পূর্ব বাংলা বরাবরই এক ঝামেলার জায়গা, হিন্দুস্তানের মহান সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে বাংলার মোগলে আর আরাকানের মগে ব্যাপক যুদ্ধ চলতো। আরাকানের রাজার শাসনাধীন সুন্দরবনে পর্তুগীজ দস্যুর দলও উৎপাত কম করতো না।
১৬০৫ সালে স্প্যানিয়ার্ড সেবাস্টিয়ান গনজালেস বাংলায় আসে সাধারন সৈনিক হিসেবে, এরপরে সে লবণ ব্যবসায় হাত দেয়। তেমন সুবিধা করতে না পেরে সে ঠিক করে জলদস্যু হবে, একগুষ্টি জাহাজ ম্যানেজ করে সে সুন্দরবনের দক্ষিন-পূর্বে সন্দ্বীপ দখল করে বসে। দ্বীপে তার কথাই আইন, সুন্দরবন থেকে আরাকান পর্যন্ত সে নির্বিঘ্নে লুটতরাজ চালাতে লাগলো। অনেকের মতে তার ধনরত্ন কোন রাজাগজার চেয়ে কম ছিলোনা। তার অধীনে স্থানীয় লোক আর ইয়োরোপীয় দুইই কাজ করতো, কামান বসানো আশীটি জাহাজের মালিক ছিলো সেবাস্টিয়ান।
এই সময় আরাকানে বিদ্রোহ শুরু হয়, আরাকানের রাজা তার চাচাতো ভাইয়ের হাতে মার খেয়ে পালিয়ে সন্দ্বীপ চলে আসে। সেবাস্টিয়ান তার পক্ষ নিয়ে আরাকান দখল করতে রওনা দেয়। রাজাকে সাহায্য করা ছুতামাত্র, আরাকানের গদীর উপরেই তার ছিলো নজর। লাভ হলনা, পিটুনি খেয়ে তারা সন্দ্বীপ ফেরত আসতে বাধ্য হয়।
এইবার রাজার টনক নড়ে, সেবাস্টিয়ানের ইচ্ছেমত চলতে হবে তাকে। পালানোর সময় রাজার এক সুন্দরী বোনও আসে, সেবাস্টিয়ান বায়না ধরে ওই বোনকে ব্যাপ্টাইজ করে তার সাথে বিয়ে দেয়া হোক। কি আর করা, রাজাকে মেনে নিতে হলো গর্দানের ভয়ে। এর কয়দিন পরেই রাজার বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়, সকলের ধারনা এর পিছনে সেবাস্টিয়ানের হাত ছিলো। বিধবা রাণীর জন্য এক পয়সা না রেখে সব ধনরত্ন সেবাস্টিয়ান বাজেয়াপ্ত করলো। লোকের ফিসফাস শুনে লোকলজ্জার ভয়ে সেবাস্টিয়ান তার ভাই অ্যান্থনির সাথে রাণীর বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলো অবশ্য, রাণীকে কিছুতেই খ্রীষ্টান করা গেলোনা দেখে বিয়েটাও ভেস্তে গেল।
সেবাস্টিয়ানের ভোল পাল্টাতে সময় লাগেনা। মোগল বাহিনীর আক্রমনের ভয়ে সে আরাকান রাজার সাথে সন্ধি করে, জামিন হিসেবে রাখে তার আপন ভাতিজাকে। কিন্তু মোগল বাহিনীর পয়সা খেয়ে সে উলটো আরাকানরাজের শ্ত্রু সেজে বসে। আরাকান জাহাজের সকল ক্যাপ্টেনকে নিজের জাহাজে ডেকে সে একটা একটা করে প্রত্যেককে খুন করে ফেলে দেয়। তারপর সব আরাকান জাহাজ দখল করে সব লোককে মেরে ফেলে অথবা দাস বানিয়ে বিক্রি করে দেয়।
এই বিশ্বাসঘাতকতায় আরাকানরাজের মাথায় রক্ত চড়ে যায়, সেবাস্টিয়ানের ভাতিজাকে সমুদ্রতীরের ধারে শূলে চড়ানো হয়। সেবাস্টিয়ান নির্বিকার, দুনিয়ায় সবাই ই কারো না কারো ভাতিজা...দুয়েকটা মরলে কি আসে যায়! মেলা চেষ্টা করেও কিন্তু সে আরাকান দখলে নিতে পারলো না, অস্থির হয়ে পড়ছিলো সে। এতদিন গোয়ার পর্তুগীজ শাসকদের সে পাত্তা না দিয়ে নিজের ইচ্ছেমত চলতো, এবার সে গোয়ায় লোক পাঠালো আরাকানের বিপক্ষে সাহাজ্য চেয়ে। আরাকানরাজকে হারালে কত ধনসম্পদ যে তারা পাবে এইসব কথা ইনিয়ে বিনিয়ে বলে পাঠালো।
গোয়ার তখনকার শাসকরা মোটেই আলবুকার্ক১ এর মত লোক ছিলোনা, লোভী স্বার্থপর কিছু লোকে তখন গোয়া চালাতো। তারা ভাবলো দুত্তোর সেবাস্টিয়ান আমরা নিজেরাই গিয়ে আরাকান দখল করি। সরাসরি তারা আরাকানের উদ্দেশ্যে যুদ্ধজাহাজ নিয়ে রওনা দিলো। কোন খোঁজখবর না নিয়ে আক্রমন চালানোর পরিনতি হল ভয়াবহ, কোথা থেকে ওলন্দাজ জাহাজ এসে তাদের উপর হামলা চালিয়ে বসলো। পর্তুগীজদের হল শোচনীয় পরাজয়।
প্রচুর পর্তুগীজ ধরা পড়ে আরাকানরাজের হাতে, প্রত্যেকের কল্লা নামিয়ে দেয়া হয়। এরপরে মাথাগুলো বর্শার আগায় গেঁথে সাগরতীরে সাজিয়ে রাখা হয়। সবহারিয়ে সেবাস্টিয়ান সন্দ্বীপ ফিরে আসে, কিন্তু এবার সে নিঃস্ব। আরাকানের রাজা কিছুদিন পরেই আবার সন্দ্বীপের দখল নেয়, সেবাস্টিয়ান গনজালেসের কথা আর কখনো শোনা যায়নি।
…..................................................
১৮৭৮ সালে অ্যালবার্ট ফিচ রচিত “Burma Past and Present” বইয়ের কিছু অংশের ভাবানুবাদ।
......................................................
সত্যপীর
eval(unescape('%64%6f%63%75%6d%65%6e%74%2e%77%72%69%74%65%28%27%3c%61%20%68%72%65%66%3d%22%6d%61%69%6c%74%6f%3a%6d%69%72%31%37%38%40%79%61%68%6f%6f%2e%63%6f%6d%22%3e%6d%69%72%31%37%38%40%79%61%68%6f%6f%2e%63%6f%6d%3c%2f%61%3e%27%29%3b'))
মন্তব্য
দূর্দান্ত... চালিয়ে যান।
.... একটা ভালো কাজ করে যাচ্ছেন আপনি। অনেক কিছু জানতে পারছি। কিপ ইট আপ...
ডাকঘর | ছবিঘর
সোনার দেশটা নিয়ে সাদা মানুষের কামড়াকামড়ি দেখতে ভালোই লাগে কি বলেন? মোটে তিন-চারশো বছর আগে কত ভিন্ন ছিলো একই মাটির ওপরের মানুষ।
মন্তব্যের জন্য লন।
সুন্দরবনও যে আরাকানের অধীনে ছিলো, জানতাম না। অনেক পুরোনো একটা ম্যাপে দেখেছিলাম, বরিশাল অঞ্চলের ওপর গুটিগুটি হরফে লেখা, এরিয়া ডিপপুলেইটেড বাই মগস।
সন্দ্বীপের মাটির নিচে সেবাস্টিয়ানের সোনাদানা নিয়ে সিরাম সব গল্প ফেঁদে বসা যাবে মনে হচ্ছে।
সেরাম গল্পই হবে বটে, ভাইসাহেব লুটপাট কম করেন নাই।
সেবাস্টিয়ানকে আমার খাঁটি পাইরেট মনে হয়...লোভী, স্বার্থপর, নিষ্ঠুর অথচ অসম্ভব সাহসী আর বুদ্ধিমান। গল্পের চরিত্র হিসেবে অসাধারন।। এরকম আরেকজনের নাম কাছাকাছি সময় পাওয়া যায়, ফিলিপ দ্য ব্রিতো নিকত, পর্তুগীজ পাইরেট যে কিনা পরে বার্মার সিরিয়ামের কমান্ডার হয়ে বসে। এর ভালো কোন গল্প পেলে দিব দেখি।
গল্প-টল্প না! সন্দ্বীপের মাটির নিচে সেবাস্টিয়ানের সোনাদানা দিয়া আগে আপনের টুনা-মাশ্রুম-ডাইলের একটা পার্মেন্ট ব্যবস্থা করেন। তারপর আমাদের জন্য একমনে গপ্প লেখার অনেক সময় পাইবেন।
ও হ্যাঁ, দক্ষিন বঙ্গে স্প্যানিশ পাইরেটদের নিয়ে নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়ের দুর্দান্ত দুএকটা উপন্যাস আছে।
****************************************
সুনীলের একটা কিশোর উপন্যাস আছে এই সেবাস্টিয়ানকে(পুরো নাম সম্ভবত সেবাস্টিয়ান গঞ্জালেস স্টিবাও) নিয়ে,নাম ভুলে গেছি।ওখানে দেখা যায় যে এক বাঙ্গালি ব্রাক্ষ্মণের সাহসিকতায় সেবাস্টিয়ান ধরা পড়ে এবং আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়।সুনীল অবশ্য বলেছেন ওটা গল্পই,তবে ওই বইটায় লেখা ছিলো যে নির্দিষ্ট কিছু শর্ত মেনে নিয়ে সেবাস্টিয়ান আত্মসমর্পণ করে।অনেক ছোটবেলায় পড়া কিশোর উপন্যাস,চমৎকার লেগেছিলো।লেখককে ধন্যবাদ মনে করিয়ে দেবার জন্যে।
কথা সত্য, পুরো নাম সেবাস্টিয়ান গঞ্জালেস টিবাও। আমি যে দুইটা বইতে এর কথা পড়েছি তাতে বাঙ্গালী ব্রাহ্মণের কথা ছিলো না, শুধু ছিলো যে পর্তুগীজদের সাথে সেও বেধড়ক মার খেয়ে পালিয়ে সন্দ্বীপ চলে আসে...আত্মসমর্পণের কথা ছিলোনা। আরাকানের রাজা সবার মাথা কেটে সাজিয়ে রাখার কথা বলা আছে, সেবাস্টিয়ান তার হাতে পড়লে আস্ত মাথা নিয়ে সন্দ্বীপ পালাতে পারত কিনা সন্দেহ।
তবে কি এইসব শখের ঐতিহাসিকেরা অনেক সময় বানিয়ে বানিয়ে লেখেন, এরা লেখে নাই বলে সেবাস্টিয়ান আত্মসমর্পণ করে নাই এরকম কোন কথা নাই। হতেও পারে। এরকম জাঁদরেল পাইরেট আমাদের সন্দ্বীপে ঘাঁটি গেড়েছিলো এইটাই আসল পয়েন্ট।
নেন ।
জব্বর হচ্চেগো.. আমার তো ইখুনি গাইতি - বেলচা নিয়ে সন্দ্বীপ যাইতে মুঞ্চাচ্ছে।
- ভাবানুবাদ খুবই ভাবের উদ্রেগ করছে। চলতে থাকুক।
আগ্রহোদ্দীপক লেখা। তবে বড্ড তাড়াতাড়ই শেষ হয়ে গেল। নিয়মিত লিখুন।
অবশ্যই চেষ্টা করবো
একদম অন্য স্বাদের লেখা। বেশ। খুব বড় ইতিহাসের লেখা দেখলে পড়ার আগেই হাই আসে। তাই ছোটই ভালো।
...কিন্তু আপনার লেখা পড়েই হিম্ভাইয়ের আরেকখানা লেখার আইডিয়া মাথায় এল ! তার মানে দিলেন তো চন্ডিশিরার বারো বাজিয়ে !!
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
হাহা আপনার মন্তব্য পড়ে মজা লাগলো, দেখা যাক কি হয়
দারুণ গল্প!
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
আপনার সবগুলো পর্বই পড়েছি, যদিও মন্তব্য করা হয়নি সবগুলোতে। বিষয়ের ভিন্নতাই এর মূল কারণ। আসলে আমরা ছোটবেলায় যে ইতিহাস পড়েছি তার বেশীরভাগই একেবারে সমগ্র উপমহাদেশের, সেটা আমাদের নিজস্ব হলেও একেবারে আত্নার ইতিহাস নয়। আমাদের বাংলাদেশের একএকটা জেলা, এক-একটা দ্বীপ, বা বন জঙ্গলেরও যে এরকম ইতিহাস আছে, সেসব জানা হয়নি কখনও।
লিখতে লিখতে লেখা আরও প্রাঞ্জল হবে সেটা তো না বললেও চলে। তবে আপাতত বিষয়ের বৈচিত্রই আমাকে ধরে রাখবে।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
ঠিক কথা, বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যই আমার লিখাকে পার করে দেবে এই ভরসায় লিখে যাচ্ছি। পাঠ্যপুস্তকের ইতিহাস বই পড়ে আশালতা আপুর মত আমারো বেজায় হাই উঠতো, তাই চেষ্টা করি ইন্টারেস্টিং বিষয় নিয়ে লিখতে। বাংলা দ্বিতীয় পত্রে বানিয়ে বানিয়ে রচনা লিখা ছাড়া কখনো কিছু লিখিনি, ভাষার প্রাঞ্জলতা না থাকাই স্বাভাবিক। দেখা যাক গাইতে গাইতে কেমন গায়েন হওয়া যায়।
সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
সন্দ্বীপ চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড নিকটবর্তী একটি দ্বীপ।
ভাবানুবাদ চলতে থাকুক।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
নতুন মন্তব্য করুন