এককালে বাসার বুজুর্গদের বুলি শুনতে শুনতে প্রায় বলি হয়ে গিয়েছিলাম, “লেখাপড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে। তাই গাড়ি-ঘোড়া চড়তে বেশি বেশি পড়ালেখা করো”। আমি মানি না, মানতাম না। কারণ জলজ্যান্ত চোখের সামনে দেখতাম, আব্বু তো কোনো পড়ালেখাই করে না। তাও দেখি দিব্যি রোজ ভুটভুট করে মটোরসাইকেল গাড়িতে করে অফিসে যায় আর আসে। আর বাসায় এসে শুধু আমার পিঠের চামড়া তোলার পাঁয়তারা খোজে। অবশ্য আব্বুকে কখনও ঘোড়ায় চড়তে দেখিনি আমি। তবে আমাকে মাঝে মাঝেই পড়ার সময় ঘোড়ার ডিম বলতে দেখেছি। তাই তখন মনে হতো আমার সাথে ঘোড়ার ডিম এর কোনো যোগসূত্র আছে বা থাকতে পারে। আর সেই ডিমটা ফুটে বাচ্চা হলেই আব্বু সে বাচ্চা ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসবে।
সেই সময়কার সে বলি বাহাদুর লেখাপড়াকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে গলাধকরণ করে আজ অবধি বলির পাঁঠা হয়ে রাস্তা রাস্তা চষে বেড়াচ্ছে। ভাগ্যে ঘোড়া জুটে নাই, আর গণ পরিবহনে হয়ে গেছে বাদুড়ঝোলা। কয়েকবার অবশ্য শেষবারের মতো গাড়ির তলা দেখার সৌভাগ্য হতে হতেও ফাটা কপালের ফাঁক গলে বেঁচে গিয়েছি বলা যায়। আর এদিকে লেখাপড়াটাও যে পুরো বাগাতে পেরেছি তা না। হেঁচকি, বিষম আর ঢেকুর তুলে তুলে ক্রমাগত বাকি গুরুপাক অংশ বদহজমের অদম্য প্রচেষ্টা চলছে এখনও।
স্কুলে ভর্তি হতে না হতেই স্যারেরা কোঁৎ করে গিলিয়ে দিলো “জ্ঞানই আলো” আর “সুস্থ দেহে সুস্থ মন”। এইগুলো নাকি “মটো”। মটো আবার কী মাল একমাত্র আল্লাহ আর স্যারেরাই জানতো ঐসময়। আমার এন্টেনায় মটোরসাইকেল আর মটোরশুটি ব্যতীত মটো এর মতো আর কিছু ছিলো না। তো সেই জ্ঞানের আলোর ছটা দেখতে গিয়ে আমার দুরন্তপনাগুলো আস্তে আস্তে চোখে অন্ধকার দেখা শুরু করলো। অন্যদিকে সুস্থ দেহে সুস্থ মন বলতে স্কুলে ছিলো বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা নামক উদ্ভট কিছু তুঘলকি কান্ডের সমাহার। আমার মন তা দেখে ভয়ে ভোঁদৌড় দিলো আপন জগতে, গিয়েই খট করে খিলকপাট আটকে দিলো। এদিকে বাইরে থেকে মন হারিয়ে সুস্থ দেহ ত্রস্ত হয়ে, আর স্কুলের নিয়মের বেড়াজালে আটকে তড়পাতে লাগলো মাকড়শার শিকারের মতো।
প্লাস্টিকের একটা ফুটবল আর একটা ছোট টেনিসের বল ছাড়া আমার খেলার উপকরণ তেমন কিছু ছিলো না। কোত্থেকে জানি একটা লোহার চাকতি ঘূর্ণী পেয়েছিলাম। মাঝে স্ক্রু এর মতো একটা দন্ড ছিলো যেটা দুই আঙ্গুলে চেপে প্যাঁচ মারলেই বনবন করে ঘুরতে শুরু করতো। মসৃণ মেঝেতে শুয়ে শুয়ে আমি তাকে অহরহ চক্কর খাওয়াতাম। প্রায় দেড় থেকে দুই মিনিট অবধি ঘুরতো ঐটা। এসময় মেঝেতে কান পেতে রাখলে মিহিসুরে ঘড়ঘড় আওয়াজ শোনা যেতো একটা। দাদুবাড়ি থেকে এ পর্যন্ত আমরা দুইবার বাড়ি পরিবর্তন করলেও সেই ঘূর্ণীটা হারিয়ে যায়নি। কীভাবে কীভাবে যেনো সেটা থেকে যেতো সাথেই। এরকম আরেকটা ঘূর্ণী ছিলো পিটালি (আমরা বলতাম পিঠুলা) গাছের ফল। যখন গাছে ফল ধরত তখন আমি বা আমরাও কাজিনেরা ঢিল মেরে সেই ফল পাড়তাম। ফলটা দেখতে চ্যাপ্টা গোলাকার, অনেকটা চাকার গোল টায়ারের মতো। সেটার মাঝে নারকেলের খিল (মাঝের শক্ত শিরা) দিয়ে ফুটো করে ঘূর্ণী বানাতাম আমরা। এরপর চলতো প্রতিযোগিতা, কার ঘূর্ণী সবচেয়ে বেশিক্ষণ ঘোরে।
ছোটখালার বাসায় একবার বেড়াতে গিয়ে একটা প্লাস্টিকের ঘোড়া পেয়েছিলাম। আম্মুর কাছে শোনা রূপকথার ডালিমকুমারের ঘোড়া হয়ে উঠেছিলো সেটা একসময়। আর ভাঙ্গা বাল্বের গোড়া, কালি ফুরোনো কলম, চকের প্যাকেট এইগুলো নিয়ে সেই রাজ্যের প্রতিকৃতি গড়ে উঠতো। আর একটা ধনুক ছিলো (বাঁশের অংশ দিয়ে তৈরি), ছোটচাচা বানিয়ে দিয়েছিলেন। সেটা দিয়ে আমি ফড়িং ধরার চেষ্টা করতাম। আর মাঝে মাঝে আকাশে উড়োজাহাজ যেতে দেখলে সেই ধনুক দিয়ে তীর ছুঁড়ে ঘায়েল করার চেষ্টা করতাম। আমার ছোঁড়া সে তীরগুলো ব্যর্থ হয়ে একটু পরে পরে টিনের চালে আর উঠোনে মুখ থুবড়ে পড়তো। একবার মনে হয় এই কাজ করতে গিয়ে বারান্দায় রাখা মাটির একটা কলসি ফাটিয়ে ফেলেছিলাম।
আব্বুর মোটরসাইকেলের পেছনের চাকার একটা পরিত্যক্ত টায়ার ছিলো বাড়িতে। সেটা ছিলো আমার গাড়ি। হাতে একটা মাঝারি সাইজের কাঠি, অনেকটা হ্যারি পটারের “ম্যাজিক ওয়ান্ড” এর মতো। ঐটা দিয়ে টায়ার গড়িয়ে নিয়ে চলতো আমার গাড়ি গাড়ি খেলা। ভ্রুম...ভ্রুউম...ভ্রুউউউম্মম্মম্ম করে মুখ দিয়ে শব্দ করে প্রায় বিদ্যুতগতিতে ছুটতাম আমার হোন্ডা নিয়ে। এরকম টায়ার আমার একারই ছিলো। যাদের সাথে খেলতাম, তাদের সবার ছিলো সাইকেলের পরিত্যক্ত রীম। আমাদের বাসার কিছু দূরেই গ্রামের প্রধান সড়ক, যেটা সাধারণ জমি থেকে প্রায় দুই মিটার উঁচু লেভেল এ ছিলো। আমাদের কাজ ছিলো টায়ার গড়িয়ে সেই ঢাল বেয়ে রাস্তায় তোলা এবং আবার নেমে আসা। ওঠার সময় কষ্ট হলেও নামার সময়ে ব্রেক রাখতে গিয়ে হিমশিম খেতাম প্রায় সবাই। রাস্তার ঢালের পাশে একটা ছোট্ট পুকুর ছিলো। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আমার এবং আরও অনেকের গাড়ি কখনওবা ডুব দিতে যেতো সে পুকুরে। আমার টায়ার হওয়াতে একটা সুবিধা ছিলো, তা ভেসে থাকতো। ফলে পড়লেও পানিতে না নেমে তুলতে পারতাম। কিন্তু অন্যদের পানিতে নেমে তুলতে হতো ডুবে যাওয়া রীম। এজন্যে কেউ কেউ আবার তার দিয়ে প্যাঁচ দেয়া কাঠি ব্যবহার করতো যেনো রীমকে আটকে ফেলা যায়।
হোন্ডার তেল ফুরিয়ে গেলে কিছুক্ষণ জিরোনোর জন্যে পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে ব্যাঙ-চিতরানো (আমাদের ভাষায়) খেলা শুরু করতাম আবার। ইতস্তত ছড়িয়ে পড়ে থাকা পাতলা ইট কিংবা মাটির টুকরো দিয়ে পানিতে ছুঁড়ে ভাসিয়ে দিতাম। পুকুর তেমন বড় না হওয়ায় লাফাতে লাফাতে সেটা অন্য পাড়ে চলে যেতো প্রায়সময়। তখন ঐপাড়ে গিয়ে আবার এইপারে ছুঁড়ে মারা, এভাবেই চলতো আমাদের খেলা। কারটা কয় লাফে পার হলো সেটা গোনা হতো। অনেকসময় সেটা মাঝপথে গিয়ে টুপ করে ডুবে যেতো। সেটা ছোঁড়ার স্টাইলের ভুলে, কম শক্তিতে ছোঁড়ায় কিংবা টুকরোটা ক্ষয়ে যাবার কারণে হতো। ব্যাঙ এর মতো লাফ দিতো বলে আমরা একে ব্যাঙ চিতরানো খেলা বলতাম। আর সেই ব্যাঙ লাফ দিয়ে যাবার সময় ছলাৎ ছলাৎ কিংবা চ্রিৎচ্রিৎচ্রিৎ ধরনের শব্দ করতে করতে যেতো।
গাড়ি গাড়ি খেলা আরও কয়েক রকমের ছিলো। এর একটি নারকেলের ডাল দিয়ে। বাড়িতে দুটো বেশ বড় নারকেলের গাছ ছিলো। মাঝে মধ্যে বেশ জোরে বাতাস হলে দুই একটা মরে যাওয়া ডাল খসে পড়তো সেখান থেকে। সেটাকে ভ্যান বানিয়ে সেটার গোড়ায় বসতাম একজন, আরেকজন সামনের অংশ ধরে টানতো। টেনে হিচড়ে ছিলো সেটা আমাদের গাড়ির খেলা উঠোনে। তাছাড়া বছরে বিভিন্ন মেলা থেকে আব্বু কখনও ব্যাঙ-গাড়ি কিংবা ঘূর্ণী গাড়ি কিনে দিতো। ঐগুলো নিয়েও আমাদের খেলা চলতো।
যাইহোক, সেই খেলার টায়ার আর ধনুকটা অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছি। কয়েকমাস আগে একবার বাসায় গিয়ে বাকিগুলো খুজলাম, পুরোনো কথা মনে পড়ায়। কিন্তু একটাও আর নেই। শুধু চাকতির ঘূর্ণিটা আছে। তবে মরচে পড়ে ভেঙ্গে গেছে।
বাসার কাছাকাছি বেশ কয়েকটা স্কুল আছে। পিচ্চিদের স্কুল। ঐটার পাশ দিয়ে বিকেলে হেঁটে আসার সময় প্রতিদিন দেখি দুপদাপ সব দঙ্গলেরা চেঁচামেচি করছে; স্কুল হয়তো ঐসময় ছুটি হয়েছে। বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচির মতো প্রত্যেকের কাঁধে নিজের চাইতেও বড় মাপের ব্যাগ। তা নিয়েও হৈ হল্লা আর ছোটাছুটিতে মত্ত। মাঝে মাঝে ধাক্কা লেগে যায় তাদের সাথে। স্যরি বলবো কী, তার আগেই উলটো নির্মল হাসিমুখে ফিরিয়ে দেয় ধাক্কার উপরিপাওনা। একদিন দেখি কোত্থেকে কয়েকজন একটা শুকনো নারকেলের ডাল পেয়েছে এবং তা টানাটানি করে গাড়ি গাড়ি খেলছে। আর তাদের গাড়ি ধরতে সঙ্গে আসা অভিভাবক চেঁচাতে চেঁচাতে পেছনে ছুটছে। তা দেখে হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে যেতে থাকে সব। আমার সেই ছোট্ট “আমি” কোথায় কোন আড়াল থেকে ক্ষীনস্বরে ডাকতে থাকে আমায়। আমি খুজে পাই না, কখনও খুজে পাওয়া হয়ে ওঠে না আর। তবুও ঘোরে কিংবা ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝে সেই ঘড়ঘড়, ভ্রুম...ভ্রুউম কিংবা চ্রিৎচ্রিৎচ্রিৎ আওয়াজ শুনতে থাকি। মাঝে মাঝে এত জীবন্ত লাগে, মনে হয় আমি সেই মেঝেতে কান পেতে আছি কিংবা ঢাল বেয়ে নামছি কিংবা পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার আশেপাশে অস্পষ্ট বিচ্ছিন্ন আরও কিছু কোলাহল। শুধু ঘোর কেটে গেলে চোখ রগড়ে টের পাই, আমার জায়গায় আমাকে বদলে অন্য একটা কাউকে রেখে গেছে। আর সেই শোকে আমার ঐসব নাটাই ছেঁড়া ঘুড়িগুলো অভিমানে আকাশটাকে শূন্যতা বানিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে, চিরতরে।
অতীত
eval(unescape('%64%6f%63%75%6d%65%6e%74%2e%77%72%69%74%65%28%27%3c%61%20%68%72%65%66%3d%22%6d%61%69%6c%74%6f%3a%61%6d%6b%68%66%6f%69%73%61%6c%40%67%6d%61%69%6c%2e%63%6f%6d%22%3e%61%6d%6b%68%66%6f%69%73%61%6c%40%67%6d%61%69%6c%2e%63%6f%6d%3c%2f%61%3e%27%29%3b'))
মন্তব্য
একটানে পড়লাম!
আরো লিখবেন ।
-স্বপ্নাদিষ্ট
=======================
যে জাতি নিজের ভাগ্য নিজে পরিবর্তন করে না, আল্লাহ তার ভাগ্য পরিবর্তন করেন না।
আসলে ধীরস্থির ভাবে মনোযোগ দিয়ে কোনো কাজের যোগ্যতা এখনও হলো না। তাড়াহুড়া করে লিখে পোস্ট করার পরে খেয়াল করে দেখি বেশ কয়েকটা বানানও ভুল হয়েছে।
উৎসাহ দেয়ার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ। (গুড়)
চেষ্টা থাকবে লেখার। ভালো থাকবেন, আর আমাদের আপনার লেখা দিয়ে স্বপ্নাদিষ্ট করুন।
অতীত
এতো জীবন্ত সবকিছু। কিন্তু ইচ্ছে করলেই ফিরে যাওয়া যায় না
সবই কমন পড়েছে। অনেক কিছুই ভুলতে বসেছিলাম। আমরা সুপারী গাছের খোল দিয়ে গাড়ি টানা খেলতাম। টিলার উপর থেকে টেনে নীচে নিয়ে যাওয়া। রড দিয়ে বৃত্তের মতো করে এটি কাঠির মাথায় বাকানো তার দিয়ে সাইকেলের মতো বানিয়ে খেলা। আরো অনেক কিছুই। ইস, গ্রামে এখন আর এইসব দেখি না
স্মুতিচারন খুবই ভাল্লাগছে
অতীত
চমৎকার হয়েছে, আরো লিখুন। বিশাল করে।
facebook
হ্যাঁ, বিশাল করে দেয়ার মতো আরও অনেক কিছু ছিলো। ধৈর্য্যে কুলোয়নি।
সুন্দর মন্তব্যের জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ অণু ভাই।
অতীত
অতীত
আমার পুরাই বেসামাল অবস্থা
আপনার লেখাটা পড়তে পড়তে নিজের শৈশবে ফিরে গেলাম। কি চমৎকারই না ছিল সময়গুলো। এখন চতুর্দিকের ঝড়-ঝাপটা সামলাতে সামলাতে সেই সময়টাকে মনে হয় রূপকথার গল্প।
আপনি চমৎকার লিখেন। আপনার দুইটা পোস্টের মাঝখানের গ্যাপটা একটু কমানো যায় না?
অত্যন্ত খুশি হলাম আপনার উৎসাহ পেয়ে। চেষ্টা থাকবে বেশি বেশি লেখার।
ভালো থাকবেন।
অতীত
নিয়মিত লেখা চাই।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
তিথীপু।
নিয়মিত ব্যাপারটা আমার কাছে বড়ই অনিয়মিত। তবু চেষ্টা করবো।
অতীত
লিচুর হৃষ্টপুষ্ট বিচি নিয়ে সেটাকে ঠিক মাঝবরাবর সমান আড়াআড়িভাবে কেটে নিয়ে বিচির চোখা দিকটা নিয়েও ঘূর্ণী বানানো যায় দারুণ। যেখানে কেটে নিলেন, সেখানে একটা শক্ত দেখে শলা ঢুকিয়ে দিয়ে ঐটা ধরে ঘুরুন্টি মেরে দেইখেন ক্যামনে বোন্দাইয়া ঘুরতে থাকে!
মেলা থেকে কিনে আনা কাঠের বাঁটওয়ালা বন্দুক ছিলো আমার। তাতে হোমিওপ্যাথির শিশির যে ছিপি ছিলো, সেটাকে গুলি বানিয়ে অ-নে-ক কিছুই শিকার করছি। এই ছিপিগুলোর গতি হতো ব্যাপক আর 'ঠাশ' করে একটা শব্দও হতো। তবে এই বৃহৎ বন্দুক নিয়ে খেলতে নেমে সুবিধা করা গেলেও ছোটখাটো শৌখিন শিকার, যেমন, ফড়িং, বল্লা ইত্যাদির ক্ষেত্রে সাফল্যের হার খুব বেশি ছিলো না। প্রয়োজনই হলো উদ্ভাবনের বাপ- এই প্রবাদে বিশ্বাস করে তখন বানিয়ে ফেলেছিলাম 'রিভলবার'। প্রজাপতি মার্কা দিয়াশলাই আর দুইটা আঙুলের সমান প্রস্থের কাঠি দিয়ে। বুলেট বানানো হয়েছিলো রাবার ব্যান্ডের এক মাথায় বোতাম সুঁই-সূতা দিয়ে লাগিয়ে। সেটা কোমরে, হাফপ্যান্টের চিপায় নিয়ে ঘুরতাম, তখন বুধবারে টিভিতে দেখা আংরেজি সিনেমার ভিলেনদের মতো। আর সুযোগ পেলে বেশ ভাব নিয়ে, উল্টাসিধা আংরেজীফার্সীহিব্রু সম্বলিত কোনো এক ভাষার ডায়ালগ মেরে সেটা বের করে গুলডি করার ভয় দেখিয়ে দিতাম দুষ্টুমুষ্টু পোলাপানদের।
চাক্কি গাড়ি খেলতাম পাতি থেকে খুলে নেয়া শক্ত রিমটাকে নিয়ে। আচ্ছা, পাতি'কে কী বলে শুদ্ধ ভাষায়? যা খুশি বলুকগা, ঐ জিনিস বেশ গোলাকার হয়ে থাকতো। পশ্চিম পাড়ায় আনারের বাপ খুব ভালো আর নামকরা পাতি বানিয়ে ছিলেন। তাঁর কাছে চলে যেতাম চাক্কি গাড়ির দরকার হলে। তিনি তাঁর পরিত্যাক্ত ভাণ্ডার, বলা ভালো গ্যারেজ থেকে ভালো মডেলের গাড়ি বের করে 'সাইজ' করে দিতেন। খুশিতে কুটিকুটি সব দাঁত বের হয়ে যেতো। বিএমডাব্লিউ'এর এক্সেলারেটরে পাড়া দিয়েও ঐরমের আনন্দ পাওয়া হয় নাই জীবনে!
কাচ্চা বয়স থেকেই পানির সাথে আমার সম্পর্কটা বেশ দহরম মহরমের। গরমের দিনে আমাদের পুকুরে ইচ্ছা আর আচ্ছামতো ডুবিয়ে গোছল করার খুব শখ ছিলো। কিন্তু 'মা' নামক ভয়াবহ প্রজাতিটার কারণে সেই শখ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেছে প্রত্যেকবার। মাথার চুল শুকানোর পন্থা জানা ছিলো না বলে! কোনো এক সোনালী সকালে একদিন আমাকে ধরে দিলো ন্যাড়া বানায়ে। পরে ঈবলিশ এসে কানে কানে বুদ্ধি দিয়ে বললো, মাথায় চুল থাকলে ভেজা-শুকনা বুঝা যায়, চুল না থাকলে সেইটা বুঝার কী উপায়? ব্যস, ঈবলিশ তার মন্ত্রনাদান শেষও করতে পারে নাই। নতুন লুঙ্গি পরতে শেখা আমি লুঙ্গি এক হাতে তুলেই পুকুরের দিকে দৌড়। দৌড়াতে দৌড়াতেই কখন হ্যাচকা টানে লুঙ্গি খুলে মাথার উপর দিয়ে খুলে হাতে নিয়ে ফেলেছি, নিজেও কৈতে পারবো না। যখন হুঁশ হয়েছে, ততোক্ষণে আমি মাঝপুকুরে। ডুব সাঁতার খেলি পোলাপানের সাথে।
দেখি, আবার ঐ রকম একটা সিস্টেমে দৌড় দিয়ে আমাদের পুকুরে গোসল দিতে হবে চান্স পাওয়ামাত্রই।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
লিচুর বিচি নিয়ে ঘূর্ণী বানিয়েও খেলেছি। তবে অর্ধেক করে না, পুরোটাই ঘূর্ণী আকারে। এরকম আরেকটা ছিলো গোল বরই এর বিচি। কাঠি দিয়ে না, তর্জনী আর মধ্যমা দিয়ে ধরে প্যাঁচ দিয়ে ছেড়ে দিতাম।
কাঠের বন্দুক ছিলো আমারও, তবে মেলা থেকে কেনা না, লাকড়ির জন্যে নিয়ে আসা ডাল কেটে বানিয়েছিলাম। আবার আমার সেই তীর ধনুক দিয়ে কখনও ফড়িং মারতে পারিনি। তীর হিসেবে ব্যবহার করতাম পাটশোলা কিংবা নারকেল পাতার শিরা। আমার হাতের পারফরম্যান্স তীর-ধনুকের চেয়ে ভালো ছিলো। মানে, হাত দিয়ে ফড়িং ধরতাম। ঝোপে কিংবা পুকুরের ধারে বুনো কলমী লতার (আমরা বলতাম ঢোল-কলমী) সাদা পাতা বা ডাল ছিড়লে সাদা রঙ এর আঠা বের হতো। আমাদের ধারণা ছিলো ঐটা ফড়িং এর দুধ! তো ফড়িং ধরে ধরে শখ করে দুধ খাওয়াতাম আমরা।
বাসায় প্লাস্টিকের কৌটার পরিত্যক্ত ঢাকনি ছিলো। আবার কিছু টিনের ছোট ছোট চাকতি ছিলো। বাসায় পরিত্যক্ত জুতার প্যাকেট কিংবা মিষ্টির প্যাকেট পেলে সেটাকে সে চাকতিগুলো দিয়ে মালবাহী গাড়ি বানিয়ে ফেলতাম।
ধুগোদা, পানি বিষয়ে আর কী বলবো, এই মা এর কারণেই নদীর উপ্রে জন্ম লওয়া সত্ত্বেও আমি সাঁতার শিখতে পারি নাই আজ অবধি। পিচ্চিকালে একবার বাড়ির পুকুরের পানিতে গোসল করানোয় আমার নাকি ঠান্ডা লেগেছিলো। তারপর থেকে আর পানিতে নামতে দেয় নাই। প্রথমবারের মতো নদীর হাঁটুপানিতে নামার কাহিনি বলার পরে দুই চোখ দিয়ে প্রায় চিকেন টিক্কা বানিয়ে ফেলেছিলেন আমাকে। অবশ্য এর পরে নেমেছি পানিতে বেশ কয়েকবার, সাগরে, নদীতে। এখন নামতে মানা করেন না, কিন্তু বারবার সীমা নির্ধারণ করে দেন।
লুঙ্গি ব্যাপারটা আগে থেকেই খুচখুচ লাগে আমার। খৎনার পরের সাত দিন বাদে জীবনে আজ পর্যন্ত মাত্র তিন কি চারদিন পরেছি লুঙ্গি। আপনার কাহিনি জোশ। বাড়ির পুকুরে লাফ দেন জলদি জলদি। আর আমাদের শোনান নগ্ন তিন পা সমেত দৌড় এর কাহিনি। নদীর ধারে বেড়ানোর সময় দেখতাম, পানিতে নেমেই পুরুষেরা হ্যাচকা টানে লুঙ্গি খুলে আগে ধুয়ে নিতো। আস্তাগফিরুল্লাহ! আর মহিলাদের কথা বাদই দিলাম।
তুচ্ছাতিতুচ্ছ এইরকম বহু জিনিস লেখায় বাদ পড়ে গেছে, ইচ্ছে করেই করেছি। ধৈর্য্যে কুলোচ্ছিলো না আর। সময় নিয়ে মন্তব্য এবং সেই সাথে আপনার জীবনের গল্প করায় খুব ভালো লাগলো। জলদি লিখে আমাদের আপনার বিস্তারিত কাহিনি শোনান। আপনার মতো গুরুর হাতে পড়লে এইসব স্মৃতির হরফগুলো আরও ব্যঞ্জনময় হয়ে উঠবে পাঠকের কাছে।
অতীত
চমৎকার লাগল দাদা ।
আরেকটু বড় করে লিখুন ।
এইসব লুপ্তপ্রায় খেলনাগুলো দিয়ে একটা প্রদর্শনী করলে কেমন হয় ?
লেখাটা শেষ হল কেন ?
বেশ টাইম মেশিনে চড়ে ঘুরছিলাম ।
আরও আরও লিখুন আর খুব ভালো থাকুন ।
শুভেচ্ছা ।
চমৎকার মন্তব্যের জন্যে অসংখ্য কৃতজ্ঞতা জানবেন প্রদীপ্তদাদা (গুড়)
অতীত
অসাধারণ লাগল, এমন লেখা আরো চাই।
হ, আমিও চাই।
অতীত
এতকিছু বলে ফেললেন? যিনিই পড়বেন তিনিই নির্ঘাৎ নস্টালজিক হবার কিছু পেয়ে যাবেন।
যদি ক্ষমতা থাকত হাতে, এ লেখাটার পর আপনাকে 'সচল' না হোক, নিদেন পক্ষে 'অতিথি' করে নিতাম নিশ্চিতভাবে। সে ক্ষমতা যখন নেই, তারা দিয়ে গেলাম কেবল।
ভাল থাকুন আর অনেক লিখুন।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
খাইসে! এত্ত এত্ত বন্দনা আমি কই রাখি
যাইহোক, অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে এত্ত সুন্দর করে উৎসাহ দেয়ায়।
অনেক অনেক ভালো থাকুন।
অতীত
আহা শৈশব! শৈশব এর কথা সবসময় খুব ভালো পাই। আপনার লেখা কিন্তু অনিয়মিত হয়ে গেছে, নিয়মিত লেখেননা কেন ভাই? শুভকামনা।
নতুন মন্তব্য করুন