আমাদের কোয়ার্টারটি ছিল তিয়শ্রী গ্রামের একেবারে শুরুতে, পাশে ছিল একটি হাসপাতাল। হাসপাতালের সামনে দিয়ে বয়ে চলা ছোট ধলাই নদী। প্রকৃতপক্ষে বিশাল কোন নদী নয়, পাশাপাশি দুই অথবা তিনটি খালের সমান চওড়া, যা বয়ে গিয়ে কয়েক কিলোমিটার দূরের মগড়া নদীতে পড়েছে। তখনো মগড়া নদীর আসল রহস্য দেখা হয়নি, শুধু আব্বার মুখে শুনতাম হেঁটে মদন যাওয়ার সময় মগড়া নদী পার হতে হয়। পুলক জাগত মনে। নদীর ওপারে আবার বিশাল হাওড় আর হাওড়ের পাশে পাশে গ্রাম। দূর থেকে গ্রামগুলোকে ঝাপশা দেখাত। স্কুল মাঠে দাড়ালে এক নি:শ্বাসে সব দেখা যেত।
একটি দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল হাসপাতালের ভবনগুলো। শুধু নামেই হাসপাতাল কারন ওখানে কোন ডাক্তার ছিলনা। কালো গেট দুটো সবসময় তালা দেয়া থাকতো। দুইটি লম্বা বিল্ডিং পাশাপাশি ছিল, ভেতরটায় ছিল কয়েকটি নারিকেল গাছ, একটি বড় আকারের দেশী পেয়ারা গাছ আর লম্বা লম্বা নাম না জানা ঘাস, আগাছায় ভর্তি। সবসময় নারিকেল গাছগুলোর দিকে তাকাতাম। কয়েকটি নারিকেল সবসময় শুকনো হয়ে থাকত। করিম মাঝে মাঝে হাসপাতালের দেয়াল ডিঙ্গিয়ে ছাদে ওঠে লম্বা বাঁশের খোটা দিয়ে নারিকেলে পাড়ার ব্যার্থ চেষ্টা করতো। আমি ওর পেছন পেছন থাকতাম ভাবতাম, ইস! যদি কোনভাবে পাড়া যেত। আমাদের আশা পূরন হতোনা।
আমার আকর্ষন ছিল পাতাবাহারের গাছগুলোর উপর। খুঁজতাম ছোট দুয়েকটি গাছ, তুলে এনে আমাদের কোয়ার্টারের সামনে আমার তৈরী করা ছোট বাগানটিতে লাগিয়ে দেয়া যায় কিনা? হাসপাতালের বাইরে থেকেও রুমের ভিতরের ভ্যাপসা ভাব ও ভাঙ্গাচোড়া টেবিল চেয়ারের অবস্থাটি দেখা যেত, আর বোঝা যেত টিকটিকিদের রাজত্ব। একটা বুনো গন্ধ বেরুত সবসময়।
সপ্তাহে একদিন মদন থেকে একজন ডাক্তার হাসপাতালের একটি রুমে এসে কিছুক্ষন বসতো। রোগীরা অনেক দূর দূর গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে আসতো। আব্বার সাথে পরিচয়ের সুবাধে ডাক্তার আমাকে দেখলেই বলতেন:
“কেমন আছ, বাবা? তোমার আব্বা আম্মা বালা আছে? এ্যহেনে তোমরা আর কতোদিন আছো?” অচেনা কোন লোক আমাদের দেখিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলতেন:
“এরারে চিনইননা? নায়েবসাবের আবুদুবাইন (পোলাপাইন)”তহশীলদার হওয়ার সুবাদে এলাকার সবাই আব্বাকে নায়েবসাব বলে চিনতো।
আমি হাসপাতালে যেতাম অন্য কারনে। ওখানে গেলেই দুই তিন প্যাকেট ফ্রি স্যালাইন পেতাম। স্যালাইনের প্যাকেটে ছিল দুই ভাগ। উপরের ছোট অংশে কিছুটা চিনি দেয়া থাকতো, পেছনের অংশটায় লবনাক্ত অংশ। চিনির অংশটুকু খেয়েই একঝটকায় প্যকেটটা ফেলে দিতাম। আমার পেছন পেছন করিম ও যেতো চিনি খাওয়ার লোভে, কিন্তু কেন যেন ও স্যালাইনের প্যাকেট পেতনা। ডাক্তার একবার ওর দিকে তাকাতো আর প্যাকেটগুলো আমার হাতে দিত। আমরা দুজনে মিলে ভাগাভাগি করতাম। ডাক্তার লম্বা প্লাস্টিকের মুখ আঁটা প্যাকেটে সবাইকে কয়েকটি প্যারাসিটামল ট্যাবলেট দিয়ে বিদায় করতেন। কেউ অন্য ঔষধ চাইলে বলতেন “এখন নাইগা, পরে আইন্যা দিমুনে” বলা বাহুল্য যে ততোদিনে আমরা তিয়শ্রী গ্রামে বছর তিনেক পার করে ফেলেছি।
ক্লাস টেনের ছেলেরা বুঝে গেল আমাদের কার্যক্রম। আমাদের ক্লাস চলাকালীন সময়ে বেশ কয়েকবার উঁকিঝুকি দিল। এটা দেখে ক্লাসের সবার মনে আবারো উত্তেজনা ছড়াল। যথারীতি ব্রেকের সময় আসলো ততক্ষন পর্যন্ত আমরা সবাই এক। সমস্যা দেখা দিল ভলিবল কোর্টের পিলার তৈরী নিয়ে কারন আমাদের পিলার বানানোর মত তেমন কিছুই নেই। আমরা খুব হতাশ হলাম। আলমামুনের নের্তৃত্ব তখন দফারফা। হঠাৎ মিজানুর রহমান যে সবার কাছে সোহাগ নামে পরিচিত ছিল সে চিৎকার দিল:
“ওই, ধন্না আছেনা! ধন্না নামাইয়ালা” এতক্ষনে আলমামুন বাহিনী যেন আচমকা জেগে উঠল। করিমের উৎসাহ ছিল দেখার মতো। আলমামুন তাড়াতাড়ি আবারো চিৎকার দিল:
“ওই তোরা তাড়াতাড়ি কর, টিফিন পিরিয়ড শেষ হইয়া যাইবোগা। টান দে, টান দে, সবতে একলগে জোড়ে টান দে। টিফিন পিরিয়ডেই কাম শেষ করন লাগবো” ঘোষনাটি ম্যাজিকের মত কাজ করল।
আমাদের মূল স্কুল ভবনটি ছিল একটি একতলা ভবন। তবে সেখানে আমাদের কোন ক্লাস হতোনা। প্রধান শিক্ষকের রুম, মাঝখানে ছিল টিচার্স কমন রুম আর একদম পাশের রুমটি সবসময় আটকানো থাকত। দুয়েকটি বইয়ের আলমাড়ি, টেবিলের উপর ছড়ানো কয়েকটি প্লাষ্টিকের বয়াম, কিছু বড় বড় কাঠের স্কেল, কম্পাস ছড়ানো অবস্থায় থাকতো। এত বড় বড় কম্পাস দেখে তখন আমাদের সবার মনে একই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতো। সবাই ভাবতাম “এতো বড় বড় কম্পাস দিয়ে কারা পড়াশোনা করে?” আমাদের ক্লাস হতো আলাদা একটি টিনশেড বিল্ডিংয়ে। মোট ছয়টি রুম ছিল। উপরে টিনের চাল তার নিচে আড়াআড়ি লম্বা বাঁশের ধন্নার উপর কাইত্যা (বাঁশের তৈরী মোটা পাটি) দেয়া থাকতো।
আমরা সবাই খুব উল্লাসে টেনে দুইটা ধন্না নামিয়ে ফেললাম। করিম আর আলমামুনের সাথে সবাই মাঠে আমাদের নির্ধারিত কোর্টে চলে গেলাম। অন্যান্য ক্লাস থেকেও কয়েকজন উৎসাহে আমাদের সাথে যোগ দিল। কথাবার্তাগুলো এরকম যে “আমরারেও কিন্তু খেলতে দেওন লাগবো” পিলার বসানো শেষ করেই চটপট সবাই ক্লাসে এসে বসে গেলাম। আমাদের সবার বুক ঢিবঢিব করছিলো যে স্যারেরা যদি একবার জানতে পারে আমরা স্কুলঘরের ধন্না নামিয়ে পিলার গেড়েছি তাহলেই হয়েছে। আমাদের সবার আশংকা একসাথে সত্যি প্রমানিত হল। ইতিমধ্যে ক্লাস টেনের একজন গিয়ে আমাদের ধন্না নামানোর কথা হেডমাষ্টারকে বলে এসেছে। আমাদের পিটি স্যার যিনি “জিতু মাস্টার” নামে পরিচিত ছিলেন তিনি হাজির হলেন এবং ক্লাসের ধন্নার অবস্থা পর্যবেক্ষন করে টিচার্স রুমে গিয়ে ঘটনাটা বললেন। ইতিমধ্যে স্কুলের পিয়ন আজরুদ্দি ভাই এসে বলেলন যে নিশিকান্ত স্যার ষাটটি কাঁচা বাঁশকঞ্চি কেটে রাখতে বলেছেন। আগামী কাল ক্লাসে একসাথে সবার বিচার হবে। (চলবে)
*****
২২শে অগ্রহায়ন,১৪১৮
মতিঝিল, ঢাকা।
স্মৃতিচারন লিংক:ঝোলায় রাখা কথামালা-১
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/42282
কবিতা লিংক:কাঠবিড়ালীর আমন্ত্রন!
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/41956
মন্তব্য
নিয়মিত ঝোলা ঝরতে থাকেন

ভাইয়া আপনি পাশে থাকলেই হবে.....অনেক অনেক ধন্যবাদ, ভাল থাকুন সবসময়, এ কামনায়
নতুন মন্তব্য করুন