গতকালের আগের দিন আমার ভার্সিটি গিয়েছিলাম, বেশ কদিন পরে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর আর যাওয়াই হয়নি। এখন আন্ডারগ্র্যাডদের ছুটি চলে, সবারই পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। তাই ক্যাম্পাসটা বেশ ফাঁকা। দুচারজন ছাত্র হেঁটে লাইব্রেরির দিকে যাচ্ছে, অল্প কজন ক্লাস থেকে বের হয়েছে, সব মিলে বেশ শান্ত-চুপচাপ এক ক্যাম্পাস। এর মধ্যেই ভার্সিটিতে ঢুকতে না ঢুকতেই বাচ্চাদের চিৎকার- চেঁচামেচি কানে ভেসে আসে। ঢোকার মুখেই দেখি, অনেক মা তাদের বাচ্চাদের হাত ধরে বের হচ্ছে, কেউ কেউ আবার সাইকেলের পেছনের সিটে বাচ্চাকে বসিয়ে নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে। আর বাচ্চাদের কথা? সে আর কি বলব। সব বিচিত্র ধরনের, কোনটা তিড়িংবিড়িং করে এদিক সেদিক ছুটছে, কোনটা সাইকেলের পেছনের সিটে বসেই এটা কি, ওটা কি, কেন-কি-কবে-কোথায় এসব মাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে ফেলছে অনবরত, আবার কারো মুখে হাসির বদলে কান্নার ছাপ, হয়ত বকা দিয়েছে মা কিছুটা তাই। এসব ফেলে যখন এগিয়ে গেলাম ভার্সিটির খোলা প্রান্তরটার দিকে, তখন মনে হল এতক্ষণ যা দেখছিলাম তা তো ট্রেইলার, আসল সিনেমা তো চলছে এখানে। রোদেলা দিনের দুপুর, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১১ ডিগ্রি ছিল সেদিন, তার আগের বেশ কদিনের থেকে অনেকটা বেশি। আরামদায়ক নরম রোদ চিকচিক করছে সবুজ ঘাসের উপর, তার মধ্যেই মাঠের এক অংশে ছায়া পড়তে শুরু করেছে। এখনও শীতকাল ফুরোয়নি, তাই বেলা বেশি বড় হয়ে ওঠে নি। সেই আলো ছায়ার মধ্যে বাচ্চারা কি করছে না? কোনটা আরেকটাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিচ্ছে, ঢালের ওপর দিয়ে গড়িয়ে গিয়ে সেই ধাক্কা খাওয়াটা হিহি করে হেসে অস্থির হয়ে যাচ্ছে, আবার চারপাঁচটা বাচ্চা মিলে ফুটবল ছোড়াছুড়ি করছে, পা দিয়ে আবার হাত দিয়েও, দড়িলাফ, অ্যাক্রব্যাট, সাইকেলে চেপে কারদানি দেখানো- কি নেই খেলাধুলার মধ্যে। উপরে মায়েরা গোল হয়ে গল্প জুড়ে দিয়েছে, বাচ্চাদের বকাঝকা করতে দেখলাম না, মনে হল যেমন খুশি তেমন করোর এক বিশাল মহোৎসব। যেগুলো বেশি ছোটো, সেগুলো একপা দুপা এগিয়ে ধপাস করে বসে পড়ছে, আবার বসে পড়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে কেউ দেখে ফেলল কিনা এমন ভঙ্গি করে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে প্রাণপণে, উঠে দাঁড়িয়ে একটা বিজয়ীর হাসি দিচ্ছে মায়ের দিকে তাকিয়ে। এক বিশাল প্রাণচাঞ্চল্যের মেলা। এমনিতে এই খোলা মাঠটা বেশ বড়, শুধু বসন্ত আর শরতেই না, বাদবাকি সময়েও আবহাওয়া একটু ভালো থাকলে প্রায়ই মায়েরা নিয়ে আসে বাচ্চাদের, বাবাদের দেখা যায় কদাচিৎ। যখন ক্লাস করতে যাই, মাঠের পাশ দিয়েই হেঁটে, তখন বাচ্চাদের কান্ডকারখানা খেয়াল করে দেখাই হয় না। হয়তো ঘুম ঘুম চোখে হেঁটে চলে যাই পাশ দিয়ে, হয়তো পরীক্ষা বা অ্যাসাইনমেন্টের চিন্তা মাথায় গিজগিজ করতে থাকে, হয়তো বা কিছুই না, এই অপূর্ব স্বর্গীয় দৃশ্য চোখে পড়ে না কারণ এ তো নিত্যদিনের ঘটনা। আর নিত্যদিনের ঘটনা কি আর আমাদের কাছে ততটা সমাদর পায়? সেদিন মনে হচ্ছিল, প্রানশক্তির এত বিপুল ভাণ্ডার নিয়ে নিজের মনে খেলে বেড়াচ্ছে যে শিশুটা, কে তাকাল কে খেয়াল করল কে না করল সেসবকে পাত্তাই দিচ্ছে না একদমই, এই স্বতঃস্ফূর্ততা, এই ক্ষুদ্রতম কারণে অসীম পরিমাণ আনন্দিত হওয়া, এই বাঁধভাঙা প্রাণের স্ফুরণ শিশুদের মধ্যে ছাড়া পাওয়া কঠিন। যত বড় হই, তত শত জটিলতা, চিন্তাভাবনা এসে ঘিরে ধরে আমাদের। এর কতটা সমাজ আরোপ করে, আর কতটা আমরা নিজেরাই ডেকে আনি। বড় হওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে নিজের শিশু সত্ত্বাকে লুকিয়ে রাখি প্রতিনিয়ত, কারো সামনে হঠাৎ বেরিয়ে না আসে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলি। এই করতে করতে আমরাও যে এককালে ওই ঢালু মাঠ বেয়ে গড়িয়ে নামতে থাকা শিশুটি ছিলাম, আমরাও একসময় পড়ে গিয়ে কেউ দেখল কিনা ইতিউতি তাকিয়ে দেখে আবার উঠে পড়তাম ব্যথার তোয়াক্কা না করেই, তাও ভুলে যাই। তারপরে এরকম ঝকঝকে রোদেলা এক দিনে, যখন তাপমাত্রা থাকে ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, তখন চোখের সামনে আত্মমগ্ন শিশুটিকে দেখে আমাদেরও আবার নির্ভাবনার সেই দিনগুলোতে ফিরে যেতে ইচ্ছা করে। সেদিন মাঠের একধারে পেতে রাখা বেঞ্চের ওপর বসে বাচ্চাগুলোকে দেখতে দেখতে আমারও কোন এক অদ্ভুত আনন্দ লাগতে থাকে, আর শুধু এই দৃশ্যটুকুর পুনরাবৃত্তি দেখার জন্যেই আরও অনেক অনেক বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে।
দীপ্ত
মন্তব্য
লেখায়
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
ধন্যবাদ! অনুপ্রাণিত হলাম।
ভারি চমৎকার, কিন্তু হুট করে শেষ হয়ে গেল। দিস্তে দিস্তে লিখুন।
..................................................................
#Banshibir.
ধন্যবাদ। আপনার অনুবাদ কিন্তু দারুণ, ইতিহাসও এত মজা করে পড়া যায় সেটা জেনেছি সেগুলো পড়ে।
ভাল লাগল ।
আরও চাই । আরও চাই ।
ভাল থাকবেন ।
শুভেচ্ছা ।
ধন্যবাদ। পাঠকের মন্তব্য আরও ভালো কিছু লিখতে চেষ্টা করায়।
দারুণ।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
ধন্যবাদ। আপনি যে প্রকৃতি নিয়ে কি চমৎকার সব লেখা দেন!
সুন্দর।
_________________
[খোমাখাতা]
অনেক ধন্যবাদ, নিটোল।
খুবই ভাল লাগলো।
নতুন মন্তব্য করুন