১৬৯৮ সালে ড্যানিশরা প্রথম বাণিজ্য শুরু করে, মহান সম্রাট আওরঙ্গজেবের নাতি আজিমউদ্দিন দশ কিস্তিতে তিরিশ হাজার রূপির বিনিময়ে তাদের পরোয়ানা প্রদান করেন। ১৭৫৩ সালে ড্যানিশ প্রশাসক সক্টমান সাহেব চান্দেরনগরে১ থাকতেন কারন ওখানেই তাঁর মাল জাহাজ থেকে খালাস হত। পরে জাহাজভরে ভারতীয় মাল বোঝাই করে পাঠানোর সময় নবাবের কাস্টমস অফিসাররা ব্যাপক যন্ত্রনা করতো, তাই ড্যানিশ কর্তৃপক্ষ ঠিক করলেন বাংলায় নিজেদের একটা কুঠি চাই। তারা গিয়ে ধরলেন কাশিমবাজারের ফরাসী এজেন্ট ল২ সাহেবকে, মুর্শিদাবাদ দরবারে তাঁর বেশ আনাগোনা। বাংলার ভাগ্যাকাশে তখন দূর্যোগের ঘনঘটা, মুর্শিদাবাদে একে তাকে ম্যানেজ করে ল সাহেব জুলাই মাসের তিরিশ তারিখে শ্রীরামপুরে কুঠিস্থাপনের পরোয়ানা বের করে আনলেন।
নবাবী ফরমান অনুযায়ী কুঠি হবে অনধিক ষাট বিঘা। ড্যানিশরা ঠিক করলো শ্রীরামপুরে তিন বিঘা আর সাতান্ন বিঘা পার্শ্ববর্তী আকনাতে৩ স্থাপিত হবে, কারন আকনাতে জাহাজ ভেড়ানোর উপায় নেই কিন্তু কুঠির জন্যে চমৎকার ফাঁকা জমি। পুরো শ্রীরামপুর ষাট বিঘা নিতে গেলে বাড়িঘর সুদ্ধ কিনতে হত, তাতে আরো দশ বারোহাজার রূপি গচ্চা। তাই সক্টমান শ্রীরামপুরের নদীপাড় সংলগ্ন আকনার জমি দখল নিলেন। ১৭৫৫ সালের ৮ই অক্টোবর শ্রীরামপুরে ডেনমার্কের পতাকা ওড়ানো হয়, চারটে গার্ডও বসানো হয় পোস্টে। ফরমান আর তিন নবাবের উপঢৌকনবাবদ মোট এক লাখ ষাট হাজার রূপি খরচ হয়। সেকেন্ড ইন কম্যান্ড জ্যগেনবাল্ক ১৫ই ডিসেম্বর জমি আবার মেপেজুকে নেন, ঠিক হয় কুঠির চারদিকে মাটির দেওয়াল আর উপরে খড়ের ছাউনি উঠবে। দেখভাল করবার জন্য একজন পাওয়া গেলো, সে প্রস্তাব দিলো তাকে লেফটেন্যান্ট বানানো হলে মাসিক চল্লিশ রুপীর বিনিময়ে সে কুঠির গভর্নর হতে রাজী আছে। সক্টমান আর জ্যগেনবাল্ক কাউন্সিলে পাস করলেন যে মাস গেলে চল্লিশ রূপি দেওয়া হবে ঠিকই কিন্তু আলাদা ঘর বা বাতির ব্যবস্থা করা হবেনা। ইংরেজ কোলকাতা দখল করার পর তরুন সিরাজউদ্দৌলা যখন এই কুঠির পাশ দিয়ে প্রতিশোধ নেবার জন্য ৫০,০০০ সৈন্য নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তিনি হুকুম দিয়েছিলেন কুঠির সকল সৈন্য, ঘোড়া আর কামান সহকারে গভর্নর যেনো তাঁর সাথে এগিয়ে যায়। গভর্নর উত্তর দিয়েছিলেন তাঁর হাতী ঘোড়া বন্দুক কিছুই নেই, মাটির ঘরে তিন চারটা চাকরবাকরই তাঁর সম্বল।
বাংলায় অন্যান্য ইয়োরোপীয় কুঠির মতই ফ্রেডরিকসনগর ফুলেফেঁপে উঠছিলো, ইংরেজ কোম্পানীর লোকজন তাদের একরকম আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়াল। খুলে কই। প্রথম প্রথম ইংরেজ করতো কি, লাভের টাকা স্থানীয় মুদ্রায় পাঠাত দেশে। বাংলার সরকার এই সুযোগে ব্যাপক ধার করার সুযোগ পেয়ে গেলো, আর টাকা ইংল্যান্ডে পৌঁছাতে দেরি হতে লাগলো। ব্রিটিশ অফিসাররা তখন স্থানীয় মুদ্রার বদলে অন্যান্য ইয়োরোপীয় কুঠিয়ালদের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করলো। এইরকম মুফতে এককাঁড়ি টাকার গন্ধে ড্যানিশ বাণিজ্য তরতর করে এগোতে থাকলো। আমেরিকা যুদ্ধের শেষদিকে ইংল্যান্ড তিন নৌজাতি আমেরিকা, ফ্রান্স আর হল্যান্ডের সাথে কাইজা বাঁধিয়ে বসে ছিলো, এছাড়া ছিল হাড়বজ্জাত জলদস্যুর দল। ফলে ইংরেজ জাহাজ চড়া প্রিমিয়ামে ইনসিওরড করা থাকতো।
শ্রীরামপুরের বড় সুদিন যাচ্ছিলো তখন। যুদ্ধের আগে দিয়ে বন্দর ছেড়ে নয় মাসে কমপক্ষে বাইশটি জাহাজ যাত্রা করেছিলো, মোট দশ হাজার টন কি তারও বেশি মালবোঝাই করে। ড্যানিশ কোম্পানীর যেমন লাভ হচ্ছিলো কোম্পানীর লোকের লাভ হচ্ছিলো তার কয়েকগুণ। এরা মাসে দুইশ রূপি বেতনে ডজন শ্যাম্পেন ৮০ রুপীতে গিলতো, আর কয়েক বছর পর মোটা টাকা পকেটে পুরে ডেনমার্ক ফিরে যেত। কোলকাতার জন পামার, ড্যানিশ কোম্পানীর এজেন্ট, দিনের পর দিন কাটাতেন শ্রীরামপুরের গোডাউনে মাল গুনে আর ওজন করে। তাঁর বেতন বছরে লাখ রুপীর কম মোটেই ছিলনা।
১৮০১ সালে ইঙ্গ-ডেন যুদ্ধে প্রথম শ্রীরামপুরের বাণিজ্যে ধস নামে। ইংরেজদের ড্যানিশদের উপর চটার অন্য কারনও ছিলো। ফরাসী জলদস্যুদের যন্ত্রনায় জাহাজ ইন্সুরেন্স প্রিমিয়াম তখন আকাশছোঁয়া, কোলকাতার সওদাগররা ইংরেজ জাহাজের বদলে নিউট্রাল ড্যানিশ জাহাজে ড্যানিশ কমান্ডারের অধীনে মাল পাঠাতে শুরু করলো। ইংরেজ ক্রমাগত লোকসান দিতে লাগলো, ফরাসীরা তাদের ডজন ডজন জাহাজ আটক করে ধ্বংস করে দিচ্ছিলো। ১৮০৮ সালে ড্যানিশ বাণিজ্যের টিমটিমে বাতি জন্মের মত নিভিয়ে দেয় ইংরেজ। কোপেনহেগেনে ইংরেজ আক্রমনের খবর পেয়ে পার্শ্ববর্তী ব্যারাকপুর থেকে নদী পার হয়ে স্থানীয় ইংরেজ ড্যানিশ কুঠি দখল করে বসে। তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড মিন্টোর পুত্র ক্যাপ্টেন জর্জ এলিয়ট ফ্রেডরিকসনগর বন্দরে নোঙ্গর করা তিনটে জাহাজভর্তি মাল জব্দ করেন। এই ঝাপ্টা সামলে ড্যানিশ কোম্পানী আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। ইউওরোপে গন্ডগোল মিটে গেলে ১৮১৫ সালে ফ্রেডরিকসনগর ইংরেজমুক্ত হয়, কিন্তু কোম্পানীর লালবাত্তি ততদিনে জ্বলে গেছে।
১৮১৫ সালের পরে মাত্র একটা জাহাজ বন্দর ছেড়ে ডেনমার্ক যাত্রা করে। ততদিনে ইংরেজ পণ্যে দেশীয় শিল্প সম্পূর্ণ ধ্বংস, আর দেশী মাল রপ্তানী করাটাই ড্যানিশ কোম্পানীর মূল ব্যবসা ছিলো। ডেনমার্কের মহান রাজা দিনের পর দিন লোকসানে তিতিবিরক্ত হয়ে ফ্রেডরিকসনগর আর ট্রাঙ্কেবার৪ এর পাট উঠিয়ে দেয়া ঠিক করলেন। ব্রিটিশদের কাছে মাত্র বারো লাখ রুপীর বিনিময়ে ফ্রেডরিকসনগর বিক্রি হয়ে যায় ১৮৪৫ সালের ১১ই অক্টোবর, সক্টমান সাহেব ডেনমার্কের পতাকা ওড়ানোর ঠিক নব্বই বছর পরে তা নামিয়ে ইউনিয়ন জ্যাক ওড়ানো হয়।
সত্যপীর
eval(unescape('%64%6f%63%75%6d%65%6e%74%2e%77%72%69%74%65%28%27%3c%61%20%68%72%65%66%3d%22%6d%61%69%6c%74%6f%3a%6d%69%72%31%37%38%40%79%61%68%6f%6f%2e%63%6f%6d%22%3e%6d%69%72%31%37%38%40%79%61%68%6f%6f%2e%63%6f%6d%3c%2f%61%3e%27%29%3b'))
মন্তব্য
কুঠির ব্যাপারটা আগে বুঝতাম না। পড়ে মনে হচ্ছে এটা অন্য দেশের মাটিতে নিজের দেশের একটা টুকরোর মতো। এমব্যাসির বাণিজ্যিক সংস্করণের মতো। নাকি?
এমব্যাসী ঠিকই, কিন্তু আসল কথা হল জাহাজ ভেড়ানোর জন্য নিজস্ব বন্দর থাকা চাই। ধরেন কোলকাতা ছিল ইংরেজদের এমব্যাসি, কেষ্টবিষ্টুরা থাকতেন ঐখানে, আবার কোলকাতা কুঠিও বটে কারন জাহাজ খালাস হত। কাশিমবাজার ছিলো শুধুই কুঠি, মালখালাসের কেন্দ্র। সুতরাং কুঠি কথাটার মানে আমার মনে হচ্ছে ফ্রি পোর্ট এবং মেজর ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টার।
ডাকঘর | ছবিঘর
ডেনিশ ইন্ডিয়া নিয়া মুলা দেখাইয়া কিঞ্চিত ঠকাইলেন (অবশ্য পাঠকদেরকে কখনোই সন্তুষ্ট করতে পারবেন না)। যাকগে, ওসব কথা থাক। বাংলা ভাষায় ডেনিশ ইন্ডিয়া নিয়ে এই প্রথম কোন লেখা পড়লাম। ডেনিশদের পুরো তৎপরতা নিয়েই লেখার চেষ্টা করুন; বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে আর ভারত মহাসাগরে। ইংরেজদের কাছে নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ বিক্রি করে দিয়ে কীভাবে তারা পাততাড়ি গুটালো সেগুলো নিয়েও লিখুন। আর একটা জুতসই ট্যাগ বের করে আপনার এই ধাঁচের লেখাগুলো ট্যাগিত করুন। তাতে পরে পাঠক রেফারেন্স হিসাবে খুঁজতে গেলে সহজে বের করতে পারবে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ভাইরে বাংলা ভাষায় ড্যানিশ ভারত নিয়া লিখতে হলে ইংরেজী ভাষায় কিছু পাইতে হবে আগে, মুলা দেখানোর জইন্য লজ্জিত। দুনিয়ার দলিলপত্র সবই ড্যানিশ কি জার্মান ভাষায়, ইংরেজীতে লিখা খুঁজে পাইনারে ভাই। চলছে "খোঁজ-The Search", কিছু পাইলে নিঘঘাত দিমু।
ট্যাগানোর ব্যাপারটা মনে ধরসে কিন্তু করতে পারবো কিনা কেজানে...ব্লগে নতুন মানুষ নিয়মকানুন ধরতে সময় লাগে।
আর এই নেন
(গুড়)
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
নতুন মন্তব্য করুন