড়ারে পালাবো আর ঘুরে ঘুরে খালি ছবি তুলব।
ছাতার এই জেবন আর ভাল্লাগে না! মন খারাপ

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

দায়ীন (frdayeen) এর ছবি

বেড়িয়ে পড়ুন। মাঝে মাঝে গারদ ভেঙে উড়ে বেড়াতে ভালো লাগে বৈকি! হাসি

বিবর্ন সময় এর ছবি

অসাধারণ!!
সেই কবে সিলেট গিয়েছি, স্মৃতিগুলো বোধ হয় ঝাপসা হয়ে আসছে! তারপরো আমার নিজের সিলেট জাফ্লং মাধবকুন্ড ট্যুর নিয়ে অনেক কিছুই মনে পড়ে গেল আপনার লেখা পড়ে।

দূরদেশ থেকে ইদানিং বড্ড মিস করি দেশকে, মিস করি সেই দিনগুলো, সেই মানুষগুলো...আপনার লেখা পড়ে কেন জানি স্মৃতিকাতরতা বেড়ে গেলো হঠাত করে!
ভালো থাকবেন।

-
বিবর্ন সময়

দায়ীন (frdayeen) এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ। হাসি

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

জায়গাটার নাম জানা ছিলনা। জাফলং, তামাবিল কয়েকবার গিয়েছি।, ভিন্ন ভিন্ন দলের সাথে।
ধন্যবাদ, নতুন একটা জায়গা চেনাবার জন্য। ছবিগুলোও খুব সুন্দর ।

দায়ীন (frdayeen) এর ছবি

এখানেও সময় পেলে ঘুরে আসুন। চমৎকার জায়গা।

রিয়েল ডেমোন এর ছবি

ভীষণ রকমের সুন্দর।

দায়ীন (frdayeen) এর ছবি

ধন্যবাদ। হাসি

তারেক অণু এর ছবি

আমি নীল-জল দিগন্ত ছুয়ে এসেছি। চলুক

দায়ীন (frdayeen) এর ছবি

হাসি

হিমু এর ছবি

আপনি এ দেখেই মুগ্ধ?

সুনামগঞ্জ থেকে নৌকা ভাড়া করে টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে ঘুরে আসুন। মনে হবে অন্য পৃথিবীতে চলে গেছেন।

দায়ীন (frdayeen) এর ছবি

চমৎকার আরেকটা জায়গার খোঁজ পেলাম। সময় পেলে অবশ্যই ঘুরে আসতে চাই। কিভাবে যাওয়া যায়? সুনামগঞ্জে নেমে বাসে করে? নাকি ঘোরপ্যাচ আছে??

মুশফিক এর ছবি

আমার মনে হয় তোদের গে ই ভাবসিলো খাইছে
সুন্দর হইসে লেখাটা !

দায়ীন (frdayeen) এর ছবি

বজ্জাত মুশ। রেগে টং
এইনে তোর জন্য ইটা রাইখ্যা গেলাম... রাইক্কা গ্যালাম। খাইছে আর ধনে পাতা আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

উচ্ছলা এর ছবি
দায়ীন (frdayeen) এর ছবি

আসলেই অনেক সুন্দর। হাসি

রু (অতিথি) এর ছবি

খুবই সুন্দর।

দায়ীন (frdayeen) এর ছবি

হাসি

দ্রোহী এর ছবি

দুইবার গেছি। হাসি

দায়ীন (frdayeen) এর ছবি

বেশ বেশ দেঁতো হাসি

ফাহিম হাসান এর ছবি

চমৎকার সব ছবি।

দায়ীন (frdayeen) এর ছবি

আপনাকে আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- দেঁতো হাসি

তৃষা এর ছবি

বাংলাদেশ যেভাবে ঘুরে দেখতে চেয়েছি, কখনও পারিনি। বগালেক, নীলগিরি...
চলুক

সিরাজুল লিটন এর ছবি

অসাধারণ!

[সিরাজুল লিটন]

বিড়ি এর ছবি

আমি ও যাব।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।