অসূয়া

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ২১/০২/২০১২ - ১০:০০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


সকাল থেকেই ঝর ঝর বৃষ্টি হচ্ছিল। এখন একটু কমেছে। উঠানের ওপাশে রান্নাঘরটা। মা ধোঁয়া উড়িয়েই যাচ্ছিলেন। একটা মোড়ায় বসেছিল রিফাত। পাশের উঠানটা একটু ঢালু। উঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তৃপ্তি। ওদের বারান্দায় বসে তন্ময়, টুলের উপর।

-এই মেয়ে ঘরে আয়।

তৃপ্তির মার ডাক শোনা যায় ওদের ঐপাশের রান্নাঘর থেকে। তৃপ্তি রান্নাঘরের দিকে একবার তাকিয়ে এর পর আবার ওদের উঠানের জমানো জলের মধ্যে পা দুটি ডুবিয়েই দাঁড়িয়ে থাকে। তৃপ্তির মার খুটখাট শব্দ পাওয়া যায় রান্না ঘরের ভিতর থেকে।

রিফাত তৃপ্তির প্রায় সমবয়সী। তন্ময় দু’বছরের ছোট হবে। রিফাতদের উঠানের মাটি কিছুটা বেলে, তবে দো-আঁশলা, প্রায় শক্ত। ওদের উঠানের জল গড়িয়ে যায় সব তৃপ্তিদের উঠানে। ওদের উঠানের মাটি এটেল, কিন্তু কনা বেশি।

রিফাতের মা রান্নাঘর থেকে উঁকি মেরে ছেলেকে দেখে নেন। রিফাত বুঝতে পারে। মোড়াতেই বসে থাকে। রান্নাঘরের পাশের গাছের ডালিমে প্রায় পাক ধরেছে। পলিথিন দিয়ে বাধা আছে। রিফাত তাকায় তৃপ্তির দিকে। ডালিম চাইতে আসুক এবার। মাকে বলে দিবে যাতে তৃপ্তিকে না দেয়। তন্ময়কে দেয়া যেতে পারে। দশ বছরের রিফাত বুঝতে পারে না তৃপ্তির মায়ের সাথে তার মায়ের তফাতটুকু। তৃপ্তি একটা বেহায়া। মায়ের কথা শোনেনা।

ফ্রক ছেড়ে কামিজ পড়তে শুরু করেছে সবে। ওকে দেখতে অনেক সুন্দর হয়েছে এখন। তন্ময়টা মোড়াতেই বসে আছে। কয়েকদিন থেকে ওর জ্বর। রিফাতের মায়া হলো তন্ময়ের জন্য।
তৃপ্তির মা বের হয়ে আসলেন রান্নাঘর থেকে। মেয়েকে টেনে হিঁচরে নিয়ে গেলেন ঘরের ভিতর।

-দুইটার এক সাথে সেবা করতে পারবো না।

রিফাত খুশি হয়। তৃপ্তি রান্নাঘরে ঢুকতে যাবার আগে একবার তাকায় রিফাতের দিকে। রিফাত চুপসে যায় আবার।

-মা ভাত দাও।
-আরেকটু বসো বাবা। এই তো হয়ে গেলো।

তন্ময়ের দিকে তাকায় রিফাত। তন্ময়ও এখন দুর্বল চোখে তাকিয়ে রিফাতের দিকে। বোনের রাগ তার চোখেও চলে এসেছে। রিফাত অবাক হয়। তৃপ্তি তো নিজের দোষেই বকা খেল। তৃপ্তির উপর রাগ চলে যায়। ক্ষুব্ধ হয় এবার জ্বরের রোগী তন্ময়ের উপর।

-তন্ময়ের শরীর কেমন?

রিফাতের মা জিজ্ঞেস করেন।

-এখন তো ভালো। শুয়ে থাকতে বললে তো শোনে না, বারান্দায় এসে বসেছে দেখেন। তৃপ্তি যা তো, তন্ময়ের শরীর টা ধরে দেখ জ্বর আছে কি না।
তৃপ্তি এসে তন্ময়ের কপালে হাত দিয়ে তাপমাত্রা পরীক্ষা করে। ভাইয়ের পাশে একটা টুল টেনে বসে পড়ে। বৃষ্টিটা একটু বেড়েছে এখন। ভাইবোন এখন আর তাকায় না রিফাতের দিকে। রিফাত ডাকেঃ

-মা, ভাত।
-আর পাঁচ মিনিট বাবা।


বিকেল হতেই বৃষ্টিটা থেমে যায়। রিফাত নামে উঠানে। এখন ওর মনটা অনেক ভালো। তৃপ্তিদের উঠান থেকে এখনো জল নামে নি। তৃপ্তি একটা স্যান্ডেল পায়ে আবার পানিতে পা ভিজিয়ে যাচ্ছে। ঘরের ভিতর থাকা তন্ময়কে দেখা যাচ্ছে না।

-এই রিফাত, খেলবি?
-কি?
-আয় লুডু খেলি।
-নাহ।
-আয় না, তন্ময়ের সাথে খেলি।

রিফাতের দয়া হল তন্ময়ের উপর। কিন্তু খেলায় হেরে গেলো। জিতলো তন্ময়। যদিও তৃপ্তির জেতার কথা। কিন্তু রিফাত দেখলো তৃপ্তি ছাড় দিচ্ছে তন্ময়কে। রাগ হলো রিফাতের। তন্ময়ের উপরেই। চড় মারতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু অসুস্থ তন্ময়ের উপর আবার দয়া হলো।

-রিফাত, ঘরে আসো বাবা, পা ধুয়ে পড়তে বসো।

মায়ের ডাকে এ দফা চলে এলো। ট্যুবুয়েলে পা ধুয়ে ঘরে এলো। পড়তে বসে রিফাত। সাধারণ বিজ্ঞান। স্কুলে রিফাত আর তৃপ্তি এক ক্লাশে, তন্ময় দুই ক্লাশ নিচে। এদের দুই ভাইবোনের রেজাল্ট ওর চেয়ে অনেক খারাপ। তবু ওদের মা ওদের বকে না। শুধ রেজাল্টের দিন রিফাতের রেজাল্ট দেখে তৃপ্তির মা রিফাতকে একটু আদর করে দেন।

খাবার পরে ঘুম পেলো রিফাতের। স্বপ্ন দেখছিলো একটা, বৃষ্টি অনেক। কোমর পর্যন্ত ভিজে যাচ্ছে, তৃপ্তির হাত ধরে আছে। ওর হাতে একটা ডালিম, তৃপ্তির হাতেও, ফেটে গিয়ে লাল দানা গুলি দেখা যাচ্ছে, তন্ময়! ঐ তো তন্ময়! কি করছে তন্ময়? এই তন্ময়! কই তন্ময়? তন্ময়!

জেগে বাবাকে তন্ময়ের বাবার সাথে কথা বলতে শোনে। ঘরের বাতি জ্বালানো। মাও জেগে গেছেন।

-কিছু হয় নি বাবা, তন্ময়ের জ্বরটা বেড়েছে। তুমি ঘুমাও।

মা এসে ছেলের পাশে শুয়ে পড়েন। আবার ঘুমিয়ে পড়ে রিফাত। সকালে উঠে দেখে বাবা ঘুমাচ্ছেন।

-বাবার অফিস নেই?
-যাবে। তন্ময় হাসপাতালে বাবা।
-কেন?
-ওর জ্বরটা অনেক বেড়ে গিয়েছিল রাতে।
-তৃপ্তি ও?
-না, তৃপ্তি তো ঘরেই আছে।

রিফাতের মনটা একটু খারাপ হয়। গতকালের স্বপ্নের কথা মনে পড়ে। তন্ময় সুস্থ হয়ে আসুক। ওর সাথে আর কখনো রাগ করবে না। তৃপ্তি বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। ভাইয়ের মোড়াটাতে বসে। মন খারাপ এটা বুঝতে পারে রিফাত। ওর মধ্যে একটু অপরাধবোধ তৈরী হয়।


সপ্তাহ খানেক পরের কথা। এই সাতদিনে আর বৃষ্টি হয় নি। তন্ময় এখনো হাসপাতাল থেকে ফিরেনি। তন্ময়ের বাবা রিফাতের বাবার সাথে প্রায়ই কথা বলতে আসেন। কিন্তু তৃপ্তি এর পর থেকে আর কথা বলে না রিফাতের সাথে। রিফাতের কি দোষ! রিফাতও রাগ করে। খেলতে যায় আজকে সম্পদের সাথে। তৃপ্তি যাবে না, এটা নিশ্চিত।

ওদের গাছের ডালিম প্রায় পেঁকে গেছে। তৃপ্তি চাইতেও আসে না। তন্ময়টা আসুক হাসপাতাল থেকে। তখন দেখা যাবে। সম্পদ আর সে মিলে মাছ ধরার পরিকল্পনা করে। সম্পদের অনেক বুদ্ধি। সে কোথা থেকে ময়দার নিয়ে আসে, টোপ দেয়ার জন্য। রিফাত কেঁচো হাতে ধরতে চায় না। এজন্য ময়দার গুলির ব্যবস্থা। ওরা প্রায় প্রস্তুত সবকিছু নিয়ে এমন সময় পল্লব ডাকে।

-এই রিফাত। বাড়ি যা। তন্ময়কে নিয়ে আসছে।

খুশি হয় রিফাত। কিন্তু পল্লবের চোখেমুখে প্রয়োজনের বেশি উত্তেজনা!

-রিফাত তুই জানিস না?
-চল রিফাত, গিয়ে দেখি।

সম্পদ হাত ধরে টানে। উঠানে যাবার আগেই রিফাত দেখে অনেক ভিড়। তন্ময়ের মা উঠানের উপর শয়ান। রিফাতের মা চেষ্টা করছেন সামলাতে। হঠাৎ পাটি পাতা হলো একটা। একটা বালিশ দেয়া হলো। তন্ময়কে ভিড় ঠেলে এনে শোয়ানো হলো। চোখদুটি বোঁজা। একটু নড়ে উঠলো তন্ময়। এর পর রিফাত দেখলো নাক দিয়ে স্রোতের মতন লাল রক্ত বের হয়ে আসছে। ডালিমের দানার মত অত লাল না। কেমন যেন ফ্যাকাশে। তৃপ্তিকে খুঁজে পেলো। ওর চোখে জল দেখতে পেলো। তৃপ্তি আর কোনো দিন কথা বলবে না রিফাতের সাথে। রিফাত কেমন ভয় পেয়ে গেল। সরে এল ভিড় থেকে।

মাছ ধরা আর হলো না আজকে। পুকুরের পাড় দিয়ে ঘুর ঘুর করলো। এর পর সম্পদের সাথে দেখা হলো। পল্লবও এসেছে, সাথে অমি আর নিরব। সবার আলোচনা তন্ময়কে নিয়ে। তন্ময় খুব ভালো ছিল। রিফাতের অপরাধ বোধটা বাড়তে থাকে।

রিফাত বুঝতে পারলো তন্ময় মারা গেছে। রাতে একটা দুঃস্বপ্ন দেখলো। মাকে নিয়ে। মা ওকে বুকে নিয়ে ঘুমালেন।

লেখকঃকুম্ভীলক


মন্তব্য

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

মন খারাপ করা লেখা। ইয়ে, মানে...

কাজি মামুন (অতিথি লেখক) এর ছবি

ভাল লেগেছে! লেখার মধ্যে সহজ-সাবলীল গতি আছে! শেষের শোকটাও ছুঁয়েছে।

ফ্রক ছেড়ে কামিজ পড়তে শুরু করেছে সবে। ওকে দেখতে অনেক সুন্দর হয়েছে এখন।

দশ বছরের রিফাতের এমন অনুভূতি বোধগম্য নয়।

মরুদ্যান এর ছবি

চলুক

তাপস শর্মা এর ছবি

ভালো লাগলো। চলুক

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

ভাল লাগল ।
আরও লিখুন ।

ইয়াকুব আলি চৌ এর ছবি

কী হল, কিছুই বুঝতি পারলাম না।

সুদীপ এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।