বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়টি হল 'বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি।'এ নিয়ে চলতি বছরেই তৃতীয় বারের মতো পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। প্রথম ধাপে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ২ টাকা ৮০ পয়সা থেকে ১৬.৭৯ শতাংশ বাড়িয়ে ৩ টাকা ২৭ পয়সা এবং দ্বিতীয় ধাপে ৩ টাকা ২৭ পয়সা থেকে ১৪.৩৭ শতাংশ বাড়িয়ে ৩ টাকা ৭৪ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রথম ধাপে ১ ডিসেম্বর এবং দ্বিতীয় ধাপে আগামী পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে বর্ধিতমূল্য কার্যকর হবে। এছাড়া খুচরা দাম বাড়ানোরও একটা প্রক্রিয়া চলছে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতেই বিদ্যুতের দাম কিছুটা বাড়াতে হয়েছে। বিশ্বব্যাপী প্রতিটি জিনিসের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা তো বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন নই। বিদ্যুত উৎপাদন করে জনগণের চাহিদা পূরণ করতে গেলে ব্যয় তো কিছুটা বাড়বেই। সব পর্যায়ে আলোচনা করে সহনশীল পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে , দাম বাড়লেও বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হলে বিল কম আসবে। যতটুকু দরকার ততটুকু বিদ্যুত ব্যবহারের জন্য তিনি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।
কিছুদিন পূর্বেই দেশে জ্বলানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। সরকার রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্লান্ট নবায়ন ও মেরামতের সহজ কাজ না করে উচ্চ দামে বিদ্যুৎ ক্রয়ের জন্য রেন্টাল, কুইক রেন্টাল ও পিকিং বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপন করেছে। এর ফলে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ছেই। ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কুইক রেন্টাল প্লান্টগুলো চালু করার পূর্বে জ্বালানি তেলের চাহিদা ছিল ৩৮ লাখ টন। কিন্তু বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮ লাখ টনে। তরল জ্বালানিভিত্তিক ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে বিপিসিকে বিদেশ থেকে উচ্চহারে সুদ দিয়ে যে তেল আমদানি করতে হচ্ছে তার জন্য লোকসানের পরিমাণ প্রতিনিয়তই বাড়ছে। সুতরাং এই ব্যবস্থা আমাদের জন্য উপকারী কি? অবশ্যই না। কেননা পিডিবির ব্যবস্থাপনায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যয় হত মাত্র ২ টাকা। সেখানে রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টে লাগছে ৮ টাকা এবং ডিজেল ব্যবহারে ১৪ টাকা। ফলে সরকারকে বিদ্যুতের দাম বাড়াতেই হচ্ছে। মোটকথা সরকারের যে টাকা ঋণ হচ্ছে তা জণগণের কাছে থেকে যেকোনো মূল্যে আদায় করতে হবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী, ২০১১ সালের মধ্যে ৫০০০ মেগাওয়াট,২০১৩ সালের মধ্যে ৭০০০ মেগাওয়াট এবং ২০২১ সালের মধ্যে ২০০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার কথা ছিল। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী বলেন,"বর্তমান সরকার যদি মাত্র দুই বছর ১০ মাসে আড়াই হাজার বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে, তবে বিএনপি-জামায়াত জোট পাঁচ বছরে এবং অসীম ক্ষমতাধর তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছরে এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারেনি কেন, তার জবাব দেশের মানুষকে দিতে হবে।"
কিন্তু দুই বছর ১০ মাসে আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেও বিদ্যুৎ চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে এখনো ঘাটতি থাকছে প্রায় দু'হাজার মেগাওয়াট। সুতরাং সরকার এক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছে। তাই সার্বিকভাবে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি অর্থনীতির হিশেবে অযৌক্তিক এবং তা জনগণের জন্য নেতিবাচক। তবে এক্ষেত্রে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। তা হল- সরকারের এই তেল বা বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির পিছনে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ভূমিকা সর্বাধিক। কেননা আইএফএফ থেকে সরকারকে বাজেট সহায়তার লক্ষে ১ কোটি ডলার ঋণ প্রদানের ৯ টি শর্তের মধ্যে তেলের মূল্য ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি একটি অন্যতম প্রধান শর্ত। কেননা এর মাধ্যমে ভর্তুকি তুলে নেওয়াটা সহজ হবে।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব সাধারণ মানুষের কাছে ইতোমধ্যেই পৌঁছে গেছে। জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ফলে পরিবহনের ক্ষেত্রে প্রতি এক কিলোমিটারে মাত্র পাঁচ পয়সা করে ভাড়া বাড়ার কথা থাকলেও মূলত বৃদ্ধি পেয়েছে এক টাকা। আমাদের দেশের ৮৩% মানুষই নিম্নবিত্ত জীবনযাপন করে। সকারের কাছে এই ১ টাকার মূল্য না থাকলেও জনসাধারণের কাছে তার মূল্য রয়েছে। বর্তমানে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির ফলে দেশের জনগণের উপর যে প্রভাব পড়বে তা আরো সুদূর প্রসারী। শিল্প কারখানা কিংবা পরিবহনের ক্ষেত্রে যে প্রভাব পড়ে তা জনগণের মধ্যে দুর্ভোগ সৃষ্টি করে। কেননা বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করলে শিল্পোৎপাদন কমে যাবে। ফলে দৈনন্দিন সাধারণ জনগণের ভোগ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া আমরা বর্তমানে বহুলাংশেই বিদ্যুতের উপর নির্ভরশীল। সাধারণভাবে একটি নিম্নমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত বাড়িতে রাইস কুকার,কারি কুকার,ফ্রিজ,টেলিভিশন,ওভেন,কম্পিউটার,ফ্যান-লাইট ইত্যদি ছাড়াও অন্যান্য বৈদুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে প্রতি ইউনিট খুচরা বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৪ টাকা থেকে ৪ টাকা বিশ পয়সা এবং পাইকারী বিদ্যুতের দাম প্রথম দফায় প্রতি কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুতের দাম ২ টাকা ৩৭ পয়সা থেকে ১১ শতাংশ বাড়িয়ে ২ টাকা ৬৩ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। তাহলে দেখাই যাচ্ছে,সরকার যে মূল্যবৃদ্ধি করেছে তা জনগণের জন্য অসহনীয়। কারণ ঐ একই, বাংলাদেশের ৮৩% মানুষ গরিব। এবং এদের ৮০ ভাগই দিন আনে দিন খায়। ফলে বিদ্যুতের নূন্যতম চাহিদাও এরা ভোগ করতে পারবে না মূল্যবৃদ্ধির ফলে। এছাড়াও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে বাড়িভাড়া,যাতায়াত এবং মানুষের সঞ্চয়ের পরিমাণ করমে যাবে। এতে দেশে গরিবের হার বৃদ্ধিই পেতে থাকবে দিন দিন। যা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সুতরাং বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির জন্য সরকার কতোটা দায়ী বা দায়ী নয় তা জনগণ দেখবে না। আমাদের দেশে সরকারের হিশাব-নিকাশ দেখার মত মানুষের সংখ্যাও কম। তাই সরকারকে নীতিনৈতিকতার বিষয়টি মাথায় রেখে এবং জনগণের ক্ষমতা,আয়-ব্যয় ও স্বার্থের কথা চিন্তা করেই তেল কিংবা জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি করা উচিৎ ছিল। কেননা বর্তমান অর্থনীতিবিদদের কাছে এটি সরকারের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের মধ্যেই পড়েছে এবং তাদের মতে এটি জনগণের জন্য দুর্ভোগ বয়ে আনবে।
-mazhar.
মন্তব্য
আপনার বক্তব্যের সাথে একমত হতে পারছি না। কিছু কিছু জায়গা স্ববিরোধীও মনে হয়েছে।
নিম্নমধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত মানুষের বাড়িতে রাইস কুকার, কারি কুকার ইত্যাদি একটু কষ্টকল্পনা বলে মনে হয়। আর এই ধরণের বৈদ্যুতিক পন্য ব্যবহারের জন্য সরকারের কাছে ভর্তুকি চাওয়া কি যৌক্তিক?
সরকার যখন কুইক রেন্টাল থেকে বিদ্যুৎ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখন অনেকটা বাধ্য হয়েই নিয়েছিল। কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল বিদ্যুতের অভাবে। তখন দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের চেয়ে কুইক রেন্টালই বেশি ফলপ্রসূ ছিল। তবে এখনো সরকারী বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর উন্নতি না হওয়াটা হতাশাজনক।
এটা ঠিক সরকার সব জায়গায় নিয়ন্ত্রন ঠিক মত ধরে রাখতে পারছে না। তেলের দাম ১টাকা বাড়ালে বাসের ভাড়া ৫টাকা বাড়ে। কিন্তু তাই বলে ভর্তুকি দিয়ে যাওয়াটা কোন সমাধান নয়।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে তেলের দামের জন্য অথবা শহুরে বিলাসী পন্যের জন্য ভর্তুকি না দিয়ে সেই টাকাটা সেচের মৌসুমে কৃষকদের দেওয়াটাই বেশি যৌক্তিক।
বিল বাড়লে আমরা নিজে থেকেই মিতব্যায়ী হব। এখনো আমরা আলসেমী করে কম্পিউটার বন্ধ করি না, সিঁড়ি ঘরের বাতি ২৪ঘন্টা জ্বলে থাকে, এসি ছেড়ে লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমাই। এই জিনিস গুলো বন্ধ করলেই বিদ্যুতের খরচ অনেক কমে যাবে।
৮৩% গরিব মানুষ তো আর ইলেকট্রিফিকেশনের আওতায় আসেনি। যারা এসেছে, তাদের অনেকেই কাছা খুলে বিদ্যুৎ খরচ করে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো উচিত কয়েকটা স্তরে। মিতব্যয়ীদের জন্যে বিদ্যুতের মূল্য হবে সাশ্রয়ী, অমিতব্যয়ীদের জন্যে হবে খাঁড়ার ঘায়ের মতো। সরকার সেটা কখনোই করে না।
এ নিয়ে একটা লেখার লিঙ্ক দিচ্ছি, সময়ে পেলে পড়ে দেখবেন।
@ঘুম কুমার
অর্থনীতিতে নিম্ন মধ্যবিত্ত বলতে নিম্নধাপের চাকুরে,ছোঁট পুজির ব্যবসায়ী এবং যারা দক্ষতাকে শ্রম হিশেবে কাজে লাগিয়ে অর্থোপার্জন করে তাদেরকে বোঝায়। এরকম পরিবারে ব্যবহারের জন্য একটা রাইস কুকারের মূল্য বড়জোড় ২০০০ টাকা হবে। সুতরাং এটি অসম্ভব কল্পনা নয়। তবে নিম্নবিত্তদের জন্য হতে পারে।
কুইক রেন্টালকে বলা হয় যুদ্ধকালীন সমাধান। সরকার এই ৩ বছরে প্রায় সাত হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারত।
বাকিটুকু একমত।
সাত হাজার মেগাওয়াট ক্যাপাসিটি কোন জ্বালানিতে চলতো?
গ্যাস কিংবা কয়লা নির্ভর পাওয়ার প্লান্ট স্থাপন করা যেত। মনে রাখা প্রয়োজন;- নির্বাচনী ইশতেহারে-
২০১১ সালের মধ্যে ৫ মেগাওয়াট, ২০১৩ সালের মধ্যে ৭ মেগাওয়াট এবং ২০১২ সালের মধ্যে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার কথা ছিল।
গ্যাসনির্ভর পাওয়ার প্ল্যান্ট যেগুলো ইতিমধ্যে আছে, সেগুলোতেই তো ঠিকমতো গ্যাস দেয়া যায় না, নতুন গ্যাসনির্ভর প্ল্যান্ট কীভাবে করবে? আর কয়লা নির্ভর পাওয়ার প্ল্যান্ট বানালেও সাত হাজার মেগাওয়াট ক্যাপাসিটি করা সম্ভব না। বাংলাদেশের নিজের এত কয়লা নেই, আর বিদেশ থেকে কয়লা আমদানির জন্যে চুক্তি আর অবকাঠামোও নেই। সরকারের কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগও নেই এই ব্যাপারে।
ক্যাপাসিটি বাড়াতে গেলে এখন সরকারকে তেলনির্ভর প্রযুক্তিতে যেতে হবে। সেটা করলে এনার্জি মিক্সের চেহারা পাল্টাবে, বিদ্যুতের দামও বাড়বে। সরকার নিজে তেলনির্ভর প্ল্যান্ট বসালে কিছু লোকের পকেটে টাকা ঢোকার সুযোগ হতো না, কুইক রেন্টাল সেই সুযোগটা করে দিয়েছে।
এই সেক্টরে এম. আজিজ খানের একটা শক্ত প্রতিযোগীর দরকার। বাজার অলিগোপলি হলে কিছুটা হলেও আমরা তার সুফল পেতাম বলে মনে হয় (সিন্ডিকেট বিষয়টা বিবেচনায় না রেখে বলছি)।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
http://www.mof.gov.bd/en/budget/11_12/ber/en/Chapter-10%20_Eng-2010_.pdf?phpMyAdmin=XRGktGpDJ7v31TJLuZ5xtAQmRx9
এই লিংক এর ৪ নম্বর পাতায় ১০.৩ টেবিল টা কি বলে , উৎপাদন কি একেবারেই হায় নাই? এটা তো সরকারী সাইট। তাহলে কার কথা সত্যি বলে মানব আমরা।
নতুন মন্তব্য করুন