রিকশাটা থামল প্রকান্ড একটা গেটের সামনে । আমি আব্বুর কোল থেকে নামলাম , চোখ মেলে দেখলাম গেটের ওপাশে একটা ইটের রাস্তা শুরু হয়ে থেমে গেছে একটা পলেস্তরা খসে পরা বিল্ডিং এর সামনে । বিল্ডিং এর উপরের দিকে বড় বড় করে লেখা “খুলনা পাবলিক কলেজ” । কলেজ ? আজব, আমি তো এসেছি একটা স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি পরীক্ষা দিতে কিন্তু নামে তো স্কুল বা বিদ্যালয় কথাটার নামগন্ধও নেই । আব্বুকে জিজ্ঞাসা করতেই জানা গেল যে নামে শুধু কলেজ হলেও এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসলে তৃতীয় শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করার ‘সুব্যাবস্থা’ আছে । নামের রহস্য তো ভেদ হল কিন্তু এই কিশোর আমি তখনো জানতাম না এই কলেজ আমার জন্য আগামী আট বছর আরও অনেক রহস্য,আনন্দ,রোমাঞ্চ আর অতি অবশ্যই ‘শিক্ষা’ নিয়ে অপেক্ষা করছে ।
আসলে স্কুল ,কলেজে আমরা কি করি ? পড়াশোনা করি ? হ্যাঁ তা করি বটে তবে আমার মনে হয় আসলে আমরা একটু একটু করে বড় হই আমাদের অজান্তেই । কিন্তু আমরা তখন বুঝতে পারি না। এই জন্য আমাদের খুব রাগ হত ঐ বুড়ো স্যারগুলোর ওপর যারা সারাদিন ঘ্যানঘ্যান করে বলত ঠিক মতো পড়াশোনা করতে , গাদা গাদা হোমওয়ার্ক দিয়ে আমাদের অবসর সময়গুলো দুঃস্বপ্নে পরিণত করতেন, বিভিন্ন হাইব্রিড জাতের উপদেশ দিয়ে আমাদের কর্ণকুহরের সহ্য ক্ষমতার পরীক্ষা নিতেন । কিন্তু সবার জীবনেই একটা সময় আসে যখন স্যারদের প্রতি এই রাগগুলো, কৃতজ্ঞতা দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়ে যায় ।
হঠাৎ কোন এক মন ভালো বা মন খারাপ দিনে কলেজের টুকরো স্মৃতিগুলো যখন মনে পড়ে তখন যে অদ্ভুত অনুভুতি সৃষ্টি হয় সেটা হয়তো রবিবুড়ো প্রকাশ করলেও করতে পারতেন তবে তা আমার কম্ম নয় । মনে পড়ে সমাজ শিক্ষক বণিক স্যার ক্লাসে এসে জিজ্ঞেস করতেন , “পুড়া হইছে ? পুড়া না হইলে ব্যাঞ্চের উপরে দাঁড়াও । ” শারীরিক শিক্ষা বিভাগের মাজিদ স্যার সম্মুখ সমরের নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চিকন একটা বেত নিয়ে অতর্কিত হামলা চালাতেন পিছন দিক থেকে । ড্রয়িং শিক্ষক শামসুল আলম স্যার কলা আঁকতে দিয়ে বেগুন সদৃশ বস্তু আঁকার অপরাধে তিরস্কার করতেন হরহামেশাই । কিন্তু এই লোকগুলোই এখন দেখা হলে নিজের সন্তানের মতো যখন খোঁজ খবর নেন তখন বুঝি আমাদের সঙ্গে আগে কি অভিনয়টাই না তারা করতেন ।
আমি ভুলতে পারি না আর কখনো পারবও না ইংরেজি শিক্ষক তাসিন কাদের স্যারকে । ক্লাসে তিনি মাঝে মাঝে paragraph অথবা essay লিখতে দিতেন । “Importance of learning English” এই paragraph এর শুরুটা যদি হত “English is the first international language of the world ………… ” এর মতো গৎবাঁধা, তাহলে খাতাটা শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে বলতেন , “মুখস্থ জিনিস আমার ক্লাসে লিখবা না ।” কারও খাতায় বানান ভুল পেলে এত জোরে ভুল বানানের ওপর দিয়ে কলম চালনা করতেন, যে খাতাটা পরবর্তীতে আর ব্যবহার যোগ্য থাকত না এবং হাতে কলমে অনুধাবন করতাম যে “অসি অপেক্ষা মসি শক্তিশালী”। আমি বুকে হাত রেখে বলতে পারি যে, আমি জীবনে যতবার সৃজনশীল কিছু করার মুখোমুখি হয়েছি ততবার তাসিন কাদির স্যার আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন ।
আমাদের বাংলা পড়াতেন মুন্সী স্যার । বাংলা গালিসম্ভারের উৎস অনুসন্ধানে তিনি অত্যন্ত ব্রতী ছিলেন । আমাদেরকে জেনেশুনে বাংলা গালাগালি প্রয়োগে উৎসাহিত করতেন । ‘মাগী’ মানে যে মায়ের জাতি এবং ‘খানকি’ মানে যে খন্দকারের স্ত্রী এরকম চমকপ্রদ তথ্য প্রদান করে তিনি আমাদের মধ্যে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন এবং সহপাঠীদের মধ্যে যাদের নামের পূর্বে ‘খন্দকার’ বংশ পরম্পরায় যুক্ত হয়েছে তাদের ভবিতব্য স্ত্রীদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলেন । আরেকজন বাংলা শিক্ষক ছিলেন হারুন স্যার । তার ক্লাসেই বোধ করি আমি প্রথম উড়োজাহাজ নির্মাণের বাস্তব প্রশিক্ষণ লাভ করি এবং আমার প্রস্তুতকৃত প্রথম উড্ডয়নক্ষম উড়োজাহাজ ক্লাস চলাকালীন সময়ে তার টেবিলেই জরুরি অবতরণ করে। তার অভিশাপেই কিনা কে জানে আমি এখন যন্ত্রকৌশলের যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে চলেছি ।
জীববিজ্ঞান পড়াতেন বেনিয়াজ জামান স্যার। যদিও সবাই স্যারকে ভয়ংকর বদরাগী হিসেবেই মনে রাখতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করে কিন্তু আমি স্যারকে জানি একজন আপাদমস্তক বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হিসেবে যিনি মাঝে মাঝেই আমাদের মধ্যে প্রচলিত কিছু কুসংস্কারের চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করতেন আর জীববিজ্ঞানের বিষয়গুলো খুব সুন্দর করে বোঝাতেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে স্যারের ক্লাসে, “যারা উভলিঙ্গ তাদের যৌনাঙ্গ এবং যৌনক্রিয়া কেমন ?” এধরণের প্রশ্ন করার স্বাধীনতা ছিল। স্কুল কলেজের বেশিরভাগ শিক্ষক যখন তাদের অর্জিত জ্ঞান নিয়েই তৃপ্ত থাকেন সেখানে আমাদের বেনিয়াজ জামান স্যার এবং পদার্থ বিজ্ঞান শিক্ষক আলাল স্যার কলেজে শিক্ষকতার পাশাপাশি কোন বিশেষ সুবিধা লাভের আশা না থাকা সত্ত্বেও পি এইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন ।
রসায়ন পড়াতেন ইউসুফ আলি স্যার। স্যারের উৎপত্তিস্থল সাতক্ষীরা বলে প্রতিটি কথার শেষে ‘বোলো’ শব্দটি যোগ করতেন। যেমন – “পড়াটা করি ফেললি হয় বোলো, পড়া না পারলি মাইর হবে নে বোলো ............।” এই জন্য আমরা তাঁকে ‘বোলো’ স্যার হিসেবেই ভাল চিনতাম। রসায়নের আরেকজন শিক্ষক ছিলেন শংকর স্যার। স্যারের বয়স কম এবং তাঁর ব্যাচের ছাত্র ছিলাম বলে তাঁর সাথে সম্পর্কটা একটু বেশীই অশিক্ষকসুলভ ছিল । একবার রাত বারটার পরে আমরা কয়েক বন্ধু মিলে স্যারকে কনফারেন্স কল করেছিলাম। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল , ব্যাপক ধরপাকর চলছে । আমরা ডি জি এফ আইয়ের লোক পরিচয় দিয়ে স্যারকে একটা নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে তাঁর সম্পদের হিসেব দাখিল করার নির্দেশ দিলাম । স্যার প্রথম দিকে একটু ভড়কে গেলেও পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন ,“তোদের কি রাইতে ঘুম আসে না । ” এরপর প্রথম সাক্ষাতেই তিনি হাসতে হাসতে তাঁর বেতের মাধ্যমে আমাদেরকে ডি জি এফ আইয়ের তদন্তের আসল স্বাদ উপভোগ করান।
আট বছরের এরকম আরও আট সহস্রাধিক স্মৃতি হয়তো মনে করা যাবে । তবে ঐ দিনগুলো আর ফিরে পাওয়া যাবে না। হয়তো এই জন্যই ঐ দিনগুলো এত দামী আর আকাঙ্ক্ষিত মনে হয় । কথিত আছে আমাদের কলেজটা নাকি মুক্তিযুদ্ধের সময় কারাগার ছিল। প্রথম প্রথম এই তথ্যটা ঠিক বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করত না কিন্তু কালে কালে যখন দেখলাম এখানে কলেজের ছাত্রদেরও বেতের বাড়ি খেতে হয়, কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ক্লাস থ্রি এর বাচ্চাদের সামনে তখন আর সন্দেহ থাকে না যে এটা অবশ্যই, অবশ্যই কারাগার ছিল। এখন আমি আপাতদৃষ্টিতে মুক্ত স্বাধীন । ক্লাস না করলে কেউ দরখাস্ত নিয়ে আসতে বলে না , পড়া না করলে কান ধরে দাঁড়িয়েও থাকতে বলে না। আমি যখন ইচ্ছে একটা আয়েশি টান দিতে পারি সিগারেটে অথবা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঘুমুতে পারি অঘোরে । বিশ্ববিদ্যালয়ের রাশভারী শিক্ষকরা হয়তো জানেই না যে আমি তাদের ছাত্র । তাই এক একটা সোনালি সকাল বা হলুদ দুপু্র কিংবা কালো রাতে আমি ফিরে যাই সেই কারাগারে ,আমার প্রিয় স্মৃতির কারাগারে...............
# হিল্লোল
মন্তব্য
“মুখস্থ জিনিস আমার ক্লাসে লিখবা না ।”
কয়জন শিক্ষক আর এভাবে বলেন! আপনার শিক্ষককে স্যালুট।
স্মৃতিচারণ ভাল লাগল। কিন্তু লেখককে চেনা চেনা মনে হল যেন...
--------------------------------------------
যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি-বাড়ি যায়
তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।
গুরুর তো শিষ্যকে চেনা চেনা মনে হওয়ারই কথা যাই হোক ভাই আপনার মন্তব্যে উৎসাহিত বোধ করছি !
বন্ধু মনে পরে সে দিন গুলার কথা ।। মনে পরে সেই সব স্যার দের কথা ।। মুন্সী স্যার ,বেনিয়ায জামান স্যার, ইয়সুফ স্যার।।
ও সবচেয়ে বেশি মনে পরে শঙ্কর স্যার, আহা প্রতি দিন সকালে তার হাত না ,, কঠোর বেতের ছোঁয়া না পেলে ভালই লাগত না...।
ও প্রতিদিন ক্লাস পালালে ক্লাস করতে আসাটায় বৃথা ছিল...। miss kori sei awesome college life ke...
শংকর স্যারের জন্য তো আমার কলেজের পুরো দুই বছর হাত ব্যাথা ছিল । তবে লেখায় অনেক স্যারের কথাই বাদ পরে গেছে । বদরুল স্যার , রোকন স্যার , মুকিত স্যার , জুনিয়র হারুন স্যার । ওহ ! কি দিন ছিল মাইরি ?
ভালো লাগল
facebook
স্মৃতিচারণ ভালো লাগলো। খন্দকারদের স্ত্রীদের প্রতি সমবেদনা।
গভীর সমবেদনা
তুমি শখ হায়াতুল হক হিল্লল না? সুন্দর লিখেছ
নতুন মন্তব্য করুন