আমি কখনও পাহাড় দেখিনি, ঝরণা দেখিনি। শিখিনি কুলকুল বয়ে যাওয়া নদীতে অবগাহন করতে। দেখিনি তালগাছে বাবুই পাখির বাসা।ইট কাঠ পাথরের এই যান্ত্রিকতায় মোড়া আমি।মাঝে মাঝে রাতের বেলা ঘুম ভেঙ্গে যায়। টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালাই তখন। আমার টেবিল ল্যাম্পটা থেকে ঝি ঝি পোকার মত একটা শব্দ বের হয়।আর ফ্যানটা ঘুরতে থাকে। কটর কটর কটর ফ্যান ঘোরার শব্দ হয়।সিগারেটের সাদা ধোয়ার আড়ালে নিজেকে ঢাকার একটা ব্যর্থ চেষ্টা চালাই তখন। আর চেখভের দ্য বেট গল্পের নায়কের মত ভাবি, এক সময় মরে যাওয়াই যদি জীবনের অলংঘনীয় পরিনতি হয় তাহলে জীবনটা কি একেবারেই অর্থহীন না!
আমার বন্ধু বান্ধবেরা এই কথা শুনলে বলবে, ‘শালার ব্যাটা!সারাদিন তো কাটাস কেম্নে আরেকজনের পিছনে আঙ্গুল দিবি এই চিন্তা কইরা! এখন আসসছ জীবনের মানে খুজতে!’ তাদের কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা এই দাবী করব না।কিন্তু তবুও মাঝে মাঝে কিছু অর্থহীন চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতেই থাকে।
তাই রাতের বেলা বন্ধুদের সাথে হাটার সময় অনেক চিন্তা ভাবনা চলে মাথায়। আমি বিশ্বাসী নই আবার অবিশ্বাসীও নই। যখন বিশ্বাস করতে যাই আমার স্বাধীণ চিন্তাভাবনা আমাকে চোখ রাঙ্গায়, আবার অবিশ্বাসী হতে গেলে আমার ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতা আমাকে ভ্রু কুচকায়। আমি তাই হেলেদুলে চলি। যখন কেউ অবিশ্বাসের কাহিনী বলে তাকে বিশ্বাসের গল্প শোনাই, যখন কেউ বিশ্বাসের কাহিনী বলে তাকে যুক্তি দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেই।আমার এক বন্ধু নিজেকে রিলিজিয়াস এথিস্ট বলতে ভালবাসে।আমার মনে হয় ইয়েস্তেন গার্ডারের কথা মত যারা আমরা বেচে আছি তারা হয়তবা লটারীতে জিতে যাওয়া টিকেট।রাতের বেলা এস.এম হল বা জগন্নাথ হলের সামনে দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় অনেক কথাই মনে হয় আশে পাশের বয়স্ক গাছ গুলোকে দেখে। এরাই হয়ত সেই নীরব দর্শক যার নিচ দিয়ে আমার বাবা এক দিন হেটে গিয়েছিলেন। জীবনের পর জীবন চলে যাচ্ছে এদের সামনে দিয়ে।এরাও কি আমাদের কান্ড কারখানা দেখে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে? মাঝে মাঝে হল গুলোর সামনে দিয়ে হাটার সময় চোখ বন্ধ করলে যেন টের পাই মার্চের সেই রাতের কথা। জগন্নাথ হলের রুমে রুমে দরজায় লাথি পড়ছে, রুমের ভেতরেই ব্রাশ ফায়ার করে মারা হচ্ছে তাদের। দেয়ালে লেগে আছে রক্তের ছোপ।এরা লটারীতে হেরে যাওয়া টিকেট এটা বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হয় তখন।
রাতের আড্ডায় ইদানিং চাকরী বাকরী পাওয়া নিয়ে বেশ আলোচনা চলে। মাঝে মাঝেই মনে হয় ছাত্র জীবনটাতো মোটেই খারাপ না বরং এর চেয়ে মজার লাইফ আর হয় না। আবার এর পরই চিন্তায় আসে আমার স্টুডেন্ট যাকে আমি এইচ.এস.সি দুই বছর পড়িয়েছি, এডমিশনের সময় পড়িয়েছি সে এখন থার্ড ইয়ারে পড়ছে। মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করে তখন। শেষ পর্যন্ত মোপাসার গল্পের নায়কদের মত হাল ছেড়ে দেয়ার চিন্তাও মাথায় আসে।
এরপর বাধ্য হয়ে চিন্তার ধারা পাল্টাই, শৈশবে কৈশোরের মজার ঘটনাগুলো চিন্তা করতে শুরু করি।ছোট থাকতে প্রতি টার্মেই ড্র্য়িং পরীক্ষার আগে আমার রঙ পেন্সিল বক্স কেনা লাগত। পরীক্ষার পরে এগুলা নিয়ে চলত গবেষনা, পানিতে গুলালে রঙ কেমন হয় কিংবা পিপড়া মারার ওষুধ হিসেবে রঙ কতটা কার্যকরী। যথারীতি পরীক্ষার আগের রাতে আব্বুর সাথে গেলাম রঙ পেন্সিল কিনতে। গিয়েই দেখলাম অগ্নিপুত্র অভয়ের নতুন একটা কমিক্স। আব্বুকে অনেকবার বলার পরও আব্বু কিনে দিল না, বলল কালকের পরীক্ষাটা শেষ হোক। দিল না তো দিলই না!শত অনুরোধেও লাভ হল না।রঙপেন্সিল নিয়ে বাসায় এসে প্রচন্ড মন খারাপ, চোখে পানি টলটল করছে, আর মাথা নিচু করে ছবি আকছি। আব্বু দেখলাম এশার নামাজ পড়তে বেরিয়ে গেল।কিছু বলতেও পারছিনা কাউকে। নামাজ থেকে আসার পরও আমি আব্বুর সাথে কথা বলছিনা।মেজাজ খুব খারাপ।তখন দেখলাম আব্বু টেবিলে দুইটা কমিক্স রাখল, একটা অগ্নিপুত্র অভয়ের আরেকটা বিল্লুর!আর বলল, “আজকে রাখ ড্রয়িং, আয় বাপ ব্যাটা একত্রে কমিক্স পড়ি”।
আরেকটা ঘটনার কথা এখন হঠাৎ করেই মনে পড়ছে, এ লেখার সাথে ঘটনাটা যায় না। তবুও বলেই ফেলি। আমি তখন ক্লাস নাইন বা টেনে পড়ি প্রতিদিন সকালে ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি পড়তে যেতাম স্যারের কাছে।সাথে আরো দুই বন্ধু ছিল, এদের মধ্যে একজনের বাসা আবার স্যারের বাসায় যাওয়ার পথেই পড়ত। আমি পায়ই যাওয়ার পথে তাকে ডেকে নিয়ে যেতাম, সে সবসময় রেডিই থাকত, ডাক দেয়ার সাথে সাথে দোতালা থেকে দৌড়ে নেমে আসত।একদিন এরকম ডাক দিলাম, কোন সাড়াশব্দ নেই, বেশ কিছুক্ষণ পরে জানালার পাশে তার মাথা দেখা গেল, আর সে প্রায় ফিসফিস করে বলল একটু দাড়া। আমি ধৈর্য ধরে আরও প্রায় ১০ মিনিট দাড়ানোর পর সে নিচে নেমে এল।ব্যাপারটা কী? এত দেরি হল কেন? সে যা বলল তা অনেকটা এরকম।ঘুম থেকে উঠার পর সে খেয়াল করল সে নাঙ্গুবাবা, পরনের লুঙ্গিটা নেই।ব্যাপারনা, সবারই মাঝে মাঝে এরকম হয় আর লুঙ্গিটা নরমালি গলায় চলে আসে, দেখেতে অনেকটা মালার মত দেখায়, আমার নিজেরো এটা হয়েছে অনেকসময়। কিন্তু সে অস্বস্তি বোধ করা শুরু করল যখন সে দেখল গলায়ও লুঙ্গিটা নেই। তারপর তাড়াতাড়ি কাথা গায়ে দিয়ে আগে লুঙ্গি খোজ়া শুরু করল, কিন্তু সমস্ত বিছানায় নাকি লুঙ্গির চিহ্ন নেই, এরপর খোজ় খোজ় খাটের তলায়, সেখানেও নেই।অস্বস্তিটা আতংকে পরিনত হচ্ছে, এমন সময় সে দেখল তাদের বাসায় কাজের বুয়া লুঙ্গিটা বালতিতে করে বাথরুমে ধুতে নিয়ে যাচ্ছে। সম্ভবতঃ ঘুমের মধ্যেই লুঙ্গিটা তার দেহ ত্যাগ করে খাট থেকে নিচে নেমে গিয়েছিল, আর বুয়া সেটা দেখে নোংরা ভেবে ধুতে নিয়ে গেছে, সেজন্যই তার এই অনাকাংক্ষিত দেরি।
কলেজ লাইফের মজার ঘটনার শেষ নেই।রাশেদা ম্যাডামের ক্লাসে শিষ দেয়া থেকে শুরু করে ইউনুস স্যারের ক্লাস থেকে বের করে দেয়ার পর রাগে দূঃখে জীবনের প্রথম পুল খেলতে যাওয়া সবই ধীরে ধীরে মনে পড়ে। কলেজ লাইফে আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু যে ছেলেটা ছিল সে ছিল আমার ছোটকাল থেকেই বন্ধু এবং আমার কলেজ জীবনের রুমমেট। আমার মতে আমাদের দেশের পাচজন ভালো ছেলের তালিকা করা হলে সে এরমধ্যে থাকবেই। এবং এরজন্যে তাকে যথেষ্ট যন্ত্রনা সহ্য করতে হয়েছে। আমাদের বাজার করা থেকে শুরু করে রাতে মশারি টাঙ্গানো সবই ও করত। যাই হোক, একদিন আমি হঠাৎ লক্ষ্য করলাম সে গোপনে গোপনে কি যেন লেখে। সে রুম থেকে বের হওয়ার পর শুরু হল ইনভেস্টিগেশন। খুজে পেলাম তার ডায়রী। সে নতুন ডায়রী লেখা শুরু করেছে। আপনারা হয়ত একমত হবেননা, কিন্তু আমি কেন যেন অন্যের ডায়রী বা পিসি ব্রাউজ় করে কেমন যেন একটা পৈশাচিক আনন্দ পাই। তাই যদিও নিজেকে বেশ কয়েকবার বোঝানোর চেষ্টা করলাম অন্যের প্রাইভেসী নষ্ট করা ঠিক না, তারপরে আবার মনে হল ‘গুষ্টি কিলাই তোর প্রাইভেসীর’।ডুব দিলাম নিষিদ্ধ আনন্দে।সেই নিষিদ্ধ আনন্দ না হয় নাই বা শেয়ার করলাম!
আর বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে আমি সবচেয়ে বড় যে জিনিসটা পেয়েছি তা হচ্ছে বন্ধু। আমি যে বিষয়ে পড়ি এর ওপর আমার বিন্দু মাত্র আগ্রহ নেই, কিন্তু তারপরো আমি যে টিকে আছি তা শুধুমাত্রই হয়ত আমার বন্ধুরূপী এই সাক্ষাত শয়তানগুলার কারনে।আর সে কি রাতের আড্ডা! ব্রাড পিট, স্কার্লেট জ়োহান্সন থেকে শুরু করে ডারউইনিজিম, ফ্রেডরিখ নিৎজের ফিলসফি কিছুই বাদ যায় না সে আড্ডায়। আর এই শয়তান গুলার ক্যারেকটারও দেখার মত। একটা কথা বলে যে শান্তিতে থাকবেন এর কোন উপায় নেই, কোন না কোন ভাবে আপনাকে খাল পার করে পাঠিয়ে দিবে উগান্ডা।আবার উগান্ডা পৌছার পর দেখবেন যাওয়ার ভাড়াটাও আপনারই দিতে হচ্ছে।
প্রতি সপ্তাহের ক্লাস শেষে হল থেকে যখন বাসায় যাই, আম্মু এসে বলে ভাত খাবি? আমি বলি, মাংস থাকলে খাব নয়ত খাব না। আম্মু হেসে বলে আজকে শুধু আলুর ভর্তা আর ডিম ভাজি। আর কিছুক্ষন পর ফ্রীজ থেকে মাংস নিয়ে গরম করে ভাত নিয়ে আসে। আব্বু এসে, কি বুদ্ধিজীবী সাহেব, এখন আর বুঝি নামাজ টামাজ় পড়া লাগে না? ছোট ভাইয়ের সাথে ডোরেমন দেখতে বসি। ছোট বোন ঘুম থেকে উঠেই শুরু করে তার গল্প, ভাইয়া জান আজকে না ক্লাসে…,আজকে এই ম্যাডাম…।আমি গল্প শুনি আর হাসি।
বাবা, মা, ভাই, বোন, বন্ধুবান্ধব আর পরিচিত মুখগুলোর কথা যখন মনে পড়ে তখন সমস্ত বিতৃষ্ণা ধুয়ে মুছে যায়।আর তারাশংকরের কবি নিতাই এর মত বলতে ইচ্ছে করে, জীবনটা এত ছোট কেনে?
কোয়াসিমোডো
মন্তব্য
আসলে জীবনটা এত ছোট কেন? ভাল লাগলো
ধন্যবাদ।
আরে, এই কাজ তো আমিও করি।
লেখা ভালো লাগলো। বেশ ভালো
-------------------------------------------------
ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
আমি তো শুধু ডোরেমনই না, টম এন্ড জেরী আর বেন টেন ও দেখি। ধন্যবাদ।
বেশ ভালো লাগলো।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
ধন্যবাদ।
লেগে ছিলাম শেষ পর্যন্ত। না, না তাচ্ছিল্য করে নয়। আপনার লেখনীর জোরেই লেগে ছিলাম আনন্দপাঠের অদম্য কৌতূহল নিয়ে।
অসংখ্য ধন্যবাদ।
প্রথম প্যারায় একটা গানের কথা মনেহলো, 'যৌবন এক গোল্লিপ সিকারেট!'
আপনেরে একটা কোবতে রিকমেন্ড করি, দেখেন, পড়েন এবং শোনেন। উপলব্ধিও করেন।
ফিজিক্সের ইউনুস স্যারের ঝারি আমিও অনেক খাইছি। ক্লাস থেকে তো বটেই, ল্যাব থেকেও বের করে দিছিলেন আমারে একাধিকবার। তাঁর চাপাবাজীতে খ্যাখ্যাখ্যা করে হেসে দিছিলাম বলে।
জীবনের অর্থ খোঁজার কী দরকাররে ভাই। আইছি ন্যাংটা যামু ন্যাংটা- এই মটো নিয়া চলতে শুরু করেন। দেখবেন পুরা দুইন্যা-ই ফকফকা।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
আইছি ন্যাংটা যামু ন্যাংটা।
ভালো বলছেন। ইউনুস স্যার যে কি পেইনটা দিসিল।একবার আমাদের গ্রুপের সবার কুইজের খাতা ছিড়ে ফেলসিল।
'চিন্তা-(এক আলিফ পরিমান টান হবে এইখানে) কত্তি পারো!'
বেঞ্চের শব্দে অতিষ্ঠ হয়ে স্যার একবার বলেছিলেন বেঞ্চের শব্দে নাকি স্যারের মস্তিষ্ক সাদা হয়ে যায়। আর যায় কৈ, পোলাপান তখন ইচ্ছা করেই বেঙ্চের শব্দ করতো, কিচির-চিচির-চ্যাওর... বিতিকিচ্ছিরি শব্দরে ভাই!
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
(গুড়)
facebook
ধন্যবাদ ভাইয়া।
এলোমেলো ভাবনাগুলো বেঁচে থাকুক আজীবন।
অতীত
ধন্যবাদ।
বাহ! মজারু লিখা তো।
বাই দ্য ওয়ে, কোয়াসিমোডো মানে কি? কোমাডো ড্রাগনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।
ধন্যবাদ। হাঞ্চব্যাক অফ নটরডেম থেকে নামটা ধার করা।এর মানে অসম্পূর্ন ভাবে গঠিত, হাফ ফর্মড।
ধন্যবাদ।
বেশ স্মৃতিজাগানীয়া লেখা।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
ধন্যবাদ।
তালগাছে বাবুই পাখির বাসা। ইদানিং আর খুব একটা দেখা যায়না।
দেখার খুব ইচ্ছে আমার।
ছুঁয়ে গেছে ভীষণ ভাবে। । লাইফ> জীবনঃ শব্দটাই যেন খুব ভারী।
নিয়মিত লিখুন।
ডাকঘর | ছবিঘর
অসংখ্য ধন্যবাদ।
তবে একখান কথা আছিল ।
কে কইছে জীবন শুধু ছোট ?
জীবন তো ছোট হইয়াও বড় তাই না দাদা ?
ভালো থাইকেন ।
আর আরও লেখেন ।
আপ্নারেও
নতুন মন্তব্য করুন