একটি কালজয়ী উপন্যাস, প্রকাশকাল ১৯৫৬। লেখক সল বেলো। মুলত ছোট্ট আকৃতি ও বিষয়বস্তুর ব্যপ্তিগত কারণে এটিকে নভেলা (novella) আখ্যা দেয়া হয়।
বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের ঘরে থাকা এক যুবকের জীবনের গল্প। মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যপ্তি, নিউইয়র্কের এক হোটেলের দৃশ্যপট। চরিত্রগুলো বিচরন করেছে কম, তবু ও তাদের প্রভাব তীব্র। প্রধান চরিত্র টমি উইলহেম, নায়ক নয় কিংবা নায়কোচিত নায়ক নয়। নায়ক বললেই যে ধরনের অভিব্যক্তি সমেত ব্যক্তি চরিত্র হাজির হয় আমাদের মানসপটে তার চেয়ে ভিন্ন। প্রচলিত পাঠক সে নায়কোচিত নায়ক দেখে অভ্যস্ত। কিংবা তার বিপরীত হলেও আমরা অবাক হইনা, মানে Tragic Hero, কিন্তু এরিস্টটল তার Poetics এ এই জাতকে চিনিয়েছেন কতগুলো তকমা এঁটে। যার মধ্যে আছে—উচ্চ বংশীয় জন্ম, এবং অপরিহার্য অনুষঙ্গ Hamartia যাকে সোজা বাংলায় বলতে পারি চারিত্রিক স্খলন, অথবা নৈতিক দৌর্বল্য যা শেষ বেলা নায়কের অপরিহার্য পতন ডেকে আনে। কিন্তু টমিকে সেই গোত্রেও ফেলে নিশ্চিন্ত হতে পারিনা আমরা। টমি যেন অ-নায়ক, আমার আপনার মত ব্যক্তি, কিন্তু আবার উপন্যাসে সে প্রধান চরিত্র কিন্তু তবু নায়ক বলতে নারাজ আমরা, বেলো ও হয়ত নায়ক বানাতে চাননি তাকে।
তাই সে Hero নয়, বরং protagonist। যাক গে, টমি’র বাবা ডাঃ এদলার একজন সফল মানুষ, পেশায় সফল ব্যক্তিজীবনেও সুখী। টাকার পেছনে ছুটে চকচকে চোখে , ভোগবাদী সমাজের চিত্রায়ন যেন তার ব্যক্তি চরিত্রে আমরা দেখি। টমিকে দেখা যায় সব ক্ষেত্রে ব্যর্থ একজন মানুষ, পেশায় অসফল, কর্পদকশুন্য, স্ত্রী ছেড়ে চলে গেছে দু’ সন্তানসহ। ডিভোর্স চায়না তার স্ত্রী। স্ত্রীর সাথে তার আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদ না হওয়াতে স্ত্রীরই লাভ, ভরণপোষণের খরচ যোগাতে হিমশিম টমি-- দু’সন্তানের অধিকার হারা পিতা, অ-পিতাসুলভ পিতা। অন্যদিকে নিজের পিতার কাছে শেষবারের মত কিছু অর্থ এবং সাহায্য চেয়ে অবিশ্বাস্যভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়। এদলার সাহেবের কাছে পুত্র বড় নয়, বড় সফলতা। টমি তখন কারও সন্তান নয়, বরং একজন ব্যর্থ মানুষ যে কিনা এদলারের মত পিতার সন্তান পরিচয়ের এবং কোন সাহায্য পাবার অযোগ্য। সব কুল হারানো টমি ভরসা খোজে ডঃ টেমকিন এর কথায়। নিজেকে সব কাজের কাজী বলে পরিচয় দেয়া টেমকিন পেশায় একজন মনস্তত্তবিদ পরিচয় দেয় নিজেকে। সরল টমি নিজের সব কোথা অকপটে বলে যায় তার কাছে। টেমকিনের বাগ্মীতায় এবার কাবু টমি, আশা জাগানিয়া কথায় তার হাতে তুলে দেয় নিজের শেষ ভরসা কয়েকশো ডলার। টেমকিনের চাতুরতা আর কপটতার সব জানতে তখনো অনেক বাকি তার। আদতে টেমকিন একজন ভণ্ড, শেয়ার বাজারের দালাল। দিনের (এবং উপন্যাসের ও) শেষদিকে টেমকিনকে খুঁজতেই বেলা বয়ে যায়, ফোন বন্ধ। শেষ চেষ্টা হিসেবে রাস্তায় নেমে আসে টমি, কুলহারা নৌকার প্রতিচ্ছবি হয় যেন। পুজিবাদী বিশ্বে মানবিক অশ্রুর মূল্য নেই জানেনা টমি। হোটেল থেকে রাস্তায় নেমে আসার সময় সজল হয়ে যায় চোখ দুটো, হঠাৎ সম্বিত ফিরলে দেখে নিজে একটি শবযাত্রার অংশ হয়ে গিয়েছে। মৃতদেহ সৎকারের উদ্দেশে চলমান বহরের অংশ হয়ে অশ্রুর বাঁধ যেন বালির বাঁধের মত ধসে পড়ে। তার অবস্থা দেখে আশেপাশের মানুষ ও তাকে মৃতের নিকটজন ভাবে। মৃতের দিকে চোখ পড়া মাত্রই টমির কি মনে হয়েছিল তা নিয়ে ভীষণ বিতর্ক আছে। এখানে লেখকের মৃত্যু হয়েছে। হয়ত ওই মৃত ব্যক্তিকে নিজের চেয়ে ভালো অবস্থায় কল্পনা করছে সে আমরা দুর্বল চিত্তরা বিপদে পড়লে যেমন ভাবি। কিংবা এ আনান্দাশ্রু, অন্তত নিজে বেচে আছে এই ভেবে টমির ভালো লাগছে। কিংবা এই শবযাত্রার সাথে অশ্রুর কোন যোগ নেই, চরম স্বার্থপর মানুশের মত অন্যের মৃত্যু দেখেও মানুষ ভাবতে পারে তার দুই পয়সার জীবনের যাপিত গ্লানি, অভিযোগ, এবং অনুযোগ। Carpe Dium বা Seize the Day মেনে নিয়ে হয়ত আজকের জন্য, এই মুহূর্তের জন্য বেচে থাকার সুখে বুঁদ হয়ে থাকার আর প্রচেষ্টা। জীবনকে এতই ভালবাসে মানুষ! বেলো কিছুই বলেননি, আমরা সাধারন পাঠক সমাজ এবং বোদ্ধাদের ভিন্ন ভিন্ন মত গল্পটাকে আর জীবন্ত আবেদনে আমাদের দরজায় করাঘাতের সুযোগ করে দিয়েছে।
অনেক বিতর্ক, বক্তব্য এবং আলোচনা সমালোচনায় ব্যস্ত হয়েছে সাহিত্যানুরাগীরা এই উপন্যাস নিয়ে। গল্পের ভিন্নতা, সমসাময়িক সমাজ, ব্যক্তির পরিচয় সঙ্কট এবং পুজিবাদী বিশ্বের কাছে সংবেদনশীল ব্যক্তির নিরব কান্না, দুর্লঙ্ঘ অসহায়ত্ব সকরুণ আর্তনাদে ফুটে উঠেছে। একটু ভেতরে গেলেই সে আবেদন আমাদেরকে কিছুক্ষনের জন্য অসহায় করে দিয়ে যায়, তীব্র নখরাঘাতে রক্তাক্ত করে আমাদের মানবীয় সত্তা। আমরাও একেকজন টমি হয়ে উঠি, তখন অনুভবে তার দুরবস্থায় নিজেকে কল্পনা করে পাথক মাত্রই কিছুক্ষনের জন্য হলেও স্তব্দ হয়ে যাই, নীরব রক্তক্ষরণের ক্ষতে ভালবাসার প্রলেপ খুঁজি।
পুঁজিবাদের কেন্দ্রে, বস্তুবাদী সভ্যতার পাদপীঠে কিভাবে কাদে যন্ত্রনায় কাতর আত্মা টমির মত নিখাদ ভালো মানুষের অসহায়ত্ব সেটাই দেখায়। বেলো এক জায়গায় বলেছেন ও যে, পুরো সমাজে (পুরো বইয়ে) একমাত্র মানবিক মানুষ শুধু টমি। সাধারন ভালো লাগা, ভালবাসা, স্ত্রীর প্রতি প্রেম, সন্তানের প্রতি বাৎসল্য এবং পিতার প্রতি সন্মানের দায়বদ্ধতা শুধু টমির একারই। এই মানসিক ঔদার্যের মূল্য তাকে দিতে হয় প্রতি পদেই। ভালবাসার মত সুকুমার বোধের প্রতিদান শুধু যেন প্রত্যাখ্যান, সরল বিশ্বাসের প্রতিক্রিয়া যেন প্রতারনা! এখানে ব্যক্তি টমি তার কাল, স্থান, ব্যপ্তি ছাড়িয়ে এক শ্রেনীরূপ নিয়েছে। সেই শ্রেণীটিই যেন আজ ক্রমশ বিলুপ্তির পথে। বৈষয়িক সাফল্য, সমাজের চোখে উঁচু হয়ে উঠতে গিয়ে রক্তের বন্ধন পিতা-পুত্রের সম্পর্ক, কিংবা স্বামী-স্ত্রী’র যে চিরন্তন টান তাও যেন এক টানে ছিঁড়ে ফেলতে চায় পুঁজিবাদী সমাজের ভ্রূকুটি। সুইমিং পুলে ডাঃ এদলারের আয়েশী ভঙ্গিতে শুয়ে নিশ্চিন্ত রিলাক্সেশন এবং টমির প্রতি ছোড়া নিষ্ঠুর বাক্যবাণ ব্যর্থ পুত্রের সাথে সফল পিতার ব্যবধান যেমন বাড়িয়েছে, তেমনি পিতা-পুত্র-পরিবার প্রতিষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জ করেছে সজোরে। টেমকিনের মত শেয়ার বাজার প্রতারক এবং ভণ্ডদের চরম দৌরাত্ম্য সমাজকে দুর্জনদের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে। টমি-টেমকিন যুদ্ধে টমি পরাজিত, কূটকৌশলে দফা-রফা তার। কিন্তু তবুও মনুষ্য হৃদয়ে কি টমি সহানুভুতি- সহমর্মিতা ছাপিয়ে একটু শ্রদ্ধার আসন পাবেনা? এখানে টমি একা, আধুনিক সমাজের ব্যক্তির আত্ম-সঙ্কট , পরিচয়হীনতা তাকে এক অন্য পরিচয়ে আসীন করেছে। পরিচয় সংকট আমেরিকান উপন্যাসগুলোর একটা সাধারন উপজীব্য। ব্যক্তিকে কখনো সমাজ, কখনো রাষ্ট্র কিংবা কোন তন্ত্রের বিপক্ষে দাড় করিয়ে ব্যক্তির আত্ম পরিচয়ের লড়াই চিত্রায়ন। আধুনিক মানুষ মাত্রই তো ‘আমি কে’ এই প্রশ্নের উত্তর খুজে হয়রান। বেলো এই উত্তর খোঁজার চেষ্টা পুরোটাই চিরন্তন রূপ পেয়েছে টমি’র মাধ্যমে।
বেলোর চিত্রায়নে উঠে এসেছে আমেরিকার মধ্যবিত্ত গোত্রের যাপিত জীবনের গ্লানির কথা, মানসিক একাকীত্বের চরম দংশনে বিপর্যস্ত ব্যক্তি মানুষ। হোটেলের আবাস, বিলাসী জীবন ছাপিয়ে আমরা দেখি বর্তমান অর্থলোভী সভ্যতার ধ্বজাধারীরা কিভাবে স্থায়ী সুখ-অনুভুতি বিকিয়ে, অস্থায়ী বিলাস কিনে নিয়েছে। আমেরিকার তৎকালীন মধ্যবিত্ত হয়ত গাঁটছাড়া বাঁধতে শুরু করেছে মাত্র, উচ্চবিত্তের অপভ্রংশ হয়ে কিংবা হঠাৎ পাওয়া সৌভাগ্যে নিম্নবিত্তের গণ্ডি ছাপিয়ে জাতে উঠার যন্ত্রণা তো লাঘব হবার নয়! তেলাপোকার মত তবু এই শ্রেণীটি টিকে থাকে, টিকে থাকবে ঘাত প্রতিঘাত সয়ে সয়েই। তাই টমির ভবিষ্যৎ চিত্রায়ন আমাদের মানসচক্ষে এক ক্রমপ্রসারমান সংগ্রামী মানুষের মুখ হয়েই থাকবে।
ইফতি
মন্তব্য
আপনার দেখি আমার মত বানান ভুলের রোগ আছে। রোগের ট্রিটমেন্ট করুন প্লীজ।
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
'রোগ' পর্যায়ে নেই বলেই বিশ্বাস। অসাবধানতায়, অভ্র-কী বোর্ড দ্বন্দ্বে হয়েছে। পরেরবার ঠিক হয়ে যাবে।
ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
আলোচনা ভালো লিখেছেন, তবে ভাষার গুনে একটু গুরুগম্ভীর হয়ে গিয়েছে। লেখকের স্বাধীনতায় হাত দিতে আগ্রহী নই, তবে পাঠক হিসেবে মতামত হচ্ছে আরো একটু সহজভাবে লেখার চেষ্টা করা, প্রাঞ্জলতাকে কোনভাবেই ক্ষুণ্ণ না করে।
আর মূলত যে কারণে পোস্টটা দেখেছিলাম, সেটা হচ্ছে পোস্টের নাম। সল বেলোর এই বইটা আমার সংগ্রহে ছিলো- কোন শালা জানি মেরে দিসে
অলমিতি বিস্তারেণ
ধন্যবাদ এরকম অনুসন্ধানী মন্তব্যের জন্য।
আসলে স্বাভাবিক ভাষায়ই লিখেছি, প্রাঞ্জলতার দিকে আর ও নজর দিলে হয়ত ভালো হতো। আরেকটা ব্যাপার theme এর গাম্ভীর্য হয়তো ভাষাতেই ছাপ ফেলেছে। ভবিষ্যতে মাথায় থাকবে।
আপনি আরেকটা কিনে নিন বই, এরকম বই সংগ্রহে থাকার দরকার আছে। আবারো ধন্যবাদ।
অসংখ্য ধন্যবাদ। পাশে থাকবেন আশা রাখি।
রিভিউটা পড়তে গিয়ে প্রতি পদে মনে হয়েছে লেখক বইটির প্রতিটি শব্দ 'উপলব্ধি' করেছেন...আর এখানের রিভিউটি'র সার্থকতা। অনেক অনেক ধন্যবাদ। খোমাখাতায় শেয়ার দিলাম
ভাই আপনাকে বিশেষ ধন্যবাদ। আপনার কথা অনেকাংশে ঠিক। আমাকে বইটা আসলেই স্পর্শ করেছে চরমভাবে। নিজেকে অনেক সময় টমি মনে হয় বিদেশে আসার পর। ভার্সিটিতে 'আমেরিকান ফিকশন' হলেই আমি ভালো নাম্বার পেতাম, গ্রুপ স্টাডিতে অনর্গল বলে যেতাম।
শুভ কামনা। ভালো থাকবেন অনেক।
সবজান্তার সাথে একমত আরেকটু সহজবোধ্য হয়ত হতে পারত। তারপরেও রিভিউ ভাল লেগেছে। রিভিউ পড়ার পরে বইটা পড়ার আগ্রহ জাগে, এখানেই রিভিউয়ারের সার্থকতা।
বইটা অত্যন্ত ছোট হলেও বক্তব্য অনেক সিরিয়াস। তাই thematically একটা কাঠিন্য তো আছেই, তবুও আরেকটু সহজ তো করাই যায়।
ধন্যবাদ।
বেশ ভাল লেগেছে, শেষের ছবিটা দেখে ফিক করে হেসে ফেললাম।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
অশেষ ধন্যবাদ। হাসি আর নাই থামুক!! ভালো থাকবেন।
নতুন মন্তব্য করুন