একঃ
গভীর রাত । আমি একটা অন্ধকার গলির ভেতর চুপ করে দাড়িয়ে আছি। দূরে একটা বাড়িতে আলো জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। হয়তো কোন ইনসোমেনিয়ার রোগী অনিদ্রায় রাত্রি যাপন করছে। চারিদিক নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে ঝি ঝি পোকার কর্কশ ডাকে চূর্ণ হয়ে যাচ্ছে নিস্তব্ধতা। এরই মধ্যে একটা পায়ের শব্দ আমার মনোযোগ কেড়ে নেয়। কেউ সম্ভবত এদিকেই আসছে। নিজের অজান্তেই ডানহাতটা পকেটে চলে যায়। আমার হাতে চলে আসে একটা অটোমেটিক ইলেকট্রোগান। প্রয়োজন হাইভোল্টেজের একটা নিখুঁত শট। ব্যাস তাতেই খেল খতম হয়ে যাবে। আমি মুক্তি পাব আমার চির শত্রুর হাত থেকে। আমি উত্তেজনায় স্নায়ুটানটান করে দাড়িঁয়ে থাকি। না! পায়ের শব্দ দূরে সরে যাচ্ছে, অর্থাৎ সে যেই হোক না কেন আমার খোঁজে আসেনি। পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাবার পর আমি সাবধানে চারিদিক দেখে নিয়ে রাস্তার আলো বাঁচিয়ে সামনে এগোতে থাকি। প্রায় ঘন্টাখানেক হাটার পর আমি ক্লান্ত হয়ে রাস্তার উপর বসে পড়ি। আমার পা আর চলতে চায়না। কিন্তু হাতে সময় কম, যত দ্রুত সম্ভব নিরাপদ জায়গায় লুকিয়ে পড়তে হবে। পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে খুব ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে।
যারা এতক্ষন আমার কথা শুনে আমাকে কন পলাতক অপরাধী ভাবছেন তাদেরকে বলছি, না আমি কোন অপরাধী নই। আমি একজন বৈজ্ঞানিক। বৈজ্ঞানিক হয়েও কেন আমাকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে সেই প্রশ্নের উত্তর যদি জানতে চান, তাহলে আমাকে ফিরে যেতে হবে তিন বছর আগের ঘটনায়। তিন বছর আগে পত্র-পত্রিকায় বহুল সমালোচিত 'Parallel Universe' থিওরীর কথা হয়তো আপনারা শুনে থাকবেন। থিওরীটা আমারই দেয়া। আমাকে সবাই ডঃ হৃদয় বলে চিনে। আমার গবেষনা পত্রটি parallel universe এর যোগাযোগের জন্য universal door তৈরি করা উপর লেখা। আমার আমার গবেষনা পত্রে আমি দাবী করেছিলাম-"কোন তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গকে যদি একটি নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে বর্গাকৃতি কোন স্থানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করা যায়, তাহলে সেখানে একটি universal door তৈরি হবে যেটার মাধ্যমে আমাদের parallel universe এর সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হবে। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, parallel universe হলো আমাদের চেনা জগতের পাশাপাশি একটা universe যেখানে আমাদের দৃশ্যমান জীবজগতের সব জীবেরই প্রতিরূপ বসবাস করে, কিন্তু তাদের অবস্থান এবং চরিত্র আমাদের মত নয়।
আমি আমার থিওরী তাত্ত্বিকভাবে প্রমান করলেও এটি আসলেই বাস্তব ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে কিনা এ ব্যাপারে কোন নিশ্চয়তা ছিলো না। ফলে সেই সময় এটি বৈজ্ঞানিক মহলে বেশ বিতর্কিত বিষয় হয়ে উঠেছিল। গবেষনা পত্রটি প্রকাশের পর এর পক্ষে-বিপক্ষে নানা মতামত আসতে থাকে। তবে বিপক্ষ মতের আধিক্যই বেশি ছিল।
আমি এক সম্মেলনে উঠে বক্তৃতা দেবার পর একজন দাড়িয়ে আমাকে প্রশ্ন করল-"ডঃ হৃদয় আপনি সত্যিই বিশ্বাস করেন parallel universe এর অস্তিত্ব রয়েছে?"
এরকম বিচ্ছিরি প্রশ্ন শুনে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল, আমি রাগ চেপে উত্তর দিলাম -" আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সাথে এর অস্তিত্বের সম্পর্ক নেই।"
আরেকজন দাড়িয়ে বললেন- " আপনার গবেষনা পত্রের ফলাফলের সাথে ঠিক একমত পোষন করতে পারছিনা। কারন আপনার ব্যবহার করা অনেকগুলো থিওরীই এখনও বৈজ্ঞানিক মহলে বিতর্কিত।"
তার কথা শুনে তার সহকর্মী কয়েকজন বৈজ্ঞানিকের মুখে মুচকি হাসি দেখা গেল।
আমি বুঝতে পারলাম আপনারা আমার থিওরীকে তারা ঠিক মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। জেদের বশে তখন আমি বলে উঠি-" আমি আপনাদের সকলের সামনে Parallel universe এর অস্তিত্ব প্রমান করে ছাড়ব।" একথা বলে আমি স্টেজ থেকে নেমে আসি।
দুইঃ
এরপর parallel universe এর সাথে যোগাযোগের জন্য আমি দিন-রাত কাজ কাজ করতে থাকি। প্রায় টানা তিনটি বছর ধরে অক্লান্ত প্রচেষ্টার পর আমি সফল হই। আমার গবেষনার সত্যতা সবার সামনে প্রমান করার জন্য সবচেয়ে সহজ উপায় ছিল ঐ জগৎ থেকে আমার নিজের প্রতিরূপ এই জগতে নিয়ে আসা। আমার পরিকল্পনা বাস্তব করার লক্ষে parallel universe এ আমি আমার প্রতিরূপের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা শুরু করি। এবং প্রায় সপ্তাহখানে পরে আমি সত্যি সত্যি আমার প্রতিরূপের সাথে যোগাযোগ করে তাকে এজগতে নিয়ে আসতে সক্ষম হই।
কিন্তু ঐ জগতের 'আমি'র সাথে এই জগতের আমার ছিল আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এখানে আমি একজন সফল বৈজ্ঞানিক,কিন্তু ঐ জগতে আমার প্রতিরূপ ছিলো একজন ব্যর্থ মানুষ। তার অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে খাবার কেনার মত পয়সাও তার কাছে ছিলনা। তার গায়ে ছিল নোংরা কাপড়। মুখভর্তি ছিল বহুদিনের না কামানো দাড়ি; এবং বহুদিন গোসল না করায় তার গা থেকে দূর্গন্ধ বের হচ্ছিল। আমি তাকে খাবার দেই এবং আমার কাপড় পড়তে দেই। সে দাড়ি কামিয়ে গোসল করে বের হবার পর আমরা দু'জন আয়নার সামনে গিয়ে দাড়াই। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করি যে আমাদের দু'জনের মধ্যে কোনই অমিল নেই। এবার আমি ওকে সকলের সামনে উপস্থিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করি।
আমার আশঙ্কা ছিল যে ওকে সবার সামনে উপস্থিত করলে আমারা শত্রুরা হয়তো ওর ক্ষতি করতে পারে। তাই সবার সামনে উপস্থিত করার আগে সাবধানতা বশতঃ ওর শরীরে একটা ট্রাকিং ডিভাইস ঢুকিয়ে দেই। এরপর আমি তাকে নিয়ে বৈজ্ঞানিক মহলে হাজির করি। আমার গবেষনার জলজ্যান্ত প্রমান পেয়ে নিন্দুকদের মুখ বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করে। এমনকি এতদিন ধরে আমার যে সহকর্মীরা আমার থিওরী নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করেছে,তারাও এখন রূপ বদলে আমার পিঠ চাপড়ে বাহবা দিতে শুরু করে।
এর কয়েকমাস পর থেকে আমি ওর মধ্যে একটা চাঞ্চল্য লক্ষ্য করি । আমার মনে হতে থাকে ও যেন আমাকে লুকিয়ে কোন পরিকল্পনা করছে। কিন্তু ও যে আমাকে খুন করার পরিকল্পনা করতে পারে তা আমি সপ্নেও ভাবিনি। একদিন রাত্রে যখন আমি রিডিং রুমে বসে আমার একটা গবেষনার বিষয়ে আর্টিকেল লিখছিলাম হঠাৎই তখন সে একটা লোহার রড নিয়ে সে আমাকে আক্রমন করে ।কিন্তু আমি সময়মতো সরে যাওয়ায় আঘাতটা আমার মাথায় না লেগে আমার ঘাড়ে লাগে। আত্মরক্ষার জন্য আমার পকেটে সবসময় একটা অটোমেটিক ইলেক্ট্রোগান থাকত। সেটা বের করে আমি তাকে একটা লো ভোল্টেজের শক দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলি,এবং তাকে বেধে ষ্টোর রুমের বন্দি করে রাখি।
তার জ্ঞান ফিরলে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি-"আমাকে মারতে চাইছিলে কেন?" ও মুচকি হেসে জবাব দেয়-"তুমি একজন নামকরা বৈজ্ঞানিক,আর আমি জীবনযুদ্ধে ব্যর্থ একজন মানুষ। তোমার থিওরী প্রমানে জন্য আমাকে এজগতে এনেছ; কিন্তু তোমার কাজ শেষ হয়ে গেলে আমাকেতো সেই আগের জগতেই ফেরত পাঠাবে।সেখানে আমার জন্য রয়েছে শুধুই অভাব আর ক্ষুধার জ্বালা।তোমাকে মারতে পারলে আমি তোমার স্থানে এজগতে থেকে যেতে পারব। তুমি আর আমি একে অন্যের প্রতিরূপ।ফলে অন্য কারও পক্ষেই ঠিক করে বোঝা সম্ভব হবে না কে আসল ডঃ হৃদয়।"
আমি বুঝলাম ক্ষমতার লোভা ওকে পেয়ে বসেছে। ঠিক করলাম রাতটা পার হলেই তাকে তার জগতে ফেরত পাঠাবো। কিন্তু আমার হিসাবে একটু ভুল হয়েছিল, কারন সকালবেলা স্টোররুমে গিয়ে দেখি দড়ি ছিড়ে ও পালিয়েছে আর আমার ল্যাবটরিতে parallel universe এর সাথে যোগাযোগ করার জন্য যে যন্ত্রটা বানিয়েছিলাম ওটাকে যাবার আগে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। এরকম আরেকটা যন্ত্র তৈরি করতে কমপক্ষে ছয় মাস সময় লাগবে। মনে মনে আমি প্রচন্ড রেগে গেলাম, ওকে অনেক সুযোগ দিয়েছি আরনা, ঠিক করলাম এরপর ওকে দেখা মাত্র গুলি করব। আমি ইলেক্ট্রোগানের লিভার টেনে হাই ভোল্টেজে সেট করি।
ওর শরীরে যে ট্রাকিং ডিভাইস ঢুকিয়েছিলাম তার মাধ্যমে বুঝতে পারলাম শহরের প্রান্তে যেখানে গৃহহীন ছন্নছাড়াগোছের কিছু লোক বসবাস করে ও সেখানে গিয়ে আস্তানা গড়েছে। আমি একটা বাই-ভার্বালে চড়ে ঐ এলাকার কাছাকাছি স্থানে নামলাম। ট্রাকিং ডিসপ্লে-মেশিন দিয়ে ও কোথায় আছে তা খুঁজে পেতে বেশি দেরি হলনা। ট্রাকিং ডিসপ্লে-মেশিনের কাটা পুরানো একটা বিবর্ণ ছাপড়া ঘরের দিকে নির্দেশ করছিলো। আমি আস্তে আস্তে গিয়ে ঐ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলাম। ঘরের এককোনায় ও বসেছিল, আমাকে দেখে সে ভুত দেখার মত চমকে উঠল। এবং প্রায় সাথে সাথেই একটা স্টেনোগান বের করে আমার দিকে গুলি ছুড়ল। গুলিটা আমার গায়ে না লেগে আমার হাতের ট্রাকিং-ডিসপ্লে মেশিনটায় লেগে সেটা বাষ্পিভূত হয়ে গেলো। আমি ধাতস্ত হতে হতে ও জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। আসে পাশে তাকিয়েও কোথাও ওকে খুজে পেলাম না।
এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসে। এই অন্ধকারে এভাবে চোর পুলিশ খেলে ওকে ধরা সম্ভব হবেনা। ওকে ধরার জন্য প্রয়োজন নিখুঁত একটা পরিকল্পনা। চারিদিক ভালোভাবে দেখে গলি থেকে বের হয়ে রাস্তার আলো বাচিয়ে আমি সাবধানে বাড়ির দিকে আগাতে থাকি।
তিনঃ
এরপর আমি হাটতে হাটতে বাসায় এসে পৌছালাম । বাড়ির সিকিউরিটি সিস্টেম চেক করে বিছানায় শুতে গেলাম। সমস্ত বাড়ির সিকিউরিটি সিস্টেম শুধু আমার কণ্ঠস্বরের মাধ্যমেই অ্যাক্টিভেট বা ডিঅ্যাক্টিভেট করা যায়।
মাঝরাতে মৃদু একটা শব্দ শুনে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমার মনে হতে থাকে ঘরে কেউ ঢুকেছে! অথচ সিকিউরিটি এল্যার্মতো বাজেনি!! চকিতে আমার মনে পরে- আমার এবং আমার প্রতিরূপের কণ্ঠস্বর একই, ও চাইলেই অ্যালার্ম ডি-অ্যাকটিভেট করতে পারবে।আমি বালিশের নিচ থেকে ইলেকট্রোগানটা বের করে নেই। ঘর থেকে বের হবার জন্য সাবধানে দরজার বাইরে পা বাড়াই। সাথে সাথে রিডিং রুমের দিকে থেকে একটা আলোর ঝলক দেখতে পাই ,স্টেনোগানের গুলিতে আমার নাইটগাউনের একটা অংশ পুড়ে যায়। ও আমার রিডিং রুমের ভেতর থেকে গুলি চালাচ্ছে।
মনে মনে হেসে উঠি, ও জানেনা বারান্দা দিয়ে ঘুরে রিডিং রুমের জানালার কাছে যাবার ব্যবস্থা আছে। আমি বারান্দা ঘুরে রিডিং রুমে ঠিক ওর পিছনের দিকের জানালায় গিয়ে উপস্থিত হই। আমি হয়তো একটু শব্দ করে ফেলেছিলাম, ও চমকে উঠে পিছনে তাকিয়েই ট্রিগারে চাপ দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে, আমার ইলেকট্রোগানের হাই ভোল্টেজে ও পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আমি ধপ করে মাটিতে বসে শান্তিতে নিঃশ্বাস ফেলি।
হঠাৎ চোখ পড়ে আকাশের দিকে। আজ সম্ভবত পূর্ণিমা। চাঁদের নরম স্নিগ্ধ আলোতে বুঝতে পারি বেঁচে থাকাটা কত আনন্দের। আমার হঠাৎই রবীন্দ্রনাথের গানের দু'টি লাইন মনে পড়ে-
'আজি জোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে,
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে... '
অসীম শান্তি নিয়ে আমি চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকি।...
দায়ীন (frdayeen)
........................................................
অন্য লেখাগুলিঃ
সমান্তরাল জগতের ক্যারিক্যাচার
নীলচে-সবুজ জলের দেশে...
সময়কালের ক্যাঁচক্যাঁচানি (!)
একটি বজ্জাত নিউট্রিনো এবং...
আজব সব জীবগুলি-৪ (বীভার)
আজব সব জীবগুলি-৩ (অল্ডার ফ্লাই)
আজব সব জীবগুলি-২ (জল মাকড়শা)
আজব সব জীবগুলি-১ (আর্চার ফিস)
মন্তব্য
ভালই, কিন্তু শেষের রবীন্দ্রনাথ একটু কেমন যেন লাগল, আমার ব্যাক্তিগত মতামত আরকি।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
আপনাকে
প্রচুর ইংরেজি আর ভুল বানান আমাকে পুরোটা পড়তে দিলো না বলে দুঃখিত
(বাংলায়)
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
হুম, বানানগুলি খেয়াল করা হয়নি ,আরও কয়েকবার প্রিভিউ দেখে নিয়ে সংরক্ষন করা উচিত ছিলো।
গল্পটা ভালো কিন্তু কিছু বানান ভুল চোখে লাগে। তবে ভালোই লেগেছে গল্প...
অনিচ্ছাকৃত ভুল বানানের জন্য
গল্প ভালো লাগবার জন্য
এমন গল্পের মাঝে আরও তথ্য থাকলে ভালো লাগত
facebook
বানান খেয়াল কইরা...
নতুন মন্তব্য করুন