নিঝুম কুয়ো

নিলয় নন্দী এর ছবি
লিখেছেন নিলয় নন্দী [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ১৪/০২/২০১২ - ১২:০২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমি। খুব ছোটবেলায়, আমি তখন স্কুলেই ভর্তি হইনি, একটা বাড়িতে আমরা ভাড়া থাকতাম। শহরের শেষ মাথায় ছিল টিনের চালওয়ালা বাড়িটা। মফস্বলের আর দশটা বাড়ি যেমনটা হতো ঠিক তেমনই। ছিমছাম তিনটা ঘর। জানালাগুলো খুলে দিলে হুহু করে খোলা মাঠের হাওয়া এসে জুড়িয়ে দিত মন। বাড়ির পেছনে ছিল বড় একটা উঠোন। উঠোনের শেষ মাথায় কাঁঠালগাছের নিচে শান বাঁধানো একটা কুয়ো। উঁকি মেরে দেখলে দেখি কতটা নিচে অন্ধকার। তার মধ্যেই জলের ওপর আলোর ঝলক। ছোটবেলার দিকে ফিরে তাকালেই আমি কুয়োটা দেখতে পাই। কেন পাই জানি না। তবু মনে হয়, মনে মনে খানিকটা বিশ্রামের জায়গা খুঁজে নিতে চাইলে আমি ওই কুয়োতলাটা বেছে নেব। যে কুয়োর অনেকটা নিচে আছে কালো জল। মাথার ওপর কাঁঠাল গাছের ঘন ছায়া।
আমার ফেসবুকের বন্ধুদের বলছি- আসুন একটা গল্প লিখে ফেলি। আমার ছোটবেলার কুয়োতলা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে বারোয়ারি একটা গল্প।

নাজিব সুমন। সেই সময় খুব ভোরবেলায় আমার ঘুম ভেঙ্গে যেত। আমি কান পেতে শুনতাম কখন ভেসে আসে আযানের ধ্বনি। বন্ধ জানালার বাইরে কলাগাছ তলা থেকে শোনা যেত শিশির ঝরার টুপটাপ শব্দ। আর একটু পরেই পাখিদের কিচিমিচি। কাকের ডাক জানিয়ে দিত সূর্য উঠছে। নিজের ওপরেই বিরক্ত হই আমি। এত তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙ্গার কি দরকার ছিল? মা যে কেন এত তাড়াতাড়ি আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয় বুঝি না। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ি। দরজার খিল খুলতে দেখেও মা কিছু বলে না। খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা নাকি ভালো। আমার দাদুও খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতেন। সকাল সকাল উঠে পুরো পাড়াটা কয়েক চক্কর ঘুরে আসতেন। পাখিদের দানা খাওয়াতেন। ফুলগাছে জল দিতেন। যেদিন আমি একটু দেরিতে ঘুম থেকে উঠতাম দেখা যেত কুয়োতলায় বসে তিনি বই পড়ছেন। ঢাকা থেকে খবরের কাগজ পৌঁছত সেই ভর দুপুরে। তার আগে কি আর করবেন? কখনো রবি ঠাকুরের গল্প পড়ছেন নয় তো নজরুলের কবিতা। মাথার ওপর কাঁঠাল গাছটা যেন মাথা ঝুঁকিয়ে শুনছে দাদুর নীরবে বই পড়া।

ফারাহ্ ইসলাম। পাশের বাসা থেকে আসত বিন্তি আর ওর ভাই বিপুল। কুয়োর জল তুলে আমরা হাঁড়ি-পাতিলে ঢেলে রান্না করতাম। কাঁঠাল গাছটা আমাদের ছায়া দিত। দাদু বারান্দায় বসে আমাদের খেলা দেখতেন, ‘আমি কিন্তু আজকে তোমাদের গেস্ট। কি রান্না করছ আজ দেখি।’ আমরা হই হই করে উঠতাম, ‘দাদুকে খেলায় নেব না।’ দাদু হাসতে হাসতে উঠে চলে যেতেন। বোধহয় মেয়েলি খেলা বলে রান্নাবান্নাটা বেশি দিন চালানো গেল না। রাস্তার ওপারে যে ধুলো ছাওয়া মাঠটা ছিল ওইখানে হতো ছেলেদের ফুটবল খেলা। তখনো স্কুলে ভর্তি হই নি। যারা ওখানে খেলত তারা সবাই স্কুলে যেত। ফলে খেলায় আমার অংশ নেয়া হয়ে উঠত না, তবে ছুটোছুটি করে বলে দু’ একটা লাথি মারতে পারতাম ঠিকই। ভর সন্ধ্যেবেলায় বাসায় ফিরলে মায়ের বকুনি জুটত কপালে। শ্যাওলা জমা কুয়োর পাড়ে দাঁড় করিয়ে মা আমার ধুলো মাখা পা ধুয়ে দিত। ভেজা গামছা দিয়ে মুছিয়ে দিত মুখ হাত। মায়ের নতুন চুড়ি দুটো বাজত আমার কানের কাছে। ঘরের ভেতর হলদে বালবের মিটমিটে আলো। আমার সামনে বুক মেলে পড়ে থাকত ছবিওয়ালা বই। আমি ‘টিয়ে পাখির ঠোঁটটি লাল- ঠাকুরদার শুকনো গাল’ পড়তে পড়তে হঠাৎ বলতাম-‘মা, ওই শোন, বাইরে কুয়োতলায় কারা যেন হুটোপুটি করছে।’ মা একটু কান খাড়া করে শুনত তারপর রেগে গিয়ে আমাকে এক ধমক দিত, ‘খুব বেশি বদমাশি বেড়েছে তোমার! আজকে আসুক তোমার বাবা!’ আমি খুব হাসতাম। বাবা এলে অবশ্য আর কিছু বলা হতো না। বাবা বালতি দিয়ে কুয়োর জল তুলে স্নান করত। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। কই, কুয়োতলায় আর কেউ তো নেই!

শাহরিয়ার তানভীর। দাদা, আর কেউ লিখছে না কেন? গল্পটা কি শেষ হয়ে গেল?

আমি। আমি তো চাইছি গল্পটা আরো খানিকটা চলুক। কেউ আছেন? বাকিটা লিখুন না-

সৈয়দ মাজহার। যেদিন আকাশ ভরা জ্যোৎস্না ভেঙ্গে পড়ত আমাদের উঠোনে, দাদু আমাদের সবাইকে নিয়ে গল্পের আসর বসাতেন। কত জায়গায় যে বেড়িয়েছেন দাদু! তিনি তাঁর বেড়ানোর গল্পগুলো এমনভাবে বলতেন যে সব কিছু আমরা ছবির মতো চোখের সামনে দেখতে পেতাম। কখনো পদ্মা নদীর গভীরে ডুবসাঁতার, কখনো দার্জিলিঙের পাহাড়ে ওঠা, কখনো কাশ্মীরের ঝিলম নদীতে নৌকার দুলুনি-এসবের মাঝেই আমার চোখ ভরে নামত রাজ্যের ঘুম। দাদু কি সত্যি ওই সব জায়গায় গিয়েছিলেন, না কেবল বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলতেন। ‘অনেক হয়েছে, দেখ শিশির পড়ে মাথা ভিজে গেল ছেলেটার,’ বলে আধো ঘুমের মধ্যে বাবা আমাকে কোলে তুলে নিত। দাদুর বাকি গল্পগুলো আর শোনা হয়ে উঠত না। হঠাৎ মা চমকে উঠত, ‘আরে ছেলেটা না খেয়েই ঘুমিয়ে গেল যে!

রতন মাহবুব।একদিন ভর দুপুরে একটা ভিক্ষুক এসে গান জুড়ে দিল। গানটার কথা আজ আর মনে নেই। খুব করুণ সুর। কি যেন খুঁজে ফিরি-তবু পাই না কেন তারে-এমনই কিছু। আমি ভেবেছি লোকটা ভিক্ষা খুঁজছে কিন্তু কারো কাছে পাচ্ছে না। মাকে গিয়ে বললাম, মা দু’মুঠো চাল নিয়ে এসে থালাটা লোকটার ঝুলিতে উপুড় করে দিল। লোকটা হঠাৎ বলল, ‘থাকবে না...হারিয়ে যাবে।’ কি হারিয়ে যাবে জিগ্যেস করা হলো না। লোকটা চলে গেল। মার মুখটা কেমন শুকিয়ে গেল। হারিয়ে যাবে- কেউ হারাবে না কিছু হারাবে? দু’দিন পরে বিকালবেলায় মা কুয়ো থেকে জল তুলছিল। আমি ঝুঁকে পড়ে দেখছিলাম। হঠাৎ বাঁধানো শানের কোনায় লেগে মায়ের হাতের একটা চুড়ি খসে পড়ে গেল কুয়োর ভেতর। এত সহজে যে হাত থেকে চুড়ি খসে পড়ে যেতে পারে তা আমি বা মা কেউ ভাবতেও পারি নি। মা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল তারপর এক হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল, ‘কি ভাগ্য দেখ! আমি ভেবেছিলাম মানুষ হারিয়ে যাবে।’ মাথার ওপর মেঘের গায়ে শেষ বিকেলের রোদ। পাখিরা ঘরে ফিরছে। একটু পরে বাবাও বাসায় ফিরল, বলল, ‘একটুর জন্য আজ একটা এ্যাক্সিডেন্ট থেকে বেঁচে গেলাম।’ মা কিছু না বলে শুধু দরজার চৌকাঠটা আঁকড়ে ধরল।

আমি। গল্পটা আর এগোনোর আগে আমি শেষ করে দিতে চাইছি। গত সপ্তাহে আমি সেই বাড়িটা খুঁজতে গিয়েছিলাম। আমার মনের ভেতর ছিল ঝিঁঝিঁডাকা ঝোপ, কাদামাখা পথঘাট, জোনাকিজ্বলা সন্ধ্যা, ঘন পাতায় ছাওয়া কাঁঠাল গাছ আর শ্যাওলাঢাকা কুয়োতলা। গিয়ে দেখি ঝলমলে ব্যস্ত শহরে গাড়ির বহর ছুটছে। বিশাল এক শপিং কমপ্লেক্স মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সেই টিনের চালওয়ালা বাড়িটার কোন চিহ্নই নেই। এদিক ওদিক খানিক ঘুরেফিরে শেষে চলে এলাম।
যা কিছু ভালো স্মৃতি আছে সব আমরা আমাদের মনে রেখে দেব। হাতের নাগালে না-ই বা থাকল। মনের ভেতরে নিশ্চয়ই থাকবে। আমাদের ছোটবেলা কখনোই আমাদের ফেলে চলে যায় না।

নিলয় নন্দী


মন্তব্য

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

লেখার আঙ্গিক ও শৈলী এককথায় অসাধারন ।
খুব খুব খুবই ভাল লাগল ।

আরও অনেক অনেক লেখা চাই ।

আর গল্পটা একদম ঠিক সময়ে শেষ করার জন্যে ধন্যবাদ ।

ছোটবেলার কত যে স্মৃতি যে উসকে দিলেন ,,,,,,,,,, আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

নিলয় নন্দী এর ছবি

আপনাকেও এক গুচ্ছ আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

Shantanu Rahman এর ছবি

চলুক
বেশ ভালো‌ই লাগল। আরও লিখুন ।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

বাহ! চমৎকার হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

নিলয় নন্দী এর ছবি

হাসি হাসি হাসি

Shamim Khan এর ছবি

সাবলীল লেখা। ভাল লাগলো।

নিলয় নন্দী এর ছবি

ধন্যবাদ শামীম। লইজ্জা লাগে ভাল থাকবেন।

anjan nandy এর ছবি

ভালো লাগলো লেখাটা। আরো লেখা চাই

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।