তা সে বেশকিছুকাল আগের কথা। গ্রামে একদিন এক গ্রাম্য ডাক্তারের দোকানে বসে আছি। ডাক্তারের কাছ থেকে গ্রাম্য চিকিৎসা পদ্ধতি ও এর হাল হকিকত সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছি।
গ্রাম্য চিকিৎসা পদ্ধতিতে ডাক্তারের 'ভিজিট' বলতে কিছু নেই। রোগীর রোগ নির্ণয়ের পর ঔষধসহ চিকিৎসামূল্য ধার্য্য করা হয়। সে ক্ষেত্রে রোগীর জানার সুযোগ হয়না, কোন ঔষধের কত দাম। আমার মনে হয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগীদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে তাদের কাছ থেকে অধিক মূল্য নেওয়া হয়। কোন কোন ডাক্তারের মধ্যে এক ধরনের মানসিকতাও দেখেছি, রোগী বা রোগীর অভিভাবককে ধারনা দেওয়া হয় যে রোগটি জটিল। সে ক্ষেত্রে ডাক্তার অধিক চিকিৎসামূল্য আদায় করতে পারেন।
যাহোক আমি আসলে গ্রাম্য চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে লিখছিনা। এ অনেকটা 'ধান ভানতে শীবের গীত' গাওয়ার মত হল। আমি, আমার দেখা একটি ঘটনা আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাচ্ছি।
ঐ ডাক্তারের দোকানে বসে থাকা অবস্থায় একটি অল্প বয়সী মা তাঁর মাস খানেক বয়সের সন্তানকে কোলে করে ডাক্তারের কাছে এসেছে। ডাক্তার সাহেব প্রথমেই জানতে চাইলেন, কি পরিমান টাকা তিনি এনেছেন। মহিলাটির কাছ থেকে জানা গেল, তিঁনি দশটি টাকা যোগাড় করতে পেরেছেন। টাকার অঙ্কটি জানার পর ডাক্তারের ত্বরিত জবাব, ঐ টাকায়তো চিকিৎসা হবেনা।
অল্প বয়সী মা'টি ডাক্তারের পা চেপে ধরতে গেলেন এবং কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন, ডাক্তার সাহেব একটু দয়া না করলে তাঁর সন্তানটি মারা যাবে এবং তিনি এও কথা দিলেন পরবর্তিতে সে যেভাবেই হোক ডাক্তারের বকেয়া মিটিয়ে দেবেন।
ডাক্তার সাহেব কোনক্রমে তাঁর পাটি ছাড়িয়ে নিয়ে সরে গেলেন এবং তাঁকে বিদায় করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন। মা'টির কাকুতি মিনতি দেখে আমি দয়াপরবশ হয়ে ডাক্তার সাহেবকে অনুরোধ করলাম বাচ্চাটির চিকিৎসা করবার জন্য এবং সব ধরনের খরচাপাতির দায়িত্বও আমি নিলাম।
ডাক্তার সাহেব তখন ওদেরকে একটা পর্দাঘেরা জায়গায় নিয়ে ঢুকলেন। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে ডাক্তার সাহেব আমাকে বললেন, বাচ্চাটির প্রচুর পাতলা পায়খানা হয়ে শরীরটা পানিশুন্য হয়ে পড়েছে।
তিনি একগ্লাস পানিতে আধা প্যাকেট খাওয়ার স্যালাইন গুলিয়ে ওটা নিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকলেন। ভিতর থেকে মাঝে মধ্যে অল্প বয়সী মা'টির ডুকরে কেঁদে ওঠার শব্দ পাচ্ছিলাম।
বেশ কিছুক্ষণ পরে সবাই বেরিয়ে আসলেন। ডাক্তার সাহেব অল্প বয়সী মা'টির হাতে কিছু ঔষধ দিয়ে তা খাওয়াবার ব্যবস্থা বুঝিয়ে দিলেন।
হঠাৎ করেই অল্প বয়সী মা'টি আমার পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন এবং আমার প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। তাঁর প্রকাশভঙ্গির মধ্যে এমন কিছু ছিল যা আমাকে মানতে বাধ্য করলো যে সেটা অকৃত্রিম। আমিও নিজের ভিতর এক ধরনের অনির্বচনীয় সুখ অনুভব করলাম।
মা-সন্তান চলে যাবার পর ডাক্তার সাহেব আমাকে বললেন, "গরীব ঘরের বউ, অভাবের সংসার, ঠিকমত খাওয়া জোটেনা, অল্প বয়সে মা হয়েছেন, বুকে(স্তনে) দুধ নেই, গরুর দুধ কেনার মত পয়সাও নেই তাই চাউলের গুড়া গুলিয়ে বাচ্চাটাকে খাইয়েছেন, বাচ্চাটার পেটে তা সহ্য হয়নি তাই পেট খারাপ হয়ে এই অবস্থা।
পরেরদিন খুঁজে পেতে সেই অল্প বয়সী মা'টির বাড়িতে গিয়েছি। বাড়িতো বলা যাবেনা, কোন রকমে চারদিকে পাটকাঠি দিয়ে ঘেরা খুপরি মত একটি ঘর। বাচ্চাটি মেঝেতে একটি কাঁথার উপর শোয়ানো। তারস্বরে কাঁদছে। আমাকে দেখে অল্প বয়সী মা'টিও ডুকরে কেঁদে উঠলেন। কান্না জড়ানো কন্ঠে বললেন, " হতচ্ছড়াডারে আমি এখন কি খাওয়াবো, আমি এখন কি করব! মাঝেমধ্যি মনে হয় ওরে গলা টিপে মেইরে নিজিও গলায় দড়ি দিই। ওর বাপটা এট্টা অকম্মার ধাড়ী। ম্যালা দিন হইল শহরে গিয়েছে কাজ খুঁজতি, তার নিজিরই আর কোন খোঁজ নেই।"
আর আমি, সুবিধাভোগী, শোষক শ্রেণীর এক প্রতিভু মুখোশ পরে দাড়িয়ে আছি বিরাট এক শুন্যতার মাঝে। এই আমিই শহীদ মিনার চত্বরে বজ্রমুষ্ঠি উঁচু করে চেঁচিয়ে বলবো, 'এ পৃথিবীকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি...নবজাতকের প্রতি এ আমার দৃঢ় অঙ্গিকার।'
কোন মা'য়ের সামনে তাঁর শিশুসন্তান ক্ষুধার জ্বালায় তারস্বরে চেঁচিয়ে কাদছে আর অসহায় মা'টির তাকিয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই। মা'য়ের এই অপারগতা, এই অসহায়ত্ব, তাঁর অনুভুতির গভীরতম যন্ত্রণাটির সামান্যও আমরা অনুধাবন করতে পারিকি! আমি এক ভাষাহীন নিরুক্ত যন্ত্রণায় আচ্ছন্ন হয়েছিলাম। এই ঘটনার পর থেকে আমার জীবনঢংই পাল্টে গিয়েছে।
শহরে লোক পাঠিয়ে খুঁজে পেতে ওঁর স্বামীটিকে ফিরিয়ে এনে একজোড়া বলদ কিনে দিয়েছিলাম। বলতে পারেন একধরনের অপরাধবোধ থেকে, এই ভেবে যে, ওদের প্রাপ্য কেড়ে খেয়ে ওদেরকে জীর্ণ-শীর্ণ বানিয়েইতো নিজেদেরকে মোটাতাজা করেছি, আঙ্গুল ফুলিয়ে কলাগাছ বানিয়েছি, যদি কিছু কমপেনসেট করা যায় এই আরকি!
"আমার ভাষাজ্ঞান দুর্বল। আবেগবশত কোন কোন ক্ষেত্রে শব্দের অপপ্রয়োগ ঘটতে পারে, ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।"
প্রৌঢ়ভাবনা
মন্তব্য
অনেক ভাল লাগল। এ ধরণের অভিজ্ঞতা আমার কিছু হয়েছে। এথনোগ্রাফিক গবেষণার কাজে দিনাজপুরের এক প্রত্যন্ত উপজেলায় ওষুধের দোকানে বসে থাকতাম। ওষুধের পয়সা যোগাতে না পারা রোগীদের দেখে খুব কষ্ট হত। নিজে একদিন দু'দিন টাকা দিয়েছি। কিন্তু আপনার মত সাসটেইনেবল কিছু করা হয়নি। এমন কাজ করতে চেয়েছিলাম আমার জীবনের প্রথম চাকরির প্রথম দুই মাসের টাকা দিয়ে। পাওয়ার টিলার আর সংশ্লিষ্ট খরচ বাবদ যে টাকা চেয়েছিল দিয়েছিলাম। কিন্তু আর কোর যোগাযোগ রাখেনি। হয়ত আপনার মত হাতে কলমে কিছু একটা করে দেয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমাদের শহুরে ব্যস্ততার ভীড়ে সেটা আর করা হয়ে ওঠেনা।
এরকম অভিজ্ঞতা আমার অনেক আছে। শহরে আমার এক বন্ধু আছে, বনের মোষ তাড়ানোই তার কাজ। আমি টাকা দিয়ে রোগী পাঠিয়ে দিতাম আর তার কাজ ছিল ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে রোগীর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি পাঠানো।
আমার পর্যবেক্ষণে দেখেছি, গ্রামের হতদরিদ্র মানুষগুলো এই চিকিৎসা সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে অসহায়।
ধন্যবাদ আপনাকে, আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করবার জন্য।
ভালো কাজ করেছেন।
এই প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের ( উনাকে ভগবান - অবতার জ্ঞান না করে) একটা কথা শেয়ার করছি - তিনি বলেছিলেন নিজের চরকায় তেল দাও... নিজের ভালো কর... এরপর নিজের ভালোটা করে এই পৃথিবীর আরেকটা মানুষের ভালোটার জন্য চিন্তা কর - এই ভাবে দেখবে চেইন সিস্টেমে সব্বার ভালো হয়ে গেছে...
ডাকঘর | ছবিঘর
ধন্যবাদ।
আমি স্বল্পাকারে হলেও চেষ্টা করি 'মাটির ঋণ' পরিশোধ করবার জন্য, পুন্য লাভের আশা না করে।
কত আগের ঘটনা এটা? বলদ কিনে দেবার বছর খানেক পরের কোন ফলোআপ করেছিলেন?
আমি বিগত প্রায় ৩৪ বছর ধরে গ্রামে যাতায়াত করি। বছরে কম করে হলেও ৪বার। রাজনীতির বাইরে থেকে আমার ক্ষুদ্র সামর্থে এই সব হতদরীদ্র অসহায় মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেছি। উঠতি যুব-সমাজকে সন্ত্রাসের বাইরে রাখার জন্য খেলাধুলায় ব্যাস্ত রেখেছি। এক সময় আমাদের গ্রামের ফুটবল দল উপজেলা চ্যাম্পিয়ন ছিল।
ধন্যবাদ আপনাকে, মন্তব্যের জন্য।
আমারো খুব ইচ্ছে হয় আমার দেশের সরল দরিদ্র ভাই বোন গুলোকে সাহায্য করতে, কিন্তু হায়, আল্লাহ আমার শুধুই ইচ্ছেটা দিলেন কিন্তু সামর্থ দিলেন না। দেখা গেল সামর্থ আস্লে ইচ্ছেটাই পাকাপাকি ভাবে বদলে গেল। হয়ত গড ফেয়ার নন।
শাফি।
সামর্থ্য শুধু অর্থের হিসাবে বিচার্য নয়। আপনি কাউকে পরামর্শ দিয়ে বা কোন অজ্ঞ ব্যাক্তিতে সে বিষয়ে জ্ঞান দিয়ে সঠিক সিন্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে পারেন। আন্তরিক ইচ্ছাটাই আসল। কিছুটা সময় হয়ত আপনাকে ব্যয় করতে হবে। শুরু করুন, দেখবেন এর ভিতর এক ধরনের অনির্বচনীয় আনন্দ আছে।
ধন্যবাদ, শুরু করছেন নিশ্চয়!
আপনি অনুসরণ এবং অনুকরণ করার মতই চমৎকার একজন মানুষ।
আপনার সর্বাঙ্গীন কল্যান হোক। মঙ্গল হোক।
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
হুদাই একটা পক্ষপাতিত্ব নয় কী ? খুবই প্রীত হলাম আপনার মন্তব্যে।
আপনার ও আপনার পরিবারেরও মঙ্গল হোক।
আমি বাংলাদেশের অসহায় বাচ্চাদের জন্য একদিন কিছু করব। সেদিন আমার এমন কিছু মানুষ লাগবে যারা মন থেকে মানুষের জন্য কিছু করতে চায়। সেদিন আপনি কি আমার সাথে থাকবেন?
ফাহিমা দিলশাদ
আপনি নিশ্চয় আমার বয়সের একটা ধারনা পেয়েছেন। আপনি যেদিন শুরু করবেন সেদিন যদি আমি শারিরিক ও মানসিকভাবে সমর্থ থাকি নিশ্চয়ই আপনার সাথে থাকবো। আর কামনা করি আপনার মনোবাসনা যেন পূরণ হয়।
নতুন মন্তব্য করুন