প্রথম অংশ - http://www.sachalayatan.com/guest_writer/42365
রাতে বেশ কয়েকবার ঘুম ভেঙ্গে গেলেও সকালের ঘুমটা ভালই হচ্ছিল। বেরসিক তেহজীব এর ডাকে আটটার কিছু আগে উঠে পড়ি। একবারে সব মাল-সামাল নিয়েই নিচে নামি। রুম ছেড়ে দিয়ে অফিস রুমে ব্যাগ রেখে বের হয়ে পড়ি অজানাকে দেখতে।
২ ডিসেম্বর, আগের দিন খোঁজ খবর করে যেটুকু বুঝেছিলাম তা হচ্ছে এখানকার রিক্সাওয়ালারা মহা ধান্দাবাজ। সবসময়ই সুযোগ খোঁজে ছিল দেয়ার। আর আমার অতীত অভিজ্ঞতা এবং অন্যান্য সোর্স মোতাবেক যে এলাকায় মটর সাইকেল ভাড়া দেয়া হয় যাতায়াত এর জন্য সেখানে অন্য বাহন ব্যবহার না করাই শ্রেয়।
তাই তেহজীবের মতামত নিয়ে (যেহেতু পয়সা ওর ) নাস্তার ফাঁকেই দুটো মটর সাইকেল ভাড়া করে ফেললাম; যাওয়া-আসা ৪০০ টাকা করে প্রতিটি।
বিরিশিরিতেই সোমেশ্বরীর তীরে গেলাম নদী পেরোতে। সোমেশ্বরীর শীতের রূপ কিছুটা দেখা হয়ে গেল এই সুযোগে।
প্রথমেই আমাদের বাহনের চালকদ্বয় নিয়ে গেলেন চীনা মাটির পাহাড়ে। হয়তো কবি রোমেল চৌধুরী বা হিমু হলে কথার জালে পাঠক-পাঠিকাদের নিয়ে যেতে পারতেন সেই অপূর্ব নিসর্গে অথবা তারেক অণু হলে দিব্বি পুরো ইতিহাস দিয়েই মাতিয়ে দিতেন সবাইকে। কিন্তু এর কোনটিই আমার দ্বারা সম্ভব নয় বিধায় আমি বরঞ্চ আমার ক্যামেরার চোখে দেখানোর একটা চেষ্টা নেই –
সেখান থেকে রওনা হলাম রাণীখং গির্জার দিকে। পানির তেষ্টা পাওয়ায় একটা বাজার এ থেমে ছোট্ট চা পানের বিরতির পর আবার এগিয়ে যাওয়া। বাইক থেকেই হাজংমাতার স্মৃতির উদ্দেশে তৈরি চমৎকার সৌধটি চোখে পড়ে পথের ধারেই।
এরপর রানীখং, গির্জার নিচে পোস্ট অফিস।
গির্জায় উঠার পথে আবারো দেখা হয় সোমেশ্বরীর সাথে। পাশেই স্কুল।
প্রবেশ করলাম যেন এক শান্তির রাজ্যে, মনে হলো এরকম কোথাও থাকতে পারলে বেশ হতো -
আমি গির্জায় বেশ কিছুক্ষণ কাটানোর পর তেহজীব এর দেখা মিলল। ওর গাইড এখানে না এসে আগে বর্ডার দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। এখান থেকে ৫ / ৭ মিনিট এর রাস্তা। দেখার বলে কিচ্ছু নাই। শুধু একটা নিরাপত্তা চৌকি। তাই আর সেদিক না গিয়ে ফেরার রাস্তা ধরলাম। রাস্তা ভাঙ্গা হলেও প্রায় পুরোটাতেই পেয়েছি প্রকৃতির সুশীতল ছায়ার ছোঁয়া।
পথে এবার ভগবান রামকৃষ্ণের মন্দির। কারুকাজ দেখলে থমকে তাকাতে হয়।
আবারো নদী পেরোতে হবে। তবে এইবার ঠিক করলাম দুর্গাপুর তেরীবাজার ঘাট দিয়ে ওই পারে যাব। আগের রাতে এই বাজারে আসলেও অন্ধকারের জন্য দেখা হয়নি ঠিকমতো।
এখানে নৌকায় করে যেমন আসে ডিম; তেমনি বাইক, ভ্যান বা বাড়ি তৈরির ইটও পার হয় নৌকাতেই।
পরিস্কার আকাশে ছেড়া ছেড়া তুলোর মতো মেঘ নিয়ে খেলায় মেতে উঠেছে প্রকৃতির দামাল ছেলে বাতাস।
ঐ দূরে দেখা যায় বিরিশিরি এবং দুর্গাপুর এর সংযোগ সেতু।
সোমেশ্বরী জুড়েই চলে বালি, পাথর এবং কয়লার গুড়ো আহরণ।
বিরিশিরিতে হচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য সরকারী বাসস্থান
বাংলাদেশের অন্যান্য নদীর মতই সোমেশ্বরীও হারিয়েছে তার যৌবন।
যখন আবার বিরিশিরি পৌছুলাম তখন কেবল ১২টা পার হয়েছে। হাতে সময় থাকায় রাস্তাতেই ঠিক করেছিলাম যে এদিকে যখন এসেইছি তখন গৌরিপুর জাংশন, নান্দাইলের ইউনুস এবং কুতুবপুরটাও দেখেই যাব। সেই অনুযায়ী আহসান হাবীব ভাইকে ফোন করে উনাদের গ্রামে যাওয়ার রাস্তাও জেনে নিয়েছি।
তেহজীব গিয়ে ওয়াই ডব্লিউ সি এ থেকে ব্যাগ নিয়ে আসার পর বাইকওয়ালাদের বিদায় জানিয়ে উঠে পড়লাম বিরিশিরি ঢাকা ডিরেক্ট বাস এ। আমাদের গন্তব্য শ্যামগঞ্জ চৌরাস্তা। এতোকাছে নেবে না দেখে ময়মনসিং-এর ভাড়া কবুল করে উঠে আবিষ্কার করলাম যে আবারও আবুল হয়েছি। কঠিন লোকাল বাস। এবং স্থানীয়রা যাচ্ছেন ২০ টাকা ভাড়ায়। আমরা দিলাম ১০০ করে ২০০ টাকা। বলতে গিয়ে শিখতে হলো যে বলে উঠানোর পরে আর কোনও কথা বলা ঠিকনা।
১ ঘণ্টার রাস্তা সোয়া ২ ঘন্টায় এসে নামলাম শ্যামগঞ্জ মোড়ে। রিকশাযোগে রেলস্টেশন সংলগ্ন ম্যাক্সি তথা হিউম্যান হলার স্ট্যান্ডে। এবার আগেই এক দোকান থেকে জেনে নেয়ায় রিক্সাওয়ালারা ২০ টাকা দিয়ে শুরু করলেও আমরা ১০ টাকাতেই যেতে পারলাম। ম্যাক্সি নিল ১৫ টাকা করে ভাড়া। প্রায় পুরোটা পথেই সাথে থাকলো আদিগন্ত ধানের ক্ষেত -
তিনটার কিছু পরে পৌঁছুলাম গোরীপুর। আবারো ১০ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে জাংশনে।
সময়-অভাবে ইচ্ছে থাকলেও ভালভাবে না দেখেই রওনা দিলাম আবার ঈশ্বরগঞ্জ এর দিকে। ইচ্ছে আজকে রাতে কুতুবপুরে হাবীব ভাইদের ওখানে থাকার।
ঈশ্বরগঞ্জ যাওয়ার রাস্তা অনেক চওড়া। দুরত্বও অল্প। কিন্তু গাড়ী কখনই ১৫ কিলোর উপর স্পীড তুলতে পারেনি।
তারপরেও রাস্তার পাশে বিকালের রোদের আলোয় উদ্ভাসিত আধাপাকা অথবা সোনালী বরণ ধানের ক্ষেত সঙ্গ দিয়ে গেছে আগের মতোই।
ঝাঁকুনি আর গোধুলীর (!) অত্যাচারে যখন ধান ক্ষেতগুলিতে শর্ষে দেখা শুরু করতে যাচ্ছি তখন ঈশ্বর এর কৃপাতেই বোধহয় তাঁর গঞ্জ-এ পৌঁছে গেলাম।
নেমে দেখি ৫টা পার হয়ে গেছে। সন্ধ্যা আসন্ন। আসে পাশে কুতুবপুর কেউ চিনতে পারলনা, কিভাবে যেতে হবে বলতে পারা তো পরে। দুপুরের খাওয়া হয়নি তখনো। তাই আগে ঢুকলাম পেট পুঁজো করতে।
ঈশ্বরগঞ্জ অনেক বড় আর জমজমাট একটা বাজার এলাকা। মধ্যরাতের পরেও এখানে অনেক ব্যস্ততা দেখা যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য জনক হলেও সত্যি যে এখানে থাকার একমাত্র বোর্ডিংটির (কাজল) অবস্থা আমাদের রুমা বাজারের কেওক্রাডাং বোর্ডিং এর চেয়েও খারাপ। তারপরেও হয়তো এখানেই থাকতে বাধ্য হতাম কিন্তু কাজল বোর্ডিং এর মালিক চাচা মিয়ার চাইতে তাঁর ১৩ / ১৪ বছরের ছেলের কথা বার্তার ধাঁর অনেক বেশি মনে হলো। শঙ্কা জাগলো এখানে থাকলে রাতে একটা গ্যাঞ্জাম অবশ্যম্ভাবী। চলে এলাম আবার অটোরিক্সা স্ট্যান্ডে। একজন বলল কুতুবপুর চেনে কিন্তু ৬০০টাকা লাগবে। এদিকে হাবিব ভাই বলে দিয়েছেন নান্দাইল চৌরাস্তা থেকে মাইল তিনেক রিক্সা নিয়ে গেলেই উনাদের গ্রাম। আর ছিল খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল না। তেহজীব বলছিল যে আর কিছু না থাক, জেলা পরিষদ এর বাংলো থাকবেই।
জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিলেন একজন। যে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমরা এতক্ষণ, সেইটিই বাংলো। অনেক ধাক্কা ধাক্কির পর গেট খুললেও অনুমতির দোহাই দিয়ে রাজি হচ্ছিলেন না কেয়ার টেকার কুদ্দুস ভাই। বিপদের কথা বলে অনুরোধ, নগদ প্রদানের আশ্বাস এবং প্রয়োজন পরলে ফোন করানোর লোকও আছে জানানোর পর রাজি হলেন তিনি।
ব্যাগ রেখে হাত মুখ ধুয়ে বের হলাম বাজার পরিদর্শনে। চা খেতে খেতে শাক-সব্জি দেখছিলাম। এতো টাটকা যে আমাদের ঢাকাবাসির চোখে তা রিতিমতো মুখফোর-এর আদম এর সেই বাক্সের মতোই মনোহর মনে হলো।
তাই নিজেদের ঈমান-মমিন নিয়ে তাড়াতাড়ি সরে এলাম বাজার থেকে। সামনেই একটা ব্রিজ। নদীটার নাম বোধহয় ‘কাঁচামাটিয়া’, ব্রিজ পার হয়ে ৭০ টাকা ঘন্টা চুক্তিতে একটা রিক্সা ঠিক করে সাইড রোড ধরে ঘুরে এলাম। অনেকদিন পর আবার এতো তারা একসাথে দেখলাম আকাশে। আর আকাশটাও যেন কত কাছে, কতই আপন, হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে দেয়া যায়।
রাতের খাবার পর ডাকবাংলোতে কুদ্দুস ভাইয়ের ২০০ টাকার আত্মীয় হয়ে, ক্যামেরা –র ব্যাটারী চার্জে দিয়ে শুয়ে পড়লাম সে রাতের মতো। আমাদের আগামীকালের গন্তব্য কুতুবপুর এর কথা ভাবতে ভাবতে।
চলবে..
তদানিন্তন পাঁঠা
মন্তব্য
কিছু ছবি খুবই ভালো লাগলো।
love the life you live. live the life you love.
ধন্যবাদ।
দারুণ ভ্রমণকাহিনী হচ্ছে। বিরিশিরি গিয়েছিলাম সেই বছর দশেক আগে। এ বছর আবারো যাওয়ার ইচ্ছা আছে।
পরবর্তী সময়ে বিরিশিরি গেলে চেষ্টা করবেন বর্ষায় যেতে। বর্ষার বিরিশিরি আর শীতের বিরিশিরি দুটো পুরোপুরি আলাদা। আর নেত্রকোনা গেলে চেষ্টা করবেন মোহনগঞ্জের হাওরে যেতে। অন্যরকম স্বাদ পাবেন।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
ধন্যবাদ। ভবিষ্যতের করণীয় লিস্টে টুকে নিলাম পয়েন্ট দুইটা।
facebook
নতুন মন্তব্য করুন