বেনারস আফিম এজেন্সী

সত্যপীর এর ছবি
লিখেছেন সত্যপীর (তারিখ: সোম, ১৬/০১/২০১২ - ৯:২৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অন্যতম প্রধান রপ্তানীদ্রব্য ছিল আফিম ও আফিমজাত মাদক। বাংলায় উৎপন্ন আফিম চড়াদামে চীনে বিক্রয় করা কোম্পানীর অন্যতম মুনাফার উৎস। আফিম চীনে নিষিদ্ধ মাল তখন, এই নিয়ে কোম্পানীর চীনের সাথে দুইবার মারপিটও হয়ে গেছে। এই লিখাটি ১৮৫১ সালে “The Records of The Bengal Government” হতে নেয়া, ঐ বইয়ে বাংলাদেশের আফিম ব্যবসা নিয়ে বিস্তারিত লেখেন কোম্পানীর শুল্ক, লবণ ও আফিম বোর্ডের প্রধান পরীক্ষক ডব্লিউ সি বি ইটওয়েল, এম ডি।
…..........................................

ভারতে পপিচাষ হয় মূলতঃ ছশো মাইল বাই দুশ মাইল বিস্তৃত এলাকায়, উত্তরে গোরকপুর, দক্ষিণে হাজারীবাগ, পূবে দিনাজপুর আর পশ্চিমে আগ্রা তক। এই বিস্তীর্ণ এলাকা দুইটি এজেন্সিতে বিভক্ত, বিহার আর বেনারস। বিহারের হেড অফিস পাটনায়, আর বেনারস এজেন্সি চালানো হয় গাজীপুর কুঠি হতে। এই দুই এজেন্ট আবার কোলকাতায় শুল্ক, লবণ ও আফিম বোর্ডের অধীনে। বিহার এজেন্সি অপেক্ষাকৃত বড় ও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এরা বেনারসের তিনগুণ আফিম উৎপন্ন করে।

বেনারস এজেন্সি আটটি ডিভিশনে বিভক্ত, যথা বেনারস ও মির্জাপুর, গাজীপুর, আজিমগড়, জৌনপুর, সেলিমপুর, গোরকপুর, কৌনপুর এবং ফতেপুর। এই আট বিভাগ মিলিয়ে ১৮৪৯-৫০ মৌশুমে মোট এক লাখ সাত হাজার আটশ বিঘা জমিতে পপিচাষ হত। প্রতিটি বিভাগ প্রধান ছিলেন সাব-ডেপুটি আফিম এজেন্ট, তিনি থাকতেন বিভাগীয় প্রধান কুঠিতে। বিভাগীয় প্রধান কুঠি হতে বাৎসরিক মাল গুনেগেঁথে পাঠানো হত গাজীপুর হেডকোয়ার্টারে।

এইসব সাব-ডেপুটির ছাড়াও ছিলেন কালেক্টররা, যারা ছিলেন বিভিন্ন কুঠির চার্জে। কালেক্টর ঠিক সাব-ডেপুটির অধীন নন, তারা সরাসরি ডেপুটি এজেন্টের সাথে কারবার করতেন। কালেক্টর কড়া নজর রাখতেন যেনো ডেপুটির অনুমোদন ব্যতিত সাব-ডেপুটি কোন মাল কিনা বা বেচা করতে না পারেন। আবার সাব-ডেপুটি খেয়াল রাখতেন যেনো কালেক্টর মাল সংগ্রহ করার সময় কোন দুই নম্বরি না হয়। বেশি মুনাফার লোভে কালেক্টররা আফিমচাষিদের যেনো না ঠকায় বা যেনো অন্যভাবে না বাঁশ দেয় সেদিকেও সাব-ডেপুটির নজর থাকতো। কোন কোন বিভাগে আবার সাব-ডেপুটি ছিলোনা, কাগজে কলমে সেখানে গাজীপুরের ডেপুটিই ছিলেন প্রধান...তবে কার্যতঃ কালেক্টরই বিভাগ চালাতো তখন। পুরো বিভাগ একলা চালানো বড় কঠিন কর্ম, অভিজ্ঞ নেটিভ অফিসারদের উপর অনেক দায়িত্ব বর্তাতো। এদের ডাকা হত গোমস্তা।

প্রতিটি বিভাগ আবার বিভিন্ন উপবিভাগে বিভক্ত, এদের বলা হত “কুঠি এলাকা”। প্রতিটি এলাকার এমনভাবে সাজানো যেনো একজন অফিসারের পক্ষেই তা সামলানো সম্ভব হয়। এলাকাগুলির দায়িত্বে থাকতেন একজন গোমস্তা। গোমস্তাদের হেড অফিস ছিল একএকটি কুঠি। কুঠি বলতে বুঝাতো দালানটাইপ কিছু, এলাকার কেন্দ্রে স্ট্র্যাটেজিক স্থানে অবস্থিত। কুঠির রাজস্ব হিসেব রাখতে গোমস্তার অধীনে থাকতো তহবিলদার বা খাজাঞ্চি, তার কাজ ছিলো এলাকার মালের ডেবিট ক্রেডিট হিসেব রাখা।

সাব-ডেপুটি এজেন্ট আফিমচাষিদের সাথে চুক্তি করার পর গোমস্তারা জমি মাপজোক করে এলাকা দাঁড় করানোর জন্যে। এরা মাপার পর সাব-ডেপুটির নিজস্ব লোক আবার গিয়ে জমি মাপে। এই দ্বিতীয় গ্রুপের লোকেদের হাতে শীতকালে জমি ন্যস্ত থাকে, তখন আফিমচাষের অযোগ্য জমি। সুতরাং পরে যেনো জমির মাপ নিয়ে ঝামেলা না লাগে তাই এই দুইবার মাপার ব্যবস্থা। গোমস্তারা আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে, সাব-ডেপুটির সইকৃত আগাম টাকা এরা বুঝিয়ে দেয় এলাকার আফিমচাষিদের মধ্যে। চাষিদের কাছ থেকে আফিম আদায় করা ও গাজীপুর সদরে পাঠিয়ে দেওয়ার গুরুদায়িত্বও গোমস্তাদের।

গোমস্তাদের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজে তাদের সহায়তা করে আরো কিছু লোক, এদের ডাকা হয় জমিদার। জমিদারদের কাজ চাষিদের সরাসরি তদারক করা, আর চাষের ভালোমন্দ দেখা। এইসব নেটিভ অফিসারদের পাশাপাশি কাজ করতো মুত্তামীমের দল, এরা মোটামুটি পান্ডাগোছের লোক...পুরো বিভাগের সব ঠিকঠাক চলছে কিনা তার রিপোর্ট দিত এরা ডেপুটি বা সাব-ডেপুটিকে। পুরো সিস্টেমে এরকম নেটিভ অফিসারের সংখ্যা প্রচুর। প্রথম শ্রেনীর নেটিভ অফিসার দেড়শ এর কাছাকাছি, তাদের অধীনে ছিল আরো বারোশ অফিসার ও চাকর। এদের মত স্থায়ী কর্মচারীর পাশাপাশি আফিম মৌসুমে চাকরি করতো আরো অনেকে। শুধুমাত্র গাজীপুর সদর দপ্তরেই ছয়শ অস্থায়ী কর্মকর্তা কাজ করতো, যাদের মধ্যে তিনচারজন ইয়োরোপীয় সহকারী হিসেবে কাজ করতো আর চোদ্দপনেরোটি ছিল সাদা খ্রীস্টান ছেলেপিলে।

মাঠে পপিচাষে নিযুক্ত মোট লোকের সংখ্যা বিপুল। লম্বরদার, যারা কোম্পানীর সাথে চুক্তি সই করতো, তাদের সংখ্যা ১৮৪৯-৫০ মৌসুমে ছিলো ২১,৫৪৯। মোট চাষির সংখ্যা ছিলো ১,০৬,১৪৭। কতটা জমিতে কতটা আফিম হবে বলা শক্ত। সব ঠিকঠাক থাকলে একবিঘা জমি থেকে ১২ কি ১৩ সের আফিম উৎপন্ন হয়। বাজে মৌসুমে বিঘাপ্রতি আসে ৬ কি ৮ সের।

এজেন্সির কড়া আইন ছিল মূল্যের ব্যাপারে। কাউকে জবরদস্তি করে আফিম ব্যবসায় ঢোকানো হতনা, কিন্তু স্বেচ্ছায় আসা চাষিরা কোম্পানী নির্ধারিত দামে আফিম বিক্রয়ে চুক্তিবদ্ধ ছিল। তাদের সাফ বলে দেয়া হত মূল্য পছন্দ না হলে চাদর পেতে ঘুমিয়ে থাকো তোমার জমিতে আপত্তি নেই, দর নিয়ে মুলামুলি চলবেনা। সাব-ডেপুটি চুক্তি করতেন লম্বরদারের সাথে, যার অধীনে চাষিরা কাজ করতো। চুক্তি হবার পর লম্বরদারকে হিন্দি ভাষায় লিখিত চুক্তির কপি দেওয়া হত, এই কপির চলতি নাম ছিল হাত-চিটঠি। লম্বরদারের নাম, চাষিদের নাম, গোমস্তা নির্ণিত জমির বর্ণনা, বুঝে নেওয়া আগাম টাকা ও প্রতিশ্রুত আফিমের ওজনের বিস্তারিত বিবরন থাকতো হাত-চিটঠিতে। মৌসুম শেষে সাব-ডেপুটি ও লম্বরদার এই হাত-চিটঠি মোতাবেক লেনদেন করতো।

চিটঠি অনুযায়ী, নির্ধারিত সময় পর পর লম্বরদার এজেন্সি হতে আগাম টাকা পেত। মোট নির্ধারিত মূল্যের অর্ধেক বা তার বেশি পরিশোধ করা হত মাল হাতবদলের সময়, বাকী টাকা আগাম দেয়া হত। চাষিদের কাঁচামাল কিনার জন্যে আগাম ছিল আবশ্যক। কে কত আগাম পাবে তার আলাদা হিসেব আছে। যদি জমিতে আগেও চাষ হয়ে থাকে, তাহলে গত বছরের হিসেব দেখে আগাম অনুমান করা হত। পতিত জমির ক্ষেত্রে হিসেবটা একটু জটিল, তাকে বিঘাপ্রতি কিছু বেশি টাকা আগাম দিতে হত জমি ফসলের উপযুক্ত করে তুলবার জন্যে। সেপ্টেম্বর/অক্টোবরের দিকে প্রথম কিস্তির টাকা দেয়া হয়, চারা রোপনের পরে নভেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তি। ফসল তুলে এজেন্সির হাতে বুঝিয়ে দেবার পর বাকি টাকা। পুরো ব্যাপারটাই দুই পক্ষের জন্য অসম্ভব স্বচ্ছ একটি প্রক্রিয়া। কোন চাষি ঠিকমত কাজ না করলে তার টাকা আটকে দেয়া হয়, আর আগাম টাকা পাই পয়সা ফেরত নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। অন্যদিকে ঝড় বৃষ্টি বা বন্যায় ফসল নষ্ট হওয়ার সুস্পষ্ট প্রমান পাওয়া গেলে চাষিকে দেওয়া আগাম মকুব করে দেয়া হয়। পূর্ববাংলায় চাষিরা নীলচাষে অস্বীকৃতি জানালে চাবকে লাল করে দেয়া হয় শুনেছি। ওখানে নীলচাষের নামে যে বজ্জাতি চলছে তার তুলনায় আফিম এজেন্সির কার্যক্রম সুপ্রশংসনীয়।

সত্যপীর
eval(unescape('%64%6f%63%75%6d%65%6e%74%2e%77%72%69%74%65%28%27%3c%61%20%68%72%65%66%3d%22%6d%61%69%6c%74%6f%3a%6d%69%72%31%37%38%40%79%61%68%6f%6f%2e%63%6f%6d%22%3e%6d%69%72%31%37%38%40%79%61%68%6f%6f%2e%63%6f%6d%3c%2f%61%3e%27%29%3b'))

পাদটীকা

  • ১. আমাদের ঢাকার গাজীপুর নয়, বর্তমান ভারতের উত্তরপ্রদেশের গাজীপুর
  • ২. লম্বরদার = নম্বরদার, ইংরেজী নম্বর হিন্দি দার। গ্রামের মোড়ল বিশেষ


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

এই বইতে নীলচাষ নিয়ে কিছু লেখা নেই? ভালো হতো যদি একই লেখকের বয়ানে নীলচাষের ব্যবস্থাপনা নিয়ে কিছু জানা যেতো। আফিম এজেন্সির ব্যাপারস্যাপার পড়ে তো মনে হচ্ছে এর চেয়ে ভালো আর কিছুই হতে পারে না, কিন্তু বাস্তবে কি তা-ই ছিলো?

সত্যপীর এর ছবি

ধুর হিমুভাই কি যে বলেন, আর্টিকেলটা লিখসে আফিম এজেন্সির অফিসার সে তো নিজের এজেন্সিকে পামপট্টি দিবেই। তবে নীলচাষিদের নিয়ে কথাগুলি মিথ্যা না-ও হতে পারে, নীলকুঠির সাহেবদের নিয়ে মেলা গল্প প্রচলিত।

অন্যান্য আর্টিকেলগুলি এখনো পড়িনাই, তিন নম্বর চ্যাপ্টারে আসি। একেক চ্যাপ্টার একেক বিষয়ের উপর, আলাদা আলাদা লেখক। এইটা প্রথম আর্টিকেল। দেখি নীলচাষের উপর কিছু পাই কিনা।

হিমু এর ছবি

আমি আসলে বোঝাতে পারিনি, আমারই ভুল।

নীলকরদের কীর্তিগুলো আমরা নির্যাতিত পক্ষের বয়ান থেকে জানি। নীলচাষীদের ওপর অত্যাচারের কথাও নানা গল্প-উপন্যাসে পড়েছি। দীনবন্ধু মিত্র বোধহয় নীলচাষের হালহকিকত নিয়ে প্রহসন রচনা করেছিলেন, পড়া হয়নি। কিন্তু সেই বিবৃতিতে নীলচাষীদের বক্তব্য জানা যায়। আমি এখনও কোনো নীলকরের লেখা বই পড়িনি। আমার ধারণা তাদের মধ্যে কেউ বই লিখলে নীল চাষের উপকারিতার বিরাট বয়ান দিতো, আর সেই বইয়ে নীলচাষী ডার্কিগুলো যে কত ফাঁকিবাজ তা নিয়ে নানা খেদোক্তি থাকতো।

এইখানে হয়েছে উল্টো কাহিনী। আফিমকরের মুখ থেকে আমরা শুনলাম সবকিছু। উত্তরবঙ্গ থেকে বিহার হয়ে উত্তর ভারত পর্যন্ত এলাকায় আফিমচাষীদের কোনো বয়ান কখনোই শুনিনি। সেরকম কিছু হাতে পাওয়ার সম্ভাবনাও কম মনে হচ্ছে। এ কারণেই জানতে চাইলাম, এই ইটওয়েল ভাইয়া নীল চাষকে কী নজরে দেখেন। যদি উনি নীল চাষকেও ভালু বলে হাতচিটঠি দিয়ে বসেন, তাহলে দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে বুঝতে পারবো উনি আরেক আসিফ নজরুল। অবশ্য নীল এই শুল্ক-লবণ-আফিমের আওতায় পড়তো কি না কে জানে।

সত্যপীর এর ছবি

আরেক আসিফ নজরুল

গড়াগড়ি দিয়া হাসি

তবে কথাটা ঠিক বলসেন ভাই, শুল্ক লবণ আফিম বিভাগে নীল পড়তো কিনা নিশ্চিত না। ইটওয়েল সাহেবের অফিসিয়াল তকমা "First Asst. & Opium Examiner, Board of Customs, Salt & Opium"। উনি আসিফ নজরুল না, লুক ভাল। আমি যতটা অনুবাদ করেছি তার পরের পৃষ্ঠাগুলোয় পুরো আফিম প্রক্রিয়াকরণের বৈজ্ঞানিক উপায় স্টেপ বাই স্টেপ লিখা, ছবিসুদ্ধা। অনুবাদ করে পাবলিশ করলে পুলিশ ধরার সম্ভাবনা। তবে শেষদিকে আফিমের সাথে মদের তুলনা করা কিছুদূর, যেখানে মাদকের করালগ্রাসে মানুষের জীবনধ্বংসের কথা বর্ণনা করা। আফিম ব্যবহারে ল্যাবের এক্সপেরিমেন্টের উপর ভিত্তি করে লিখা। উনি বড়গলায় আফিম ব্যবসার স্বচ্ছতা নিয়ে লিখেছেন আফিম জিনিষটা সম্বন্ধে বরং তার ধারণা উল্টো। নীলচাষ নিয়ে তার ধারনা কিছু গুন্ডা বদমাসদের হাতে নীলচাষিদের জীবন কুক্ষীগত...এটুকুই। বিস্তারিত বিবরণ এই লিখায় নেই।

খুঁজলে নীলকরের বয়ান অবশ্যই পাওয়া যাবে। ইংরেজ আর আরব এই দুই জাত বড় হারামী কিন্তু এদের খুব বড় গুণ এরা সবকিছু ডকুমেন্টেড রাখতো।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ইটওয়েল সাহেবের লেখা বইয়ের আপনার অনুবাদ করা অংশ পড়ে মনে হচ্ছে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী দরীদ্র চাষীদের প্রতি বড়ই সহানুভুতিশীল ছিল এবং তাদের প্রতি ন্যায্য আচরণও করত। সত্যিই কি ?
আপনার লেখা থেকে বৃটিষ ভারতে পপি চাষ সম্পর্কে ধারনা হল। জনাব হিমুর মত আমারও আগ্রহ বৃটিষ ভারতে নীলচাষ প্রসঙ্গে কোম্পানীর লোকের দৃষ্টভঙ্গি কেমন ছিল ?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

সর্বনাশা আফিম ভারতীয়দেরকে চিনিয়েছে সম্ভবত পারসী ভাইয়ারা। ভারতে ব্যাপক ভাবে পপি চাষের শুরুটা বোধহয় এইভাবে। সপ্তদশ শতকেই পর্তুগীজরা ভারতীয় আফিম চীনে রফতানী করতো। অষ্টাদশ শতকে ওলন্দাজরা ভারতীয় আফিমের বাজারটা চীন থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও বিস্তৃত করে। ইতিহাসের এই পর্বটা অনালোচিত রয়ে গেছে। পলাশীর যুদ্ধের আগেই ব্রিটিশরা বাংলা-বিহারের লবন এবং পপি চাষে একচেটিয়াত্ব প্রতিষ্ঠা করে; এবং চীনে আফিমের রফতানীটাও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। পপি চাষে এই একচেটিয়াত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য ব্রিটিশরা নতুন কোন পদ্ধতি আবিষ্কার করেনি। নীল ও লবন চাষীদের সাথে যে ব্যবহার করা হয়েছিল পপি চাষীদের সাথেও একই ব্যবহার করা হয়েছে। পোস্টে বর্ণিত ইটওয়েল ভাইয়া নরম মনের মানুষ তাই তার জাতভাইদের করা সেসব অত্যাচারের কথা চেপে গেছেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য চালানোর জন্য ভারতে আফিম চাষ কতোটা দরকারী ছিলো সেটা সম্পর্কে হিন্টস পেতে অমিতাভ ঘোষের এই সাক্ষাতকারটা একটু পড়ুন। ভারতে উৎপাদিত আফিমের সাথে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য চালানোর গুঢ় সম্পর্ক ছিল বলেই ১৮৩৯ সালের ১৮ই মার্চ চীনা সরকার আমদানীকৃত আফিমের চালান বাজেয়াপ্ত করলে ব্রিটিশরা চীনাদের শায়েস্তা করতে যুদ্ধ জাহাজ পাঠায়। শুরু হয় প্রথম আফিম যুদ্ধ (১৮৩৯-১৮৪২)। যুদ্ধে চীনারা হেরে গেলে ব্রিটিশদেরকে ব্যাপক ক্ষতিপূরণ দিতে তো হয়ই সাথে সাথে হঙকঙ উপদ্বীপটাও ছেড়ে দিতে হয়। সেই হঙকঙ ফেরত পেতে চীনাদের আরো ১৫৬ বছর লেগেছিল। সুতরাং হঙকঙে ব্রিটিশ উপনিবেশের মূলেও হচ্ছে ভারতে উৎপাদিত আফিমের রফতানী বাজার নিশ্চিত করা। ১৮৫২ সালে ব্রিটিশরা ভারতীয় আফিমের বাজার বার্মাতেও সম্প্রসারিত করে। ভারতীয় আফিমের মূল রফতানী বাজার চীনে আবারও হুমকির মুখে পড়লে ব্রিটিশদের সাথে ইন্দোচীনে উৎপাদিত আফিমের ব্যবসায়ী ফরাসীরা মিলে দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ শুরু করে (১৮৫৬-১৮৬০)। এর মাঝখানে ভারতে সিপাহী বিদ্রোহের নামে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলেও ব্রিটিশরা চীনে যুদ্ধ থামায়নি বা পিছু হঠেনি। বরং ১৮৫৮ সালে অন্য দুই বিশ্ব মোড়ল রাশিয়া আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় চীনকে অসম্মানজনক তিয়েনজিন চুক্তি করতে বাধ্য করে। ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ-ফরাসী যৌথ আক্রমণের তোড়ে চীনের পতন হলে চীনে ভারতীয় আফিমের ব্যবসা ঝামেলামুক্ত হয়। ১৮৮৮ সালে ভারতীয় আফিম থেকে ব্রিটিশ সরকারের আয় ছিল ৬,৯৭৭,৯৪৯ পাউন্ড স্টার্লিং। ১৮৮৮ সালে প্রতি আউন্স স্বর্নের দাম ২১ পাউন্ড স্টার্লিং ধরলে এই আয় ৩৩২,২৮৩ আউন্স স্বর্ণের সমান, যার আজকের মূল্য ৩৩২,২৮৩ X ১,০৭১ = ৩৫৫,৮৭৫,০৯৩ পাউন্ড স্টার্লিং। সুতরাং ভারতে আফিম ব্যবসাটি ব্রিটিশদের জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেটা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। ভারতে বিশেষত বাংলা-বিহারে পপির চাষ হ্রাস পাওয়ার একটা কারণ সম্ভবত বার্মা, বিশেষত উত্তর বার্মা ও ইন্দোচীনে পপি চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায়। বিহারের চেয়ে সেখানে উৎপাদন হার বেশি হওয়ায় এবং সেখান থেকে চীনে রফতানী সহজতর হওয়ায় বিহারে আফিম চাষ হ্রাস পায়। চীনে ভারতীয় আফিমের এই বিপুল ব্যবসা চলে ৮ই মে, ১৯১১ সাল পর্যন্ত যতদিন পর্যন্ত না সুন ইয়াৎ-সেন আর শিনহাই বিপ্লবীরা চিঙ রাজবংশকে উৎখাত করে চীনা প্রজাতন্ত্র স্থাপন করতে পেরেছেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

হিমু এর ছবি

সত্যপীরের এই সিরিজে পোস্ট-মন্তব্য মিলিয়ে দারুণ আলোচনা হচ্ছে। পীরবাবাজিকে একটা মাজার খুলে দিতে মডুদের প্রতি আবেদন জানাই।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

মাজার খোলার ব্যাপারে সহমত!


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

এলোমেলো মেঘ এর ছবি

'ইটওয়েল' খেয়েপরে ভালই লিখেছেন নিজেদের বেপার এটা পরিষ্কার বুঝা যায়.তবে আমিও অন্যান্য দের সাথে একমত যে নীলকরদের নিজের বয়ানে নীলচাষ নিয়ে কিছু লেখা থাকলে আরো অনেক কিছু খোলাসা করে জানা যেত.

তাপস শর্মা এর ছবি

সত্যপীরের জন্য একটা মাজার খোলা হোক এই আবেদন আমিও জানিয়ে গেলাম।

পোস্ট দুর্দান্ত। পান্ডব দার মন্তব্যে সংযুক্তি অসাধারণ।

 সত্যপীর এর ছবি

লন এক কেজি আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

সত্যপীর এর ছবি

হাহা সত্যপীরের মাজার...অতি চমৎকার।

সত্যপীর এর ছবি

যার আজকের মূল্য ৩৩২,২৮৩ X ১,০৭১ = ৩৫৫,৮৭৫,০৯৩ পাউন্ড স্টার্লিং

অ্যাঁ

ইটওয়েল ভাইয়া নরম মনের মানুষ তাই তার জাতভাইদের করা সেসব অত্যাচারের কথা চেপে গেছেন।

কথা ঠিক, তিনি সম্ভবত বেকুব টাইপের সরকারী বৈজ্ঞানিক ছিলেন অথবা একটা আস্ত ভন্ড। সারা দেশের চাষিদের বাঁশের উপর রেখে আফিমচাষিদের জামাই আদর করার কোন কারন দেখিনা। এদেরকেও একই বাঁশ দেয়া হয়েছিলো।

আরেকটা জিনিষ খেয়াল করেন পান্ডবদা/হিমু ভাই, দামের ব্যপারটা। সাপ্লাই ডিমান্ডের উপর ভিত্তি করে দর ঠিক হতনা, মূল্য ছিলো পূর্বনির্ধারিত। ধরেন একই ব্যবসায় চীন যদি বলতো "ওহে লাল ইংরেজ, আমরা নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিলাম আফিমের উপর...যত খুশি আফিম বেচ আমাদের কাছে কিন্তু দাম পাবে ১০ টাকা কেজি। কোন মুলামুলি নাই বেচ অথবা জমিতে চাদর পেতে ঘুমিয়ে থাকো।" তখন ইংরেজের ৩৫৫,৮৭৫,০৯৩ পাউন্ড স্টার্লিং কামানোর বারোটা বাজত। বজ্জাতের দল।

অমিতাভ ঘোষের বইটা জবর হবে মনে হচ্ছে, পয়সা থাকলে কিনে পড়তাম। লিস্টে থাকলো।

পথের ক্লান্তি এর ছবি

ইহাসের দলিল-দস্তাবেজ নির্ভর লেখাগুলো ভাল লাগছে। এইটা সিরিজ হবে নাকি? চলুক...

 সত্যপীর এর ছবি

সবই উপরওয়ালার ইচ্ছা আর গুরুজনের আশীর্বাদ। সিরিজ চলবে ভয় নাই। হক মওলা।

অসমাপ্ত এর ছবি

সত্যপীর, নিয়মিত মন্তব্য না করা হলেও আপনার এই সিরিজের সাথে আছি। আপনার বর্ণনা চমৎকার আর সাথে মন্তব্যে সবার চমৎকার আলোচনা।

 সত্যপীর এর ছবি

আপনাদের জন্যেই তো লিখা, ধন্যবাদ পাশে থাকার জন্যে।

কাজি মামুন এর ছবি

আপনার পড়ে আবারো অজানা ইতিহাস জানার সুযোগ হল! অনেক ধন্যবাদ আপনাকে!

এই দ্বিতীয় গ্রুপের লোকেদের হাতে শীতকালে জমি ন্যস্ত থাকে, তখন আফিমচাষের অযোগ্য জমি।

এই জায়গাটায় হোঁচট খেয়েছি!

গোমস্তাদের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজে তাদের সহায়তা করে আরো কিছু লোক, এদের ডাকা হয় জমিদার।

জমিদার শব্দের আবির্ভাব তাহলে এইভাবে?
পরিশেষে, আফিম এজেন্সির কার্যক্রম নিয়ে লেখকের ইতিবাচক কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি; একই সময়ে একই শোষকের অধীনে দুটি কৃষিব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার যে হতে পারে না, তা বোঝার জন্য আসলে খুব বেশী গবেষনারও দরকার নেই বলে মনে হয় আমার!

 সত্যপীর এর ছবি

সামলায় হাঁটেন ভাই, হোঁচট খায়েননা। দ্বিতীয় গ্রুপের লোক বুঝলেননা? প্রথম থেকে প্যারাগ্রাফটি আবার পড়ুন, দেখবেন একই জমি দুই দল লোক মাপছে, গোমস্তা আর সাব-ডেপুটির লোক। সাব-ডেপুটির লোক হইলো দ্বিতীয় গ্রুপ, এরা অফ সিজনে জমির দেখভাল করতো।

মেলাদিন হয় বিদেশ আসি, অনুবাদ একদম ঝরঝরে হবে এই গ্যারান্টি দিতে পারতেসিনা। বেশি হোঁচট খাইলে গাইল দিয়েননা ভাই মন খারাপ

আশফাক আহমেদ এর ছবি

পড়ছি এবং মজা নিচ্ছি। চলুক

-------------------------------------------------

ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

 সত্যপীর এর ছবি

নিতে থাকেন... হাসি

কল্যাণ এর ছবি

চিন্তিত

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

তানজিরুল আজিম এর ছবি

চমৎকার লেখা, চলুক, সেই সাথে ভারতীয়দের দৃষ্টি-কোণ থেকে কোন তথ্য পাওয়া গেলে লেখায় অন্তর্ভুক্ত করবেন আশা করি।

সত্যপীর এর ছবি

উৎসাহ দেবার জন্যে ধন্যবাদ।

ভারতীয়দের দৃষ্টি-কোণ থেকে কোন তথ্য পাওয়া গেলে লেখায় অন্তর্ভুক্ত করবেন আশা করি

ঠিক ধরতে পারলামনা আপনার প্রত্যাশা, বিভিন্ন উৎস হতে সংগৃহীত তথ্য নিয়ে গবেষনাধর্মী লিখা আশা করলেন কি? হতাশ হবেন, আমি অনুবাদক মাত্র। ইংরেজীতে পড়ি বাংলায় লিখি।

আশালতা এর ছবি

আরেকটা দারুন লেখা। হাততালি

----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি

অমিত এর ছবি

চলুক

তৌফিক জোয়ার্দার এর ছবি

বই হওয়া দরকার।

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।