বাদশা মিয়ার হাঁপানির টান উঠেছে।
নিঃশ্বাস নিতে গেলে জীবন বেরিয়ে যাওয়ার মত কষ্ট হচ্ছে তার। চারিদিকে বাতাসের ছড়াছড়ি, কিন্তু তার মধ্যে একটু বাতাসও বাদশা মিয়ার জন্যে না। বেঁচে থাকার জন্য যা কিছু দরকার, তার সবটুকুই যুদ্ধ করে আদায় করতে হয়। নিঃশ্বাস নেওয়ার লড়াই করে বাদশা মিয়ার সেটা বুঝে নিতে হচ্ছে। সে প্রানপণে শ্বাস টানে। তার বুক হাপরের মত ওঠা নামা করে। তাতে তেমন কোন লাভ হয় না। বায়ু শূন্য বুকে বাদশা মিয়া কিছুক্ষণের জন্য হাল ছেড়ে দেয়; পরক্ষণে আবার যুদ্ধ শুরু করে।
বাদশা মিয়ার পরিচয়, সে একজন বর্গা চাষি। বয়স ৭০ এর মত। এই দীর্ঘ সময়ে দারিদ্র কখনও তাকে ছাড়েনি। তার পুত্র মোহর আলি পিতার অপ্রসন্ন ভাগ্য উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। মোহর আলিও বর্গা চাষি। কঠিন পরিশ্রমে সে গতবার চেয়ারম্যানের পরিত্যক্ত জমিতে সোনা ফলিয়ে ছেড়েছিল। কার্তিকের শেষে সবুজ ধানের ছড়া হাতে ধরে চেয়ারম্যান বলেছিল, “মোহর, তোর কাজে আমি অনেক খুশি হয়েছি। এই ফসলের তিন ভাগের এক ভাগ তোর পাওনা, কিন্তু আমি তোকে অর্ধেক দেব। কি খুশি তো?” মোহর আলি সেদিন তার ভাগ্যকে চিনতে পারেনি। সৌভাগ্য ব্যাপারটা তার কাছে তখন অচেনা ছিল। এখনও অবশ্য অচেনাই আছে। সেই ধানের প্রায় পুরোটাই কিভাবে কিভাবে যেন চেয়ারম্যানের গোলায় উঠে গেছে। পারিশ্রমিক হিসেবে সে যা পেয়েছে, তাকে উচ্চশ্রেণীর রসিকতা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।
বাদশা মিয়া খক খক করে কাশে। তার শ্বাস নিতে আরও কষ্ট হয়। পাশে রাখা মাটির মালশায় সে থুতু ফেলে। কফের সাথে কিছুটা রক্ত বের হয়ে আসে। বাদশা মিয়া হতাশ চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। মোহর আলি হেকমত কবিরাজের তেল পড়া গভীর বিশ্বাস নিয়ে পিতার পিঠে বুকে মালিশ করতে থাকে। তাতে অবস্থার কোন উন্নতি হয় না। বাদশা মিয়ার বুকে ঘড়ঘড় শব্দ হয়।
মোহর আলি জিজ্ঞাসা করে, “ বাজান, শইলডা একটু কি ভালা লাগে?”
বাদশা মিয়া অনেক কষ্টে না সূচক মাথা নাড়ায়। মোহর আলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “ঠিক হইয়া যাইব বাজান, আল্লারে ডাকো।”
বাদশা মিয়া কিছু বলে না। তার গলা দিয়ে গোঙানির মত শব্দ বের হয়।
মোহর আলির স্ত্রী জুলেখা স্বামীর পাশে ভীত চোখে দাঁড়িয়ে আছে। বাচ্চা মেয়ে, সে কোনদিন মৃত্যু দেখেনি। তবুও সে যেন এই ঘরে মৃত্যুর উপস্থিতি টের পায়। বাদশা মিয়া যুদ্ধ করতে করতে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। তার সাথে অপেক্ষা করে মোহর আলি আর জুলেখা।
বাদশা মিয়ার খাটের পাশে জায়নামাজ বিছিয়ে মাওলানা ইবাদত আলি কোরান খতম দিচ্ছেন। মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের কানে পাক কালামের শব্দ পৌঁছে দিলে তার অনেক গুনাহ মাফ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর বাদশা মিয়াকে তওবা পড়ানো হবে। দারিদ্রের তাড়া খেতে খেতে বাদশা মিয়া গুনাহ করার সুযোগ তেমন পায় নি। তবুও মানুষ মাত্রেই গুনাহগার। আল্লাহের কাছে মাফ চেয়ে যতটা পাপ মুক্ত হওয়া যায়।
ইবাদত আলি তওবা পড়িয়ে চলে যাওয়ার পর মোহর আলি চোখ ভর্তি পানি নিয়ে পিতাকে জিজ্ঞাসা করে, “বাজান, কিছু খাইতে মন চায়?”
বাদশা মিয়া কিছু বলে না। শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।
গলায় কান্না নিয়ে মোহর আলি জানতে চায়, “বাজান, কিছু মন চায় তোমার?”
শ্বাস নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে তিন চার বারের চেষ্টায় বাদশা মিয়া জানায়, সে একবার ঢাকায় গিয়ে ডাক্তার দেখাতে চায়।
জুলেখার নাকফুল কানের দুল আর একটা সরু চেইন বন্ধক রেখে সাড়ে সাত হাজার টাকা পায় মোহর আলি। শীতের এক ক্ষুদ্র বিকেলে প্রায় মৃত বাপকে নিয়ে সে থ্রি হুইলারে উঠে বসে।
মধ্যরাতের ঢাকা মেডিকেল কলেজ ইমারজেন্সি গেটে দাঁড়িয়ে নিজেকে অনেক অসহায় লাগে মোহর আলির। এই জায়গাটা বহু মানুষের দুঃখের মিলনস্থল। এরকম সুখের মিলন ক্ষেত্রও হয়ত আছে কোথাও। মোহর আলি মুমূর্ষু বাদশা মিয়াকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে হাসপাতালে ঢুকে যায়।
সরকারি হাসপাতালের অবস্থা ঠিক সরকারের মতই বেহাল। মেঝেতে রোগী আর রোগ জীবাণু একত্রে বসবাস করছে। কর্তব্যরত ডাক্তারের কাছ থেকে মোহর আলি জানল বাদশা মিয়ার হার্ট এবং কিডনি দুইয়ের অবস্থাই খুব খারাপ। আই সি ইউ নামের এক বিশেষ জায়গায় রোগীকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা করতে হবে।
সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যাবস্থা করা গেল না। ডাক্তার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দিয়ে দিলেন, যেখানে কম খরচে এই চিকিৎসা পাওয়া যেতে পারে।
বাতাসের ক্ষুধায় অর্ধমৃত বাদশা মিয়াকে নিয়ে মোহর আলি ঢাকার স্বনামধন্য এক বেসরকারি হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে তার নাম পড়তে চেষ্টা করে। বিদ্যায় কুলায় না। মোহর আলি রোগী ভর্তির ব্যাপারে কথা বলতে এগিয়ে যায়।
“আই সি ইউ এবং ডায়ালাইসিস দিয়ে প্রথম দিনে খরচ হবে ত্রিশ হাজার টাকা।” প্রথম দুটি শব্দ মোহর আলি বুঝতে পারে না। টাকার অঙ্কটা বুঝতে পারে। পিতার শেষ ইচ্ছা আর মৃত্যুর মধ্যে দূরত্ব এই টাকার অঙ্কের সমান। এটা তার চেয়ে ভাল আর কারও বোঝার কথা না। প্যান্টের পকেটে সাত হাজার টাকা খামচে ধরে মোহর আলি। বন্ধকের গহনা গুলো ছাড়ানো ছাড়া এগুলোর আর কোন ব্যবহার খুঁজে পায় না সে।
শ্বাসকষ্টে কুঁকড়ে যাওয়া বাদশা মিয়াকে নিয়ে মোহর আলি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসে। পিতার শেষ ইচ্ছার অস্পর্শনীয় উচ্চতা তাকে বিদ্রুপ করে। অশ্রুময় চোখে সেই বিদ্রুপ উপভোগ করে মোহর আলি। তাদের নামের সাথে বাস্তবতার অমিল বাদশা মিয়ার শেষ ইচ্ছের মতই অপূরণীয়। আদতে নিঃস্ব একজন বাদশা মিয়ার কপর্দক শূন্য সন্তান মোহর আলি, ত্রিশ হাজার টাকা যার জন্য রূপকথার মতই অলীক। বাদশা মিয়া আর মোহর আলির কেউই হয়ত জানে না, তাদের মত আর একজন আছেন। নিজের নামের সাথে বিস্তর পার্থক্য নিয়ে যিনি দুনিয়া চালাচ্ছেন; তার নাম সর্বশক্তিমান। হঠাৎ কি মনে করে মোহর আলি হাসপাতালের বারান্দার দিকে ছুটে যায়।
একখানা কড়কড়ে কাগজ মোহর আলি ধরিয়ে দেয় বাদশা মিয়ার হাতে। এটাকে বলে প্রেসক্রিপশন। হাসপাতাল থেকে পাঁচশো টাকার বিনিময়ে সে এটা ‘কিনে’ এনেছে। কত গুলো ওষুধের নাম লেখা তাতে। বাদশা মিয়া কাগজ খানা হাতে ধরে গভীর তৃপ্তি বোধ করে। ঢাকায় এনে তার ছেলে তার চিকিৎসা করিয়েছে বড় ডাক্তার দিয়ে। এই ওষুধ শুরু করতে পারলে নিশ্চয়ই সে সেরে উঠবে। বাদশা মিয়ার শ্বাসকষ্ট তীব্রতর হয়। সে শক্ত করে তার হাতের কাগজ খানা আঁকড়ে ধরে।
পরিশিষ্টঃ
বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই বাদশা মিয়া মারা যায়। তার বসত বাড়ির পিছনে বাপ দাদার কবরের পাশে তার কবর হয়। পাঁচশো টাকার সেই প্রেসক্রিপশনটা কোথায় তা কেউ জানে না। ওটাকে বাদশা মিয়ার কবরে দিয়ে দিতে পারলে ভাল হত। সবচেয়ে ভাল হত কবরের গায়ে এপিটাফ হিসেবে ঝুলিয়ে দিতে পারলে। একজন আছেন যিনি মানুষের জন্ম মৃত্যুর পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব রাখেন। দূর অন্তরীক্ষে বসে এই অদ্ভুত এপিটাফ দেখে তিনি হয়তো গভীর আনন্দ বোধ করতেন।
______
শুভ্র সৈকত
মন্তব্য
ভালো লিখেছেন।
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
ব্লগে এটা আমার প্রথম লেখা। স্বাগত মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ
আপনার গল্প এবং বিশেষত আপনার লেখনশৈলী আমার অসাধারণ লেগেছে । খুবই ভালো লেগেছে । ধন্যবাদ । আমার ভাল লাগা কয়েকটা লাইন নীচে উদ্ধৃত করছি ।
"চারিদিকে বাতাসের ছড়াছড়ি, কিন্তু তার মধ্যে একটু বাতাসও বাদশা মিয়ার জন্যে না"
"অশ্রুময় চোখে সেই বিদ্রূপ উপভোগ করে মোহর আলি ।"
"......তাদের মত আরেকজন আছেন । নিজের নামের সাথে বিস্তর পার্থক্য নিয়ে যিনি দুনিয়া চালাচ্ছেন;"
"দূর অন্তরীক্ষে বসে এই অদ্ভুত এপিটাফ দেখে তিনি হয়তো গভীর আনন্দ বোধ করতেন ।"
আপনার পরবর্তী গল্পের অপেক্ষায় থাকব ।
সম্মানিত বোধ করছি। ধন্যবাদ
"অবাঙমানসী" মানে কী? এই শব্দ আগে কখনো শুনিনি।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
"অবাঙমানসী" শব্দটা "অবাঙমানসগোচর" থেকে ধার করেছি। অর্থটা যাতে এমন দাঁড়ায় যে "বলে ফেলা যে ইচ্ছা শেষ পর্যন্ত পূর্ণ হল না।" অর্থ খুব মজবুত হয় নি, কিন্তু শব্দটির শ্রুতি সৌন্দর্যের কাছে হার মেনেছি। একটা বিমূর্ত নামকরন ভাবও প্রকাশ পেল।
ধন্যবাদ। আপনি যদি একটি শব্দ নির্মাণ করেন, তাহলে তার উৎপত্তিটা লেখার শেষে বা ফুটনোটে এমন কোথাও দিয়ে দেবেন। নয়তো পাঠক শব্দটার অর্থ বুঝতে না পারলে আপনার পরিশ্রমটা বিফলে যাবে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আরো লিখুন।
অনেক অনেক লেখার ফাঁকে কোন একদিন যখন আবার এ পাতায় ফিরে আসবেন, কোথাও কোথাও বদলে দেয়ার ইচ্ছে হয় কি না দেখার অনুরোধ রইল।
সচল সমৃদ্ধ হোক আপনার লেখায়।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
আমি আস্তিক মানুষ, তাই লেখার কন্টেন্ট নিয়ে না বলি।
আপনার লেখার হাত ভালো। আরও লিখুন, পড়তে ভালো লাগবে আশা রাখি।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
আপনার লেখার মাঝের আবেগটুকু মন ছুয়ে গেল।
যাক পরিচিত জনের লেখা দেখে ভাল লাগল। তোর লিখার হাত ভালো আগেই দেখেছি। সচলায়তনে নিয়মিত লিখতে থাক। শুভকামনা রইল।
ভাল লাগল লেখাটা। কিছু কিছু লাইন চমকে দিল। আরো অনেক লিখুন
নতুন মন্তব্য করুন