আজকে আমাদের ব্যাচের পুনর্মিলনী। কত যে পুরাতন মুখের সাথে দেখা হোল। আমাদের কেউই মনে হয় কারো চোখে বদলাইনি। যার সাথেই দেখা হচ্ছিল মনে হচ্ছিল, এইতো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দিনের ছবির সেই মুখ। কারও একটু দাঁড়িগোঁফ উঠেছে বেশি, কারও মুখে একটু ভারিক্কি এসেছে, কেউ বা আবার আমার মত বিয়ে করে পুরোদস্তুর সংসারী মানুষের দলে নাম লিখিয়েছে। কিন্তু ওসব তো বাইরের পরিবর্তন। আরে কেমন আছিস? বলে জড়িয়ে ধরলে ঠিকই যেন আগের অনুভূতি পাওয়া যায়। সেই বন্ধনহীন, নির্ভার, মুক্ত বিহঙ্গের জীবনের একটু ঘ্রাণ যেন কোত্থেকে নাকে এসে লাগে।
তা এত উচ্ছ্বাস-আবেগ-অনুভূতি থাকবেই না বা কেন? কতদিন পরে দেখা। বছর ছয়? তাতো হবেই। আজ করি তো কাল করি করতে করতে আল্যাম্নাই এর গড়িমিসিতে এত দিন একটা পুনর্মিলনী পর্যন্ত করা হয় নি। বন্ধুরা এর মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে কত জায়গায়। মারুফের কাছে শুনছিলাম ওর দলের বাকি দুজনের কথা, সাদমান আর অনিকের কথা। ওদের আমরা ত্রয়ী বলতাম, সবকিছুতেই এদের একসাথে পাওয়া যেতো। ক্লাস পলাবে তো একসাথে, প্রজেক্ট করবে তো একসাথে, পরীক্ষার আগে রাত জেগে ঢুলেঢুলে পড়া- সেও একসাথে। কখনও ভাবিই নি ওরা তিনজন আলাদা আলাদা কেউ। তাই আজ মারুফ যখন বলল সাদমানের সাথে দীর্ঘদিন কোন যোগাযোগই নেই, তখন অবাকই লেগেছে। আর অনিক তো পাশ করে বেরিয়ে চলে গেছে বিদেশে। মারুফ বলল আছে ভালই, মাঝেসাঝে স্কাইপ চ্যাট আর ফেসবুক এইতো। অবাক হই কিন্তু জীবনেরই কোন অমোঘ নির্দেশ ভেবে আবার অবাক হইনা। ভাবি ওই অবাস্তব, অসম্ভব, কল্পনার জগতটা হারিয়ে গেছে বলেই হয়তো এত মধুর ঠেকে। কে না জানে যা কিছু ভালো তা অল্প হলেই ভালো।
অনেক আয়োজন ছিল আজ। কিন্তু আড্ডার জন্যে আবার কোন আয়োজন লাগে নাকি। সবাই গোল হয়ে বসে নিজের ব্যাচের মানুষের সাথে আড্ডা জুড়ে দিলো, স্যারদের নিয়ে রসিকতাও হল বিস্তর, কোন স্যার কেমন ভঙ্গিতে কথা বলতেন সেটা নকল করে দেখালো কেউ কেউ। কতদিন পরে যে আজ এত প্রাণখুলে আড্ডা দিলাম আমরা। আর দেখো, পুরো ভার্সিটি জীবনে ক্লাসের এক কোনায় চুপ করে বসে থাকা যে ছেলেটার সাথে কদাচিৎ কথা বলেছি, তাকে দেখেও আজ কি ভীষণ আনন্দ লাগছিল। মনে হচ্ছিলো, মোরা সুখের দুখের কথা কব প্রাণ জুড়াবে তায়।
এমন সময়ই দেখলাম নীল রঙের শাড়ি পড়া দীর্ঘ গড়নের এক মেয়ে এগিয়ে আসছে আমাদের চেয়ারগুলোর দিকে। আমার দুবার দেখতে হয়নি, ওই হাঁটার ভঙ্গি কি ভুলতে পারি। অতি পরিচিত ভঙ্গি যে। প্রজ্ঞা বাদে আর কেই বা ওভাবে হাঁটতে পারে। দেখেই আমার কি হল জানি না, একটু আসছি বলে আড্ডা থেকে বেরিয়ে আসলাম।
প্রজ্ঞাকে দেখে আমার বেরিয়ে আসার কোন কারণ নেই। প্রজ্ঞা আর আমার মধ্যে সম্পর্ক ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় সবাই জানত। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে প্রেম করা ছিল আমাদের নেশা। সবার এতটাই সয়ে গেছিল যে, আমরা দুজন হাত ধরাধরি করে হাসাহাসি করে হেঁটে গেলেও ক্যাম্পাসের কেউ ফিরেও তাকাত না। যে সাড়ে চার বছর ক্যাম্পাসে ছিলাম, প্রজ্ঞার সাথে পরিচয় হবার পর তার শেষ তিন বছরে কতটা ক্লাস করেছি আর কতটা প্রজ্ঞার সাথে ঘুরেছি তা বলা কঠিন। ছাত্র আমি বরাবরই খারাপ ছিলাম না, কিন্তু পড়াশুনার বাইরে নাচ-গান-আবৃত্তি- বিতর্ক এসবেই আমার আগ্রহ ছিল বেশি। কোন জায়গায় মঞ্চনাটক হলে প্রজ্ঞাকে সহ আমার সেটা দেখা চাই। চারুকলায় প্রদর্শনী হলে সেখানে যেতে হবে, আর গেলে কি একা যাবো? অবশ্যই না, প্রজ্ঞা তো সাথে যাবেই। তেল-গ্যাস রক্ষার মানববন্ধন থেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উচ্ছেদ পর্যন্ত সব ধরনের কার্যক্রমেই আমার ভীষণ আগ্রহ ছিল। আর তখন একটা বয়স ছিল বটে। ভাবতাম এই করেই বোধ করি চার বছরে দেশ বদলে দেব। বিপ্লব ছিল আমার নেশা, আর প্রজ্ঞা ছিল অনুপ্রেরণা। এসব একগাদা কাজ করতে গিয়ে পড়াশোনা করার সময় বের করা হয়নি। প্রজ্ঞা অবশ্য ছাত্রী হিসেবে বেশ ভালই ছিল, আমার সাথে দেখা হওয়ার পরও ওর পড়াশোনার তেমন একটা হেরফের হয়নি। এত কিছু সামলে, আমার সাথে কতো জায়গায় ঘুরে, নিজে দুইটা টিউশনি করে পড়াশোনাটা কেমন করে ধরে রাখত ও, অনেকবার ভেবেছি শুনব ওর কাছে । কিন্তু সেসব শোনার কি আর সময় ছিল? কথা বলার বিষয়েরও তখন ঘাটতি ছিল না, একপ্রান্ত থেকে কথা শুরু করলে অন্য কোন প্রান্তে গিয়ে থামবে তা বলা কঠিন ছিল।
শেষমেশ প্রজ্ঞার সাথে আমার সম্পর্কটা পরিণতি পায়নি। সবাই খুব অবাক হয়েছিল। কার কারণে টিকলো না বলা কঠিন। ভার্সিটি শেষ হওয়ার পরেই প্রজ্ঞার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব আস্তে শুরু করে। প্রজ্ঞা দেখতে শুনতে ভালো ছিল, আমরা যাকে উজ্জ্বল শ্যামলা বলি রঙ ছিল সেটাই। চালচলন, কথাবার্তায় ছিল সাবলীল। তবে সবচেয়ে সুন্দর ছিল বোধহয় ওর দাঁত, হাসলে যে কি চমৎকার দেখাত ওকে। আর হাসতেও পারত মেয়েটা, একবার হাসি শুরু করলে থামাতেই পারত না। ওর হাসি শুরু হলে আমি মাঝে বিব্রত বোধ করতাম, বিশেষত রিকশায় উঠে যখন ও হাসতে শুরু করত তখন। যারাই পাশ দিয়ে যেতো তারা উঁকিঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করত। হ্যাঁ, কিছুটা অদ্ভুত ধরনের মেয়ে ছিল ও। মেয়েসুলভ দিকগুলো ওর মধ্যে তেমন একটা ছিল না কখনই। এই নিয়ে কত খেপিয়েছিও যে ওকে। বলতাম তোমাকে বাসায় নিয়ে গেলে তুমি আবার হাসি শুরু করো না দোহাই, আম্মা তোমাকে তাহলে আর পছন্দ করেছে। ও হাসতে হাসতেই বলত, আন্টি তো আর তোমার মত গোমড়ামুখো না, নিমপাতা। দেখবা আমার হাসির জন্যেই তোমাকে আমার সাথে বিয়ে বসিয়ে দিয়েছে। আমাকে বিচিত্র নামে ডাকত ও, কখনো তান, কখনো নিম, কখনো মাতিন, তানিম বলত না প্রায় কখনই। আমি বিরক্ত হতাম না, ওর পাগলামি ভালই লাগত। আর বিরক্ত হলেও বা ওর বয়েই গেল, ওর সাথে কথায় পেরে উঠবো সে জো কি আছে।
মধুর দিনগুলো একসময় শেষ হল। ওর একটা খুব ভালো প্রস্তাব আসলো, আমি তখন প্রতিষ্ঠিত হওয়া দূরে থাক, ভালোমত কোন কাজবাজও ধরতে পারিনি, ছাত্রজীবন শেষ হয়েছে কিন্তু ছাত্র পড়িয়েই জীবন চলছে, একবার ভাবছি বাইরে চলে যাই, আরেকবার ভাবি বিসিএস দিই, আরেকবার ভাবি কোর্স করি, কিছুই ঠিক হয়না। বাসায় এসে খালি হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
এমন সময় ও বলল একদিন, আমার কিন্তু বিয়ে। ভাবলাম ওর আরেকটা প্র্যাক্টিকাল জোক বোধহয়। ও হাসছে না দেখে হুঁশ হল। চুপ করে রইলাম। সেদিন লেকের পারে বসেছিলাম দুইজন, অনেকটা সময়। হাতে হাত ধরে, কিন্তু কথা হয়নি। দেখা হওয়ার পর ওদিনই কি সবচেয়ে কম কথা হয়েছিলো? নাকি ওর বিয়ের দিন, যেদিন ও আমাকে দেখেই হাতের চুড়ি নেড়ে অপূর্ব ভঙ্গি করে বলেছিল আমাকে কেমন দেখাচ্ছে বল তো? তারপরই ব্যস্ততার ভঙ্গি করে ওর স্বামী ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। ওদিনও চুপ করেই ছিলাম। ওকে বলতে পারিনি যে অপূর্ব লাগছিল ওকে সেদিন, মনে হচ্ছিল কোন ভিনগ্রহের দেবী। এতটা সময় পাশাপাশি কাটিয়েছি আমরা, কই এরকম তো কোনদিনই মনে হয়নি। প্রজ্ঞা যখন আমার ছিল তখন একবারো ভাবিনি ও দূরে চলে যেতে পারে, ধরেই নিয়েছি যে কালকে সকালে গিয়েই প্রথম কাজ হবে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ওকে নিয়ে বলাকায় যাওয়া বা কোন ঘুড়ির প্রদর্শনীতে যাওয়া বা চারুকলা বা কলাভবনের সামনে গল্প করা। ভেবেছি আমরা একসাথে ঘুরব-ফিরব-আড্ডা দেব, আর সামনের পুরোটা সময় একসাথে থাকব এইতো স্বাভাবিক। এভাবেই তো হওয়ার কথা। কিন্তু ও যখন ওর বিয়ের কথা বলেই বসল, আর একেবারেই হাসলো না ওইদিন, আমি বুঝলাম ব্যাপার গুরুতর।
সেদিন যখন আমরা লেকের পারে বসেছিলাম, তার বহুক্ষণ পরে, সূর্য ডুবিডুবি তখন। ও বলেছিল একবার, তুমি কি একবার আমার বাসায়... বলে চুপ করে ছিল, হয়তো ও আশা করে ছিল, যে ওর বাসায় প্রস্তাব নিয়ে যাবো আমি। কিন্তু প্রজ্ঞার ভাবি বরের পাশে নিজেকে কল্পনা করে এত ছোটো লাগছিল আমার যে সে চিন্তা করতে পারি নি। ভদ্রলোক কানাডার গ্রিনকার্ডধারী, ঢাকায় পৈতৃক সূত্রে বিরাট বাড়ির মালিক, এখন চাকরি করছেন নামকরা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির বেশ উঁচু পদে, ফ্যামিলি উচ্চশিক্ষিত, সবাই প্রতিষ্ঠিত, দেখতে শুনতে সুদর্শন। তাই প্রজ্ঞার বাসায় গিয়ে হাজির হয়ে হঠাৎ বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে নিজেকে উলটো হাসির পাত্র করে তুলব ভেবে পিছিয়ে থেকেছি আমি। তাই ওর কথায় নীরব থেকেছিলাম। তারপরও অনেকটা সময়, কতটা সময় আমার জানা নেই, আমরা হাত ধরে চুপচাপ বসেছিলাম। অন্ধকার হয়ে এসেছিল ভাগ্যিস, আমার ব্যর্থ ভাঙাচোড়া মুখটা প্রজ্ঞাকে দেখতে দিতে চাইনি আমি। কে জানে বাইরে বাইরে ভীষণ শিশুসুলভ, ছটফটে, স্পষ্টভাষী, হাশিখুশি যে মেয়েটা তার হৃদয়ে কি ভাঙাচোরা চলছিল। কে জানে দুএক ফোঁটা অশ্রুজল বেরিয়ে এসেছিল কিনা ওর নিজের অজান্তেই। আর চোখের পানি যদি বেরিয়ে এসেই থাকতো, তাহলে নিশ্চয়ই আমার কাছ থেকে লুকোতে চাইতে ও। দুর্বলতা প্রকাশ করতে চায়নি যে ও কখনই। তাই অন্ধকারই ভালো।
আমার কি কিছুই করার ছিল না? একটা চাকরির জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরেও তখন কাজ হচ্ছে না। আব্বা রিটায়ারমেন্টে চলে গেছেন ততদিনে। বড় এক বোনের বিয়ের তোড়জোড় চলছে, শুধু টাকার অভাবেই আটকে যাচ্ছে। নিয়তির কাছে আমরা কেমন অসহায় হতে পারি তা সেদিনই উপলব্ধি করেছিলাম। বিপ্লবের সাধস্বপ্ন ততদিনে বিসর্জন দিয়েছি, ছোটখাটো একটা কর্পোরেট কোম্পানিতে ঢুকতে পারলেও বর্তে যাই এমন অবস্থা। কিন্তু কোম্পানিগুলো তো আমার মত আধাবিপ্লবী, রোমান্টিক ছেলে চায় না, চায় যোগ্যতাসম্পন্ন মেধাবী ভালো ছেলেদের, তাই আমার ইন্টারভিউ এর ডাক আসেনা।
এরপর একদিন প্রজ্ঞা এসে হাসতে হাসতে আমার হাতে কার্ড ধরিয়ে দিলো। আমার কি বুক কেঁপে উঠেছিল কিছুটা? জানতাম, তারপরও শুনলাম, কিসের কার্ড? প্রজ্ঞা স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বিদ্রুপের সুরে বলল, এহ, ন্যাকা সাজা হচ্ছে, না? কিসের কার্ড উনি জানেন না? আমি বিবাহ করিতেছি, উক্ত বিবাহে আপনার নেমন্তন্ন, সপরিবারে। বলে হেসে ফেলল, আমি কি বলব ভেবে না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। প্রজ্ঞা হেসে বলল অমন উজবুকের মত দাঁড়িয়ে না থেকে চল সিঁড়ির কোনাটায় গিয়ে বসি। “আমি ভেবে দেখলাম”, ও বলতে থাকে, “আমরা যেহেতু এতটা সময় একসাথে কাটিয়েছি, তাই আমরা তো অন্তত বন্ধুত্বটা টিকিয়ে রাখতে পারি, না?” ওর কথা আমার কানে ঢুকছিল না, শুন্য লাগছিল সবকিছু, মনে হচ্ছিল পুরো দুনিয়াটা বিস্বাদ হয়ে গেছে। ও বোধহয় আমার অবস্থা খেয়াল করেনি, বা করেও না করার ভান করছিল। “জানো আমার কার্ড নিয়ে কি ঘটনা। আম্মু তো আজাদের কার্ড অর্ডার দিয়ে ফেলছিল আরেকটু হলে। আরে আমার বিয়ে, আর কার্ড আমার মনমত না হলে কি হল বল...” আমি কথায় মনোযোগ ধরে রাখতে পারিনি। আমার অক্ষমতা আমাকে গ্রাস করে ফেলছিল। বুঝতে পারছিলাম, কি প্রচণ্ড কষ্টটাই না পাচ্ছে মেয়েটা ভিতরে ভিতরে। সেদিন বেশী কথা না বললে হয়তো কেঁদেই ফেলত ও।
এমন সময় বিয়ের দিন চলে এল। ততদিনে ধাক্কাটা কিছুটা সয়ে এসেছে, অন্তত দার্শনিক কিছু একটা যুক্তি দিয়ে নিজেকে সাতপাঁচ বোঝাতে পেরেছি। আর মাস তিনেক ওর সাথে দেখা না হওয়ায় আমার মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে ওর স্মৃতির কোষগুলো একপাশে সরিয়ে রাখছে যাতে আমার ব্যাথার অনুভূতিগুলোও আস্তে আস্তে ভোঁতা হয়ে যায়। একবার ভেবেছিলাম যাবো না। পরে ভেবে দেখলাম না গেলে নিশ্চয়ই ভাববে, আমি এখনও ওর প্রতি অনুভূতি আঁকড়ে ধরে পড়ে আছি। আর যেখানে ও নিজে থেকে কার্ড দিয়ে এত বার করে যেতে বলেছে। গিয়েছিলাম তাই। কিন্তু দেখলাম, হৃদয় বড়ই প্রতারক, ওকে দেখেই আমার আস্তে আস্তে অসাড় হয়ে যেতে থাকা পুরনো অনুভূতিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। তাই না খেয়েই পালিয়ে চলে আসি। ওদিন ঘুরেছিলাম ঢাকার রাস্তায় সারা রাত, এক মুহুর্তের জন্যে হাঁটা থামাই নি। চোর-ডাকাত-ছিনতাইকারী- পুলিশ কেউই ধরেনি আমাকে। কি জানি হয়তো সবাই ভেবেছে নিশি ধরেছে আমাকে। ভোর বেলা যখন নিজের ঘরে ফিরে আসি তখন ক্লান্ত, শ্রান্ত, অবসান্ন আমি। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলাম।
সেদিনের পরও বার কয়েক ফোনে কথা হয়েছিল, একবার ফোন দিয়েছিল বিয়ের ঠিক পরপরই। বলেছিল আমি যে গিফটটা দিয়েছি তা নাক ভীষণ পছন্দ হয়েছে ওর, আর একবার আমিই দিয়েছিলাম ও কানাডা যাওয়ার আগে। আর বছর তিনেক কাটিয়ে দেশে ফিরে আসার পরে আবার ফোন দিয়েছিল কিন্তু আমি বাসায় ছিলাম না, তাই কথাও হয়নি।
এর মধ্যে আমার জীবনেও বেশ কিছু বড়সড় ঘটনা ঘটেছে। আমি সংসার বেঁধেছি, বউ আব্বা আম্মার পছন্দ। আব্বা আম্মার পছন্দ যে নেহাত খারাপ না, তা বুঝতে শুরু করেছি। রিমা, মানে আমার ঘরণী, প্রজ্ঞার কথা জানে। ওর সাথে পরিচয় হওয়ার কয়েক বারের মধ্যেই আমি বলেছি। খুলে বলিনি, শুধু বলেছি, আমার সাথে আরেকজনের সম্পর্ক ছিল। এতে কি তোমার কোন সমস্যা আছে? রিমা খুবই পজিটিভ মেয়ে, এত চমৎকার মনের মেয়ে সচারচর দেখা যায় না। ও বলেছিল আমি কি শুনতে চেয়েছি যে কারও সাথে আপনার কিছু ছিল কিনা? “না বলে রাখা আরকি।’’ আমতা আমতা করে বলি আমি। প্রজ্ঞার কথা ততদিনে আমি অনেকটাই ভুলে যেতে পেরেছি। বেশ ভালো একটা চাকরি জুটিয়েছি পরিচয়ের সূত্রে। জীবনেও স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে এসেছে, পরিবারেও সচ্ছলতা ফিরেছে, এখন একটা স্থায়ী কিছুর কথা ভাবাই যায়। এমন সময় আব্বা আম্মা রিমার ছবি এনে দেখালেন। দুএকবার কথা বলেই বুঝলাম আমার সাথে বনছে বেশ। তারপর বেশ হুট করেই বিয়ে করে ফেললাম।
এই অবস্থায় আজকে দেখা হয়ে গেলো প্রজ্ঞার সাথে। আমি যখন পুনর্মিলনীতে আসব তখনই মনে হচ্ছিল আজকে তো প্রজ্ঞা আসতেও পারে। এক অদ্ভুত অনুভূতি, একবার ভাবছি যে প্রজ্ঞা আসুক। আর একবার ভাবছি যে ও যেন কিছুতেই না আসে। যে অনুভূতি পাথর চেপে রেখেছি, তা যদি সামনে এসে পড়ে অবচেতন কোন মুহুর্তে, তাহলে কেলেঙ্কারির শেষ থাকবে না। শেষে প্রজ্ঞা যখন দেখা দিলোই তখন আমি আড্ডা ছেড়ে উঠে না গিয়ে পারলাম না।
প্রজ্ঞা এসে সবার সাথে কুশল বিনিময় করার একটু পরে আমি গিয়ে বেশ অবাক হওয়ার ভান করে বললাম, আরে প্রজ্ঞা! কতদিন পর। “ও তুমি! এমন ভাব নিচ্ছ যেন, খুশি হওনি খুব একটা।“ ওর উত্তর। আমি কি বলব ভেবে পাইনা। প্রজ্ঞা হাসতে হাসতে বলে, আর তুমি আমাকে দেখে অমন পালালে কেন বল তো দেখি। ভেবেছ আমি কিছুই দেখি নাই, না? আমি শুনেও না শোনার ভান করে বলি, তারপর, তোমার দিনকাল কেমন চলছে? প্রশ্নটা করে আমার নিজের কাছেই নিজেকে বোকা লাগতে থাকে, প্রজ্ঞার সাথে তো কোনদিনই এভাবে কথা বলিনি। প্রজ্ঞা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে, আগের মতই। আরে তুমি তো দেখি পুরোই বদলে গেছ, কি মজার মজার ভঙ্গিতে কথা বলছ। তা তুমি যখন এমন সব ফর্ম্যাল আলাপ শুরু করলে, আমি আর কি করি। “তা মশায়ের কি করা হচ্ছে এখন?” আমার উচ্চারণ ভঙ্গি নকল করে প্রজ্ঞা বলে ওঠে। আমার অবাক লাগা বাড়ে, ভাবি এই ছ’বছরে আমিই বদলে গেছি, প্রজ্ঞা কি একদমই বদলায় নি? নাকি নিজের অনুভুতিগুলোকে চেপে রাখার জন্যে আমার এই ভনিতা। প্রজ্ঞার সাথে কথা বলার কোন ভালো টপিক খুঁজে বের করার প্রাণপণ চেষ্টা চালাই। ভেবে অবাক লাগে এই মেয়ের সাথে বছর দশেক আগে কথা বলার সময় আমার মনে হত সময় উড়ে যাচ্ছে, এক রাতে পাঁচবার মোবাইল রিচার্জ করার ঘটনাও আছে আমার।
প্রজ্ঞা এদিকে চুপ করে হাসিহাসি মুখে আমাকে দেখছে। তোমার হয়েছেটা কি বলত? আমি বলে উঠি, কিছু না, কিছু না। তারপর কোন কারণ ছাড়াই প্রজ্ঞার স্বামীর কথা জানতে চাই। মাহবুব ভাইকে আনলে না যে? আর বলো না, এত ব্যস্ত থাকে। ওর খালি এই কাজ,সেই কাজ, বাইরের ক্লায়েন্টদের সাথে মিটিং, ভীষণ ব্যস্ত। বাচ্চাটাকেও সময় দিতে পারে না। আমি কতদিন ধরে বলছি যে একটা শনিবার বের করো, লং ড্রাইভে ঘুরে আসি কোথাও। প্রজ্ঞা আরও কি সব বলতে থাকে, আমি অন্যমনস্কভাবে বলি বাচ্চাটার বয়স কত হোল? এইতো সামনে জুলাইয়ে দুই বছর পুরবে। নাম কি রাখলে? তন্ময়। প্রজ্ঞা বলে ওঠে, অ্যাই শোন, তুমি তাড়াতাড়ি একটা বেবি নাও তো, মেয়ে হলে তোমারটার সাথে না আমারটার বিয়ে দেব। বলে হাসতে থাকে ও। আর তোমার বউটা কিন্তু ভীষণ সুইট, কি নাম জানি, রিমা না? প্রজ্ঞার স্মৃতিশক্তি দেখে আমি অবাক হই। আমার বিয়ের সময় ও কানাডা ছিল। দেশে এসে পরে একবার এসেছিল আমাদের বাসায়। এসেই তো রিমার সাথে খাতির জমিয়ে একাকার। এদিক থেকে আমি কিন্তু মাহবুব ভাইয়ের সাথে একেবারেই কথা জমাতে পারিনি। ভদ্রলোক রাশভারী প্রকৃতির না, কিন্তু কেন জানি না কথা দুইজনের কথাবার্তা কুশলাদি বিনিময় আর পত্রিকার প্রথম পাতার খবরের পরে আর এগোয়নি। এদিকে প্রজ্ঞা যতক্ষণ আমার বাসায় ছিল, আমার সাথে কথা বলার সময়ই পায় নি। যাবার সময় বলেছিল, তোমার মত একটা হতভাগ্য, লক্ষ্মীছাড়া যে রিমার মত এত চমৎকার একটা মেয়ে পেয়েছে এটার জন্য শুকরিয়া কর, বুঝেছো? প্রজ্ঞা যতক্ষণ বাসায় ছিল আমি ভীষণ আড়ষ্ট বোধ করছিলাম। যদিও ওর বিষয়ে আমি আগেই রিমাকে বলেছি, আমার সাথে প্রজ্ঞার গোপন কিছুই ছিল না, তাও।
প্রজ্ঞার গল্প চলতে থাকেই। রিমা ভাল আছে তো? আমি বলে হু। অ্যাই শোন আমরা লেকের যে পাড়টাতে বসে প্রায়ই গল্প করতাম খেয়াল আছে? আমি অস্বস্তি অনুভব করি। ও বলে, ওখানে এক বাদামওয়ালা বসতো না। গতকাল যাচ্ছিলাম, ওখানে গাড়ি থামিয়ে বাদাম কিনে খেলাম। আমি তো ওকে বলেছি যে আমি তোমার সাথে এখানে বসে এই চাচার বাদাম খেতাম। আমার বিস্ময় বাড়ে। ভাবি, প্রজ্ঞা কি মাহবুব ভাইয়ের সাথে এইসব কথাও বলে নাকি? আমি তো রিমার সাথে এড়িয়ে যেতে চাই। ভেবেছিলাম যে অধ্যায়টা জীবন থেকে পিছনে ফেলে এসেছি তার কথা প্রানপণে ভুলে থাকতে চাইব আমরা দুজনেই- আমিও, ও-ও। কিন্তু কিসের কি?
আমি আগের মতই শ্রোতার ভূমিকা পালন করতে শুরু করি। ও বলে, তুমি তো ভালই বদলে গেছ, আগে হলে তো এতক্ষণে সমাজ বদলানো পুঁজিবাদবিরোধী কোন ভাষণ দিতে শুরু করতে। উফফ, কি জ্বালাতনটাই না করতে তুমি আমাকে। একদিনও তোমার জন্যে সকালের ক্লাসটা যদি ঠিকঠাকমত করতে পারতাম। খালি এই মিটিং, সেই মিছিল, এই এজেন্ডা। ওসব হাবিজাবি করে কি অমন লাভটাই হলো বলো তো? এর চেয়ে আমরা আর একটু বেশি গল্প করলে কি হত জান? আজকে তোমার মাহবুব ভাইয়ের জায়াগায় তুমিও থাকতে পারতে। বলে হাসতে থাকে ও, প্রাণখোলা হাসি। আমি অবাক হই বললেও কম বলা হয়। এতদিন পরে এই কথা, নাকি শুধুই মজা করছে ও? শোন মিস্টার, ওসব আশা বাদ রাখ। আমার পতিদেব বেজায় ভালো মানুষ, তাকে ছেড়ে দিয়ে তোমার সাথে ঘরে বাঁধা-সে হচ্ছে না।
বিয়ের সময় প্রজ্ঞার সাথে যখন কথা হয়েছিল তখনও ওর ভাবভঙ্গি দেখে মনেই হয়নি, ওর আর আমার এককালে কি দুরন্ত সম্পর্কটাই না ছিল। একদিন ও আমাকে বলেছিল, শোন, তুমি আবার অন্য মেয়ের পেছনে সটকে যেয়ো না, আমি কিছুতেই তোমার পিছু ছাড়ছি না, দেখে রেখো। এরকমই ছেলেমানুষি করত ও মাঝেমাঝে। সেই প্রজ্ঞাকে বিয়ের দিন দেখে আমার সন্দেহ হয়েছিল আদপেই ও আমাকে ভালবাসত কিনা। স্বামীর পাশে বসে ওর আনন্দ দেখে ঈর্ষাও হয়েছিল। ভাবছিলাম নিশ্চয়ই মনের কোন গহিন গোপনে আমার জন্যে লুকিয়ে রেখেছে ওর আবেগগুলো। অথচ বিয়ের সময় কোন লুকানো আবেগের বিন্দুমাত্র আভাস দেয়নি ও, অথচ আজ এসব কি বলছে হঠাৎ? নাকি এসবই ওর আরেক পাগলামি, আমার সাথে মজা করছে আগে যেমন করত।
সে যাই হোক, বুঝতে পারি পুরোন বোধগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে আমার। দীর্ঘদিন যাকে সযত্নে লুকিয়ে রেখেছি নিজের কাছ থেকেই, তার হঠাৎ আবির্ভাবে শঙ্কিত হয়ে উঠি আমি। বুঝি, বাইরে বাইরে ভীষণ সৎ আর বিশ্বস্ত এই আমিকে আর বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না আমি নিজেই। প্রজ্ঞার কথা ভুলে নতুন সংসার পেতেছি আমি, সব গুছিয়ে নিয়েছি, ভালো আছি প্রজ্ঞাকে ছাড়াই এই বাহাদুরি দেখাতে চেয়েছিলাম। দেখলাম, এই মিথ্যাচার কত ঠুনকো। এই ঠুনকো বাঁধ ভেঙে অনুভূতিরা যদি একবার বেরিয়ে আসতে পারে, ভেবে শিউরে উঠি আমি। রিমার কথা ভাবি। ভাবি, না কিছুতেই এমন চমৎকার মেয়ের সাথে প্রতারণা করা যাবে না।
নিজের সততার মুখোশ খসে পড়ার এই টলায়মান মুহুর্তে আমি মুঠোফোন হাতে তুলে নিই। রিমার মুঠোফোনে মেসেজ পাঠাই। আজ তুমি জেগে থেকো প্লিজ। একসাথে ডিনার করব। তোমাকে অনেক মিস করছি। রিমা হয়তো অবাক হবে। স্বামী হিসেবে আমি বেশ যত্নবান, দায়িত্বশীল আর বিশ্বস্ত, পুরোপুরি ভদ্রলোক যাকে বলে। কিন্তু এসব রোমান্টিকতা খুব বেশী করা হয়নি ওর সাথে, কি জানি কেন, প্রজ্ঞার অস্তিত্ব মাঝপথে এসে দাঁড়িয়েছে বলেই কিনা। আমার প্রায়ই রাতে ফিরতে দেরি হয় অফিস থেকে, প্রথমদিকে রিমা বসে থাকতো আমার জন্যে। আমিই রাত জেগে বসে থাকতে নিষেধ করে দিয়েছি ওকে। রিমা শুরুরদিকে মন খারাপ করলে এখন সইয়ে নিয়েছে। আজকের মেসেজ পড়ে নিশ্চয়ই ভীষণ অবাক হচ্ছে রিমা, হয়তো খুশিতে সাজতে বসে গেছে এতক্ষণে।
প্রজ্ঞার হাসিহাসি মুখের দিকে তাকিয়ে আমি অস্থির বোধ করতে থাকি আর রিমার কথা ভেবে প্রাণপণে নিজের বিশ্বাসঘাতক স্মৃতিকে শিকল পড়াতে থাকি।
দীপ্ত
মন্তব্য
খুব ভালো লাগল। আরও লিখুন...
ডাকঘর | ছবিঘর
অনেক ধন্যবাদ।
গল্পটা শেষ পর্যন্ত একটা ক্লিশে প্রেমের গল্প হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত পড়লাম, কোন চমক থাকে কিনা দেখার জন্যে। আপনার লেখার হাত ভাল, লেখালেখি চলুক। আরও বৈচিত্র আসুক।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
সময় নিয়ে পড়ে মন্তব্য করেছেন বলে ধন্যবাদ।
হাত পা খুলে লিখতে থাকুন। আপনার ভাষায় একটা স্বচ্ছন্দ প্রবাহ আছে। পড়তে পড়তে নিজেই কখন যেন নিমপাতা হয়ে গেলাম।
ধন্যবাদ, মন্তব্যের জন্যে, প্রশংসার জন্যেও।
ভালো ছিলো দীপ্ত। প্রথম যেকোনো কিছুই সবার কাছে অন্য যেকোনো কিছুর থেকে অনেক আলাদা। তোর গল্পটা পড়ে সে সত্যটাই আবার মনে পরে গেল আর সামান্য স্মৃতিকাতরতা তো আছেই...
অসম্ভব সুন্দর হয়েছে ।
নতুন মন্তব্য করুন