ইংরেজ জোসি কন্ডের১ সাহেব ঘুরতে ঘুরতে আমাদের ঢাকা শহর আসেন ১৮২৪ সালে। তাঁর ১৮২৮ সালে প্রকাশিত বই The modern traveller: a popular description, geographical, historical, and topographical of the various countries of the globe, Volume 3 এর ১৩৪ পৃষ্ঠা হতে আমাদের প্রিয় ঢাকা শহরের বর্ণনার ভাবানুবাদ।
....................................................................................
শহরের নাম হিসেবে ঢাকা নামটা নতুন২, এখান থেকে তেরো মাইল দক্ষিন পূর্বে সোনারগাঁও শহরে এর পত্তন মনে হয়। ১৩৪০ সালে প্রথম স্বাধীন মুসলমান শাসক ফখরুদ্দিন সোনারগাঁয়ে ঘাঁটি গাড়েন, কিন্তু এখন তা একটা গ্রাম মাত্র। আকবরের আমলে রাজমহল (বর্তমান ভারতের ঝাড়খন্ডের সাহিবগঞ্জ জেলার শহর) কে রাজধানী করা হয়, কিন্তু ১৬০৮ সালে সুবাদার৩ ইসলাম খাঁ ঢাকাকে তাঁর রাজধানীতে রূপান্তর করেন আর তৎকালীন মহান মোগল বাদশা জাহাঙ্গীরের নামানুসারে শহরের নতুন নাম দেন জাহাঙ্গীরনগর। এখানে তিনি প্রাসাদ দূর্গ সবই তৈরী করেন। কিন্তু পরে ১৬৩৯ সালে মোগল বাদশা শাজাহানের দ্বিতীয় পুত্র শা সুজা বাংলার সুবাদার হয়ে এসে রাজধানী আবার রাজমহলে ফেরত নিয়ে যান। আবার ১৬৫৭ সালে আওরঙ্গজেবের প্রধান সেনাপতি মীর জুমলা ঢাকাকে রাজধানী হিসেবে বহাল করেন। এই সময় ঢাকা ঐশ্বর্যে পূর্ণ হয়ে ওঠে, তখনকার ধ্বংসাবশেষ দেখে মনে হয় ধনদৌলতে ঢাকা সারা ভারতের যেকোন শহরের সাথে পাল্লা দিতে পারতো। মোগলেরা এইখানে বিশাল নৌঘাঁটি বসিয়েছিলো, ৭৬৮ টি বিধ্বংসী যুদ্ধজাহাজ টহল দিত এদিকে। দক্ষিন সীমান্তে আরাকান জলদস্যুদের উৎপাত ঠেকাতেই এই ব্যবস্থা।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিকে মহান আওরঙ্গজেবের নাতি আজিমুশশান ঢাকায় থানা গাড়েন। একটা অসম্ভব সুন্দর প্রাসাদ তিনি প্রায় তৈরী করে এনেছিলেন। শহরতলী মিলিয়ে ঢাকা প্রায় ছয় মাইল বিস্তৃত, অন্যান্য স্থানীয় শহরের মতই এখানে বাড়ীঘর কিছু ইটের কিছু খড়ের। রাস্তাঘাট অসম্ভব সরু আর ভাঙ্গাচোরাও বটে। বিশপ হেবেরের৪ মতে এই জায়গাটা চিতপুরের কাছে কোলকাতার নিকৃষ্টতম অংশগুলোর মতই, কিন্তু তাও হঠাৎ হঠাৎ দেখা যায় কিছু মনোমুগ্ধকর ঘরবাড়ীর ধ্বংসাবশেষ। বিশপের মতে নির্মানকৌশল "অবিকল মস্কোর ক্রেমলিনের মত"। মুসলমানদের প্রাবল্যে মন্দিরের সংখ্যা অল্প, আর প্রায় সব ইটের বাড়িতে আরবী ফারসী খোদাই করা। এগুলো দেখলে মনে হয় অনেক পুরোন, কিন্তু আসলে এগুলোর বয়স বেশী না। কোলকাতার তুলনায় ইয়োরোপীয়দের বাড়িগুলি সাইজে ছোট, আর বাড়ীগুলি এত দূরে দূরে আর চারপাশে এত ঝোপজঙ্গল যে এদের খুবই অস্বাস্থ্যকর দেখায়। একর বিশেক জায়গা মিলিটারিদের জন্য পরিষ্কার করা হয়েছে, বাকী জায়গাগুলো অবহেলায় পড়ে আছে। নদীর তীরে চমৎকার ভিউ সম্পন্ন গ্রীক স্টাইলে তৈরী নবাবের বাড়িগুলি বছর কয় আগে নদীর জোয়ারে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। প্রাসাদ, বড় মসজিদ, নবাবের বাড়ি, ওলন্দাজ ফরাসী পর্তুগীজের তৈরী কুঠি আর গীর্জা সবই আজ ধ্বংস। ইংরেজ বিচারক মাস্টার সাহেব একটা পুরোনো রাজবাড়ীতে বাঘ মারতে গেলে একটা আস্ত হাতী ঝোপজঙ্গলের আড়ালে কূয়ার ভিতর পড়ে যায়।
হেবের সাহেবের ভাষ্যে, "শহরে এখনো কিছু আর্মেনীয় আছে, তাদের কেউ কেউ বিরাট ধনী। অল্পকিছু পর্তুগীজ, ভারি গরীব আর নীচপ্রকৃতির। কিছু আছে গ্রীক, তারা বেশ বুদ্ধিমান। ইংরেজের সাথে তারা মেলামেশা রাখে আর সরকারী কাজেও তারা আগ্রহী"। একটা খুব সুন্দর গথিক ইংরেজ গীর্জার ক্লার্ক গ্রীক। ইংরেজ বলতে কিছু নীলচাষী, সিভিল সার্ভিস আর মিলিটারির লোক, এছাড়া তেমন কেউ নেই। অবশ্য একটা মিশন আছে সেই ১৮১৬ সাল থেকে, সেখানে ইংরেজী, হিন্দুস্তানী আর বাংলা ভাষায় ধর্মপ্রচার করা হয় আর স্কুল চালানো হয়। বাণিজ্যে ঢাকা শহর ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে, স্থানীয় তুলা কাঁচাই ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়, আর ইংরেজ মাল ভারি সস্তা দেখে এখানে খুব চলে।
সারা বাংলায় ঢাকা স্বাস্থ্যকর স্থান হিসেবে পরিচিত। খুবই আরামের আবহাওয়া, পাশেই বয়ে চলা বিস্তৃত নদীর কল্যাণে তেমন গরম বোধ হয়না। আর নদীর খরস্রোতে শহরের সব ময়লা আবর্জনা ধুয়ে নিয়ে যায়, হুগলী নদীতে এইটা হয়না। কোলকাতার মতন কুয়াশা বা চট্টগ্রামের মতন ভারী বৃষ্টি কোনটাই এদের নেই। যদিও ঢাকা রোগমুক্ত নয়, ১৮২৬ সালে কলেরায় ১৫০০ এর অধিক লোক মারা যায়, সকলে শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিলো আর কোর্টকাচারীও মাসতিনেক বন্ধ ছিলো। মেজর রেনেলের৫ আঁকা ম্যাপের চেয়ে অনেকটাই সরে এসেছে এখন নদী। তখন ছিলো সরু নদী, কিন্তু এখন এমনকী শুকনো মরসুমেও নদী কোলকাতার হুগলী নদীর চেয়ে অনেক চওড়া। তবে ছোট নৌকা ছাড়া কোন জাহাজ এ নদীতে আসেনা, তীরের জমি তেমন মজবুত নয়। কিছু জাহাজ মাঝে মাঝে লক্ষীপুর পর্যন্ত আসে, কিন্তু বেশীরভাগই চট্টগ্রামে নোঙ্গর করে। বার্মার সাথে বাংলার যুদ্ধে ঢাকার কলজে শুকিয়ে গিয়েছিলো, বিশপ বলেন "যদি বার্মিজেরা সত্যই শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজ নিয়ে পাশের টেকনাফ পর্যন্ত আসতে পারতো তাহলে ঢাকা কব্জা করে নিতে তাদের বেশি সময় লাগতো না"।
(পরের পর্বে সমাপ্য)
সত্যপীর
eval(unescape('%64%6f%63%75%6d%65%6e%74%2e%77%72%69%74%65%28%27%3c%61%20%68%72%65%66%3d%22%6d%61%69%6c%74%6f%3a%6d%69%72%31%37%38%40%79%61%68%6f%6f%2e%63%6f%6d%22%3e%6d%69%72%31%37%38%40%79%61%68%6f%6f%2e%63%6f%6d%3c%2f%61%3e%27%29%3b'))
...................................................................
"ওয়া লাল আখিরাতু খাইরুন লাকা মিনালে উলা"
অতীতের চেয়ে নিশ্চয় ভালো হবে ভবিষ্যত।
মন্তব্য
ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধ্বে, যখন ঢাকা থেকে টেকনাফে যেতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগতো, তখন তো দূরের কথা আজকেও যদি দুনিয়ার সেরা নৌবাহিনী টেকনাফে ঘাঁটি গাড়ে তাহলেও তাদের পক্ষে ঢাকাকে কব্জা করতে কালোঘাম বের হয়ে যাবে। আর ঐসময় এটা নিশ্চিতভাবেই অসম্ভব একটা ব্যাপার ছিল। সত্যপীর, ভেবে দেখুন তথাকথিত ঐতিহাসিকেরা সত্য ঘটনা/বর্ণনার সাথে কী রকম ব্যক্তিগত মতামত বা বাজারী গল্প মিশিয়ে দেয়!
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ইংরেজ যত সহজে ঢাকা "কব্জা" করতে পেরেছে তত সহজে বার্মা দখল করতে পারেনি, আরাকান মগ আর পর্তুগীজরা পুরোটা সময়ই ইংরেজদের দৌড়ের উপর রেখেছে। তাই আরাকান আর পর্তুগীজরা ইংরেজদের বর্ণনায় শুধুই জলদস্যুর দল, কোনদিন কোনজায়গা কব্জা করে ফেলে সেই চিন্তায় এরা অস্থির। অন্য একটা ইংরেজী বইয়ে পড়ছিলাম মোগল থেকে ইংরেজ সবাই চট্টগ্রাম দখল করে আর কয়দিন পর আবার শহরটা আরাকানরাজের হাতে চলে যায়।
চমৎকার পর্যবেক্ষনের জন্য আপনাকে।
অনুবাদ ভাল হচ্ছে
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
হাতিটার জন্য মায়া লাগছে। ম্যানহোলে পড়ার ঐতিহ্য দেখি সুপ্রাচীন!
মায়া লাগারই কথা, বেচারা হাতী নিশ্চয়ই ঐ কূয়াতেই আটকে মারা গেছে। দেশভর্তি হাতী ছিল তখন, দুয়েকটা মরলে কি আসে যায়!
মন্তব্যের জন্য ।
আপনার সেই ফরাসি পর্যটকের পোস্ট পড়ে মনে হয়েছিলো, ইংরেজ ছাড়া অন্য কারো চোখ দিয়ে দেখা বাংলার খোঁজ তো করা হয়নি। আমার ফরাসি জ্ঞানের দৌড় খুব বেশি নয় বলে জার্মান বই খোঁজ করলাম। গুগল বুকসে কিছু পেলাম, সেগুলোতে ভারতবর্ষ নিয়ে কথাবার্তা আছে, কিন্তু বাংলার ওপর তেমন নেই। লাইব্রেরিতে রেফারেন্স সেকশনে গিয়ে খুঁজে দেখতে হবে কিছু পাই কি না। আপনার সিরিজটা চলুক, উপভোগ করছি। মন্তব্য না করলেও অনুসরণ করছি, এটা জানিয়ে রাখলাম।
ফরাসী জার্মান আমি কিছুই জানিনা, ভাঙাচোরা ইংরেজীই ভরসা। বাংলার খোঁজ পাওয়া আসলেও শক্ত, থাকলেও অল্প কিছু। ইদানিং ড্যানিশ ইন্ডিয়া নিয়ে লিখা খুঁজছি, পশ্চিমবাংলায় ফ্রেডরিকসনগর বলে তাদের একটা কুঠি ছিলো। দুঃখের কথা ওগুলোর অনলাইন দলিলপত্র সবই ড্যানিশ ভাষায়, তাই একটু চিপায় আছি। ভালো কিছু পেলে ঠিক লিখা দেব।
ড্যানিশ ইন্ডিয়া নিয়ে পোস্ট পড়ার জন্য লাইনে খাড়াইলাম। ডাচদের নিয়েও কোন লেখা কখনো পড়িনি। পর্তুগীজদের নিয়ে সামান্য গালাগালিমূলক বর্ণনা ছাড়া বিস্তারিত পাওয়া যায় কম। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান জাতি (?) তৈরি হবার অনেক আগেই পর্তুগীজ-ইন্ডিয়ান জাতি বা কালা ফিরিঙ্গী তৈরি হয়েছিল।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
লাইনে যখন খাড়াইসেন মুড়িওলাকে ডাইকা কিছু ঝালমুড়ি খাইতে থাকেন, লাইনে কিছু সময় থাকতে হইতে পারে
ডাচ ড্যানিশ যেটাই হোক কিছু পেলে লিখা দিব নিশ্চিত থাকেন।
ইন্টারেস্টিং।
অনেক অনেক
আমিও পড়ছি।
লিখা শুরুর দিকে সচলে পাবলিশ হবে কিনা সেইটা নিয়ে বিরাট সংশয় ছিলো, আগে কখনো কোথাও লিখিনি। আপনাদের কমেন্ট পড়ে বুকে বল পাই, লিখা তত খারাপ হচ্ছেনা তাহলে। ধন্যবাদ পাশে থাকবার জন্যে।
০৭ এ হিমু ভাইয়ের মন্তব্যে হেসে দিয়েছিলাম। খুব ভালো লাগছে পড়তে। আচ্ছা, হাতি যে কুয়াটায় পড়েছিল, ঐটা কত বড় ছিল? "ম্যানহোল"/"এলিফ্যান্টহোল" নিয়ে চিন্তা করতেই কেমন জানি দুখঃ দুখঃ লাগছে হাতিটার জন্য।
লেখার জন্য
রাজবাড়ীর কূয়া হাতী পড়ে যাওয়ার মত বিশালই হওয়ার কথা। রাজাগজা টাইপ লোকজন সেকালে (একালেও আসলে) তেমন কিছু করতো না, কিন্তু খেতো পেটপুরে। বড়সড় কূয়ার পানি তাই অপরিহার্য! এছাড়া কূয়ার কিছু ফ্রিঞ্জ বেনিফিটও ছিলো নিশ্চয়ই, ধরেন রাজার বউ রাজার ভাইয়ের সাথে দুষ্টুমি করে ধরা পড়লে দুইটাকেই ধরে কূয়ায় ফেলে দিত।
হাতীর জন্য , আপনের মন্তব্যের জন্য
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
নতুন মন্তব্য করুন