হাফসা বেগম একবার প্রায় চলেই যাচ্ছিল। কি একটা যেন তারে হঠাৎ আটকে দিল। এই জান’টা আসলে কে নিয়ে যায়, কই যায়, আসমানে না অন্য কোনখানে, আজরাইল আইস্যা নিয়া যায় নাকি অন্য কেউ, নাকি এমনিতেই হাওয়া হয়ে উবে যায় কোন একখানে... কতইনা ভেবেছে সে একলা একা। হয়ত খাঁচাটার যখন আর কোন কদর থাকেনা, পৃথিবীর কাছে সে খাঁচা তার, যখন এক নিষ্প্রাণ জড় কাঠ তখন কি বা মুল্য তার, জানটাকে তখনই হয়ত চলে যেতে হয়।
হাফসা কিন্তু আগে এমনতর ছিল না। পিয়ার আলী যতদিন ছিল ততদিন ছিল যথেষ্টই জীবন্ত প্রাণ তার। দুই বুড়াবুড়ি দক্ষিনের ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে ঘরটায় ছিল অনেক বছর। গোয়ালের গন্ধ, মশাদের ঝাঁক, মাছি, পোকা সকলই উপেক্ষা করে তারা ছিল বহাল তবিয়তেই। একদিন হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই সকাল বেলায় চলে গেল পিয়ার আলী। না কয়ে এইভাবে কেউ যায়, সকালে উঠে হাফসা দেখে নিষ্প্রাণ শরীরটা পরে আছে মাটিতে উবু হয়ে। এখন একলা ঘরে সে কেমনে থাকবে একা। মানুষ কথা দিয়ে কেন রাখে নারে কথা। হাফসার অনেক ইচ্ছা ছিল কাদেরকে বলতে বড় ঘরটার খুপরির মধ্যে একটু জায়গা দিতে, ছেলেকে বলতে আর সে সাহস করে নাই।
বাড়িতে বড় ঘর হয়েছে আগেই। কাদেরের জমজ পোলা হয়, সংসার বড় হয়, বড় জায়গার দরকার পরে। একশ বছরের বয়স্ক ঘর ভেঙে ফেলতে হয় তাই। পোস্তা করা ঘর হয়, স্বাভাবিকভাবেই সে ঘরে জায়গা হয়না বুড়াবুড়ির। নতুনদের জায়গা ছেড়ে দিতেই হয়, পুরাতন’দের পৃথিবী সুনজরে দেখে না। ছেলে, নাতি নাতনী ভাল থাকবে এইত চাওয়া বুড়াবুড়ির।
সুদূর যৌবনে, পিয়ার আলী ছিল যথেষ্টই জাঁদরেল মানুষ। দশ গেরামের মানুষ তারে মান্য করত। আশ্চর্য হয়ে পৌঢ়ত্বে সে খেয়াল করে বার্ধক্য মানুষকে দুর্বল করে দেয়, আবার পিছিয়ে নিয়ে যেতে থাকে, আবার পৌঢ় শিশুতে নেমে যেতে থাকে ক্রমশ। যে ছেলেকে নিজ হাতে খাইয়ে পরিয়ে বড় করে তুলল, তার সামনে মাথা উচু করে কথা বলতে তার বুক কাঁপে, ছেলের কাছে সে নিতান্তই খড়কুটো বৈ আর কিছু না।
ছেলের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভ জমে ছিল বুড়ার মনে। অবাক বিস্ময়ে সে খেয়াল করে তার কিছুই বলতে সাহস হয় না। সে সত্যই শিশু হয়ে যাচ্ছিল, মিঠাই দেখলে যেমন বাচ্চা ছেলের জিহ্বায় জল আসে তাদেরও ঠিক একই ঘটনা। নাতীদের জন্য কত কিছু আসে, বুড়াবুড়ি দূরে দাড়ায়ে বুভুক্ষু কাকের মতো তাকায়ে থাকে। মনে পড়ে বুড়াবুরির, শুক্রবার হাঁট থেকে পীয়ার আলী কত কিছুই আনত, হাওয়াই মিঠাই, জিলাপা, বাতাসা। কাদের রাস্তায় দাড়ায়ে থাকত বাপের অপেক্ষায়। জীবন এক অমোঘ চক্রে এইভাবেই ঘোরে অহর্নিশ।
সম্ভবত প্রচণ্ড ইচ্ছা আর ক্ষুধা নিয়েই চলে গেল পিয়ার আলী। সে চলে যাবার কয়দিনের মাথায় হাফসা; যে ছিল অপেক্ষাকৃত কম বয়স্ক সে হুটহাট বুড়িয়ে গেল। কয়দিন যেতে না যেতেই সে অথর্ব নিষ্প্রাণ জড় মাংশপিণ্ড। মাছি এসে বসে শরীরের উপর, মশা চামড়া ভেদ করে শুঁড় ঢুকায় আধখোলা চোখের সামনেই কিন্তু বুড়ীর নড়ার ক্ষমতা নাই। অন্ধকার ভাঙা ঘরটায় যেটুকুন আলো বাতাস ছিল এতদিন সেও হঠাৎ উবে যায়, পিয়ার চলে যাওয়াতেই হয়ত ঘরটার এত অভিমান।
এক মাসের মাথায় বুড়ি ঘরে পরল। মাঘ মাসের প্রচণ্ড শীত। কাঁথা ভেদ করে শীতের বাতাস তার অস্থি মজ্জায় ধাক্কা দিচ্ছিল। ভাঙা বেড়ার ফাক গলে উত্তরী বাতাস তাকে পৃথিবীকে বিদায় জানানোরই তাগাদা দিচ্ছিল। এই কুয়াশায়, শীত কম্পিত অবয়ব নিয়েই দুয়ারে বসে হয়ত অপেক্ষা করছিল আজরাইল।
শেষ দায়িত্ব পালন করতে এই পর্বে কাদেরের আগমন। কাদের মনে মনে হাফ ছেড়ে বাঁচার নিশ্বাস ঝাড়ছে যদিও তার মনে সামান্য বিষাদ। বুড়াবুড়ি বাড়িতে উৎকট অতিরিক্ত ঝামেলা হয়ে থাকলেও খুব বেশি ঝামেলা পোহাতে হয় নাই কাদেরকে। সেও ব্যাপারটা ভালভাবেই জানে অনেক কিছুই করা হয় নি, বাপ তার হুট করেই চলে গিয়েছিল, তাই মায়ের ব্যাপারে আজ একটু অন্যমনস্ক, একটু বিষাদগ্রস্থ। স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা ঘরের মেঝেতে নিষ্প্রাণ মাকে নিথর পরে থাকতে দেখতে তার মন কিঞ্চিত চঞ্চল হয়।
সে বুড়িকে বড় ঘরটায় নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা করে। শেষ নিশ্বাস একটু ভাল ভাবেই ত্যাগ করুক। পাকা মেঝেতে চাটাই বিছায়ে উত্তর সিথানে শোইয়ে দেয়া হয়। আগরবাতি জ্বলে, সুর করে আয়াত পরে পাড়ার মহিলারা। বুড়ি জোরে জোরে শ্বাস নেয়। আজরাইল কি পাশেই বসা? নাকি কেউ নাই, আত্বাই নাই শরীরে, জীবনের নিয়মেই শরীরের শেষ সীমানায় মরে যেতে হয় জীবনকে?
এক ঘণ্টা যায়, পাঁচ ঘণ্টা যায় বুড়ির আর যাওয়ার নাম নাই, বিরক্তি এসে যায় সবার মনে। দিনটা কেটে যায়, বুড়ি পরে থাকে নিষ্প্রাণ প্রাণ নিয়ে। ভ্রু কুচকায় কাদেরের। একদিন যায়, দুই দিন যায় ... বুড়ির মুখ দিয়ে চিনির পানি ঢেলে দেয় ছালেহার মা। বুড়ি শুষে নেয়। বুড়ি বুঝি বেঁচে গেল এ যাত্রায়। বুড়িকে আবার রেখে আসা হল স্যাঁতস্যাঁতে ঘরটায়।
বুড়িকে শুইয়ে দেয়া হল পুরাতন ছারপোকার আখড়ায়। তিন দিনের দিন একটা মিউ শব্দে বুড়ি আঁতকে উঠে। বুড়ির দেহে যেন প্রাণ ফিরে আসল। বুড়ি চোখ মেলে চায়। বিশ্রী আর নোংরা বিড়ালটা কনকনে শীতে উষ্ণতা খুঁজছিল ঘরময়। বুড়ি কাঁথাকে সামান্য ধাক্কা দিয়ে ওর জন্য জায়গা করে দেয়। আদুরে গলায় গোঙাতে থাকে বিড়ালটা। ধীরে ধীরে কাছে ঘেঁষতে থাকে সে। বুড়ি ওর শরীরের উত্তাপ টের পায়, এই প্রচণ্ড শীতে বিড়ালটা তার জন্য একরাশ উষ্ণতা নিয়ে এসেছে।
বুড়ি বিড়ালটাকে ধরে পাশ ফিরে শোয়। বুড়ির ভীষণরকম ভাল লাগতে থাকে। অনেক দিন পর তাকে আর একেলা মনে হচ্ছেনা। দিন যায়, বুড়ির বরাদ্দের খাবার থেকে বিড়ালকে ভাগ দেয় সে। বিড়াল বিপুল উৎসাহে বুড়ির সাথে দিনযাপন করতে থাকে। কয়দিনের মধ্যে বিড়ালটার সাথে বুড়ির গভীর ভাব জমে উঠে। নানা রকম খেলাধুলা করতে থাকে। বুড়ির ভেবেই লজ্জা করতে থাকে, বাচ্চাদের মতই সে পাঠকাঠি ছুড়ে দিলে বিড়ালটাও পাঠকাঠি খামছে ধরে। এরকম ব্যাস্ত সময় তার ধীর্ঘ দিন কাটানো হয় নি।
বুড়ির দিন ভালই যাচ্ছিল। মাঝে মাঝেই পিয়ারের কথা মনে হয় তার। বিড়ালটা বাইরে যায়, আবার ঘুরে ফিরে চলে আসে। বুড়ি তার ফেরার অপেক্ষা করে, ফিরে এলে ওর সাথে খেলাধুলা করে। দুইজনে ভাগযোগ করে খায় শাকভাত, শুকনা ভাত, চেটে পুটে খায় চিংড়ি মাছের ঝোল।
বিড়ালের পশমে উকুন খোঁজে বুড়ি, সেদিন ধরে গোসল করিয়ে দিল ওকে, বিড়ালের সেকি ছটফট। পানির ব্যাপারে তার ভীষণ আপত্তি কিন্তু বুড়ীর তাতে ভ্রূক্ষেপ নাই। ওকে গোসল করিয়ে অনেক বড় কাজ সেরে ফেলার মত হাফ ছাড়ে বুড়ি। শরীর মুছায়ে দেয় সে, বিড়ালটা লেজ উঁচায়ে প্রতিবাদ জানায় যদিও সে জানে বুড়ীর হাত থেকে সে ছারা পাবে না।
বুড়ি ওইদিন যখন খেয়াল করল ব্যাপারটা, লজ্জায় তার গাল লাল হয়ে গেল। সে বিড়ালটার একটা নাম দিয়ে দিয়েছে। সে নিজের অজান্তেই বিড়ালকে পিয়ার বলে ডাকছিল, সে তাকে ওই নামেই ডাকবে বলে ঠিক করে। ওর সাথে এমনিতেই সারাদিন কথা বলে বুড়ি, বিড়ালও নিজের মতই উত্তর করে। বেঁচে থাকতে কোনদিন বুড়ি পিয়ারের নাম ধরে ডাকে নাই, আজ তার তাই ভীষণ রকম শিহরিত লাগে। মানুষটারে ইদানিং তার খুব বেশি মনে পরে। কি দরকার ছিল আগে আগে চলে যাওয়ার।
দিন যায়, মাসা যায়। কাদেরের জমজ ছেলে হাসেম কাশেম বড় হয়। কাদেরের সুখে শান্তিতে দিন কেটে যায়, সুর্য উঠে সুর্য ডুবে, বুড়ীর ব্যাস্ত সময় কাঠে স্যাঁতস্যাঁতে বিছানায়, পিয়ারের সাথে খেলেদুলে। ওইদিনটা ছিল একটু অন্যরকম। পিয়ারের ফিরে আসতে আসতে আজ সন্ধ্যা হয়ে যায়। হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে সে লুকিয়ে পরে কাথার তলে। বুড়ি তার আদুরে হাত বুলিয়ে দেয় ওর শরীরে। হঠাৎ রিতিমত রড হাতে ঘরে ঢুকে হাশেম আর কাশেম। ‘ওই বুড়ি, বিলাইডা কনেরে? ওরে মারমু’ বলে হাশেম। সে রড উচিয়ে পিয়ারকে খুঁজে। বুড়ি হুড়মুড় করে উঠে বসে, ‘ক্যান, কি করছে ওই? হ্যাঁ’ । ‘আমার দুধের গ্লাসে মুখ দিছে, তারপর তরকারীতে মুখ দিছে হালায়’ জবাব দেয় কাশেম। ‘ওরে মারমু’ দৃঢ় কণ্ঠে কয় সে। বুড়ি আঁতকে উঠে, মাজা সোজা করে ওদের সামনে দাড়ায় বুড়ি। ‘যা, আর খাবনা, তোরা যাহ’, বুড়ি কয় ওদের। ‘ওই বুড়ি চুপ, ওরে মাইর্যা ফালামু, সর’ বলে হাসেম। ‘ওই যে খ্যাতার তলে মার মার......’ চিল্লায় কাশেম। বুড়ি বাঁধা দেয়ার প্রচণ্ড চেষ্টা করে। ক্ষিপ্র গতি আর শক্তি ভর করি বুড়ির ভঙ্গুর শরীরে, কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। মাজায় লাগা রডের বাড়ি বিড়ালকে শোইয়ে দেয় মাটিতে। অস্ফুট গোঙ্গানি বের হয় পিয়ারের গলা দিয়ে, একরাশ ফেনিল লালা বের হয় বিড়ালটার মুখ থেকে। শরীরটা ওর কাটা মাছের মত তড়পায়। হাশেম কাশেমের উত্তেজিত চোখে মুখে দিকবিজয়ের আনন্দ। বুড়ি বিড়ালকে ধরে অঝোরে কান্নায় ভেঙে পরে। মারাত্বক আহত পিয়ারের দেহটা কুলে নিয়ে বিলাপ শুরু করে বুড়ি। হাশেম কাশেমর উত্তেজনায় ভাটা পরে। সামান্য শঙ্কাগ্রস্থ হয় ওরা। অবস্থা বেগতিক দেখে কেটে পরে ওরা।
বুড়ি পড়ে থাকে পিয়ারের নিষ্প্রাণ দেহকে কুলে নিয়ে।
সকাল গড়ায়, দুপুর গড়ায় বুড়ির অনুপস্থিতে কাশেম হাশেমের মা ঘরে উঁকি দেয়ার চেষ্টা করা। দরজা ধাক্কানোর পরও সারা মিলল না বুড়ির। তখন পাড়ার অনেকেই জড়ো হয়েছে বুড়ির ভাঙা ঘরের সামনে। হাশেম ছিদ্রি দিয়ে উঁকি মেরে চেচিয়ে উঠে ‘ওই কাশেম বিলাইডা মইর্যা রইছে, আয় ওরে কব্বর দেই’। কাশেম দৌড়ে এসে ছিদ্রে উঁকি দেয়। বড়রা দরজা ভাঙতে থাকে, বেশি কিছু করতে হয় না। সামান্য ধাক্কাতেই চৌকাঠ হতে খসে পড়ে দরজা। বুড়ি মুখ লুটিয়ে মরে পড়ে আছে, মরা বিড়ালকে কোলে নিয়ে তার নিঃসাড় দেহ উবু হয়ে পরে আছে ভেজা মাটিতে। হাশেম আর কাশেম মৃত বিড়ালটার লেজ ধরে টান মেরে বুড়ির মুষ্ঠি হতে বিচ্ছিন্ন করে পিয়ারের দেহ। ওদের এখন অনেক কাজ, এই বিড়ালকে কবর দিতে হবে, বড়রা যেমন মানুষ কবর দেয়, নয়লে মরদেহ গন্ধ ছড়ায়।
১২ ডিসেম্বর, ২০১১
সোয়াদ আহমেদ।
eval(unescape('%64%6f%63%75%6d%65%6e%74%2e%77%72%69%74%65%28%27%3c%61%20%68%72%65%66%3d%22%6d%61%69%6c%74%6f%3a%73%6f%77%61%64%61%68%6d%65%64%40%67%6d%61%69%6c%2e%63%6f%6d%22%3e%73%6f%77%61%64%61%68%6d%65%64%40%67%6d%61%69%6c%2e%63%6f%6d%3c%2f%61%3e%27%29%3b'))
মন্তব্য
___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে
লেখা বেশ! কিন্তু বানান ভুলগুলো অস্বস্তি জাগায়।
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
আপনার লেখার হাত বেশ ভালো। পড়তে ভালো লাগলো। তবে প্যারাগুলোর মাঝে আরেকটু গ্যাপ দিলে চোখে আরাম হয়। একদম শুরুটা একটু অন্যরকম শব্দ দিয়ে দিলে মনে হয় ভালো হত আরেকটু। প্রথম তিনটা লাইন পড়তে গিয়ে একটু হোঁচট খেয়েছি। আজরাইল শব্দটা আসার পরে ক্লিয়ার হল। আরও লিখুন।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
সবাইরে অসংখ্য ধন্যবাদ, লেখাটি পড়ার জন্য। শিশিরকনা এবং আশালতাকে বিশেষ ধন্যবাদ সুনির্দিষ্ট পরামর্শের জন্য।
সোয়াদ আহমেদ।
নতুন মন্তব্য করুন