অর্ক সেবার খুলনা থেকে মা বাবার সাথে দাদু বাড়ি যাচ্ছে। পাকশি ঘাট ,ফেরি পার হয়ে আরো দেড় ঘণ্টার রাস্তা। ছোট্ট অর্ককে বাবা দেখায়
নদীর ওপর ঐ যে লাল ব্রিজটা দেখছো, ওটা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ।
বাবা আমাদের বাস ঐ ব্রিজ এর ওপর দিয়ে যাচ্ছে না কেন?
ওর ওপর দিয়ে শুধু ট্রেন যায়। বাস এর জন্য ঐ ব্রিজটা না।
বাবা বাসের জন্য কোনো হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নেই কেন?
কেউ বানায়নি তাই।
ব্রিজ কারা বানায় বাবা ?
ইঞ্জিনিয়াররা।
বাবা অর্ককে বুঝিয়ে বলেন, অনেক লেখাপড়া করে ইঞ্জিনিয়ার হতে হয়। অর্কর সাধারণ জ্ঞান এর বইয়ে যে বাংলাদেশ এর সর্বোচ্চ বিল্ডিং বাংলাদেশ ব্যাংক এর ছবি আছে সেটাও ইঞ্জিনিয়ারদেরই বানানো।
বাবা, আমি ইঞ্জিনিয়ার হবো।
হুম ! তুই বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে বাস চলার জন্য হার্ডিঞ্জ ব্রিজ বানাস।
সেই থেকে অর্কর ইচ্ছা, সে বাস চলার জন্য হার্ডিঞ্জ ব্রিজ বানাবে।
দাদু বাড়ি গিয়েই অর্ক কয়েকটা বসার পিঁড়ি জোড়া দিয়ে তার সাথে কাঠের তক্তা লোহার বাটখারার ওপর রেখে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ বানানোর কাজে লেগে গেল। অর্কর বানানো ব্রিজ দেখে তো মামাত ভাইয়েরা হেসেই খুন। এটা কোনো ব্রিজ হইছে নাকি! অতঃপর মামাত ভাইদের সাথে মারামারি, মায়ের হাতে মার খাওয়া - আর সেই থেকে ছোট্ট অর্কর জিদ সে বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ বানিয়ে দেখাবে।
অর্কর সব কিছুতেই জিদ। একবার অর্ক আর বন্ধুরা বনভোজনে গেছে। হঠাৎ এক বন্ধু কোথা থেকে যেন এক বোতল স্কচ এনেছে। সেটা নাকি যে পুরোটা এক সিটিং এ খেয়ে ফেলতে পারবে সে বাপের ব্যাটা সাদ্দাম! অর্কর জিদ উঠে গেল অতঃপর খাওয়া শেষে অর্ক কষে সেই বন্ধুকে লাথি মেরে বললো ; দেখ আমিই বাপের ব্যাটা সাদ্দাম।
অর্ক বড় হয়ে ঠিকই ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে।কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু অর্কের সেই জিদ আজ কম্প্রোমাইজ শব্দ দ্বারা রিপ্লেসড্ হয়ে গেছে। নিতুর কাছ থেকেই অর্কর প্রথম কম্প্রোমাইজের মর্মটা শেখা। মানুষের মনটা তো আর খেলনা নয় ! ছোটবেলায় যেমন বাবার সাথে বাজার গেলে যদি কোনো খেলনা পছন্দ হয়ে যায়। সেই জিদ ধরা, বাবা তো কিনে দিবেই। নিতুর মনটা তো আর খেলনা নয় যে জিদ ধরলেই পাওয়া যাবে।
নিতুকে কথাটা বলাও হয়নি অর্কের। তার আগেই অর্ক জেনে গেছে নিতু পছন্দ করে তারই সব থেকে কাছের বন্ধু সফেনকে। ওরা এখন ভালোই আছে। আর সেই প্রথম আর্কর কম্প্রোমাইজ। বন্ধুত্বের সাথে ভালোলাগা, ভালবাসার কম্প্রোমাইজ।
সেই থেকে শুধুই কম্প্রোমাইজ আর কম্প্রোমাইজ। ক্যারিয়ারের সাথে বন্ধুত্বের কম্প্রোমাইজ। শুধু ক্যারিয়ারের জন্যই আজ বন্ধু বান্ধব-বিহীন এই বিদেশ বিভুঁই-এ পাড়ি জমানো।
কানাডার ম্যানিটোভায় নিজ অফিসের জানালার কাঁচ দিয়ে বাইরের তুষার পড়া দেখছে অর্ক। আস্তে আস্তে গাছের সবুজগুলো সাদা তুষারে ঢেকে যাচ্ছে। ওর মনের সবুজটাও সেই কবে হিম শীতল বরফে ঢাকা পড়েছে।
গত আড়াই বছর ধরে দেশে যাওয়া হয় না অর্কর। অর্কর আজ মায়ের হাতের ইলিশ-খিচুড়ি খেতে খুব মন চাচ্ছে আর প্রথম বানানো ভাপা পিঠা কে আগে খাবে সেটা নিয়ে ছোট বোনের সাথে ঝগড়া করতে খুব ইচ্ছে করছে। বাবার সাথে ছিপ হুইল আর নেট নিয়ে মাছ ধরতে যেতে খুব মন চাচ্ছে। নিজের অজান্তেই অর্কর চোখটা জলে ভিজে যায়........
ছোট বেলার দিনগুলো আজ অর্কর চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সেই সাতচারা, সেই গোল্লাছুট আর ছোটবেলার মার্বেলগুলো আজ ওকে খুব করে ডাকছে। আজ আবার অর্কর বন্ধুদের সাথে সুন্দরবন গিয়ে লঞ্চের ওপর খোলা আকাশের নিচে শুয়ে চাঁদের রঙধনু দেখতে খুব মন চাচ্ছে। সুতাকাটা ঘুড়ির মতো ওর মনটা আজ স্মৃতির আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। স্মৃতিগুলো আজ ওর সাথে খুব লুকোচুরি খেলায় মেতে উঠেছে। প্রিয় সেই মুখগুলো আজ ওর খুব মনে পড়ছে । মন চাচ্ছে আজ ওদেরকে খুব করে দেখতে ।
ছোটবেলার মুনিয়া পাখিগুলোর কথা মনে পড়ছে ওর। কিভাবে যেন একটা পাখি খাঁচা থেকে বের হয়ে গিয়ে সামনের গাছে বসে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়, পাখিটি গাছেই বসে থাকে।আর সমস্বরে ডেকে যায়।ডেকে যায় তার সাথীদের। অর্কর দৃঢ় বিশ্বাস, ওর সাথে এতদিনে পাখিগুলোর যে ভাব হয়ে গেছে তার জন্যই পাখিটি চলে যাচ্ছে না।পাখিটি ওর ভালবাসার শিকলে বন্দী।পাখিটা হয়ত খাঁচায় আবার ফিরে আসতে চায় দেখেই চলে যাচ্ছে না। অর্কর ধারণা খাঁচার দরজা খুলে ডাক দিলেই পাখিটি খাঁচার ভেতর এ এসে ঢুকবে। তাই মা বার বার মানা করা সত্ত্বেও জিদ ধরে খাঁচার দরজা খুলে দেয় অর্ক। যা হলো তা অর্কের কল্পনারও বাইরে ছিল। বাকি সব মুনিয়া পাখি একসাথে খাঁচা ছাড়া। নিঃসঙ্গ পাখি টা এবার তার সাথীদের সাথে একসাথে ডানা মেলে উড়াল দিল খোলা আকাশে । তারা আজ মুক্ত,বাধনহারা।মুক্তির আনন্দে আত্মহারা। আর অর্কের সে কি কান্না।জিদটা যে শুধুই বোকামি ছিল, তা আজ বুঝতে পারে অর্ক। সব জিদ হয়ত ভাল ফল নিয়ে আসে না।
সেই প্রথম দলছুট পাখিটার কথা আবার মনে হয় অর্কর। পাখিটি তো তার দল ছেড়ে একা একা মুক্ত আকাশে স্বার্থপরের মতো উড়ে যায়নি। তবে অর্ক কেন? কিসের মোহে? তার পরিবার বন্ধু-বান্ধব সব ফেলে এই বিদেশ বিভুঁই-এ পড়ে থাকবে ! অর্কর আবার ছোটবেলার মতো একরোখা হতে ইচ্ছা করছে। কিসের জন্য কার জন্য তার এই কম্প্রোমাইজ। বিদেশ তাকে কি দিয়েছে ? যা দিয়েছে তার থেকে কেড়েই নিয়েছে বেশি । তার মনটা আজ সেই দলছুট পাখিটার মত নিঃসঙ্গ,খুব একা। ওর আজ কেউ নেই। ওর মনটাকে আজ খুব টানছে বন্ধুদের সেই আড্ডা, মায়ের আদর আর বোনের ভালবাসা। ওর সেই ছোট্ট বেলার জিদ আবার জেগে উঠছে ।ওর আজ খুব দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে...দেশ এর জন্য কিছু করতে ইচ্ছা করছে। হয়ত পদ্মা নদীর উপর বাস চলার জন্য হার্ডিঞ্জ ব্রিজ বানানো কখনই ওর দ্বারা হবে না। তবুও আজ অর্কের জিদ; দেশে ফিরে যেয়ে দেশ এর জন্য কিছু একটা করে সে দেখাবেই। যদিও ও এখন খুব ভাল করেই জানে সব জিদ শুভ ফল নিয়ে আসে না । যদি হয় বোকামি হোক না ;তবুও আজ ও সিদ্ধান্তটা নিয়েই নিবে। ওর বিক্ষিপ্ত মনটা আজ পেন্ডুলাম এর মত দুলছে।একবার এদিক আর একবার ওদিক।একদিকে জিদ আর অন্যদিকে কম্প্রোমাইজ। একদিকে মনের টান আর অন্যদিকে ক্যারিয়ার। কি সিদ্ধান্ত নিবে অর্ক ...?
----------------------------
তূর্য কুণ্ডু (turja kundu)
মন্তব্য
ভাল লাগল।
ধন্যবাদ।
আগে পড়েছি যদিও। ভাল লাগল। লেখা চালিয়ে যা। সচল স্বাগতম...
-স্বপ্নাদিষ্ট
=======================
যে জাতি নিজের ভাগ্য নিজে পরিবর্তন করে না, আল্লাহ তার ভাগ্য পরিবর্তন করেন না।
আপনার লেখা ভালো লাগল ভাই ।
তবে আরও আরও ভালো লেখার প্রত্যাশায় থাকব ।
আপনি ভালো থাকবেন ।
শুভেচ্ছা ।
উৎসাহিত হলাম।
আপনিও ভালো থাকবেন । ধন্যবাদ।
গল্পের নায়ককে বয়সের দিক থেকে ম্যাচিউর মনে হল, কিন্তু চিন্তাভাবনার দিক থেকে না
বর্ণনাভঙ্গি ভালো। চালিয়ে যান
-------------------------------------------------
ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
সবাই কি আর সব দিক দিয়ে বড় হতে পারে। কেউ কেউ বয়সে বড় হলেও চিন্তাভাবনায় ছোট বেলার দুরন্তপনা থেকে যায়।
গল্পের নায়কেও হয়ত ঠিক সে রকম।
ধন্যবাদ।
চমৎকার । আরো পর্ব আসছে নিশ্চইয়ই ।
নাওয়ারিদ নূর সাবা
নতুন মন্তব্য করুন