মাটিতে খড় বিছিয়ে তার উপর চটের বস্তা পাতা একটা বিছানা। সেখানেই দুইটা মোটা ছেড়া ময়লা কাথাঁয় মাথামুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছিল রইছুদ্দি। সাত-সকালে আচমকা চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গে তার। ঘুম ভাঙ্গতেই ছেলে আর ছেলের বউয়ের তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বর ভেসে এলো কানে--
: ‘কাজ কাম কিছুই করে না খালি বইয়্যা বইয়্যা খায়। বুইড়া বাপ কোত্থেইক্যা কেমনে রোজগার পাতি করে তার কোন খোঁজ নাই, আর উনি পেট কিলায়া কিলায়া খায়। একবেলা খায় তো পরের দুই বেলার খাওনের ঠিক নাই। কোলে আমার দুধের পোলা। আর পারিনা, আমি আজই বাপের বাইত চইল্যা যামু’।
: ‘যাছ না কেন? তোরে আটকায় রাখছে কেডা? যা, এক্কেবারে চইল্যা যা বাপের বাড়ি, গিয়া ফষ্টি-নষ্টি কর’।
: ‘যাইতামগা অনেক আগেই। হুদা এই দুধের পোলাডার লাইগায় পারতাছিনা’।
: ‘ও-উ, এখন একমাত্র সমস্যা তাইলে এই দুধের পোলা? পোলাসহ মাইয়্যা তো কেউ নিব না’।
: ‘পয়দা করণের সময় মনে আছিল না যে ছাইরা দিলে পোলাসহ কেউ নিব না আমারে?’
: ‘খাড়া বান্দি, তোরে ছারনের ব্যবস্থাই করতাছি। আমি তোরে তালাক দিমু’
না না, আর শুয়ে থাকা যায় না। আবার শীতের এই সকাল বেলা উঠতেও ইচ্ছে করছে না রইছুদ্দির। বেশ শীত পড়েছে এবার। সে নিজে অবশ্য শীতের তারতম্য ধরতে পারেনা খুব একটা। তবে গতকাল সন্ধ্যায় পাশের চৌধুরী বাড়ির ছেলেটি মাথায় কানটুপি, গায়ে মোটা কাপড়ের স্যুয়েটার, হাতে পায়ে মোজা পড়েও শীতে ঠক ঠক করে কাপঁছিল। এই দেখেই মনে হল শীত বোদ হয় গতবারের চেয়ে এবার একটু বেশীই হবে।
দুই ছেলে আর তিন কন্যার জনক এই রইছুদ্দি। তিন মেয়েকেই বিয়ে দিয়ে অনেকখানি নিশ্চিন্ত। সবচেয়ে ছোট যে মেয়েটি তারও বিয়ে হল আজ প্রায় দেড়-যুগেরও কিছু বেশী। তারা হয়ত সুখেই আছে কিংবা নেই। সেই খবরই-বা কে রাখে? রইছুদ্দি’র স্ত্রী গত হয়েছেন প্রায় এক যুগ। মেয়েরা তাদের মায়ের মৃত্যুর পর প্রথম প্রথম কিছুদিন এলেও পরে আর কখনোই আসেনি। এমন না যে বাবাকে তারা কেউ ভালবাসে না। আসে না কারণ তাদের মায়ের মৃত্যুর পর রইছুদ্দির বড় ছেলে হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে যায়। তার আর কোন হদিস পাওয়া যায়না। বেচেঁ আছে নাকি মরে গেছে তাও কেউ জানে না। আর রইছুদ্দির ছেলেমেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট হাসেম। সে আবার বোনদের সহ্য করতে পারে না। আসলেই গালি-গালাজ করে, তেড়ে যায় মারতে। সেই ছেলে বিয়ে করেছে। একটি সন্তানও আছে তার, নাম হাবু। হাসেমের একমাত্র কাজ সারাদিন ঘরে বসে ঝিম মেরে থাকা আর বউয়ের সাথে নিত্য ঝগড়া করা। আর রইছুদ্দির আপন-পর বলতে দুই-ই এই সংসার।
হঠাৎ সুতীব্র কান্নার শব্দে চিন্তাভাবনায় ব্যঘাত ঘটে। ছেলের বউ সমস্ত রাগ মিটাচ্ছে অবুঝ দুধের শিশু হাবুকে মেরে। রইছুদ্দি ভাবে ‘কি আচানক দুনিয়া এইডা, আর আচানক সব মানুষ। যে কোন দোষ করে নাই, যার কোন অপরাধ নাই সে-ও শাস্তি ভোগ করে এই দুনিয়ায়’।
গায়ে তবনটা জড়িয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে পরে রইছুদ্দি। বাইরে ঘন কুয়াশার দম এখনো কাটেনি। শীতের তীব্রতা এবার বুঝতে পারে সে। কুয়াশা কেটে কেটে গায়েঁর বাজারের দিকে এগুতে থাকে। কিছুদূর হাটতেই ক্ষুধার আহবান জাগে তার। গতরাতেও ঠিক মতো খাওয়া হয়নি। শহর থেকে এসেই জ্বর জ্বর লাগছিল। তাই কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়েছিল। ভেবেছিল সকালে ঘুম থেকে উঠে গরম গরম চারটা ভাত খেয়ে তারপর যা করার করবে। হয়ত নিয়তি এমনি হয়, যাহা চায় তাহা পায় না। এই দীর্ঘ জীবনকালে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির খাতাটার দিকে তাকিয়ে রইছুদ্দির বড় শূণ্য শূণ্য লাগে।
বাজারে ঢোকার পথেই মিনুর ডাক আসে-
: ‘কেডা, জ্যাডা নি? ও-জ্যাডা, ও-জ্যাডা কই যাইতাছেন এই সাত সকালে?’
তার ছোট ভাইয়ের ছেলে এই মিনু। বাজারে ঢোকার মোড়েই মিনুর দোকান ঘর। সেই দোকান ঘরের দিকেই এগিয়ে গেল রইছুদ্দি।
: ‘নেন, চারটা গুড় মুড়ি খান। যেই শীত পড়ছে এবার’
ক্ষুধার আহবানকে অগ্রাহ্য করতে পারে না রইছুদ্দি। মুঠো ভরে মুড়ি-গুড় মুখে তুলে নেয় সে।
: ‘জ্যাডার কপালে আজকেও বুঝি খাওন জুটে নাই? কি করবেন কন, সবই কপালের নসিব’
মিনুর এই কথায় রইছুদ্দির মুখে রা সরে না। সারা মুখ তার তেতো হয়ে আসে। গুড়ের মিষ্টতাও হার মানে এই তিক্ত পরিহাসের কাছে। আনমনা হয়ে মুড়ি-গুড় মুখে নিয়েই ভাবে বয়স কত হল এবাব? ৫৩/৫৪ তো নিশ্চয়। এই বয়সে এসে কি জবাব দেবে তাও ভেবে পায় না যেন। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে উঠে পড়ে রইছুদ্দি। মিনুর দোকান আড়াল হতেই সমস্ত মুড়ি-গুড় ফেলে দেয়। জীবন যেখানে অস্থমিত প্রায়, ক্ষুধার বিচরণ সর্বদায় গতিময় সেখানে। অন্যদিকে ক্ষুধার হাহাকারও মুখ থুবড়ে পড়ে তিক্ত পরিহাসে। দুই-ই বিদ্যমান এই সংসারে।
সাপের মত একেঁবেকেঁ যাওয়া মেঠোপথটি চলে গেছে স্টেশন পর্যন্ত, সেই পথ ধরেই হাটতে থাকে সে। এলোমেলো ভাবে মনে পড়তে থাকে তার ছোট বেলার কথা। মনে পড়ে সুফিয়ার কথা। পাশের গ্রামের মেয়ে সুফিয়া। টানা টানা চোখ, বেণী করা চুল, লাল ফ্রক পড়া এক চঞ্চলা-কিশোরী সুফিয়া। সুফিয়াকে দেখার জন্যই বইখাতা নিয়ে প্রতিদিন বের হত রইছুদ্দি। খড়ের গাদায় বইখাতা লুকিয়ে রেখে সুফিয়ার বাড়ির পিছনের মাঠে বসে থাকত। সুফিয়াও রইছুদ্দির আহবানে সাড়া দেয়। গড়ে উঠে গ্রাম্য কিশোর কিশোরীর আবেগী প্রণয়। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। তাদের লুকোচুরি প্রণয়ে দেখতে দেখতে এভাবেই কেটে গেল কয়েক বছর। কেউ কারো সাথে কথা বলেনি কখনো। অথচ একটু চোখের আড়াল হলেই প্রাণ বুঝি বেরিয়ে আসতে চায়।
এরই মাঝে রইছুদ্দি জ্বরে পড়ে। একদিন, দুইদিন করে কেটে যায় এক সপ্তাহ। জ্বর ক্রমেই বাড়তে থাকতে তার। গ্রামের মানুষ বলা বলি করতে থাকে ‘কালাজ্বরে ধরছে, রইছুদ্দি মনে হয় আর বাচঁতো না’। জুম্মাঘরের হুজুর প্রতিদিন ফজর শেষে দেখে যান রইছুদ্দিকে। হুজুরের দোয়ায় হোক্ কিংবা কঠিন প্রাণের দরুণই হোক জ্বরের ১৫ দিনের মাথায় অনেকটা হঠাৎ করেই জ্বর ছেড়ে দেয় রইছুদ্দির। এ যাত্রায় প্রাণে টিকে গেলেও অজ্ঞাত কালাজ্বর রেখে যায় রুগ্ন, ভগ্ন রইছুদ্দিকে। সুঠাম দেহখানি ভেঙ্গে এখন পাজঁরের প্রতিটি হাড় গোনা যায়। চোখ কোটরের ভিতরে ঢুকে গেছে। হাটতে গেলে এই বুঝি পড়ে যায়।
এভাবেই হাটি হাটি পা পা করে একদিন সুফিয়ার গ্রামে যায় সে। গ্রীষ্মের রোদে সারাটা দুপুর বসে থাকে। একটি বারের জন্যও সুফিয়ার দেখা মেলে না। বড় অস্থির লাগে রইছুদ্দির। অনেক ভেবে দুরুদুরু বুকে সুফিয়াদের কলপাড়ে যায়। অনেকক্ষণ ধরে হাতমুখ ধোয়, শব্দ করে কাশে। তবুও কোন সারা শব্দ আসেনা। রইছুদ্দির বুক দুমড়ে মুচড়ে যেতে থাকে। এত অভিমান সুফিয়ার? তার নিজেরও অভিমান হয়। ভীরু পায়ে ভিতর বাড়িতে ঢোকে সে। সারা বাড়ি শূণ্য, কোথাও কেউ নেই। নিঃশব্দতার শব্দে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে দুর্বল পায়ে।
সারারাত অস্থিরতায় কাটে। কত ভাবনায়, কত দুঃসহ ঝড়ে বিধ্বস্থ ভঙ্গুর লাগে নিজেকে। পরদিন আবার যায় সুফিয়ার বাড়ি। আজও কাউকেই খুঁজে পায় না। সারাটা দুপুর, সারাটা বিকেল বসে থেকে ফেরার পথ ধরে সে। ফেরার পথেই দূরে দেখা যায় সুফিয়াকে। লাল শাড়ি পড়েছে সুফিয়া। কি সুন্দর তার মুখশ্রী। আর লাল শাড়িতে আরও অপরুপ লাগছে তাকে। আনন্দে প্রাণে নাচন জাগে রইছুদ্দির। কাছাকাছি আসতেই সুফিয়ার পাশেই পাঞ্জাবী গায়ে এক অপিচিত লোককে দেখা যায়। সুফিয়ার ছলছল চোখের দিকে তাকিয়েই রইছুদ্দি সব বুঝতে পারে। রইছুদ্দির বুকে হাহাকারের ঝড় উঠে। চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চায়। জাগতিক সংসারের সবকিছুই বড় বেমানান, বড় অর্থহীন ঠেকে তার কাছে। তাগিদ আসেনা পথ চলার।
না, না এসব কি ভাবছে সে? সেইসব দুঃসহ স্মৃতি কিছুতেই মনে করতে চায় না রইছুদ্দি। নিজের অজান্তেই ‘দূর হ দূর হ’ বলে শব্দ করে উঠে সে। রাস্তার পাশ থেকে হাঁক আসে
: ‘কারে তাড়াও রইছুদ্দি?’
সংবিত ফিরে পেয়ে রইছুদ্দি উত্তর দেয়
: ‘মরণে পাইছে। পিছন পিছন আইতেছিল। খেদাইয়্যা দিলাম’
গুটি গুটি পায়ে গায়েঁর মেঠোপথ ধরে স্টেশনে পৌছে যায়। এখান থেকে তিন স্টেশন পরেই একটা মফস্বল শহর। সেখানেই এখন রোজগারের জন্য যায় সে। মেইল ট্রেন ধরে চলে যায়। ফিরতি পথে আবার একই মেইল ট্রেন। আসা যাওয়ায় তাই কোন সমস্যা হয়না। মফস্বল শহরের ব্যস্ত মানুষের ভীড়ে একটু ভদ্র, পরিষ্কার পোষাক-আশাক দেখলেই রইছুদ্দি এগিয়ে যায়। কাছে গিয়ে বিনীত অনুরোধে বলে
: ‘বাবা, আমি বৃদ্ধ, আমার ছোট মেয়েটার ভাল একটা সম্নদ্ধ আসছে। টাকার অভাবে বিয়া দিতে পারতাছিনা’
বৃদ্ধ পিতার অসহায়ত্ব ও অপারগতায় কেউ কেউ সমব্যথিত হয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। বাসা বাড়ি গুলোতে মহিলারা টাকা না থাকলে চাল দিয়ে বৃদ্ধ রইছুদ্দিকে সাহায্য করেন। অন্যসব দিনের মত আজও যত চাল উঠে পুরোটায় শহরের বাজারে বিক্রি করে নগদ টাকা হাতে গ্রামে ফিরে আসে রইছুদ্দি। গ্রামের বাজার থেকে চাল, ডাল ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফেরে। বড় ক্লান্ত লাগে নিজেকে। ছেলের বউকে খিচুড়ী করতে বলে ক্লান্তিতে শুয়ে পড়ে চটের বস্তা পাতা বিছানাতে। রাজ্যের গাঢ় ঘুম এসে ভর করে রইছুদ্দির চোখে যেন কতকাল ধরে ঘুমহীন তার দু’চোখ। একধরণের বিভোরতার তৈরী হয় তার মাঝে। আধো খোলা চোখে রইছুদ্দি দেখতে পায় তার মৃত স্ত্রীকে। মৃত স্ত্রীকে তার কাছে কিশোরী সুফিয়ার মত লাগে। লাল ফ্রক গায়ে বেণী করা চুল দুলিয়ে দুলিয়ে হাটছে। রইছুদ্দি দৌড়াচ্ছে পিছন পিছন। এই বুঝি ধরে ফেলল সুফিয়াকে। এই বুঝি ধরে ফেলল---।
কিছুতেই চোখ খোলা রাখতে পারছে না রইছুদ্দি। গাঢ় ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছে সে। শুধু ঘুম আর ঘুম।
সারা বাড়ি ভর্তি মানুষ। রইছুদ্দির ছেলের বউটা থেমে থেমে বিনিয়ে বিনিয়ে কেদেঁ উঠছে। হাবুর কান্নাও কেউ থামাতে পারছেনা। মায়ের কান্না দেখে সেও কাদঁছে ক্রমাগত। পাশেই চুলা থেকে কালো ঝাঝালো ধোঁয়া বের হয়ে ঢেকে দিচ্ছে চারপাশ। এমন দিনে চুলোয় আগুন জ্বালিয়ে দেবার তাগিদ নেই কারো।
...........................
মোখলেছুর রহমান সজল
মন্তব্য
গল্পে নতুনত্ব নেই। অবশ্য সব গল্পে থাকতেই হবে এমন কোনো কথাও নেই। পড়লাম
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। ভাল থাকুন।
ধন্যবাদ।
ভালোই।
-------------------------------------------------
ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
ভাল লাগলো জেনে আমার নিজেরও ভাল লাগছে। ধন্যবাদ।
আরো গল্প আশা করছি আপনার কাছ থেকে
ধন্যবাদ তানিম ভাই। লিখার ইচ্ছা আছে। বাকীটা . . .
* চোক -->চোখ অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য দুঃখিত।
আপনার লেখার হাত বেশ পোক্ত ।
ভালো লাগল ।
আরও ভালো গল্পের অপেক্ষায় থাকলাম ।
ভালো থাকবেন ।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। লিখব, এই প্রত্যাশা রাখি।
আসাধারণ । লেখাটা পরতে পরতে যখন শেষের দিকে চলে আসি ,হঠাৎ লেখকের নামটা দেখে চমকে উঠি।চালিয়ে যা।আমি বার বার চমকাতে চাই।
তোকে পেয়ে অনেক আনন্দ হচ্ছে। ভাল থাকিস।
নতুন মন্তব্য করুন