১)
দাঁড়িয়ে থেকেই পরপর তিন কাপ চা খেলাম। স্বচ্ছ-লম্বা চায়ের কাপের নিচের অংশটুকু অনেকটা চাপানো। নিচ থেকে উপরে উঠতে উঠতে অনেকটা হঠাৎ করেই কাপটা চওড়া হয়ে গেছে। মজার ব্যাপার হল, চা কিন্তু কাপটা চওড়া হবার আগ পর্যন্ত এসেই থমকে দাঁড়ায় প্রতিবার! আপাতত এই কাপের নাম দিলাম সাশ্রয়ী কাপ । চা চমৎকার হয়েছে কিন্তু প্রতিবারই সাশ্রয়ী কাপে খেতে হয়েছে বলে পুরোপুরি তৃপ্তি পাইনি। আরো এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে টঙের পাশে রাখা কাঠের বেঞ্চে গিয়ে বসলাম।
বাসায় বড় একটা মগ ভর্তি করে চা খাই। আমি প্রতি রাতেই জাগি থাকি। সকালে মা-বাবা অফিসে চলে গেলে নাস্তা করে ঘুমুতে যাই। প্রতি রাতেই ঠিক বারোটার দিকে পরপর দুই মগ চা খাই। চা খেতে খেতে গান শুনি। পট থেকে মগে চা ঢেলে নিয়েই প্লে-লিস্ট সিলেক্ট করে দিতেই গানগুলো বাজতে থাকে। গতরাতে শুনলাম ক্ষমা করো মোরে, এ মনিহার আমায় এবং খেলাঘর বাধতে দেখেছি এই তিনটা রবীন্দ্রসঙ্গীত। চায়ের টঙেও গান বাজছে-- দুই দুইটা গার্লফ্রেন্ড লইয়্যা পড়ছি আমি ফান্দে, বড়-গুরে মায়া করলে মাইজ্জ্যা-গুয়ে কান্দে । খুব সম্ভবত চা-ওয়ালার মোবাইল ফোন থেকেই গানটা বাজছে।
এখনো চা পাইনি, লিকার শেষ বলে চা দিতে দেরি হচ্ছে। নতুন করে কেতলি বসবে, তাই দেরি হলেও নতুন লিকারের প্রথম চা-টা আমিই পাব ভেবে মনে মনে খুশি-ই হয়েছি। বাসায় চা হলে সব সময় আমাকেই প্রথম চা দেয়া হয়, তাই অপেক্ষাতে ভালই লাগছে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে চা-ওয়ালা পুরোনো কেতলিতে পানি ঢেলে কিছু চায়ের পাতা ছেড়ে দিল, নতুন করে আর কেতলি বসাল না। চা খাবার সিদ্ধান্ত তাই বাতিল করে উঠে পরলাম। বিল দিতে গেলেই চা-ওয়ালা বলে উঠল-
-মামা, একটু বসেন। পানি এই ফুটে উঠল বলে।
পাশে দাঁড়ানো লোকটাও সমস্বরে একাত্মত্বা জানালো। আর অন্যদিকে আমি ভাবছি চা-ওয়ালা আমাকে মামা বলে ডাকছে কেন? আমাকে বেশীক্ষণ ভাবতে হল না। প্রশ্নের উত্তর পেলাম যখন নতুন একজন চা খেতে এল।
-কড়া লিকারে একটা চা দিও তো মামা। সাথে একটা বেনসন।
-দিচ্ছি মামা।
বুঝলাম চায়ের টঙে আমি, তুমি কিংবা সে, সবাই মামা। আমি আবার কাঠের বেঞ্চিতে বসে মামার হাতের চায়ের অপেক্ষা করছি।
মামার চা হাতে বসে আছি, খেতে ইচ্ছে করছে না। কাপ হাতে নিয়েই বাসার কথা ভাবছি। এতক্ষণে নিশ্চয় তুলকালাম অনেক কিছুই ঘটে গেছে আমাকে ঘরে না পেয়ে। গত দীর্ঘ ছয় মাস ধরে একটি বারের জন্যও ঘর থেকে বের হইনি আমি। আমার উপস্থিতিতে মা-বাবা দু-জনই ঝগড়া করা থেকে বিরত থাকেন। একেবারেই যে বিরত থাকেন তা নয়, নীরব যুদ্ধ চলতেই থাকে দু-জনের। আজ অবশ্য প্রকাশ্যেই ঝগড়ায় মেতে উঠবেন দুজনে। আমি সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছি। কেন দিয়েছি তা আমি জানি না। শুধু জানি স্রোত থেমে গিয়ে যেখানে কলকল শব্দে বয়ে চলা নদীর বুক চিড়ে চর জেগে উঠে, যেখানে জীবনকে উপজীব্য করে ঘৃণার আদিম বসত বিস্তার, যেখানে অবদমিত প্রাত্যহিক সকল সত্ত্বা জুড়ে ধুলোর সাদা শ্যাওলায় তীক্ষ্ণ অনুভূতিগুলো স্তব্ধ উচ্ছাসে মাতে তা জীবন নয়, জীবনের উচ্ছিষ্ট মাত্র।
২)
আমার বাবা ছিলেন দুরন্ত মেধাবী। শিক্ষা জীবনে তিনি কখনোই দ্বিতীয় হন নি। অনার্স-মাস্টার্স দুটোতেই ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছেন। আমারও মাও ছিলেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, তবে অন্য বিভাগের। মা-র মেধার উজ্জ্বল্যতা জুড়ে ছিল সঙ্গীত। বিশ্ববিদ্যালয়ের কালচারাল প্রোগ্রামে মায়ের পরিবেশনা থাকত, চমৎকার গাইতেন মা। মায়ের গান শুনেই বাবা মাকে ভালবেসে ফেলেন। এক সময় বাবা-মায়ের প্রণয় পরিণতি পায়। আমার জন্মের পর বাবা স্কলারশীপ নিয়ে জার্মানী চলে যান। একটা সময় মা কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। ধীরে ধীরে আমি বড় হতে থাকি। আমি বড় হয়েছি অনেকটা একাকীত্ব ও নিঃস্বঙ্গতায়। মা আমাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে কলেজে চলে যেতেন। বাবা তখনও বাইরে। পিএইচডি প্রোগ্রাম শেষে আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে জয়েন করেছেন।
দীর্ঘ দিন বাইরে থেকে দেশে ফিরে আসেন। মা-ও অধ্যাপনা ছেড়ে দেন। আর আমি সারাদিন বাবার কাধে চড়ে থাকি। সন্ধ্যায় প্রতিদিন গানের আসর হতে থাকে। আমি বাবার কোলে শুয়ে শুয়ে গান শুনি, মা একের পর এক গান করে যান। কত আনন্দের কত রঙিন সেই দিনগুলো। প্রায়ই আমরা গাড়ি নিয়ে দূরে কোথাও বেড়াতে যাই। এভাবেই কাটছিল বিমোহিত অতি চমৎকার সব প্রহর। একদিন বাবা আবারও আমেরিকা ফিরে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। মা অনেক বার বোঝানোর চেষ্টা করলেন, আমিও কেঁদে কেঁদে বাবাকে অনুরোধ করলাম। কিন্তু না, বাবাকে মায়ার বাধনে বাধা গেল না। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নত গবেষণার সুযোগ নেই এই অযুহাতে ফিরে গেলেন স্বপ্নপুরী আমেরিকায়। আমি আর মা জঞ্জালমাত্র শহরে পড়ে রইলাম।
মা আবারও কলেজে অধ্যাপনা শুরু করলেন। আমি আমার মত বড় হতে থাকলাম। বাবা আর মায়ের দূরত্ব তৈরীর প্রথম ধাপ। বাবা প্রায় প্রতিদিনই ফোন দিতেন। পুরোটা সময় আমার সাথেই বাবার কথা হত, মা বাবার সাথে কথা বলতেন না, আর বললেও খুবই কদাচিৎ। আট-নয় বছর থেকে বাবা একেবারে দেশে ফিরে আসেন। আমি তখন এইচ.এস.সি পরীক্ষা দিয়ে দিয়েছি। রেজাল্টের অপেক্ষায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রিপারেশান নিচ্ছি। ততদিনে মা পুরোপুরি বদলে গেছেন। গান গাওয়া একেবারেই ছেড়ে দিয়েছেন। দিনের পুরোটা সময় কলেজে কাটিয়ে আসেন। বাসায় এখন আর গানের আসর বসে না। আমারও বাবার কোলে মাথা রেখে মায়ের কন্ঠে গান শোনা হয় না। এত কাছে থেকেও দূরের শীতল নিস্তব্ধতা আমাদের গ্রাস করতে থাকে প্রতিনিয়ত। যেন এত কাছের, এত নিবিড় কোন অচেনা তিনটি প্রাণ।
৩)
খুব কাছ থেকে Why this Kolavery Kolavery Kolavery Di? বেজে উঠতেই আমার ভাবনার স্রোতে চর জেগে উঠে। চমকে নড়ে উঠতেই কাপ থেকে খানিকটা চা ছিটকে এসে পড়ে আমার প্যান্টের উপর। কাঠের বেঞ্চটিতে আমার ঠিক পাশেই বসা ছেলেটির মোবাইল ফোনে বাজছে গানটি। ছেলেটির এক হাতে জলন্ত সিগারেট অন্য হাতে চায়ের কাপ। এই ছেলেটি-ই একটু আগে মামার কাছে চা আর সিগারেট চেয়েছিল। ফোনে বেজেই চলছে Why this Kolavery Kolavery Kolavery Di? ছেলেটি ফোন রিসিভ করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাচ্ছে না। দেখলাম চায়ের টঙের মামা ও কিছু কাস্টমার খুব আগ্রহ নিয়ে শুনছে। আমিও শুনছি। গান থামতে না থামতেই আবারও বেজে উঠল Why this Kolavery Kolavery Kolavery Di? ছেলেটি চায়ের কাপ রেখে অত্যন্ত বিরক্তি নিয়ে কল রিসিভ করল। খুব কাছে বসাতে এবং ছেলেটির হেডসেটের ভলিউম হাই হবার কারণে আমি সবকিছু স্পষ্ট শুনতে পেলাম।
-কোথায় তুমি? আর ফোনই-বা ধরনি কেন?
-ক্লাসে ছিলাম। তুমি যা করনা, ক্লাসের মাঝে ফোন দিয়ে বসো। তুমি জানোনা এই সময় আমার ক্লাস থাকে।
-সরি, তোমার সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল। আচ্ছা এত শব্দ কিসের?
-ক্লাস আমি একা করি নাকি? ৬০-৭০ জন স্টুডেন্ট, শব্দতো হবেই। এখন তাড়াতাড়ি বল কি বলবে?
-অনেক দিনতো হল তোমার সাথে দেখা হয় না। চল না আজ বিকেলে একটু বের হই?
-তোমাকে না বলেছি বিকেলে আমার টিউশনি আছে। ৪টা থেকে ৭টা পর্যন্ত আমি বিজি থাকি। এই সময়ে কিন্তু আমাকে ফোন দেবে না। তাছাড়া যাকে পড়াই সে কিন্তু আমার রিলেটিভ, ঐ সময় তুমি ফোন দিলে সমস্যা হবে।
-আচ্ছা তখন ফোন দেব না। টিউশনি থেকে বের হয়েই কিন্তু আমাকে ফোন দিবে। আমি অপেক্ষায় থাকবো। আগামীকাল দেখা......
-স্যার ক্লাসে ঢুকে পড়েছে। রেখে দিচ্ছি। পরে কথা হবে।
এই বলেই কলটি কেটে দিল ছেলেটি। সিগারেটের আগুন নিভে গেছে। দেয়াশলাই জ্বালিয়ে সিগারেটটি ধরাতেই আবার ফোন বেজে উঠল- Why this Kolavery Kolavery Kolavery Di? বিরক্তিতে কপালে ভাঁজ পড়ল ছেলেটির। পকেট থেকে ফোন বের করতেই মুখে হাসি ফোটে উঠল। ঠান্ডা কাপে চুমুক দিতেই ছেলেটির কণ্ঠ শুনলাম।
-জান, তোমাকে ফোন দিতে মোবাইলটা হাতে নিতেই তোমার কল। What a Coincidence?
-
ছেলেটি কাঠের বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়াতে কথোপকথন শুনতে পারলাম না। কিন্তু ছেলেটির সব কথা স্বষ্ট শুনলাম।
-বিকেলে একদম ফ্রি আছি। তোমার সাথে দেখা করব ভেবেই বিকেলটা পুরোপুরি ফ্রি রেখেছি।
-
-না না, কোন সমস্যা নেই। তোমার জন্য এতটুকু করতে পারবো না ?
-
-আজ কিন্তু সারাটা বিকেল রিক্সায় ঘুরে বেড়াবো?
-
-Okey. See Ywa Jaan.
-
-Bye, B-y-e!
চায়ের কাপটা কাঠের বেঞ্চে রেখে বিল দিতে মামার কাছে এগিয়ে গেলাম। পকেট থেকে টাকা বের করছি আর তখনি টঙ মামা ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বলল-
-মামার মোবাইলে যে গানটা বাজল সেটা কি আমাকে দিবেন? আমার মোবাইলে ব্লু-টুথ আছে। আপনার ব্লু-টুথ থাকলে একটু কষ্ট করে পাঠায় দেন না?
বিশ টাকার একটা নোট রেখে আমি হাঁটতে শুরু করলাম। সারারাত জেগে থেকে প্রতিদিন এই সময়টাতে আমি ঘুমে বিভোর থাকি। হয়ত তাই আমার কিছুটা ক্লান্ত লাগছে। ফুটপাত ঘেঁষে হাঁটছি, ব্যস্ত নগরীর চেনা-অচেনা মুখর কোলাহলে ডুবে যাচ্ছি প্রতিনয়ত। সবাই ছুটছে, কেউ থেমে নেই। যারা দাঁড়িয়ে কিংবা বসে আছে তারাও থেমে নেই, হাত-পা নেড়ে নেড়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে কথা বলছে ক্রমাগত। ছোট্ট শিশুটিও থেমে নেই, মায়ের হাত ধরে কাধে রাখা স্কুল ব্যাগ নিয়ে দৌড়ে পার হচ্ছে রাস্তা। থেমে নেই এক পা হারানো কাঠের ক্র্যাচে ভর দিয়ে চলা কেরামত আলী, ক্র্যাচে ভর করে করে সেও জীবিকার সন্ধানে ছুটে চলছে একজন থেকে অন্যজনে।
শুধু অনেকটা সময় থেমে ছিলাম এই আমি। অবিরাম ছুটে চলা গতিময় জীবন থেকে বিদায় নিয়ে কাটিয়েছি প্রতিটি দীর্ঘ অলস রজনী। দিনের আলোয় নিজেকে অন্ধকারের কালো চাদরে ঢেকে রেখে কাটিয়েছি দুঃস্বপ্নের প্রতিটি প্রহর। সন্ধ্যায় নীড়হারা পাখিরা যখন নীড়ে ফিরতে শুরু করে তখন আমি রাত জাগা পাখিদের সঙ্গ দিতে জেগে উঠি। প্রকান্ড একটা রুমের আলো নিভিয়ে দিয়ে জানালার পাশে বসে থাকি অনেকটা সময়। রাত জাগা নিঃস্বঙ্গ কোন পাখি ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে কখনোতো আসেনি আমার সঙ্গ পেতে?! অথচ আমিতো তাদেরই আশাতে কাটিয়েছি বিনিদ্র প্রতিটি রাত।
দীর্ঘ দিনের অলস প্রহর শেষে আমিও নগরীর বিষাদমাখা ব্যস্ত কোলাহলে নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছি আজ। স্তব্ধ নিশ্চল নীরব জীবনে এনেছি গতির ধারা, ছুটে চলেছি মুখর জনারণ্যে।
৪)
অনেকক্ষণ হল মিতুদের বাসার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ওদের বাসায় যাব কিনা সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না, দ্বিধান্বিত মন আমার চিন্তা চেতনাকে এলোমেলো আচ্ছন্নে ঢেকে দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রথম পরিচয় হয় মিতুর সাথে। প্রথম দিন ক্লাস শুরুর অনেক আগেই পৌছে যাই বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনেকদিন পর বাবা-মা দু'জনেই একসঙ্গে গাড়িতে করে আমাকে নামিয়ে দিয়ে যান। গাড়ি থেকে নেমে ডিপার্টমেন্টের সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখি একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পিঠময় ছড়ানো তার খোলা চুল, কাজল দেয়া কালো চোখদুটো যেন এক একটি স্বপ্নীল দ্বীপ। মিতুই প্রথম এগিয়ে এসে আমার সাথে পরিচিত হয়। বন্ধু-বান্ধবহীন এই আমি কিছুটা বিচলতি, কিছুটা বিব্রত বোধ করি।
মিতুই হয়ে উঠে একমাত্র বন্ধু, সঙ্গী, অনুপ্রেরণাময়ী এবং আমার অগোছালো অনুভূতিগুলোর একমাত্র আশ্রয়স্থল। নিঃস্বঙ্গতায় ডুবে থাকা এই আমি ধীরে ধীরে জেগে উঠি। ওর প্রাণোচ্ছল দীপ্তিময় ভালবাসায় আমার পরিত্যাক্ত বিরান ভূমিতে সবুজের অভয়ারোণ্য গড়ে উঠে। সেখানে সকালে পাখির উচ্ছল কলতানে প্রতিদিন ঘুম ভাঙ্গে, ঝুম বরষায় পাখিরা সবুজ বৃক্ষের পাতার আড়ালে বসে ভালবাসার গল্প শোনায়। নাম না জানা অজস্র বুনোফুল আমায় মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। নাগরিক বাতাসের ঝাঁপটা, তপ্ত রাস্তার পিচ গলা গন্ধ, উন্মত্ত জনসভার অশ্লীল দাবীগুলোর আড়ালে বৃষ্টির ভাঁজে ভাঁজে নীলাকাশে আমি সাদা মেঘের জাল বুনতে থাকি।
প্রতিদিন খুব সকালেই বাসা থেকে বের হয়ে যেতাম। সারাদিন ক্লাস, আড্ডা ও বিকেলের পুরোটা সময় জুড়ে মিতুর উষ্ণ ভালবাসায় কেটেছে জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয়, সবচেয়ে আনন্দের এবং মধুর দিনগুলো। সন্ধ্যায় মিতুকে বাসায় পৌছে দিয়ে আনমনা হাঁটতাম গলিতে গলিতে। বাসায় ফিরে যাবার তাগিদ পেতাম না একটুও। কিন্তু কোন পথই খোলা ছিল না। প্রতিদিনই বাসায় ফিরে দেখতাম সবকিছু বড় বেশী গম্ভীর ও থমথমে হয়ে আছে। ভালবাসার সবুজ অরণ্যে এমনটিতো হবার কথা ছিল না। কথা ছিল ভালবাসার জোয়ারে ভেসে ভেসে সাগরের বিশাল জলরাশির পথ ধরে অসীমে পৌছে যাবার। অথচ ঝলমলে দিনগুলোতে বালুচরে তরী নিয়ে আটকে রইল দু-জনে, অনন্তকালের পথে। ভাবতেই অবাক লাগে, কেমন করে আমারই চোখের সামনে দিয়ে বদলে গেল দুজনে। হয়ে গেল অপরিচিত কেউ।
আমি ভবে পাই না, একই ছাদের নিচে একই মাত্রায় কত বৈচিত্র্য, একই সম্পর্কে কত দূরত্ব, মতাদর্শে কত বিভেদ কত দ্বি-মত। ঝলমলে বিকেলে কেউ মুক্ত হাওয়ার অবগাহনে তো অন্যজন বদ্ধ ঘরের নিশ্চল গোমড় বায়ুরোগে নির্জীব। ঝমঝম বৃষ্টিতে খোলা জানালায় বৃষ্টির ছাঁট এলে কেউ হাত বাড়িয়ে দেয় তো অন্যজন নিজেকে আড়াল করে। কখনোবা একজন পূর্ণ জ্যোছনা বেলায় ঝিরি ঝিরি বাতাসে জ্যোছনা স্নানে নামে, নীরব রাতের স্বপ্নীল সম্মোহনে করে নিজেকে সমর্পণ। আর অন্যজন, অমোঘ আঁধারে নিজেকে লুকিয়ে রেখে গোপন দীর্ঘশ্বাসে নিস্তব্ধতার আবরণ লেপে দেয় দেয়ালের পরতে পরতে।
মাঝে মাঝে ভাবনা আমাকেও আচ্ছন্ন করে। আমিও কি বদলে যাবো বাবার-ই মতন! মিতুও কি বদলে যাবে তেমনি! নিয়তির অমোঘ আঁধারে আমিও হারিয়ে যাই যদি অচেনা কোন এক পথের বাঁকে!
বাবার মত আমিও ছিলাম দুরন্ত মেধাবী। সারা দেশে সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে আমি এইচ.এস.সি পাস করি। একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই নিজের পছন্দের বিভাগে। অনার্স এবং মাস্টার্সে বাবারই মত আমিও ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হই। ঐদিকে বাসায় বাবা-মায়ের মৌনতা ভেঙ্গে কলহ শুরু হয় সকাল, সন্ধ্যা, রাত। অজানা ভয়ে জীবন থেকে পালিয়ে একটা স্কলারশীপ নিয়ে মিতুকে না জানিয়ে নিভৃতেই পাড়ি জমাই দূরদেশে।
দারোয়ান এসে লাঠি হাতে গেটে শব্দ করতেই আমি চমকে উঠি। তখনই ভাবনায় খেলে গেল-- যে জীবন থেকে আমি পালিয়ে গিয়েছি সেখানে অচেনা এক আগুন্তুকের মত এখন আর সামনে দাঁড়াতে চাইনা। আমি আবারও ফুটপাত ঘেঁষে হাঁটতে থাকি। আজ সারাদিন শুধুই হাঁটবো।
৫)
সন্ধ্যার আকাশে গোধূলির আলোর নিভে গিয়ে আঁধারে ঢেকে যাচ্ছে চারপাশ। শহরের ব্যস্ত মানুষগুলো ঘরে ফিরে যাচ্ছে। রাত বাড়তেই ব্যস্ত রাজপথে প্রজ্জ্বলিত নিয়নের আলোয় রাতের স্তব্ধতা নেমে আসে। ফুটপাতে নীড়হীন কিছু মানুষের রাতের ঘুমের প্রস্তুতি চলছে। আকাশে গুড়গুড় শব্দে মেঘের ঘনঘটা। পাশেই একটা ল্যাম্পপোষ্টে নিয়নের আলো কেঁপে কেঁপে জ্বলছে নিভছে। দমকা বাতাসে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। যারা ঘুমিয়ে পড়েছিল সবাই উঠে ফুটপাতের দোকান ঘেঁষে নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে। আমিও আজ তাদেরই একজন। আজ রাতে ওদের সাথে আমার কোন পার্থক্য নেই।
বৃষ্টির ছাঁট এসে গায়ে পড়ছে। ঐ দিকে আমার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। আমি মায়ের কথা, বাবার কথা ভাবছি। বাবা-মা দু-জনেরই আলাদা আলাদা ভাবে বড় আদরের একমাত্র সন্তান এই আমি। হয়ত একটা সময় দুটি প্রাণের এক ও অবিচ্ছেদ্য একটি জীবন ছিলাম। কিন্তু আজ আর নই, এরই মাঝে পেরিয়ে গেছে বহুকাল। সময়ের স্রোতে জনবহুল ব্যস্ত দ্বীপে আজ আমরা বড় বেশী স্বতন্ত্র, বড় বেশী অনুভূতিহীন তিনটি নিঃস্বঙ্গ প্রাণ।
দীর্ঘ অনেক সময়ের পর আজ আমার ব্যতিক্রম একটা দিন কেটেছে। আচ্ছা পৃথিবীর সবকিছুতেই কি ব্যতিক্রম আছে? যেমন আমি কখনোই কনডেন্স মিল্ক দিয়ে তৈরী চা খাই না কিন্তু আজ খেলাম। গাড়ি ছাড়া একা একা আমি কোথাও বের হইনা, অথচ আজ আধারীর ঘনঘটায়, পূর্ব দিগন্তে সূর্য অসীম উষ্ণ-মমতায় পৃথিবীকে আলিঙ্গন করারও অনেক আগে বাসা থেকে বের হয়েছি। অনেকটা পথ হেঁটেছি পথ থেকে পথে। অন্ধকারে ঘুমের ঘোরে টলতে থাকা রাত প্রহরীকে দেখেছি খুব কাছ থেকে। ফুটপাত ঘেঁষে নিদ্রাতুর অসংখ্য জীবনের প্রতিচ্ছবি এঁকেছি সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে। অন্ধকারে কুকুরের ডাকে আগের মত ভয়ে ছুটে পালিয়ে যাইনি, হেঁটে হেঁটে কুকুরের খুব কাছে চলে গিয়েছি। অতিকায় দানবীয় শরীরে ধারণ ক্ষমতারও অধিক পণ্য নিয়ে ঘুমন্ত রাজপথ কাঁপিয়ে দিয়ে শো শো শব্দে চলে যাওয়া ট্রাক দেখেছি, দেখেছি ট্রাফিক মোড়ে থেমে যাওয়া ট্রাক থেকে মুঠোভরা বাড়িয়ে দেওয়া হাত। এ সমস্ত সব কিছুই কি ব্যতিক্রম? মাতাল ভাবে টলতে থাকা একটা মাইক্রো শো-শব্দ করে নিমিষেই মিশে গেল। হয়ত এসব কিছুই ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম নেই শুধু মৃত্যুতে।
চারিদিকে তীব্র সাদা আলোর ছড়াছড়ি। এটা কি মৃত্যুর পরের কোন জীবন, আমি কি মরে গেছি? চোখ মেলতে চাইছি কিন্তু কোন ভাবেই তা পারছিনা। প্রচণ্ড শীতে জমে যেতে শুরু করেছি, মনে হচ্ছে হিমশীতল কোন এক ঘরের মেঝেতে শুয়ে আছি। একটু উষ্ণতার আশায় আমি মরিয়া তখন। এমন-ই ক্ষণে কারা যেন আমার দু'হাত চেপে ধরল পরম উষ্ণতায়। অদম্য ইচ্ছা শক্তি নিয়ে চোখ মেলে দিতেই দেখি বাবা-মা'কে, চোখে মুখে হাসি নিয়ে পরম স্নেহে আমার ডান হাত চেপে আছেন দুজনে। নিশ্চিত মৃত্যু জগতে পড়ে আছি এই ভয়ে আমি আবারও চোখ বন্ধ করে ফেলি। কিন্তু উষ্ণ হাতের বাধন শিথিল হল না বরং আরো তীব্রতায় আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরল আমাকে।
ফোঁটা ফোঁটা উষ্ণ জলে আমার বাম হাত ভিজে উঠছে। কৌতুহল নিয়ে এবার পাশ ফিরে চোখ মেলে তাকাতেই দেখি মিতু দু-হাত চেপে অঝোরে কাঁদছে। আমি দুচোখ ভরে মিতুর দিকে তাকিয়ে থেকে আবারও চোখ বন্ধ করে ফেলি। চোখ বন্ধ করতেই পরম ভালবাসায় মিতু ডেকে উঠে। রাজ্যের নিঃস্বঙ্গতা, পাহাড়সম হতাশার মূল উপড়ে ফেলে অশ্রুসিক্ত উষ্ণ ভালবাসায় আমি জেগে উঠি।
সময়ের স্রোতে ছুটে চলা বিচ্ছিন্ন মানুষের অনিশ্চিত জীবনের ভূমিকার শেষে গল্প শেষ হতে পারত। কিন্তু তা হয় নি, কারণ মৃত্যুর মত ভালবাসাতেও কোন ব্যতিক্রম নেই। মৃত্যু যেমন সময়ে-অসময়ে নানা রঙে, নানা ঢঙ্গে প্রকাশ পেয়ে থাকে, ভালবাসার প্রকাশও তেমন-ই। আবার শক্তির যেমন কোন ধ্বংস কিংবা বিনাস নেই, শুধু এক রুপ থেকে অন্য রুপে পরিবর্তিত হয়, তেমনি ভালবাসারও কোন ধ্বংস কিংবা বিনাস নেই, সময়ের প্রয়োজনে এক রুপ থেকে অন্য রুপে পরিবর্তিত হয় মাত্র।
তেমনি, সকালে ছেলেকে ঘরে না পেয়ে প্রতিটি স্যাটেলাইট চ্যানেলে নিখোঁজ সংবাদ প্রচারের ব্যবস্থা করেন এবং কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে দিয়েই প্রচারিত হতে থাকে তা। এদিকে ভালবাসার প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে থাকা মিতুর চোখে পড়ে সেই সংবাদ। সাথে সাথেই বাবাকে করে গাড়ি নিয়ে বের হয় ভালবাসার মানুষটিকে খুঁজতে। প্রতিটি হাসপাতাল, পুলিশ স্টেশান, রেল স্টেশান, বাস টার্মিনাল, পার্ক সহ সারা শহর খুঁজতে খুঁজতে ভোরের দিকে ফুটপাতে কর্দমাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে নিয়ে যায় হাসপাতালে। (লেখক)
...................................
মোখলেছুর রহমান সজল
মন্তব্য
১। আমি প্রতি রাতেই জাগি থাকি --> আমি প্রতি রাতেই জেগে থাকি।
২। আমারও মাও ছিলেন --> আমার মাও ছিলেন।
৩। -------------------------------------------------।
৪। আমি ভবে পাই না --> আমি ভেবে পাই না।
৫। সাথে সাথেই বাবাকে করে --> সাথে সাথেই বাবাকে সঙ্গে করে।
প্যারাগুলোতে উপরোক্ত অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য দুঃখিত। --- লেখক
ভাই অন্যের ক্থা কান পেতে শোনা ভাল না।
যাইহোক ভাল লিখেছেন
হা হা হা। নিষেধ করে দেব যেন আড়ি না পাতে।
ধন্যবাদ, ভাল থাকুন।
নতুন মন্তব্য করুন