শ্রদ্ধাঞ্জলি

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৩/০২/২০১২ - ২:৩৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

‘তোমারে কইছিলাম চেয়ারম্যান সাবের নামটা ইয়া বড় বড় কইরা লেখতে, যাতে দুইমাইল দূর থেইকা মানুষ নামডা পড়তে পারে। এইগুলান কী লেখছো? পড়তে তো অণুবীক্ষণ যন্ত্র আনতে হইবো!’
চিৎকার করে কথা বলায় রমিজ উদ্দিনের মুখ থেকে দলা দলা থুতু ছিটকে পড়ছে সামনের লোকটির গায়ে। লোকটি নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছে বেকুবের মত।

রমিজ উদ্দিন চেয়ারম্যানের ডান হাত। চেয়ারম্যান সাহেব বলে দিয়েছেন ফুলের ডালাটি যেন অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয়। মাঝখানে চেয়ারম্যানের নামটি বড় বড় করে লেখা থাকতে হবে। আশে-পাশের দু-দশটি উপজেলায় যেন এই ফুলের ডালার সুনাম থাকে আগামী বছর পর্যন্ত। কিন্তু এই বেকুব ফুলের দোকানদারটি সব মাটি করে দিয়েছে। চেয়ারম্যান সাহেবের নামটি লিখেছে বিশ্রী রকমের ছোট করে। লোকটি মিনমিন করে বলার চেষ্টা করে, ‘ভাইজান, দেখেন এই ডালায় বড় কইরা নাম লেখতে গেলে তো ফুল লাগানোর জায়গা থাকতো না।’

রমিজ উদ্দিন খেঁকিয়ে ওঠে, ‘ফুল লাগানোর জায়গা থাকতো কিনা হেইডা তোরে কে দেখতে কইছে! মাইনষে কি ফুল দেখবো! দেখবো তো যে ফুল দিছে হের নামডা। ব্যাডা ব্যাক্কল, তুই একটা পয়সাও পাবি না।’

গরীব লোকটির কালো মুখটা আরো কালো হয়ে যায়। তাকে দেখে মনে হয় তাকে কেউ ছুঁয়ে দিলেই সে এখন কেঁদে ফেলবে। রমিজ উদ্দিনের সাগরেদরা ফুলের ডালা নিয়ে হাঁটতে শুরু করে।

‘ওস্তাদ ২০টা ট্যাকা দেন, এক প্যাকেট সিগ্রেট কিইন্যা টানতে টানতে যাই।’ সিরাজ মিয়ার কথাটা শুনে রমিজ উদ্দিন একটু অবাক হয়, ‘ এহন আবার কিয়ের ট্যাকা, তগো ট্যাকা দিয়া দিলাম না!’

‘আমাগো ট্যাকা তো পাইছি। তয় মনে করেন কিছু উপরি দিবেন না! ফুলের ট্যান্ডার মাইরা তো কিছু ইনকাম হইছে, এহন আবার দোকানদারের ট্যাকাও দিবেন না কইলেন। এই উপরি ইনকাম থেইকা আমাগোরে কিছু দেন।’ সিরাজ মিয়ার কথাটা শুনে রমিজ উদ্দিন এক মুহূর্ত কী যেন চিন্তা করে, তারপর পকেট থেকে ২০ টাকার একটি নোট বের করে দেয়। এখন ঝামেলা করে লাভ নেই। চেয়ারম্যান সাহেব এতক্ষণে চলে এসেছেন মনে হয়, রাত তো বারোটা বাজার কাছাকাছি।

শহীদ মিনারটাকে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। এতদিন ধরে এর বেদীটাতে যে ময়লা আবর্জনার স্তুপ জমেছিল সেগুলো একদম সাফ সুতরো করে ফেলা হয়েছে। সপ্তাহ খানেক আগেও যে এখানে এসেছিল, সে এখন আসলে জায়গাটাকে আর চিনতে পারবে না।

রাত বারোটা এক হওয়ার জন্য সবাই অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে। সবার মধ্যেই টান টান উত্তেজনা। চেয়ারম্যান সাহেব রমিজ উদ্দিনের কানে কানে বললেন, ‘শহীদ মিনারে তো জুতা নিয়া যাওন যাইবো না। তুই আমার জুতাগুলান দেখিস, বহুত দামী জুতা, সিঙ্গাপুর থেইকা আনছি।’

শহীদ মিনারে উঠলেই সাংবাদিকরা ছবি তুলবে। কালকে সেই ছবি পত্রিকায় ছাপা হবে। রমিজ উদ্দিন বেদীতে ওঠার লোভ সামলাতে পারে না। সে সিরাজ মিয়াকে ডেকে বলে, ‘তোর বেদীতে যাওনের দরকার নাই। তুই চেয়ারম্যান সাহেবের জুতাগুলান পাহারা দিবি। জুতা হারাইলে কিন্তু জানে মাইরা ফেলামু।’

বারোটা এক বাজার সাথে সাথে সমবেত জনতা মৃদু সুরে গেয়ে উঠলো শিহরণ জাগানো সেই বিখ্যাত গান, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি...।’ চেয়ারম্যান সাহেবও ফুলের ডালাটি দুই হাতে ধরে নগ্ন পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বেসুরো গলায় গাইতে থাকেন, ‘...আমি কি ভুলিতে পারি।’

যথাযোগ্য ভাবগাম্ভীর্যের মধ্যে দিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণের পর বেদী থেকে নেমে এল চেয়ারম্যানের দলটি। এরপর অপেক্ষমাণ অন্য একটি দল বেদীতে ফুল দেওয়ার জন্য গেল। তারা চেয়ারম্যানের ফুলের ডালাটি একটু একপাশে করে তাদের ডালাটি রাখতেই বজ্রকন্ঠে গর্জে উঠলো রমিজ উদ্দিন, ‘খবরদার আমাগো ডালা সরাবি না। আমাগোডা মইধ্যখানে থাকবো কইলাম।’

পুষ্পস্তবক প্রদানরত অপর দলটিও সমান গর্জনে জবাব দিল, ‘ক্যান শহীদ মিনার কি তোমাগো বাপের জমি পাইছো! এইডা সবার।’

পাল্টা জবাব শুনে রমিজ উদ্দিনের চোখ দিয়ে আগুন বেরোতে থাকে, ‘কী কইলি তুই, ধর হালারে ধর, ধর। আইজকা তোরে জিন্দা কবর দিয়া দিমু।’

মুহূর্তেই শুরু হয়ে গেল দৌড়াদৌড়ি, হাতাহাতি আর চরম বিশৃঙ্খলা। এই ভীষণ গোলযোগের মধ্যে কে যে কাকে ধরে মারছে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

একটু উপরেই বাতাসে ভেসে ছিলেন পাঁচজন মহান আত্মা। তাঁদের মধ্যে সালাম নামের একজন অপর একজনের কান্না থামানোর জন্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছিলেন, ‘বরকত ভাই, আপনি খুব আবেগী মানুষ, এইজন্য আপনাকে আনতে মানা করেছিলাম। এত নরম মনের একজন মানুষ কীভাবে যে পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছিলেন বুঝতে পারি না। আমরা তো ভাষাশহীদ, লোকে আমাদেরকে জানবে পাথরের মত কঠিন আর পাহাড়ের মত অবিচল।’ বলতে বলতে সালাম নামের ভাষাশহীদও কেঁদে দিলেন।

এই দুজনের কান্না থামাতে রফিক, জব্বার, শফিউর নামের আরো তিনজন এসে ঘিরে ধরলেন তাঁদের। ততোক্ষণে পুব আকাশে ভোরের সূর্যটা তার অস্তিত্ব জানান দিতে শুরু করেছে। আর সেই সূর্যের রক্তিম লাল আভায় ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগলেন পাঁচজন মহান আত্মা।

জুয়েল দেব


মন্তব্য

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা।
গল্প ভালো লাগল। সত্যিই যদি শহীদেরা আমাদের দেখতেন, তাহলে, আফসোস করতেন এই ভেবে এমন একটা জাতির ভবিষ্যতের জন্য তাঁরা তাঁদের বর্তমান বিসর্জন দিয়েছিলেন।

জুয়েল দেব এর ছবি

আমরা ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছি সভ্যতা থেকে।

গল্প পড়ার জন্য এবং মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।

শিশিরকণা এর ছবি

দেশে কি আসলেই কোন মানুষ নেই যে দেশকে অন্তর থেকে ভালোবাসে? "The world suffers more from the silence of good people" ভালো মানুষের চুপ করে থাকেন বলেই রমিজউদ্দীনঅদের গলার জোর বড্ড বেশি জোরে শোনা যায়।

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

জুয়েল দেব এর ছবি

আমার মনে হয় যারা দেশকে ভালোবাসে না, তাদের চেয়ে যারা দেশকে ভালোবাসে তাদের সংখ্যা অনেক বেশী। আপনাকে ধন্যবাদ।

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

খুব ভাল লাগল আপনার লেখা ।

রাজনীতির সর্বগ্রাসী মুখের সামনে কারও নিস্তার নেই ।
এত ছোটর মধ্যে এত সুন্দরভাবে একটা বিষয় তুলে ধরার জন্যে ধন্যবাদ ।

জুয়েল দেব এর ছবি

রাজনীতির সর্বগ্রাসী মুখের সামনে কারও নিস্তার নেই । ঠিক বলেছেন।

মরুদ্যান এর ছবি

ভাল লাগল।

জুয়েল দেব এর ছবি

ধন্যবাদ।

অতিথিঃ অতীত এর ছবি

এইরকম ক্রুর বাস্তবতা নিয়ে গল্প আর কদ্দিন লিখতে হবে মন খারাপ মন খারাপ মন খারাপ

অতীত

জুয়েল দেব এর ছবি

যেদিন লিখতে হবে না, সেদিন খুব বেশী দূরে না।

নিটোল এর ছবি

ভালো লাগল।

_________________
[খোমাখাতা]

জুয়েল দেব এর ছবি

ধন্যবাদ।

মাইনুল এইচ সিরাজী এর ছবি

ভালো লাগল। ধন্যবাদ জুয়েল দেব।

জুয়েল দেব এর ছবি

গল্প পড়েছেন দেখে খুব খুশী হলাম। ধন্যবাদ আপনাকে।

কুমার. এর ছবি

চমৎকার। আপনার নামটা পরিচিত লাগছে, কোথাও আপনার লেখা পড়েছি। প্রথমালুতে কি?

জুয়েল দেব এর ছবি

লেখা পড়ার জন্য ধন্যবাদ। আমি প্রথম আলো'র ছুটির দিনেতে মাঝে মাঝে লিখি।

guest_writer এর ছবি

চমৎকার। কিন্তু বেচারা চেয়ারম্যান। Bacteria Man

জুয়েল দেব এর ছবি

লেখা পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

মর্ম এর ছবি

দুঃখজনক হলেও সত্য, শহীদ মিনার দেখলে আর আর কিছুর সাথে এ ব্যাপারটাও মনে পড়ে!

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

জুয়েল দেব এর ছবি

এই ঘটনাটি প্রত্যেক বছর আমাদের দেশের কোথাও না কোথাও ঘটছে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।