… ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশ দিয়ে ঠিক সেই মেঘের মতো একটি ছেলেকে হেঁটে যেতে দেখা গেলো নবাবপুরের দিকে । দক্ষিণ থেকে উত্তরে । পরনে তার একটা সদ্য-ধোয়ানো সাদা সার্ট । সাদা প্যান্ট । পা জোড়া খালি । জুতো নেই । ...
… সব আছে তার । ধবধবে জামা । প্যান্ট । পকেটে কলম । কবজিতে বাঁধা ঘড়ি । হাতে একটা খাতা । মুখের দিকে তাকালে ভদ্রলোকের সন্তান বলে মনে হয় । কিন্তু পায়ে জুতো নেই কেন ওর ? ...
… ওরা এখন দশজন ।
দশজন মার্জিত পোশাক-পরা নগ্নপায়ের যাত্রী । ...
… কী গভীর বিষাদে ছেয়ে গেছে তার মুখ । একটু পরে বিষাদ দূর হয়ে সে-মুখ কঠিন হয়ে এলো । ...
… আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো ।
জহির রায়হানের আরেক ফাল্গুন বইটা প্রথম পড়ি ক্লাস নাইন-টেনে থাকতে । সেই সময়ের কিশোর মনকে প্রচন্ডভাবে নাড়া দিয়েছিল বইটি । কি অসাধারণ কতগুলো মানুষ । যারা কোন কিছুকে ভয় করে না, সবাইকে উপেক্ষা করে নগ্ন পায়ে রাস্তায় নামাকে যারা পরিণত করে প্রতিবাদের ভাষাতে, যাদের নগ্ন পা হয়ে উঠে ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের প্রতীক । ক্লাস নাইন-টেন খুব সম্ভবত আমার জীবনের সবচে গুরুত্বপূর্ণ সময় । নিজের চিন্তার জগতের সবচে বড় বড় পরিবর্তনগুলো হয়েছিল সেই সময়ে । সেসব পরিবর্তনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূমিকা ছিল এই বইটারও । আরেক ফাল্গুন পড়ার পর থেকেই অদ্ভুত একটা পাগলামো আসে মাথায় । ঠিক করে ফেলি যে কোনদিনও পায়ে স্যান্ডেল নিয়ে শহীদ মিনারে উঠবো না ।
আমাদের স্কুলেও শহীদ মিনারের ছিল জরাজীর্ণ অবস্থা । সবসময়ি জমা হয়ে থাকতো একপ্রস্থ ধূলাবালি । তাই স্কুলের শহীদ মিনারে কখনো কোনদিন আড্ডা দিতে বসতো না কেউ । এরপরে স্কুল পেরিয়ে যাই কলেজে । গেটের কাছেই বেশ বড় শহীদ মিনার । উঠতি কলেজের ছাত্রদের আড্ডা দেয়ার প্রিয় একটা জায়গা । কিন্তু না, কোনদিন সেখানে বসি নাই । বন্ধুরা বসতো, আড্ডা দিত, আমি পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাল মেলাতাম । এইভাবে কলেজ পার হয়ে একদিন পা রাখলাম বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে । সেখানে শহীদ মিনারের আয়তন আরো বড়, আরো বড় তার আড্ডার স্থান । এখানে আর পাশে দাঁড়িয়ে তাল মেলানো সম্ভব না । তাই সবার সাথে উঠতাম শহীদ মিনারে, তবে স্যান্ডেলটা খুলে নিচে রেখে । প্রথমদিনই সম্মুখীন হই মোটামুটি বড় আকারের হাসাহাসির । আশ-পাশ থেকে বিদ্রুপময় কিছু কথাও ছুটে আসে । নাহ্, সেই হাসাহাসি, বিদ্রুপ উপেক্ষা করার মত সাহস সেদিন আমার ছিল । কোন উত্তর না দিয়ে নগ্ন পায়ে উঠে যাই শহীদ মিনারে । কাউকে কিছু বলিনা, আমার নগ্ন পাই ছিল সব বিদ্রুপের উত্তর । পরে চুপি চুপি শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখা ছোটবেলার বন্ধুটিকে বলি, “যদি সমাজ পরিবর্তন করতে হয় তবে সবার প্রথমে পরিবর্তন করতে হবে নিজেকে । অন্যরা কি ভাববে, সমাজ কি বলবে এসব চিন্তা করে যদি ঠিক কাজটি করতে পিছিয়ে যাই তবে কখনোই আমরা সমাজের পরিবর্তন আনতে পারবো না ।”
তারপরে কেটে গেছে বহুদিন । একাকীত্বের মাঝে ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে সব উৎসাহ, হতাশার সাগরে একসময় ডুবে গেছে সমাজকে উপেক্ষা করার সাহস, বাস্তবতার বেড়াজালে আটকে পড়েছে সব স্বপ্ন । তারপরে একসময় আমি স্যান্ডেল পায়ে শহীদ মিনারে বসে আড্ডা দিয়েছি, দুই টাকা কাপের চায়ের তলানি ঢেলে দিয়েছি, কখনো ছুঁড়ে ফেলেছি বাদামের খোসা । আর আমার স্যান্ডেলের ধূলা-ময়লার নিচে ধর্ষিত হয়েছে ভাষা শহীদের আত্মত্যাগ, ধর্ষিত হয়েছে আমার মা, ধর্ষিত হয়েছে আমার মাতৃভাষা … ...
মানুষের মস্তিষ্ক খুব অদ্ভুত একটা জিনিষ । কখন কোন স্মৃতি হঠাৎ করে সামনে নিয়ে আসে কে জানে । জহির রায়হানের অন্তর্ধান দিবসে শ্রদ্ধেয় একজন ফেসবুকে পোস্ট করেছেন "আসছে ফাগুনে আমরা দ্বিগুণ হবো" আর এই একটা কথাতেই হুড়মুড় করে মনে পড়ে গেল এইসব একগাদা অর্থহীন কথা ।
… … ভাবছি এরপরে যেদিন শহীদ মিনারে উঠবো সেদিন স্যান্ডেলটা খুলেই উঠবো । তাতে যদি কারো হাসি পায় তো পাক, কেউ যদি হাসতে চায় তো হাসুক ।
-- তাসকিনুর
মন্তব্য
আপনার ভাবনাকে শ্রদ্ধা
-------------------------------------------------
ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
টুকরো টুকরো কথা গুলি মনে স্থায়ী দাগ কেটে যায়...
ডাকঘর | ছবিঘর
সম্ববত প্রথম হাসিটা আপনিই হাসবেন। তবে সামাল দিতে পারলে আত্মশুদ্ধি ঘটবে।
আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো ।
আরেক ফাল্গুন পড়ে যতটা ভাল লেগেছিল, শেষ লাইনটা পড়ার পর ভাল লাগা কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছিল এমনিতেই।
facebook
আপনি আপনার সংকল্পে অটল থাকুন ।
লেখা খুব ভালো লাগলো ।
ভালো থাকুন আর মাঝে মাঝে এভাবেই আমাদের দৈনন্দিন অসভ্যতাগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিন ।
ভালো থাকবেন ।
শুভেচ্ছা ।
ওয়েলকাম (ব্যাক?)! লেখা ভালো লেগেছে।
নিজের মাঝের আবেগকে মরে যেতে না দেয়াই বড় কথা, বাহ্যিক আচরণের চেয়েও সেটা বড় ব্যাপার। অবশ্য বাহ্যিক আচরণে ভেতরটাই প্রতিফলিত হয়।
জহির রায়হানের উপন্যাস সমগ্র পড়া ছিলো স্কুলে পড়ার সময়, কিন্তু আরেক ফাল্গুন নিয়ে কিছুই মনে করতে পারছি না, আবার পড়ে দেখতে হবে
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
আমি কখনই জুতা পায়ে শহীদ মিনারে উঠিনি। বাবা আমাদের খুব ছোট থাকতেই এটা শিখিয়েছিলেন, আমি ভাবতাম এটাই স্বাভাবিক-এটাই নিয়ম, উপাসনালয়ে যেমন জুতা পরে উঠতে নেই ঠিক তেমন। আমরা ২১শে ফেব্রুয়ারীতে, বাবার সাথে অনেকটা পথ খালিপায়ে হেঁটে ফুল দিয়ে আসতাম। আর এবার ১৬ই ডিসেম্বর স্মৃতিসৌধে গিয়ে দেখি, অনেক লোক জুতা তো জুতা তারা ফোটোসেসন করার জন্য স্মৃতিসৌধের ধার বেয়ে যতটা সম্ভব উপড়ে উঠছে।
ধন্যবাদ তাসকিন বন্ধু...........মন ছুয়ে গেল লেখাটা...........
আমি প্রথম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যাই ২০১১ তে। ২১ ফেব্রুয়ারীতে তো কাছেই যেতে পারিনি অনেক দূরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেছি, আর প্রথম কাছে গিয়েছি গেল ডিসেম্বরে। খালি পায়েই উঠেছিলাম। লেখককে ধন্যবাদ। চমৎকার লেখা।
অফ টপিকঃ টিভিতে এবং গত বছর নিজের চোখে দেখলাম, প্রধান মন্ত্রী আর রাষ্ট্রপতির ফুলের তোড়া বাদে সবগুলোই (যেগুলো সাধারন মানুষ/সংগঠন দেয়) একদল কর্মী ব্যবচ্ছেদ করে ফুলগুলো আলাদা করে ফেলে, পরের দিন পত্রিকায় বা টিভিতে দেখি, সেই ছেঁড়া তোড়ার ফুলগুলো দিয়েকেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে নকশা (একবার দেখেছিলাম, মানচিত্র) করে, হয়তো ওপর থেকে দেখতে বা ছবি তুলতে ভাল লাগে, কিন্তু আমার কষ্ট হয়, মানুষের ভেতরের ভালবাসায় তৈরী তোড়া গুলোর নির্দয় ব্যবচ্ছেদ দেখে।
যদি সবার তোড়াগুলোই সুশৃঙ্খলভাবে সাজিয়ে রাখা যেত, বেশি ভাল লাগত মনে হয়।
আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো - সুন্দর
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
নতুন মন্তব্য করুন