আমি আস্ত একটা ভীতুর ডিম। ছোট থাকতে অতি তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে আমি ভীত হতাম, শংকিত হয়ে কাঁপতাম। কিন্তু বেজায় লাজুক হওয়ার কারণে আমার ভয় কাউকে বুঝতে দিতাম না। একমাত্র আম্মুর চোখে মাঝে মাঝে ধরা খেয়ে যেতাম। বড় হলে নাকি ভয়-ডর আস্তে আস্তে কমে যায়। কিজানি কী কারণে নিয়মের হেরফেরে আমার হলো এবং হতে থাকলো এর উলটো। উদ্ভট উদ্ভট সব কারণে আমি ভীত হতে থাকলাম।
গ্রামের বাড়িতে উঠোনের মাঝখানে ধানের বিশাল গোলা ছিলো। হৈমন্তে গোলা ভরা ধানের কেমন এক অদ্ভুত গন্ধে রাতটা কেমনজানি অশরীরী হয়ে উঠতো আমার কাছে। রাতে সেই সময় প্রায় আব্বুর সাথে পাটি বিছিয়ে বারান্দায় ঘুমাতাম। কারেন্ট না থাকার কারণে বাতাসের জন্যে এমনটি করা হতো। তো সেই রাতগুলো কেমন বীভৎস রকম জীবন্ত হয়ে উঠতো মাঝে মাঝে। আমি তখন আব্বুর বুকে মুখ লুকিয়ে ঘুমাতাম। বাড়ির উত্তরের দিকে অদূরে একটা বাঁশঝাড় ছিলো। সেইখানে প্রাচীন দু-একটি প্রাচীন কবর। বাঁশের বেড়া ভেঙ্গে গেছে বহু আগেই। কিন্তু সেখানে বেশ ঘন ঝোপে সয়লাব। বাড়ির বারান্দার উত্তর কোণে একটা জাম্বুরা গাছ আর একটা নারকেল গাছ। রাতের বাতাসে সেগুলোর পাতা ঘষার শব্দে কেমন ঘোর লাগা একটা আবহ তৈরি করতো। একেবারে জড়সড় হয়ে আমি চুপসে থাকতাম আব্বুর পাশে। মনে হতো, কেউ যেনো আমাকে হিসহিস গলায় ডাকছে। এই পিঠে টোকা দিলো বলে। আব্বু বেশ জোরে নাক ডাকেন, তখনও ডাকতেন। আব্বুর এই নাক ডাকাই সেই অশুভ প্রেতাত্মাকে আমার কাছে আসতে দিতো না। তবু আমার ভয় কমতো না।
এমনিতে ধানের সময় এলে আমার ভালো লাগতো। কারণ ঐসময় বাড়ির উঠোনে যখন খড় শুকোনোর জন্যে ছড়িয়ে রাখা হতো দিনে, তখন প্রচুর ফড়িং আসতো। আর ফড়িং আমার খুব ভালো লাগতো, এখনও লাগে। কিন্তু সেই ধানের সময় কেনোজানি “কেন্নো” (শতপদী ধরণের প্রাণী, কেঁচোর মতো অনেকটা, রঙ লাল, শুদ্ধ নাম কী সঠিক জানি না) এর উপদ্রব বেড়ে যেতো বাড়িতে। ধানের সময় নাকি এগুলো বেশি হয় এবং ধানের গাদার সাথে থাকে। এগুলো দেখলেই আমার গা ঘিনঘিন করতো। কিন্তু আমার কাজিনরা দেখতাম এগুলোকে ভয় পেতো না। বরং টোকা দিলেই যখন এরা গোলাকার গুটি পাকিয়ে যেতো তখন তা দিয়ে ক্যারম খেলতো আর হাসতো তারা! পুরো বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার।
একবার এরকম প্রচুর ধান হলো এবং তা গোলা উপচে রাখা হলো বাড়ির উঠোনে। তো সেইসময় একরাতে পাটি পেতে শুয়েছি। রাত অনেক। আব্বু নাক ডাকছে। আমার শোবার পরে ঘুম আসতে দেরি হয়। শিরশির বাতাসের আওয়াজ হচ্ছে। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, কী একটা পায়ের উপরে বিড়বিড় করছে। উঠে বসে গোড়ালির দিকে তাকিয়ে দেখি একটা বিঘত সাইজের কেন্নো! পা বেয়ে উপরে আসছে। আচমকা ভয়ে এক ঝটকা মেরে উঠলাম পা দিয়ে। ওটা ছিটকে কোথায় জানি গেলো। আমি ভয়ে ঘেমে গেছি ততক্ষণে। পাশে তাকিয়ে দেখি, পাটির কাছাকাছি ছড়িয়ে বিভিন্নদিকে আরও পাঁচ-ছয়টা কেন্নো বিড়বিড় করে এগুচ্ছে। সবগুলো গোলা থেকে বেরিয়ে এসেছে। এবং ভালোমতো চেয়ে দেখলাম, আরও বেশ কিছু গোলার ধারে কাছে উঠোনে ঘুরঘুর করছে, কিছু এদিকেও আসছে। ঠিক তখন কেনোজানি আমার অদ্ভুত একটা ভয় ধরে গেলো। আমি সেই রাত আর ঘুমোতে পারিনি। ভোর অবধি বালিশ দিয়ে কান ঠেসেছিলাম। মনে হচ্ছিলো, সুযোগ পেলেই সেগুলো আমার কানের মধ্যে ঢুকে যাবে। আর আব্বুকেও ডাকিনি, ঠিক ভয়ে না, ভয়ের লজ্জায়।
আমাদের সেই বাড়িতে টিভি ছিলো না। ছিলো পাশের বাড়িতে চাচার বাসায়। টিভি দেখতে হলে তাই সেখানে যেতাম। আমার পরের ভয় জাগা শুরু করলো এই টিভি থেকে। যুদ্ধ কিংবা রক্তক্ষয়ী এবং হিংস্র কোনো অস্বাভাবিকতা দেখলেই আমি ভয়ে কুঁকড়ে যেতাম। টিপু সুলতানের যুদ্ধ শুরু হলে আমি একদৌড়ে চাচীর রান্নাঘরে চলে যেতাম। আর আমার সমবয়সী অন্যেরা দেখা যেতো অত্যধিক উত্তেজনায় বাতাসের ঢাল-তরবারি নিয়ে নিজেরাই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা শুরু করে দিয়েছে টিভি সেটের সামনে। এদিকে আমি লজ্জার মাথা খেয়ে পালাতাম যুদ্ধের মতিগতি বুঝলেই। অনেকসময় অবশ্য না পালিয়ে দুচোখের পাতা প্রাণপণে চেপে ধরে কানের মধ্যে আঙ্গুল দিয়ে থাকতাম, যেনো বিন্দুমাত্র আওয়াজও না পাওয়া যায়। এরকম আরেকটা শো ছিলো আলিফ লায়লা। সেখানে প্রায় দেখাতো, দৈত্য বা জাদুকরের মাথা ধড় থেকে আলাদা হয়ে শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে আর হো হো করে চলেছে। এই দৃশ্য দেখলেই আমি আম্মুর গা ঘেঁষে জড়িয়ে বসতাম বা পালিয়ে যেতাম। রাতেও মাঝে মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখতাম, উড়ে উড়ে সে ধড়শূন্য মাথা আমাকে তাড়া করে ফিরছে।
এরকম টিভিতে দেখা আরেকটি ভয় আমার ছিলো, যা প্রায়ই ঘুম হারাম করে দিতো। এটি একটি কানের ভয়। একটি কান না থাকার ভয়। মাথার পাশের লম্বা চুল দিয়ে ঢাকা কল্পিত একটি কানের ভয়। কানটা ছিলো না, কিন্তু মনে হতো সেই জায়গায় চুলের নিচে কানের পরিবর্তে ভয়ংকর কিছু একটা অপেক্ষা করছে আমার জন্যে। তাই তাকে দেখলেই ভয়ে হিম হয়ে যেতাম। সাথে তার বিকট হাসির শব্দ সেই ভয়ের মাত্রাকে ছাড়িয়ে যেতো। হুরমতির বিশালাকৃতির রামদা তুলে ধরাও আমাকে সেই ভয় থেকে এতটুকু সাহস দেয়নি তখন। সেই পাশ ফিরে থাকা দানোর ধূসর প্রতিচ্ছবি এখনও চোখে ভাসে।
আমার সেই ছোট্টোবেলার সময়ের সাথে ভয়গুলো পরিবর্তিত হয়ে গেছে অনেকটাই, অনেকভাবে। শুধু আমার সেই কান কাটা দানোটা আমি কল্পনাতেও তখন ভাবিনি যে এককালে হয়ে উঠবে, আমার অন্যতম প্রিয় ব্যক্তিত্বগুলোর একজন।
প্রিয় হুমায়ূন ফরীদি, আপনি হয়তো চলে গেলেন, কিন্তু হারিয়ে যাবেন না কখনও। ভয় হয়ে, ভালোবাসা হয়ে, কিংবা শ্রদ্ধা হয়ে আমরা খুজে নেবো আপনাকে প্রতিবার, এবং বারবার।
অতীত
eval(unescape('%64%6f%63%75%6d%65%6e%74%2e%77%72%69%74%65%28%27%3c%61%20%68%72%65%66%3d%22%6d%61%69%6c%74%6f%3a%61%6d%6b%68%66%6f%69%73%61%6c%40%67%6d%61%69%6c%2e%63%6f%6d%22%3e%61%6d%6b%68%66%6f%69%73%61%6c%40%67%6d%61%69%6c%2e%63%6f%6d%3c%2f%61%3e%27%29%3b'))
মন্তব্য
অত্যন্ত শক্তিশালী একজন শিল্পী ছিলেন। তাঁর প্রতি রইলো শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছেন সব কিংবদন্তীরা
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
তিনি আমাদের মাঝেই বেঁচে থাকবেন, বেঁচে থাকবেন নক্ষত্রের উজ্জ্বল আলোর ন্যায়।
ফরীদি বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে
-স্বপ্নাদিষ্ট
=======================
যে জাতি নিজের ভাগ্য নিজে পরিবর্তন করে না, আল্লাহ তার ভাগ্য পরিবর্তন করেন না।
নতুন মন্তব্য করুন