আজকের দিনটা খুব গুমোট, দমবন্ধ করা, এই দুপুরবেলাতেও রোদের তেজ নেই, আকাশটা ঝিম ধরান, মাঝে মাঝে আকাশে যখন একফোঁটা মেঘ ও থাকে না তখন আকাশটাকে কেন যেন খুব অচেনা মনে হয়,বুকের ভিতরটা শূন্যতায় ভরে যায়। খোলা ছাদে দাড়িয়েও তাই নিশিতার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। ওর অনেক জোরে, খুব জোরে একটা চিৎকার দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল, মাঝে মাঝেই হয়। যে চিৎকারটা বুকের মধ্যে জমতে জমতে ওর ফুসফুসটাই এখন বোধহয় লুপ্ত হতে চলেছে। যে চিৎকারটা একবার দিয়ে দিতে পারলে ওর বুক, গলা, ফুসফুস, মাথা সবকিছুই হালকা হয়ে যেত,সেই ছোটবেলার মত, যে দিনগুলিকে ওর ইদানীং স্বপ্ন মনে হয়, ওর নিজের স্মৃতি বলে বিশ্বাস হয় না। গত কয়েক বছর ধরে ওর ঘাড়ের যে ব্যথাটা ওকে ভোগাচ্ছে খুব, ডাক্তার দেখে সব চেক আপ করিয়ে বলেছিল “আপনার মাথার উপর এত কিসের বোঝা? ঘাড়টা ভেঙ্গে যাবে তো”।তারপর একগাদা ঘুমের ওষুধ দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছিল। সেই ব্যথাটা বয়ে বেড়াতে বেড়াতে এত অভ্যাস হয়ে গিয়েছে হটাত হটাত ব্যথাটা না থাকলেই কেমন অন্যরকম লাগে সবকিছু, আজ হটাত একটা চিৎকার দিয়ে সেই ব্যথাটাকে চিরবিদায় দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কষ্ট, বেদনা, শোক সব কিছুই ও মেনে নিবে, বুকের কোন অচেনা প্রকোষ্ঠে জমিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে,অভিমানগুলোকে লুকিয়ে রাখবে একান্ত আপন ভেবে, সমস্ত না পাওয়াগুলোকে সহ্য করে নিবে, নিজের ভালোলাগাকে গলা টিপে ধরবে, ধরছেই তো সমগ্র জীবনভর। সবই পারবে নিশিতা, তোমরা যা যা চাও, শুধু ওর ঘাড়ের ব্যথাটা কমিয়ে দাও, ওর শ্বাসপ্রশ্বাসের রাস্তাটা খুলে দাও। এক-বুক ভর্তি বাতাস টেনে অনেক বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে চায় ও, ওর বুকের ভিতরে অনেকদিন ধরে জমানো অনুভূতিগুলো বের করে দিতে চায়। আর পারছে না ও, আর পারবে না।
স্মৃতিরা সব এক এক করে ভিড় জমাচ্ছে, বাবা সেই যে ওকে স্কুলে নিয়ে যেত প্রতিদিন, শেষ পরীক্ষা দিয়ে বের হলেই একটা আইসক্রিম বরাদ্দ থাকত ওর জন্য, এই তো সেদিন বাবা ওকে প্রথম কলেজে ভর্তি করিয়ে দিল গর্বিত মুখে, তারপর এইতো সেদিন বাবাটা ওকে এই নির্দয়, বন্ধুহীন পৃথিবীতে একা রেখে না ফেরার দেশে চলে গেল।
তারপর ভার্সিটির সেই ভাইয়াটা, ওকে নিয়ে নাকি লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা লিখত, দেখা হলেই মায়া মাখানো চোখে তাকিয়ে থাকত, মনে হত কিসের যেন এক ঘোরের মধ্যে আছে বেচারা। ওরও খুব ইচ্ছে হত চোখদুটোর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে,ও পারেনি। ও খুব কল্পনা করত একদিন সে সাহস করে ওকে ভালবাসি বলবে, একবারই নাহয় বলত, সে বলেনি।
বিয়ের পর স্বামী নামক মানুষটাকে সুখী করতে ও অনেক কিছুই করেছে, নিজের সাধ্যের বাইরেও চেষ্টা করেছে ওর মত করে,বিয়ের কয়েকদিন আগেও যা অসম্ভব মনে হয়েছিল। কিন্তু বিয়ে না করেই বা কি করে হবে! ওদের টানাটানির সংসারে ও একটা বাড়তি অস্তিত্ব, প্রয়োজন-হীন। তার মধ্যে এত-বড় ব্যবসায়ী পাত্র, সে তো কেবল সিন্ডারেলারাই পায়। ওকেও সবাই সিন্ডারেলা ভেবেছিল তখন। সবার ভাবনাটাই তো ও নিজের ভাবনা করে নিতে চেয়েছে। ওর নিজের ভাবনার জগতটাকে নিয়ে সারাজীবন লজ্জিত থেকেছে। মেয়ে হয়ে জন্মেও ওর ভাবতে ভাল লাগে, এই অদ্ভুত,কাউকে বলতে না পারা অন্যায়ের জন্য নিজেকে অপরাধী ভেবে এসেছে চিরকাল।
ওর স্বামীর ওর জন্য সময় কম ছিল, আর ভালবাসা যা ছিল তা এতই উচ্চমার্গের যে ও তা কখনও ধরতেই পারেনি। তবুও তো সংসারের ঝুট ঝামেলা, শাশুড়ির খোঁটা, আর স্বামীর নির্লিপ্ততা নিয়ে ও বেচেই ছিল। কিন্তু বিয়ের ৫ মাসের মাথায় যেদিন সকালবেলার টেস্টের রিপোর্ট অনেক উচ্ছ্বাস, স্বপ্ন আর আবেগ নিয়ে ও স্বামীকে জানাল, ওর ব্যস্ত স্বামীর প্রথম প্রশ্ন ছিল “প্রেগন্যান্সি টার্মিনেট কিভাবে করাতে চাও, ওষুধ খেয়ে করা যায় কিনা খোঁজ নাও”। সেদিন থেকে ও আর বেঁচে নেই, এরপর প্রতিদিন ওর আত্মার খণ্ড খণ্ড অংশের মৃত্যু হতে হতে আজ তা শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখন ওর বই পড়তে ভাল লাগে না, কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয় না, গান শুনার কথা মনেই পড়ে না কখনও। ও তখন বোকার মত কত অনুরধ করেছিল, ওর সব অনুরধ স্বামীর লজিকের কাছে হার মেনেছে, এত তাড়াতাড়ি কেন, গুছিয়ে করতে হবে যা করার, ইত্যাদি যুক্তির কথা যার অধিকাংশই ও বুঝেনি তখন, এখনও বুঝতে পারে না। তারপর স্বামীর বিরক্তি, হতাশা, ক্রোধ থামাতে ও মেনে নিয়েছিল, রাজি হয়েছিল মেরে ফেলতে ওর আত্মার সবচেয়ে অবিচ্ছেদ্য অংশটাকে। ভেবেছিল এবার হয়ত স্বামীর মন পাবে, এরপর হয়ত নিশিতার জন্য তার মায়া হবে,হয়ত কোন এক নির্জীব সকালে ওর দিকে মায়া মাখানো চোখে তাকাবে। ও প্রতীক্ষা করে ছিল অনেকদিন,প্রতিদিন ধরে, যতদিন না বুঝেছে ওর প্রতীক্ষা করার জন্য জন্ম হয়নি, কারও জন্য প্রতীক্ষায় যে আনন্দ সেটা পাওয়ার যোগ্যতাই ওর নেই।
মাঝখানের দুবছর ও শুধু টিকে ছিল যেমন করে পিঁপড়েরা টিকে থাকে, চারপাশের সমস্ত বড় বড় অস্তিত্বের চাপে যে কোন সময় পিষ্ট হওয়ার ভয় বুকে নিয়ে। প্রথম ৬ মাস ও ঘুমাতে পারত না, দূরে কোথাও থেকে বাচ্চার কান্নার প্রতিধ্বনি শুনত রাত জেগে একা একা, খেতে পারত না, ভাতগুলোকে দেখলেই ওর ভয় হত কেন কে জানে।আস্তে আস্তে সয়ে এসেছিল। কিন্তু ও কিছুই মনে রাখতে পারত না, কেবলই ভুল হয়ে যেত, রান্না করতে, চুলা নিভাতে, বাথরুমের লাইট বন্ধ করতে, চুল আঁচড়াতে, হাসতে, কাঁদতে। তাইত এত বিরক্ত হত ওর স্বামী। “তোমার সমস্যা কি?” এই প্রশ্নটা গত দুবছরে কত অজস্রবার শুনেছে। শুনতে শুনতে ওর নিজের মাথায় একসময় প্রশ্নটা ঢুকে গেছে, সমস্যা কি, ওর সমস্যাটা কি?
মনে পড়ছে মাঝখানে বেঁচে থাকার, আবার বেঁচে উঠার প্রবল তৃষ্ণা নিয়ে ও মায়ের কাছে গিয়েছিল। মা ই তো ওকে একবার জন্ম দিয়েছে, আর একবার কি পারবে না? কত কথা জমে ছিল বুকের ভিতর! সব বলতে চেয়েছিল। জমে থাকা যত কান্না, দীর্ঘশ্বাস, হাহাকার সব বের করে দেখাতে চেয়েছিল। “মা,আমার অনেক কষ্ট, তুমি কি কখনও টের পাও? যেমন করে আগে সব টের পেয়ে যেতে”। কথাটা বললেই নিশ্চয়ই ওর মা ওকে বুকে টেনে নিত, ওরই হয়ত দোষ। ও তো বলতেই পারেনি ঠিকমত কোনদিন কোন কিছুই। ওর কিছু একটা বলার চেষ্টা দেখেই ওর মা যখন বুঝিয়েছে, “মেয়ে মানুষের ধৈর্য থাকতে হয় পাহাড়ের মত, গায়ের চামড়া করতে হয় গণ্ডারের মত, এত কিছু ধরলে জীবন চলে না। কষ্ট, অভিমান এইসব বিলাসিতা মেয়ে মানুষের সাজে না। বাস্তবতা মেনে নিতে হয়, সবাই নেয়।” এরপর আর কিছু বলতে পারেনি নিশিতা। ও বলতে পারেনি ওর পাহাড়, গণ্ডার অথবা মেয়ে হওয়ার সামান্যতম যোগ্যতাও নেই,ও শুধু ভুল করে একজন বোকা মানুষ হয়ে জন্মেছিল।
আজ ওর গোছানো সংসারে সবাই নতুন অতিথি চায়। ওর স্বামীরও লজিক্যালি এখন একটা বাচ্চা দরকার। বেশ কয়েকদিনের চেষ্টার পর, কিছু ডাক্তারের মতামত, আর পরীক্ষা নিরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পাবার পর ওরা নিশ্চিত হল ওর পক্ষে এখন আর মা হওয়া সম্ভব না। একটা অপারেশন ওর পৃথিবীতে মেয়ে হিসেবে টিকে থাকার সবচেয়ে বড় অধিকারটা কেড়ে নিয়েছে। কি করবে নিশিতা, কি করতে পারে ও? ওর লজিক্যাল স্বামীর ততোধিক লজিক্যাল মা এখন তার ছেলেকে আর একটা বিয়ে করাতে চান। ওর স্বামী না না করছে, কিন্তু সেই না বলার স্বরটা ক্ষীণ, দুর্বল। যেমন জোর দিয়ে এতোটা দিন ওকে শাসন করে এসেছে, যেমন জোর খাটিয়ে ওকে মন খারাপ করে থাকার অধিকারটুকু পর্যন্ত দেয়নি, যেমন জোর দিয়ে ওর কষ্ট গুলোকে তাচ্ছিল্য ভরে উড়িয়ে দিয়েছে, তেমন জোর দিয়ে তো না বলছে না সে এখন। তবে কি ওর সাথেই এমন হয়, ওরই দোষ, ওই পারেনি পাল্টা জোর খাটাতে, শক্ত হয়ে রুখে দাড়াতে, সবকিছু ভেঙ্গেচুরে নতুন করে শুরু করতে, দোমড়ানো মোচড়ানো স্বপ্নগুলো পূরণ করার দুঃসাহসিক কোন চেষ্টা করতে। ও পারেনি, কতটুকুই বা পারে ও ? তাই তো আজ শেষবারের মত আকাশ কাঁপিয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে সেই কবিতাটা -
আমি আর কতোটুকু পারি?
কতোটুকু দিলে বলো মনে হবে দিয়েছি তোমায়,
আপাতত তাই নাও যতোটুকু তোমাকে মানায়।
ওইটুকু নিয়ে তুমি বড় হও,
বড় হতে হতে কিছু নত হও
নত হতে হতে হবে পৃথক পাহাড়,
মাটি ও মানুষ পাবে
পেয়ে যাবে ধ্রুপদী আকাশ।
আমি আর কতোটুকু পারি?
এর বেশি পারেনি মানুষ।
পরিশিষ্ট- পরেরদিন খবরের কাগজে নিশিতার ছবি বের হয়। ছাদ থেকে পরে এক তরুণীর অকাল মৃত্যু। খবরের কাগজওয়ালারা কাগজের কাটতি বাড়ার সম্ভাবনায় কিছুদিন খুব আগ্রহসহকারে নিশিতাকে নিয়ে রূপকথার নানা গল্প সাজায়। চারপাশের একঘেয়ে হয়ে যাওয়া জীবনটাতে অতিষ্ঠ হয়ে যাওয়া মানুষেরা কিছুদিন সেই রূপকথা পড়ে আনন্দিত হয়, দুঃখিত হয়, রোমাঞ্চিত হয়। আর নিশিতার মত করে বেচেঁ থাকা অন্য সব নিশিতারা হয়ত গোপনে আরও কিছু দীর্ঘশ্বাস জমায়, ফুসফুসটাকে ভারী করে, ঘাড়ের উপর বোঝা বাড়ায়। তারপর আবার একদিন সবাই মিলে নিশিতাকে ভুলেও যায়, ভুলতে হয়। নিশিতাদের মনে রাখতে নেই। মনে রাখতে গেলেই মধ্যাহ্নগুলো শূন্যতায় ভরে উঠে।
ধূসর জলছবি
মন্তব্য
মনখারাপ করা লেখা; ভাল লাগল পড়ে।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে
লেখাটা পড়ে ভালই লাগল, তবে একটা কথা মনে হল, শেষটাতে বর্ণনা না দিয়ে যদি হঠাৎ করে শেষ করে দিতেন মনে হয় আঘাতটা আরও তীব্র হত । আপনার পররবর্তী লেখার প্রত্যাশায় থাকলাম । ভালো থাকবেন ।
ধন্যবাদ, আসলে আমি নিজেও একবার এমটাই ভেবেছিলাম, কিন্তু যে কথাগুলো বলতে চেয়েছি তাহলে তা বলা হত না। আমাদের দেশের পত্রিকা আর মানুষের এসমস্ত ঘটনায় যে অভিব্যাক্তি দেখি সে ব্যপারটাও দেখাতে চেয়েছিলাম । আপনার জন্য অনেক শুভকামনা রইল।
হুমম... সেটা আপনি ঠিকই বলেছেন ।
ভয়ানক এক কষ্টের জায়গায় হাত দিয়েছেন ভাই। এই নিয়ে বলতে গেলে রাত ফুরোবে না।
লেখা বেশ।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
ধন্যবাদ। ঠিকই বলেছেন, এই নিয়ে বলতে গেলে বলার এত বেশি কিছু আছে যে কোনটা রেখে কোনটা বলব মাঝে মাঝে ভেবে পাই না।
মন খারাপ করা সুন্দর লেখনি ...
ধন্যবাদ আপনাকে
খুব মানের লেখা। ভালো থাকেন, চালিয়ে যান।
অসংখ্য ধন্যবাদ
গল্প ভাল লাগল। আরো লিখুন।
কোথাও কোথাও কিছু কিছু অংশ একটু বাড়তি, সেটা পরের লেখাগুলোয় এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে।
সচলে স্বাগতম!!
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
অনেক ধন্যবাদ
একটা দুঃখ বোধ ছুঁয়ে গেলো......ভালো হয়েছে।
ধন্যবাদ
নতুন মন্তব্য করুন