অনেক অনেক কাল আগের কথা! আরে না না, এই মাত্র সেদিনের কথা, আলভোলা হয়ে মগড়া নদীর তীরে পৌছানোর কথা, পৌছুনোর পথে পথে অবাক হয়ে মৌজায় লেগে থাকা চোর কাটা ছাড়ানোর কথা, কোয়ার্টারের সামনে পেছনে কলাপাতা দিয়ে ছাউনির কথা, আশে পাশে বন্য কবুতরের গম্ভীর সুরে বাকবাকুম ডাক শোনার কথা, সন্ধায় হঠাৎ করে চারপাশ ধেয়ে আসা অন্ধকারের কথা, কোয়ার্টারের অদূরে বসবাস করা জেলে (জাউল্যা) সম্প্রদায়ের কথা, সন্ধায় বিশাল ঘোমটা টানা জেলে বধুদের উলু ধ্বনি দেয়ার কথা, শনিবার ও বুধবারের হাট বসার কথা, হাটের মাঝে ঝাকড়া চুলের মলম বিক্রেতার পাশে চুপচাপ তন্ময় হয়ে বসে থাকা, তার ঢোলের বাড়ির শব্দের কথা, সন্ধায় হাট ভাঙ্গার কথা, নৌকা নিয়ে হাট বিক্রেতার বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা, বিশাল ধানী নোকার ডাক ছেড়ে আশুগঞ্জের উদ্যেশ্যে ছেড়ে যাওয়ার কথা, বড়শির ছিপ দিয়ে ঘাঘট মাছ শিকারের দৃশ্য দেখা, নদীর তীরে দাড়িয়ে দূর এক গ্রামের পাশে লাল সূর্যটার ডুবে যাওয়ার কথা, দাদন দেয়া লোকটির হাঁক দেয়ার কথা, আজানের সাথে সাথে ঘরে ফিরে এসে পড়তে বসার কথা সাথে পরবর্তী দিনের ইংরেজি ক্লাসের বাবু নিশিকান্ত ভৌমিকের কাঁচা বাঁশকঞ্চির বাড়ি খাওয়ার ভয়ের কথা, আরো অনেক, অনেক কথা........
ইংরেজি স্যার “বাবু নিশিকান্ত ভৌমিক” ছিলেন “তিয়শ্রী এন এইচ খান একাডেমী, মদন, নেত্রকোনা” এর সবচেয়ে কঠিন শিক্ষক। স্বভাবী ছিলেন চারটি বেত একসাথে করে বেদম প্রহার করায়। কারো নিস্তার নেই। তখনো ক্লাস এইটে। ক্লাসের সবচেয়ে দুরন্ত চারজন আব্দুল করিম, আল মামুন, মিজানুর রহমান ও লুৎফুল হাসান শামীমের সাথে হাড় কিপ্টে ইকবাল সহ আমরা মেরুদন্ডহীন আরো কয়েকজন। শীত ইতিমধ্যে হানা দিয়েছে। বিকেলে চলে স্কুল মাঠ জুড়ে ভলিবল, ব্যাডমিন্টন খেলার আয়োজন। সদ্য যুবক হয়ে ওঠা যুবকদের পথে হাল জুড়ে দেয়ার কথা আমাদের মনের মাঝে তখনো জোড়েসোরে উকিঝুকি দিচ্ছিলনা। তবে আমাদের সবার ইচ্ছা হল ভলিবলে বিশাল সার্ভ করে সবাইকে ভাব দেখানোর, সাথে ক্লাস টেনকে ভলিবল খেলায় হারানোর। এতে সবচেয়ে বড় বাঁধা ছিল ক্লাস টেন। ক্লাস এইটের ছেলেরা ওল্ড টেন ও নিউ টেনের স্টুডেন্টদের ভীড়ে কোন রকমেই পাত্তা পাচ্ছিলনা, বল ছোঁয়াতো অনেক দূরের কথা! আচমকা আলমামুন রেগে গিয়ে একদিন ক্লাসে ঘোষনা দিল
“ওরা আমরারে খেলায় নেয়না, খালি পাট মারে। তোরা সবাই আয় আমরা নতুন একটা ভলিবল কোর্ট বানামু, আমাগোরটা আমরাই বানামু। ওগোরে আর জিগামুনা। স্যারেরা ভলিবল কিন্যা না দিলে নিজেরা চান্দা তুলুমু, মদন থিক্যা গিয়া ভলিবল কিন্যা আনুম, কারো ধার ধারিনা”
ব্যাপক হাততালি উঠল আবার সাথে সাথেই হাততালি মিলিয়ে গেল কারন স্কুল ঘর থেকে সোজা স্যারদের রুম দেখা যায়। সবাই আবার দোষ ঘাড়ে পড়ার ভয়ে শন্কিত, কিছু যদি হয়, কিছু যদি হয় এমন অবস্থা। এদিন আর বেশী দূর যাওয়ার শক্তি কারোই ছিলনা। সহসাই যেন সবাই অবসন্ন হয়ে পড়ল। ভেতরে ভেতরে সবাই উত্তেজনায় টগবগ টগবগ করছিল কিছু একটি করে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। আলমামুনের হুন্কার
“সবাই একসাথে থাকমু, যেইডা যাইবোনা হেইডারে পরে বোঝামু, একসাথে ওগুলিরে বানামু আর মাথার মধ্যে ঠাউল্যা দিমু”
আলমামুনের বাড়ি স্কুলপাশের একটি নামকরা গ্রামে। যদিও অনেক বয়স ছিল তবুও সে আমাদের সাথে একই ক্লাসে পড়তো। এক্কেবারে পেছনের বেঞ্চিতে বসতো। গলায় একটি মাফলার ঝুলতো, মাফলার এর পার গিয়ে পড়তো একদম হাটুর নীচ পর্যন্ত, মাফলার দিয়ে মুখের কিয়দংশ ঢাকা থাকতো। কলম দিয়ে অযথাই কাগজে আঁকাআঁকি করতো, সামনের বেঞ্চিতে বসা ছেলেটিকে অকারনে “বিটলা” বলতো। আর ক্লাসের কোন মেয়েটি সবচেয়ে বেশী সুন্দর সেটা বসে বসে ভাবতো। স্যার ক্লাসে পড়া জিজ্ঞাস করলে মুখ বন্ধ করে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকতো। আর সুখের কথা নিশি কান্ত ভৌমিক স্যারের চার কঞ্চির বাড়ি সে নিয়মিত হজম করতো। ক্লাস শেষে বাড়ি খাওয়ার জায়গাটি পরখ করতো কাল হয়ে গেল কিনা?
ঘটনাটা ঘটলো পরের দিন। ক্লাস কয়েকটি হওয়ার পর টিফিন পিরিয়ডের দিকে ভলিবল কোর্ট বানানোর জন্য কয়েকজন মাঠে নেমে গেল। আমরা সবাই সাথে সাথে গেলাম সিদ্ধান্ত নেয়ার উত্তেজনায় বা আগ বাড়ানোদের নিকট দোষী প্রমানিত না হওয়ার জন্য। যথারীতি চারজন কোদাল নিয়ে নেমে গেল আর আমরা সব সুতা নিয়ে এদিক সেদিক দাগ সোজা করার ব্যার্থ চেষ্টায় রত হলাম। পুরোটা শেষ করা গেলনা কারন টিফিন পিরিয়ডের ঘন্টা পড়ে গেল। সেদিনের মতো উত্তেজনা শেষ হল। (চলবে)
*****
১৮ই অগ্রহায়ন,১৪১৮
মতিঝিল, ঢাকা।
মন্তব্য
এই যাহ্, এত সুন্দর করে লিখলেন কিন্তু নামটাই যে লিখতে ভুলে গেলেন। এখন তো এটা আমার লেখা বলে বেশ চালিয়ে দেয়া যাবে !
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
ক্যাটেগরি দেখে মনে হচ্ছে লেখকের নাম আশরাফুল কবির
হুম, ক্যাটাগরি খেয়াল করিনি। আমি আসলে সর্বগ্রাসী পাঠক, সামনে যা পাই, বুঝি আর না বুঝি, তাইই হামলে পড়ে খেয়ে ফেলি। এজন্যে বোধহয় প্রথমটায় চোখে পড়েনি।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে.....ভাল থাকুন সবসময়, এ সুন্দর কামনায়...
প্রিয় ভাইয়া,
জ্বি, আমার নাম আশরাফুল কবীর....ভাল থাকুন।
প্রিয় লতা আপু,
অনেক অনেক ধন্যবাদ, আমার লেখায় এত্তো সুন্দর মন্তব্য দেয়ার জন্য। ভাল থাকুন সবসময়, এ কামনায়...
ভালো লেগেছে। নিজের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোতে হারিয়ে গেলাম।
অসংখ্য ভাললাগা বোধ করলাম। ভাল থাকুন আপনি....
দারুণ আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। তাড়াতাড়ি পরের অংশটুকু পোস্ট করুন।
প্রিয় তৌফিক ভাইয়া,
ভাইয়া চেষ্টা থাকবে খুব ভালভাবে স্মৃতি চারন করার। ভাল থাকুন, এ প্রত্যাশায়...
ভালো লাগলো, চলুক
ধন্যবাদ ভাইয়া, সঙ্গে থাকবেন, আশা রাখছি..ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন