রিকশা থেকে নামতেই ভালোমতোই একটা ধাক্কা খেল রবিন। তাকিয়ে দেখে একটা ফুল বিক্রেতা মেয়ে। ধাক্কার চোটে মেয়েটার হাতের ফুলগুলো রাস্তায় ছড়িয়ে গেছে।
বাসা থেকে বেরিয়ে রবিন রিকশায় উঠেছে। রিকশাঅলার সঙ্গে টুকটাক কথা বলা ওর স্বভাব। সে জানতে চাইল, চাচা বাড়ি কোথায়?
অনেক দূরে বাবা। কুড়িগ্রাম।
বাড়ি যান না?
যাই। দুই ঈদে।
কে কে আছে বাড়িতে?
ছেলে মেয়ে চারজন। আর বাবা-মা।
কার বাবা-মা? আপনার?
হ্যাঁ।
আপনার বউ নেই?
না। মারা গেছে।
বিয়ে করেননি আর?
না। ঝামেলা বাবা। ঝামেলা।
রাস্তার পাশে ওষুধের দোকানে নয়নাকে দেখে রিকশাঅলাকে থামতে বলল রবিন। তারপর যে-ই নামতে গেল, অমনি ধাক্কা খেল ফুল হাতে এগিয়ে আসা মেয়েটার সঙ্গে। রবিনের চোখ নয়নার দিকে ছিল বলে মেয়েটাকে দেখতে পায়নি সে।
রবিন মেয়েটার দিকে তাকিয়ে একটা ভিরমি খায়। মারাত্মক সুন্দর তো মেয়েটা! লম্বাও। কম করে হলেও পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি হবে। বয়স কত হবে মেয়েটার? বারো কি তের। এই বয়সেই এত লম্বা! অথচ...। একটা দীর্ঘশ্বাস আটকায় রবিন।
ইদানিং রবিন ফুল বিক্রেতা মেয়ের দিকেও হা করে তাকিয়ে থাকে। এমন কী, কম বয়সী মেয়ে ভিক্ষুককেও খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে সে। এত অধঃপতন কবে থেকে হলো ওর? এ প্রশ্নের উত্তর রবিন জানে। নয়নার সঙ্গে প্রেম হওয়ার পর থেকেই রবিনের চোখ শুধু এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়। ঘুরে ঘুরে মেয়ে খোঁজে। তাদের সৌন্দর্য দেখে সে মুগ্ধ হয়। মুগ্ধ হয়ে হতাশ হয়। হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কখনো বা দীর্ঘশ্বাস লুকায়।
অথচ এমন ছিল না সে। ছোটবেলা থেকে লাজুক, ভদ্র, রুচিশীল হিসেবে তার একটা পরিচিতি ছিল। মেয়েদের বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সম্মানসূচক। যখন সে স্কুলে পড়েছে, যখন সে কলেজে পড়েছে, তার সহপাঠীরা যখন মেয়েদের পেছনে ঘুরঘুর করত, আজেবাজে কথাবার্তা বলত-লজ্জায় মরে যেত সে। রবিন ভাবত, এই ছেলেগুলোর কি আত্মসম্মানবোধ নেই। তারা কি জানে না এমন করলে মেয়েরা তাদেরকে অসভ্য ভাবে? অন্যরা অসভ্য ভাবুক- কোনো মানুষ কি এটা চাইতে পারে? অথচ এই ছেলেরা যেন সেটাই চায়। আশ্চর্য!
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও একই বোধ রবিনের মাঝে কাজ করেছে। এ নিয়ে বন্ধুদের টিটকারিও কম শুনতে হয়নি তাকে। চাকরিতে প্রবেশ করার পর নারী সহকর্মীদের প্রতি তার সম্মানবোধে একটুও চিড় ধরেনি।
কিন্তু সবকিছু উল্টাপাল্টা হয়ে গেল নয়নার সাথে প্রেম হওয়ার পর। কোন একটা বইতে রবিন পড়েছিল বিয়ের পরে পুরুষরা অসভ্য হয়ে যায়। তারা অন্য মেয়ের দিকে তাকিয়ে মেলানোর চেষ্টা করে কে সুন্দর-মেয়েটা নাকি ঘরের বউ? এবং প্রতিবারই মেয়েটাকে তাদের কাছে সুন্দর লাগে। তখন তাদের দীর্ঘশ্বাস বের হয় এবং দৃষ্টি লোভী হয়।
কিন্তু রবিন তো এখনো বিয়ে করেনি। প্রেমে পড়েছে মাত্র। আর প্রেমে পড়েই সে অন্য মেয়ের দিকে তাকিয়ে মেলানোর চেষ্টা করে কে সুন্দর- মেয়েটা নাকি নয়না? এবং প্রতিবারই মেয়েটাকে তার কাছে সুন্দর লাগে। তখন তার দীর্ঘশ্বাস বের হয় এবং দৃষ্টি লোভী হয়।
বিবাহিত পুরুষদের ব্যাপারটা সে বোঝার চেষ্টা করে। বিয়ের পরে কখন বউকে তার অসুন্দর লাগতে শুরু করে? সাধারণ বোধ-বুদ্ধি দিয়ে রবিন উত্তরটা মেলায়।
কিন্তু রবিনের বেলায় তো সে রকম কিছু ঘটেনি। নারীর সৌন্দর্যের রহস্য, নারীর শরীরের রহস্য- এখনো তার কাছে দুর্ভেদ্য রহস্যই। অসংখ্যবার নয়, একবারও সে সেই রহস্যের আগল খোলেনি। বিবাহিত পুরুষরা যা অসংখ্যবার খুলতে খুলতে ক্লান্ত হয়ে যায়। ক্লান্ত হয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এক সময়ের কৌতূহল বিরক্তিতে পরিণত হয়। তার আগ্রহ আর কৌতূহল তখন অন্য নারীতে ভর করে। তাই চলতে ফিরতে পথেঘাটে সে লোভী দৃষ্টিতে নারী খুঁজে বেড়ায়। এবং কৌতূহল আছে বলেই তাদেরকেই আকর্ষণীয় মনে হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়তো বা পুরুষের তেমন কিছু করার থাকে না। তাই দীর্ঘশ্বাস তার সঙ্গি হয়।
কিন্তু রবিন তো এখনো সংসারের বন্ধনে আবদ্ধ হয়নি। তাহলে সে কেন দীর্ঘশ্বাস লুকাবে? তার যদি কোনো হতাশা থাকে সেটা সে চাইলেই জয় করতে পারে। রবিন তো মাত্র প্রেম করছে। বিয়ে তো করেনি।
ফুলওয়ালা মেয়েটার দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকে রবিন। রোদে পুড়ে লালচে হয়ে গেছে মেয়েটার চেহারা। রবিন একটা ঢোক গিলে। সারাদিন ধুলাবালি-রোদের মধ্যে থাকে। তবু কী সুন্দর মেয়েটার নাক, চোখ, ঠোঁট! রবিন শিউরে ওঠে। কল্পনায় মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে। জড়িয়ে ধরে আদর করে। আদর করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
মেয়েটা ভ্যাঁ করে কেঁদে দেয়। কাঁদতে কাঁদতেই রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফুলগুলো ডালায় তুলতে থাকে। ফুলগুলোর পাপড়ি ঝরে গেছে। বালিও লেগেছে অনেক। মেয়েটা ফুঁ দিয়ে বালি ঝরানোর চেষ্টা করল কিছুক্ষণ। পারল না। তার কান্নার শব্দ আরও বেড়ে গেল।
এবার পুরোপুরি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ওঠে রবিন। ফুল বিক্রেতা মেয়ের সৌন্দর্যচিন্তা হঠাৎ মিইয়ে যায়। তার সঙ্গে ধাক্কা লেগে মেয়েটার সব ফুল নষ্ট হয়েছে। তার উপার্জনের ওপরই হয়তো নির্ভর করছে পুরো পরিবার। রবিন নিজেকে মারাত্মক অপরাধী ভাবে। মেয়েটার জন্য কিছু একটা করতে ইচ্ছে করে তার। মেয়েটা উপুড় হয়ে ফুল তুলছিল। রবিন তার বাহু ধরে বলল, শোনো।
মেয়েটা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কী?
বাসায় কে কে আছে তোমার?
মা আছে। আর চার ভাইবোন।
বাবা নাই?
না।
রবিনের বুকটা হুহু করে উঠল। বলল, যাবে আমার সঙ্গে? চাকরি করবে?
মেয়েটার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বাম হাতের পাতা উল্টিয়ে চোখ দুটো মুছে ফেলল সে।
এখানে কী করছ তুমি? নয়না এসে মেয়েটার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে বলে, কী হয়েছে এখানে?
রবিন আরেকবার ভ্যাবাচ্যাকা খায়। ফুলওয়ালা মেয়েটা তো আসলেই সুন্দরী! নয়না পাশে এসে দাঁড়ানোয় মেয়েটার সৌন্দর্য যেন আরও স্পষ্ট হয়ে ঠিকরে বেরুচ্ছে। রবিন একবার মেয়েটার দিকে আবার নয়নার দিকে তাকিয়ে একটা ঢোক গিলল।
নয়না ধমক দিয়ে বলল, কী হয়েছে এখানে? কিছু বলছ না যে?
রবিন আরেকটা ঢোক গিলে বলে, তেমন কিছু না। আমার সঙ্গে ধাক্কা লেগে ওর ফুলগুলো পড়ে গিয়েছে।
তাতে কী? এটা হতেই পারে। অ্যাকসিডেন্ট।
হ্যাঁ, হ্যাঁ অ্যাকসিডেন্ট।
তাহলে এখানে সময় নষ্ট করছ কেন? ওকে কিছু টাকা দিয়ে দাও। চলে যাক।
রবিন চুপসে গিয়ে জমে যায়। কোথায় নয়না একটু আফসোস করবে-তা না। উল্টো বলছে কিছু টাকা দিয়ে দাও, চলে যাক। মেয়েরা আসলেই নিষ্ঠুর। দয়ামায়ার ছিটেফোটা নেই। নাকি তাদের দয়ামায়া শুধু ছেলেদের ক্ষেত্রে? মেয়েদের বেলায় ওরা কাঠখোট্টা। তা সে যে মেয়েই হোক না কেন?
বিরক্ত হয়ে রবিন প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে।
মেয়েটা মুখ ঝামটা মেরে বলে, আপনে একটা ভণ্ড। তারপর হনহন করে চলে যায়।
নয়না বলে, ভারী বেয়াদব তো মেয়েটা। এই, ও তোমাকে ভণ্ড বলল কেন?
আমি জানি না।
কী বলেছ তুমি ওকে?
কিছু তো বলিনি। শুধু ধাক্কা লেগে ফুলগুলো পড়ে গিয়েছে।
হ্যাঁ। শুধু ধাক্কা লেগে ফুলগুলো পড়ে গিয়েছে? তাতে তো তোমাকে শালা টালা গালি দিতে পারত। ভণ্ড বলল কেন?
এই গালিটা হয়তো তার পছন্দ। বাদ দাও। তুমি এখানে কী করছিলে?
নয়না ঠোঁট বাঁকা করে বলে, ওষুধ কিনতে এসেছি।
কার অসুখ? তোমার?
কারও অসুখ না।
তাহলে?
অত প্রশ্ন কোরো না। তুমি বুঝবে না।
আহা, বুঝিয়ে বললে বুঝব না কেন? আমি ছোট নাকি?
ছোটই তো।
রবিনের দিকে তাকিয়ে নয়না হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে একটা রিকশা ডাকে। রবিনকে বলে, ওঠ।
কোথায় যাব?
ওঠই না। জাহান্নামে যাব। আমার সঙ্গে জাহান্নামে যেতে পারবে না?
রবিন নিস্পৃহ গলায় বলে, পারব।
তাহলে ওঠ।
রবিন রিকশায় উঠে বসে। নয়না হুড তুলে দিয়ে আরও ঘন হয়ে বসে। রবিনের কাছে ভালো লাগে না এসব। ফুলওয়ালা মেয়েটা ওর মনটাকে আচ্ছন্ন করে আছে। ওকে কিছু টাকা দিতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু নিল না তো সে। মেয়েটার আত্মসম্মানবোধ দেখে অনেকক্ষণ পর অবাক হয় রবিন।
নয়না বলে, কী হলো, মুখ গোমড়া করে বসে আছ কেন? ভালো লাগছে না? তাহলে নেমে যাই।
না না। ভালো লাগছে। সারাদিন দৌড়ের ওপর ছিলাম তো। কিছুটা ক্লান্তি লাগছে।
শুক্রবারে তোমার কিসের এত ব্যস্ততা?
বাসা খুঁজছিলাম।
আমাদের জন্য?
রবিন নিস্পৃহ গলায় বলে, না আমাদের জন্য।
নয়না আরও ঘনিষ্ঠ হয়। এক হাতে রবিনকে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের কাছে নিয়ে আসতে চায়। তারপর বলে, মিথ্যে করে হলেও বলো না- আমাদের জন্য।
রবিন বলে, বললাম তো।
নয়না ঝুঁকে এসে রবিনের ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ায়।
রবিন বলে, সত্যিই ক্লান্তি লাগছে।
নয়না বলে, তোমার সব ক্লান্তি এভাবেই শুষে নেব আমি। সারাজীবন।
উষ্ণ স্পর্শে রবিন এবার পুলকিত হয়। এই স্পর্শ নয়নার। কিন্তু নয়নার জায়গায় রবিন ফুলওয়ালা মেয়েটার কথা কল্পনা করে । আনমনা রবিন অন্যরকম পুলকের রাজ্যে ডুবে যায়।
নয়না বলে, কিছু খাব। ঝাল কিছু। মাথাটা ধরেছে।
হুঁ।
ফুচকা বা চটপটি।
হুঁ।
শুধু হুঁ হুঁ করছ কেন? নয়না ক্ষেপে যায়।
রবিন আস্তে আস্তে বলে, খাব। ফুচকাই খাব।
এ্যাই, মাথাটা খুব ধরেছে।
ওষুধ খেয়ে নাওনি কেন? ওষুধ কিনেছ না?
ধ্যাৎ। ওষুধ মাথাধরার জন্য কিনিনি।
তাহলে?
এ্যাই।
কী?
মাথাটা একটু টিপে দাও না।
এই রিকশায় বসে?
তাহলে তোমার বাসায় নিয়ে যাও আমাকে। নয়না হেসে দেয়। হাসতে হাসতে রবিনের ডান হাতটা নিজের কপালে রেখে বলে, টিপে দাও।
রবিন টিপতে থাকে। কপাল, মাথা, গাল। চোখ বন্ধ করে টিপে। নয়নার নয়। ফুলওয়ালা মেয়েটির।
মন্তব্য
নয়নার তো মনে হচ্ছে অসহনীয় মাথাব্যথা
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
প্রেমিক যদি এমন গবেট হয় তবে মাথা তো ব্যাথা করবেই।
প্রেমিকরা গবেটই হয়
কি কইলেন
কন তো হাসা কতা কিনা? প্রচণ্ড ভাববার মতো একটা বিষয়
ডাকঘর | ছবিঘর
আর হ্যাঁ। লেখার শেষে আগের লেখার লিঙ্ক এবং নিচে আপনার নামটা একটু লিখে দিয়েন। উপন্যাস ভালো চলছে । আর একটা কথা লেখায় প্যারাগ্রাফ মানে একটু স্পেইস রেখে দিলে পড়তে আরাম লাগে
ডাকঘর | ছবিঘর
কতা হাছা। এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত বলেছি আমার উপন্যাস 'প্রেম পৃথিবীর পাঁচালি'তে।
আর হ্যাঁ, আগের লেখার লিংক কেমনে দেয় জানি না।
এবার নিজের নামটা লিখতে ভুলে গেছি। স্পেস দেয়ার কথা মনে থাকবে।
লেখাটা যখন টাইপ করেন সচলে এসে তখন দেখবেন উপরে কতগুলি অপশন আছে - যেমন 'হাসিমুখ', 'ইটালিক', 'ছবি যুক্ত বা সম্পাদনা' ইত্যাদি। এমনই একটা অপশন আছে - 'লিঙ্ক যুক্ত/সম্পাদনা' নামে । ওটাতে ক্লিক করুন তারপর লেখার ইউ আর এল টা দিন. URL Address - টাস্কবারে আছে । যেমন আপনার এই লেখার হল - http://www.sachalayatan.com/guest_writer/42543
ঠিক আছে। এইবার এক ঘরে URL Address দিন আর লেখার ঘরে লিখুন কোন পর্ব এটা । যেমন এটা ২য় পর্ব ...
দেখুন আমি করে দিচ্ছি - ২য় পর্ব ।
খুবই ইজি ট্রাই করুন... হয়ে যাবে ।
লেখালেখি চলুক আপনার। খুব ভালো লিখছেন
ডাকঘর | ছবিঘর
আপনাকে অনেক... অনেক... অনেক ধন্যবাদ
ভাল লেগেছে।
চমৎকার। তবে যা বল্লেন সেটা বিবাহিত ভাই ও আপুদের দিয়ে ভেরিফাই হয়ে আসা উচিত, নাইলে টেনশনে পড়ে যাব।
নতুন মন্তব্য করুন