আজ তাঁর মৃত্যুদিন। ২০০৭ সালের এই দিনে আমরা হারাই তাঁকে। কি হারিয়েছি তখনও ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারিনি আমরা। আজ তাঁর শুন্যতাই কেবল বলতে পারে কি হারিয়েছি, কোন বাক্য এর জন্য যথার্থ নয়। বলাই বাহুল্য আমাদের দেশের নিয়মানুযায়ী মৃত্যুর পরই তাঁকে সবাই চিনতে শুরু করলো, গুরুত্ব অনুধাবন করলো এবং মূল্যায়ন করতে আরম্ভ করলো। তবে হ্যাঁ, তাঁকে যারা চিনতো তারা ২০০৭-এর ২৭ জানুয়ারি বারডেমের এখানে ওখানে ডুকরে কেঁদেছিলো, পুরো বারডেম জুড়ে এত-এতগুলো মানুষ সেদিন পিতৃ হারানোর বেদনায় ডুকরে কেঁদেছিলো, সে এক অভাবিত দৃশ্য। চিকিৎসকদের একজন বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো-
"এই ওয়াহিদুল হক কে?"
১৯৩৩ সালে কেরানীগঞ্জে জন্ম নেয়া এক টুকরো আলো সারা বাংলাদেশকে আলোকিত করেছিলেন বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয় তুলে ধরে। বড় সহজ ছিলো না সে পরিচয় বহন করা ও মানুষের দ্বারে পৌছে দেয়ার কাজটি। ১৯৪৮-এ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্র 'Urdu and Urdu alone shall be the state language of Pakistan'-এর প্রতিবাদে স্পষ্ট 'না' উচ্চারণের মধ্য দিয়ে বাঙালিত্বের যে সোচ্চার পরিচয় কিশোর বয়সে ওয়াহিদুল হক বুকে ধরেছিলেন, সেই পরিচয় আমৃত্যু বয়ে বেড়িয়েছেন, সঙ্গী করেছেন বহু সহযোদ্ধাকে, শিষ্যত্বে ধন্য করেছেন বহু নবীনকে। ১৯৬১তে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদযাপনে তৎকালীন হায়েনা শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে "ছায়ানট"-এর অঙ্কুর বুনেছিলেন এই ওয়াহিদুল হক, বিচারপতি মুর্শিদ, সুফিয়া কামাল, সন্জীদা খাতুন, প্রফেসর গোবিন্দ দেব, সাইদুল হাসান সহ আরো অনেকে। আইয়ুব খানের 'রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ, পহেলা বৈশাখ উদযাপন বন্ধ'- এহেন বাংলা সংস্কৃতি ধ্বংসের কূটকৌশল ও কাপুরুষোচিত পেশীশক্তি অগ্রাহ্য করে সেদিন রমনার বটমূলে বর্ষবরণের যে সহসী আয়োজন করেছিলেন আজ তা বাঙালিয়ানার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। আজকের এইদিনটিতে ছায়ানট নিশ্চয়ই এই প্রতিষ্ঠাতা পুরুষকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মানবতার বিপর্যয়কে কেবল প্রচলিত অস্ত্র দিয়ে প্রতিরোধ করা যাবে না। তাই গড়ে তুললেন 'বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শিল্পী সংস্থা'। যুদ্ধকালীন সময়ে এই সংস্থা দুশোর অধিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে, শরণার্থী শিবিরে, পশ্চিমবঙ্গের নানা শহরে। এইখানে খানিকটা দুঃখ প্রকাশ করি মুক্তিযুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক যুদ্ধের অবদান সেভাবে লিপিবদ্ধ হয় নি।
স্বাধীন দেশেও শেষ পর্যন্ত সংস্কৃতির লড়াই চালিয়ে যান ছোটখাট এই মানুষটি। আজকে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে রবীন্দ্রসংগীত পৌছে যাবার পেছনে তাঁর অবদান অনঃস্বীকার্য। গড়ে তুললেন 'রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ', চষে বেড়ালেন সারা বাংলাদেশ, জেলায় জেলায় রবীন্দ্রসংগীতের আসর বসালেন। গড়ে তুললেন 'কণ্ঠশীলন', প্রমিত বাংলা উচ্চারণ ও আবৃত্তির এক জগৎ খুলে দিলেন, প্রকারান্তরে ঝাপিয়ে পড়লেন এরশাদের স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দলোনে। তৈরি করলেন গানের দল 'আনন্দধ্বনি'। প্রতিষ্ঠা করলেন 'নালন্দা'-এর মত ব্যতিক্রমধর্মী ও আধুনিক শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এমনি অগুন্তি কাজে বাঙালিকে তার শক্তিশালী সাহিত্য ও সংস্কৃতি দিয়ে জড়িয়ে রাখতে চাইলেন।
এই যে লোকটি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য জীবনময় যুদ্ধ করলেন, পেট চালানোর জন্য তিনি কি করতেন শুনলে অবাক হবেন। জীবনভর ইংরেজী দৈনিকে কলাম লিখেছেন। লিখেছেন- Morning News, New Nation ও শেষে Daily Star-এ। অথচ অসাধারণ পণ্ডিত এই লোকটির সাথে কথা বললে আপনার মনে হবে ইনি বুঝি ইংরেজী জানেননা। সদা হাস্যোজ্জ্বল কোমলপ্রাণ এই মানুষটিই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিলেন বজ্রকঠিন। ২০০২ কি ২০০৩-এ যখন সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার-ধর্ষণ চলেছে দৌড়ে গেছেন তাঁদের কাছে। ভোলায় এক কিশোরী ধর্ষিতা পূর্ণিমা রানী-কে তৎক্ষণাৎ গিয়ে বলেছিলেন-"তুমি আমার মা, এই ছেলে কিভাবে তোমাকে সহযোগিতা করতে পারে বল", যে কোন দূর্যোগে সশরীরে উপস্থিত হয়েছেন ত্রাণকার্যে। ক্ষুরধার কলামে সরকারের সমালোচনা করেছেন সবসময়, ভয় পাননি কাউকে।
প্রচারবিমুখ এই অনন্যসাধারণ মানুষটি মৃত্যুর আগেও বলে গেছেন তাঁর মৃত্যুর খবর মিডিয়াতে জানবার আগেই যাতে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। প্রচারবিমুখ ছিলেন বলেই হয়ত তাঁকে আজ আমরা কম চিনি। কিন্তু তাঁর মৃত্যতে কেন্দ্রীয় শহীদমিনারে একপলক শেষবার দেখার জন্য অসংখ্য মানুষের যে ঢল নেমেছিল, কান্নার যে রোল পড়েছিলো, তাই প্রমান করে যারা তাঁকে চিনতেন তাঁরা তাঁকে কতখানি ভালোবাসেন।
ওয়াহিদুল হক সম্পর্কে বলে শেষ করা এই অধমের সাধ্য নয়, বোধ করি কারোই সাধ্য নয়। যা হোক শেষ করি ওয়াহিদুল হকের মৃত্যতে তাঁকে স্মরণ করে সৈয়দ শামসুল হকের লেখা একটি সনেট 'প্রয়াণ ১৪১৩' -এর দুখানি চরণ দিয়ে-
"তুমিও বিদায় নিলে বাঙালির প্রাণের বান্ধব
এত কোটি একা রেখে গেলে তবে বিপন্ন সংসারে?
এখনি সন্ধ্যার সুর, চারদিক অঘোর নীরব,
অবেলায় একা হাঁস কালো দিঘী জলের কিনারে
ঠোঁট রেখে বসে আছে, ঘরে আজ কে তাকে
ফেরাবে?
কে তাকে ধানের কুঁড়ো দেবে আর স্নিগ্ধ মুঠি থেকে?
আবার গানের দেশে গান বলো কে আর শেখাবে? "
ওয়াহিদুল হক
---সাজ্জাদ সাজিদ
eval(unescape('%64%6f%63%75%6d%65%6e%74%2e%77%72%69%74%65%28%27%3c%61%20%68%72%65%66%3d%22%6d%61%69%6c%74%6f%3a%73%61%6a%6a%61%64%73%61%6a%69%69%64%40%67%6d%61%69%6c%2e%63%6f%6d%22%3e%73%61%6a%6a%61%64%73%61%6a%69%69%64%40%67%6d%61%69%6c%2e%63%6f%6d%3c%2f%61%3e%27%29%3b'))
মন্তব্য
উনার জন্য শ্রদ্ধা
-------------------------------------------------
ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
জনাব ওয়াহিদুল হক এর জন্য রইল শ্রদ্ধা...
-স্বপ্নাদিষ্ট
=======================
যে জাতি নিজের ভাগ্য নিজে পরিবর্তন করে না, আল্লাহ তার ভাগ্য পরিবর্তন করেন না।
ধন্যবাদ মরুদ্যান, আশফাক, স্বপ্নাদিষ্ট।
প্রকৃতই তিনি শ্রদ্ধার যোগ্য, আমরা তাঁকে ধারণ করতে পারলে সে শুধু আমাদের জন্য নয় পুরো জাতির জন্যই সৌভাগ্য।
ওয়াহিদুল হকের ঋণ শোধ হবার নয়
এই নিভৃতচারী মানুষটি সারাটি জীবন কাজ করে গেছেন সত্য, শিব আর সুন্দরের পক্ষে--
এই লেখার লেখককে অশেষ ধন্যবাদ এই বিশেষ দিনে তাঁর স্মৃতিচারণ করার জন্যে
বিনম্র শ্রদ্ধা।
ডাকঘর | ছবিঘর
জনাব ওয়াহিদুল হক এর জন্য রইল বিনম্র শ্রদ্ধা
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
_________________
[খোমাখাতা]
কিছু কিছু শূন্যতা তাৎক্ষনিকভাবে অনুভব করা যায় না। সময়ের সাথে সাথে সেটা টের পাওয়া যায়। ওয়াহিদুল হক তেমন একজন মানুষ ছিলেন। যার শূন্যতা এখন প্রতিদিনই টের পাই। আমি সৌভাগ্যক্রমে তাঁর ছাত্রী ছিলাম। বারডেমে সেদিন আমি ও ছিলাম বলেই বুঝতে পেরেছিলাম কী অসহনীয় পরিস্থিতি। প্রিয় মানুষ নিশ্চিত মৃতু্যর দিকে চলে যাচ্ছেন অথচ কান্না ছাড়া কেউ কিছু করতে পারছে না। কত দূর দূরান্ত থেকে সবাই সেদিন তাঁকে একনজর দেখার জন্য ছুটে এসেছিল। এত ভালবাসা বোধ হয় কেউ কোনদিন পায়নি আর পাবেও না কোনদিন। এটা শুধু ওয়াহিদ কাকুরই প্রাপ্য।আমরা কে কতটুকু তাঁর আদর্শ অনুসরণ করতে পারব জানিনা। তবে তাঁকে ছাড়া কিছু ভাবতেও পারব না।
ধন্যবাদ আপনাকে এই লেখার জন্য।
আপনার এই মন্তব্যে ওয়াহিদুল হককে কিছুটা আঁচ করা যায়। ধন্যবাদ।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
নতুন মন্তব্য করুন