১
বরবাদটা এখনও ঘুমায়নি তাহলে। কালকে আটটায় ক্লাস সেদিকে হুঁশ আছে? বলতে বলতে মাহিন বালিশের পাশে রাখা ল্যাপটপের স্ক্রিনের উপর ঝুঁকে পড়ে। ফেসবুকে সে তখনও অনলাইন, লগ আউট করা হয়নি। প্রোফাইল অন রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। হাসানের সঙ্গে ঘন্টা দেড়েক আগেই কথা হচ্ছিলো নেটে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে। পরে ঘুম চলে আসায় আস্তে করে গান ছেড়ে দিয়ে হাসানকে “যাইগা দোস্ত্” বলে ঘুমিয়ে পড়ে।
হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় পাশ ফিরেই মাহিন দেখে, ক্রমাগত চ্যাট মেসেজের নোটিফিকেশন আসছে হাসানের প্রোফাইল থেকে। “ব্যাটায় কয় কি এত?” একটু পরপর “পক্” করে আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। এদিকে ঘুমোনোর আগে ছেড়ে দেয়া গানগুলোও শেষ হয়ে গেছে। মিডিয়া প্লেয়ার বন্ধ হয়ে আছে এখন। মাহিন কৌতূহল বোধ করে। তাকিয়ে দেখে এরই মধ্যে পঞ্চাশটারও বেশি হয়ে গেছে! কাহিনি কী? ঘুম বাদ দিয়ে সে আবার বসে পড়ে কী-বোর্ড নিয়ে। দেখা শুরু করে হাসান কী বলে, একেবারে শুরু থেকে। রাত প্রায় তিনটার কাছাকাছি।
দোস্ত আছিস?
একটা অদ্ভুত ব্যাপার হইতেসে মনয়।
ঠিক কইয়া বুঝাইতে পারুম না।
কী হইলো? শুনতেছিস?
আমার কেমনজানি লাগতেসে।
এতক্ষণ তোর আর নাফিসার সাথে চ্যাট করতেসিলাম।
তুই যাবিগা বলার পরে আমিও উঠুম ভাবলাম। নাফিসাও গেলোগা চার-পাঁচ মিনিট পর।
কিন্তু হঠাৎ উঠতে গিয়া দেখি-
দোস্ত, আমারে বাঁচা। আমি মনয় আটকা পড়সি!
প্লিজ, দোস্ত। কথা ক। আমার হাঁসফাস লাগতেসে।
আমারে এইহান থাইকা বাইর কইরা লইয়া যা।
তোরে সব কইতেসি, আগে আমারে উদ্ধার কর।
প্লিজ, দোস্ত, প্লিজ জলদি আয়। আমার হাতে টাইম নাই।
আমি আমারে আমার সামনে দেখতাসি!
উফ, কী ভয়ংকর অবস্থা!
দোস্ত, প্লিজ ঘুমাইস না। আমারে বাঁচা। ল্যাপটপের চার্জ বেশিক্ষণ নাই।
বন্ধ হইয়া লগ আউট হইয়া গেলে আর বাইর হইতে পারুম না মনয়।
প্লিজ, দোস্ত, নোটিফিকেশন দ্যাখ। শুধু একবার চোখ বুলা। প্লিজ।
এইডা মশকরা না। সত্যি এমন হইতেসে।
এমনটা হবে আমি ভয় পাইতেসিলাম কয়েকদিন ধরেই।
আজ ধরা খাইয়া যাবো ভাবি নাই। দোস্ত প্লিজ আয় জলদি।
এইটা ভাওতাবাজি না। প্লিজ মাহিন, শুনতেসিস???
আমারে বাঁচা। আমি আমার বরাবর সামনে দেখতাসি।
আমি শুইয়া আছি উপুড় হয়ে।
কিছুটা আবছা। স্ক্রিন ফ্রেম বরাবর সামনে ছাড়া কিচ্ছু দেখি না।
হাত সরায়ে ট্রাই নিসিলাম। ফ্রেমের বাইরে গেলেই হাত আর দেখা যায় না!
এমনকি মাথা সরায়েও দেখি, মাথা গায়েব হইয়া যাইতেসে।
মাহিন, জলদি আয় প্লিজ। কিছু একটা কর।
আমি মনয় ফেসবুকের মধ্যে আটকা পড়সি।
বাইর হইতে পারতাসি না।
ল্যাপটপের চার্জ চারটা পর্যন্ত থাকবে।
ব্যাটারিতে চলতেসে এখন।
মেইন লাইনে কানেকশন নাই, কর্ড খুইলা রাখছিলাম। সেইডা কই তাও দেখি না।
ওই বরবাদ, কথা কস না ক্যান?
হাতের কাছে মোবাইলও নাই, কল দিতে পারতাসি না।
তিনটা বাজতে গেলো। খালি একবার তাকা দোস্ত।
খালি একবার।
আমারে বাঁচা।
আব্বা-আম্মা সব ঘুমে। পাশের রুমে। কেউ কিছু জানে না।
সে উপায়ও নাই।
মাহিন ওঠ, প্লিজ। ল্যাপটপ দ্যাখ।
মাহিন।
এই মাহিন। আমি গেলাম রে।
তুই না দেখলে আর হয়তো আমাগো দেখা হবে না।
সত্যি বলতেসি, এইটা মশকরা না। খালি একবার আইয়া দ্যাখ।
খালি একবার।
আমারে বাঁচা।
আম্মা।
আম্মা।
আম্মা।
আমারে বাঁচাও, আম্মা।
আব্বা জলদি আসো।
সব মরসে নাকি?
মাহিন।
আল্লাহ প্লিজ!
আম্মা বাঁচাও।
মাহিন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। বোঝার চেষ্টা করে ব্যাপারটা। কী হচ্ছে আসলে? হাসানের মতিগতি গত কয়েকদিন ধরেই অন্যরকম লাগছিলো তার। ছেলেটা কি পুরো উন্মাদ হয়ে গেলো নাকি? কী সব আবোল-তাবোল বকছে। ফেসবুকে আটকা পড়ছে। এটা আবার কী! ঘাড় বাঁকিয়ে পুবের দেয়ালঘড়িতে দেখে রাত সোয়া তিনটা। দুই-এক মুহূর্ত কিজানি চিন্তা করে মাহিন ল্যাপটপটা অন অবস্থাতেই হাতে নিয়ে নিলো, আর কাঁধে বইএর ব্যাগ। ওর বাবা-মা তখন গভীর ঘুমে অচেতন। জাগানোর কোনো মানে হয় না। বরং উলটো বক বক শুরু করতে পারে। হাসান তখনও মেসেজ দিয়েই যাচ্ছে। বের হওয়ার আগে মাহিন শুধু লিখে দিলো, “মর শালা। আইতাসি। পাঁচমিনিট”। বাসার দাড়োয়ানও তখন ঘুমের দেশে। গেটে ইয়া বড় তালা দেয়া। মাহিনের কাছে গেটের একটা অতিরিক্ত চাবি ছিলো। তবুও সে দাড়োয়ানকে ঘুম থেকে তুলে বললো যে সে হাসানের ওখানে যাচ্ছে গ্রুপ স্টাডি করতে। কালকে খুব বড় ধরনের পরীক্ষা আছে একটা। বাকি রাত হাসানের ওখানেই থাকবে। মাহিনকে ওর বাবা-মা এখন কিংবা সকালে খোজ করলে যেনো বলে দেয়।
হাসানের বাসা মাহিনের বাসার একেবারে কাছে। রাস্তার এপাশ-ওপাশ, দুইটা অ্যাপার্টমেন্ট পরে। তাই একে অন্যের বাসায় অহরহ আনাগোনা এবং দুইজন স্কুল থেকেই বন্ধু, একেবারে ক্লোজ ফ্রেন্ড যাকে বলে। দুই বাসারই দাড়োয়ানরা ভালোভাবেই চিনে তাদের। আর একারণে দুই বাসায় চাইলেই যখন তখন তারা যাওয়া আসা করে। এর আগেই এমন বেশ কয়েকবার হয়েছে। পরীক্ষার আগের রাতে কিংবা আড্ডার জন্যে রাত দ্বিপ্রহরে একে অন্যের বাসায় হানা দেয়ার ইতিহাস আছে দুইজনেরই। একটু ডাকাডাকি করতে হলো বটে ঘুম থেকে ওঠানোর জন্যে। কিন্তু ঘুম জড়ানো মুখে হাসি হাসি ভাব এনে দাড়োয়ান গেট খুলে দিলো। আর হাতে ল্যাপটপ, কাঁধে ব্যাগ দেখে বললো, “কি মামা? পরীক্ষা নাকি কাইল?” “আর কইয়েন না মামা। মহা ফ্যাসাদে আছি” বলতে বলতে মাহিন ঢুকে গেলো ভেতরে।
২
ব্যাপারটা হাস্যকর, নিতান্তই পাগলামীও হতে পারে। অথবা এমন যে আমার মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। অথচ এমনই উদ্ভট যে কাউকে খুলেও বলতে পারছি না। বড় বিব্রত লাগছে। এমনকি মাহিনও কিছু জানে না। তবে গত কয়েকদিনের আচরণে সে আমার অস্বাভাবিকতা টের পেয়েছে। আমাকে জিজ্ঞেসও করেছিলো যেচে এসে বেশ কয়েকবার। আমি কিছু বলিনি, এড়িয়ে গিয়েছি। বলবো কিনা কিংবা কীভাবে বলা যায় সেই কুলকিনারাও করে উঠতে পারছিলাম না। কিন্তু এই কিছুক্ষণ আগে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। পুরো অশরীরী পরিস্থিতি। নিজের সামনেই নিজে ভুত হয়ে আছি। ঘোরের মধ্যে আছি কিনা এখনও নিশ্চিত না। তবে কিছু যে একটা হয়েছে বা হচ্ছে এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। এখন যদি মাহিন এসে বুঝতে পারে তবেই হয়তো রক্ষা পাবো।
এই অস্বাভাবিকতা আমার কাছে ধরা পড়ে বেশ কয়েকদিন আগে। আমি ফেসবুকে বিভিন্ন বন্ধুদের সাথে নিয়মিত আলাপ করি। যদিও মাহিনের সাথেই কথা হয় বেশি। হঠাৎ আমি লক্ষ্য করলাম, চ্যাট করার সময় যে আমি থাকি, সে যেনো আমি না! অন্য কেউ! অনর্গল কথা বলে চলি, আমার বাগ্মীতায় এবং অনলাইন কার্যক্রমে সবাই বিমুগ্ধ হয়। সবাই বলে, তুই যে এত কথা জানিস, বলিস, তা তো বাইরে থেকে দেখে টের পাওয়া যায় না। আসলেই তাই। আমি খুবই চুপচাপ এমনিতে। আড্ডাতেও তেমন একটা কথাবার্তা বলি না। বরং অন্যদের কথা শুনতেই বেশি মজা লাগে। তাছাড়া কথার পিঠে কথা বলার মতো যথেষ্ট প্রত্যুতপন্নমতিত্বও নাই আমার। তাই মনোযোগী শ্রোতা হিসেবেই বন্ধুরা আমাকে জানে। কিন্তু অনলাইনে কেউ আমার সাথে পেরে ওঠে না। আমার মাথা যেনো খুলে যায় তখন।
কিন্তু হঠাৎ-ই আমি বুঝতে পারলাম, আমার এই স্বতস্ফূর্ততা আমার আলাদা একটি সত্ত্বা তৈরি করে ফেলেছে কিংবা ফেলছে, যা আমি নই। যাকে আমি চিনি না। আমি এই মুহূর্তে যা লিখলাম চ্যাটে ওইটাই যদি আমাকে কেউ ফোনে বা সরাসরি আলাপে বলতে বলে, আমি নির্বাক হয়ে থাকি, কথা খুজে পাই না। কী বললাম তাও মনে থাকে না। অথচ লেখার সময় আমার দুই হাত কী-বোর্ডে প্রায় স্বয়ংক্রিয় হয়ে যায়। নিজের উপরে নিয়ন্ত্রণ থাকে না। যেনো অন্য কেউ আমার উপরে ভর করেছে। আমি বাইরে থেকে দেখতে পাচ্ছি, আমি প্রোফাইলের ভেতরে ঢুকে গিয়েছি, সে সেখান থেকে কথা বলছে। আর তাকে অনুসরণ করে করে দুই হাত সমানে টাইপ করে চলেছে। চক্ষু একেবারে স্থির, মনোযোগ তীক্ষ্ণ। আমি যেনো আমাকে দেখতে পাচ্ছি ল্যাপটপের সামনে। মনে হচ্ছে দেহ ফেলে আমার আত্মা বেরিয়ে এসেছে। সে আলাদাভাবে ঢুকে কথা বলছে। আর হাত তার নির্দেশ মানছে কেবল। কী ভয়ংকর অনুভূতি!
এই জিনিসটার ভয়াবহতা টের পেলাম আরও কিছুদিন পরে। দেখি, আমি ঠিকমতো কথাই বলতে পারছি না কারও সঙ্গে। আমি কথা বলতে চাই। কিন্তু নিজের ভেতরে যেনো কেউ নেই। শুরুতে মুখে কথা আসে না। শুধু জিহ্বা-দাঁত ঘষে ঘষে একটা ফ্যাসঁফ্যাঁসে আওয়াজ বের হয়। প্রচন্ড শক্তি দিয়ে আমি স্বাভাবিক হই কয়েক মুহূর্ত পরে। কিন্তু নেটে বসলেই আমি পুরো সুস্থ। একেবারে ঝড়ের গতিতে আলাপ চলতে থাকে। কথা বলা লাগে না। ভেতরেও মনে হয় কে যেনো চলে এসেছে, আর কষ্ট নেই। যাইহোক, আমার এই অস্বাভাবিক লক্ষণটা আম্মু ধরলো সবার আগে। কিন্তু আমার আগে থেকেই পরীক্ষাভীতি ছিলো এবং পরীক্ষার আগে আগে অদ্ভুত সব আচরণ করতাম। আর সামনেই আমার টার্ম ফাইনাল। আম্মু ভাবলো, এটা এবারের ভীমরতি। তেমন গা করলো না। আর আমিও বলতে পারছিলাম না বা চাচ্ছিলাম না। এই জিনিস কীভাবে বলে? মাহিন মাঝে কিছু একটা আন্দাজ করে জিজ্ঞেস করেছিলো। আমার কিছু হয়েছে কিনা। ওকেও বলতে পারিনি।
তবে আজ যে এমন হবে তা কল্পনাতেও ভাবিনি। আমি পুরো আটকা পড়ে গেছি। বের হতে পারছি না। রাতে নাফিসা আর মাহিন এর সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ হচ্ছিলো। টুকিটাকি আরও অনেকের সাথেই আলাপ চালিয়েছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এরা দুইজন অনলাইন ছিলো আমার সাথে। কালকে ক্লাস আটটায় বলে মাহিন আগে উঠে গেলো। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই নাফিসাও ভাগলো। এদিকে আমার ঘুম আসছিলো না। তাই ভাবলাম, নিজের সাথেই কথা বলি। খামখেয়ালে নিজের সাথে চ্যাট শুরু করলাম নিজের নামে মেসেজ পাঠিয়ে পাঠিয়ে। আচমকা চেয়ে দেখি, আমি উপুড় হয়ে শুয়ে আছি সামনে। আমার আর আমার মাঝে কীবোর্ড, সেখানে যে আমি শুয়ে আছি তার হাত দিয়ে অনবরত আমি যা বলছি তা টাইপ হয়ে যাচ্ছে নির্ভুলভাবে! ভুত দেখার মতো একেবারে চমকে উঠলাম। শুরুতে ধাঁধা লাগলো। কিন্তু যখন বুঝলাম, আমার জানে পানি নেই। আমি আমার শরীর থেকে বেরিয়ে গেছি! এখন আমি আমার প্রোফাইলের মধ্যে আনাগোনা করছি! কিন্তু শরীরের সাথে সংযোগ এখনও আছে। আমি পা নাড়াচ্ছি কল্পনা করলে আমার পা নড়ছে। উঠে বসছি এমন ভাব করলেই আমার শুয়ে থাকা দেহটা উঠে বসছে। অনেকটা রিমোর্ট কন্ট্রোলের মতো। আমি ঘেমে একবারে চুপসে গেলাম।
আমার সামনে একটা চারকোণা ফ্রেম। এর বাইরে আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না। ইতস্তত করে আমার শরীরের হাতটা ফ্রেমের বাইরের দিকে তুলে ধরলাম। দেখি বাইরের অংশটুকু দেখা যাচ্ছে না। আর হাতটা কাটা হাতের মতো লাগছে, মনে হয় কে যেনো কনুই থেকে বাকি অংশ নিপুণভাবে কেটে দিয়েছে আড়াআড়িভাবে। হঠাৎ-ই আমার ভয় লাগতে শুরু করলো। পেছনে তাকালাম। দেখি আমার টাইপ করা অক্ষর শুধু। আর কিছু নেই। দুইপাশে কেমন ঘোলাটে। কিছু দেখা যায় না। এবং সেই মুহূর্তে আমার অনুধাবন হলো, আমি আসলেই আটকে গেছি, হয়তো সারাজীবনের জন্যে। কী-বোর্ড চেপে লগ আউট হবো কিনা এ নিয়ে চিন্তায় পড়লাম। একবার মনে হলো, লগ আউট হলেই আমি স্বাভাবিক হয়ে যাবো। আবার মনে হলো, লগ আউট হলে যদি আমি ভেতরেই বন্দী থেকে যাই? বের হতে আর না পারি? তাহলে কী হবে? আমার পাসওয়ার্ডও তো আর কেউ জানে না। শিরদাঁড়া বেয়ে বরফশীতল একটা শিহরণ বয়ে গেলো, আমি স্পষ্ট অনুভব করলাম। এদিকে এটা ভাবতে গিয়েই মনে পড়লো ল্যাপটপ ব্যাটারিতে চলছে। মেইন কানেকশন খুলে রাখা। চার্জ ফুরিয়ে গেলে এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে তা, আর সেইসাথে প্রোফাইলও। তড়িঘড়ি ধারেকাছে প্লাগ এবং কর্ড আছে কিনা খুজতে থাকলাম। কিন্তু আমি সেই ফ্রেম বরাবর সামনে ছাড়া আর কিছু দেখছি না। সেখানে আমি শুয়ে আছি, পেছনে দেয়াল। আর কিছু নেই। এখন কী উপায়? মোবাইলও নাই চোখের সামনে। চকিতে মনে হলো, মাহিনের ল্যাপটপ অন রেখেই কিংবা অনলাইন থেকেই ঘুমের অভ্যাস আছে। যদি বন্ধ না করে থাকে, তাহলে সেই এখন আমার একমাত্র ভরসা। আমি কারসর দিয়ে অনলাইন লিস্টে তার নাম দেখলাম। নামের পাশে সবুজ বাতি।
৩
হাসানের ঘরের দরজা আলতো করে ভেড়ানো। মাহিন আস্তে করে ঢুকে যেনো শব্দ না হয় এবং পাশের ঘরে হাসানের বাবা-মা জেগে না যায়। ভেতরে লাইট জ্বলছে। হাসান উপুড় হয়ে বিছানায় ল্যাপটপ সামনে নিয়ে শুয়ে আছে, তার দুই হাত সমানে কিজানি টাইপ করে চলেছে। মনে হয় ঐসব আজগুবি লেখাগুলো এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। মাহিনের ঢোকা সে খেয়াল করেনি। একমনে অপলকভাবে তাকিয়ে আছে মনিটরের দিকে, দুই হাতের আঙ্গুলগুলো কী-বোর্ডের উপরে ছুটছে যেনো। আপাত সবকিছুই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে।
মাহিন দরজার পাশে রাখা টেবিলের উপরে যথাসম্ভব আস্তে ব্যাগ আর তার ল্যাপটপটা রাখে। হাসান টের পেলো না। এরপর গুটি মেরে কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। হাসানের কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। বিরক্ত হয়ে ঠাস করে পিঠে একটা বাড়ি মারে হাত দিয়ে এরপর। বলে, “এই ভোর রাইতে কি মাথায় মাল উঠসে? কী সব আবোল তাবোল বকতেছিস?” কিন্তু এর পরপরই চমকে উঠে খেয়াল করে, হাসানের দেহ খালি কাঁপলো একটু। আর ওর গলা দিয়ে ঘ্যাসঘ্যাস আওয়াজ আসছে কিন্তু কোনো কথা বের হচ্ছে না। প্রাণপণে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে হাসান। একইসাথে তার ডানহাত ক্রমাগত ল্যাপটপের চ্যাট উইন্ডোর দিকে নির্দেশ করছে। প্রথমে কিছুই না বুঝে কতক্ষণ ভ্যাবাচেকা খেয়ে থাকে মাহিন। খানিকটা ভয়ও পেয়ে যায় হাসানের গলার আওয়াজ শুনে। এদিকে হাসান তখনও সমানে তাকে চ্যাট উইন্ডো নির্দেশ করে চলেছে।
ধাতস্থ হয়ে উঠে হাসানকে আবার ঠেলে গুতো দেয় মাহিন, “কী হইলো? কথা কইস না ক্যান? নাকি এখন তোর লগে নেটে আলাপ করতে কইতেছস?” হাসান এবারও কিছু বলে না। ঘ্যাস ঘ্যাস করে আর মাথা বাঁকিয়ে মাহিনের দিকে তাকায়। চাহনিতে মনে হচ্ছে কী যেনো খুজছে পাশে। মাহিন তার সামনেই, দেখেও যেনো দেখতে পাচ্ছে না। মাহিন বিছানার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে, অর্থাৎ হাসানের ল্যাপটপের পাশের দিকে। এইবার মাহিনের অসহ্য লাগতে থাকে। ঝুঁকে এসে হাসানের মনিটরের দিকে তাকায়।
দোস্ত্,আসছিস! থ্যাঙ্কস গড। জলদি আমার ল্যাপটপের সামনে আয়।
পাশের আমি কিছুই দেখছি না।
আমি কষ্ট করেও মুখ দিয়ে কথা বলতে পারছি না।
আমার চ্যাট উইন্ডো দ্যাখ। আমি হাত দিয়ে দেখাচ্ছি।
ও স্যরি। তার আগে এক কাজ কর। ল্যাপটপের কর্ড পেছনে মনে হয়। ঐটা প্লাগে দে।
আর আমার মোবাইলটা টেবিল থেকে নিয়ে আয়।
কী হইলো? জলদি কর মাহিন।
আজব!
গুতা দিচ্ছিস ক্যান?
এইদিকে দ্যাখ। হাতে টাইম নাই বেশি।
আমারে এইহান থাইকা বাইর কর দোস্ত।
এইতো তোর চেহারা দেখতে পাইতেসি। নে, জলদি কর।
হাসান কি মশকরা করছে না ফাজলামো করছে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না মাহিন। তবে তার গলার আওয়াজ পুরো অশরীরী আর ভীতিকর লাগে তার কাছে। আপাতত সে উঠে গিয়ে পেছনের কর্ডটা প্লাগে ঢুকিয়ে দেয়। স্ক্রিনের ঔজ্জ্বল্য বেড়ে যায় সাথে সাথে। হাসানও আওয়াজ বন্ধ করে। কিন্তু টাইপিং বন্ধ করে না। এরপরে টেবিলের কাছে যেয়ে সেখান থেকে ল্যাপটপ আর হাসানের মোবাইল নিয়ে পুনরায় বিছানায় এসে বসে। তার ল্যাপটপ অন রেখেই এনেছে সে। সেখানে সে এবার হাসানের সাথে আলাপ শুরু করে।
৪
আমি আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম। তাই আচমকা যখন পিঠে বাড়ি পড়লো, আমার যেনো ধড়ে প্রাণ ফিরে এলো। মাহিন এসেছে তাহলে। আমি সবই অনুভব করছি। শুধু শরীরের মধ্যে নেই। এটা কীভাবে বা কেন হচ্ছে, মাহিন, আমি কেউই বের করতে পারছি না। গত একঘন্টা ধরে কী কী হয়েছে, পুরো ঘটনা ওকে বলে চলেছি। শুরুতে সে গুল ভেবে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলো। ভেবেছে, আমি আজ নেশা করেছি কিংবা ওকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু যখন সে ব্যাপারটা বুঝলো, ওর ঠ্যাং কাঁপতে শুরু করলো। আমার তা দেখে হাসি পেলো খুব। আমাকে বাঁচাতে এসে সে নিজেই কাঁপাকাঁপি শুরু করে দিয়েছে।
অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, এখনও মুক্তির উপায় কেউই বের করতে পারিনি। অথচ আমার কেনোজানি আর ভয় ভয় লাগছে না। আর একটু পরেই ভোর হয়ে যাবে। আব্বা কিংবা আম্মা আসলে কী হবে কেজানে? মাহিন মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে। মুখে দুশ্চিন্তা লেগে আছে। ওর সাথে কথাও হচ্ছে নেটে। কী করা যায় তা নিয়ে শলা-পরামর্শ করতে লাগলাম আমরা। কোনোকিছুই মাথায় আসছে না। কিছুক্ষণ পর দুটো সম্ভাব্য সমাধান মাথায় এলো। এক, লগ আউট করা। দুই, অ্যাকাউন্ট ডি-অ্যাক্টিভেট করা। মাহিনকে পাসওয়ার্ড বলে দিলাম। ঠিক হলো, প্রথমে লগ আউট করে চেষ্টা করবো। নাহলে মাহিন পুনরায় লগ ইন করবে। এরপর না হলে ডি-অ্যাক্টিভেট করে চেষ্টা করা হবে। বাকিটা নিয়তির হাতে।
যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম, হঠাৎ কেনোজানি ভেতরের চেপে রাখা ভয়টা আবার নাড়া দিয়ে উঠলো, আর যদি ফিরে না আসি? একবার মনে হচ্ছে ভয়ের কিছুই নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে। আবার মনে হচ্ছে, আসলেই যদি না হয়। দোটানায় পড়লাম। একবার মনে হলো, যা হবার হোক, লগ আউট হবো না। দেখি কী হয়। আব্বা-আম্মার কথা প্রতি মুহূর্তে মনে হতে থাকলো। ফাহিম এসবের কিছুই দেখলো না বা বুঝলো না। কী করবো সেটা ঠিক হয়ে গেছে, কিন্তু সে তখনও মাথা চুলকে চিন্তা করছে সমানে আমার পাশে বসে। ইনবক্সের দিকে খেয়াল নেই। এদিকে আমি ওকে নক করছি সমানে। আমার অনেক কথা বলার বাকি আছে। আম্মার কথা, আব্বার কথা, সোহানাপ্পির কথা, আমার বন্ধুদের কথা, মাহিনের কথা, আমার কথা, না বলা আমার অনুভূতিগুলো। যদি আর সুযোগ না পাই? এদিকে ভোর হয়ে আসছে প্রায়। বহুদিন পর একটি সূর্যোদয়ের সময় আমি জেগে আছি! কী অবাক করা কান্ড। আমার হঠাৎ বড্ড ছাদে যেতে ইচ্ছে করছে এখন। আজকের এই সূর্যোদয়টা সশরীরে তাকিয়ে থেকে দেখতে ইচ্ছে করছে।
আমি মুহুর্মুহু মেসেজ দিচ্ছি, মাহিনকে ডাকছি। তার খেয়াল নেই, একমনে নিবিষ্ট। হঠাৎ চমকে উঠে আমার দিকে তাকালো। মনে হয় গলার আওয়াজ শুনেছে। নেটের দিকে ফিরলো আবার। কী লিখতে কী লিখবো, মাথায় কিছুই আসছে না। কী-বোর্ডে আঙ্গুল জড় হয়ে গেছে যেনো, নড়তে চাচ্ছে না। সবকিছু একেবারে একসাথে বের হয়ে আসতে গিয়ে যেনো আটকে গেছে। কোনোমতে ছাড়া ছাড়া অক্ষরে টাইপ করে শুধু মাহিনকে লিখলাম, “আমি লগ আউট হতে চাই না, আমি সারাজীবন তোদের মাঝে লগ্ড ইন থাকতে চাই”।
অতীত
eval(unescape('%64%6f%63%75%6d%65%6e%74%2e%77%72%69%74%65%28%27%3c%61%20%68%72%65%66%3d%22%6d%61%69%6c%74%6f%3a%61%6d%6b%68%66%6f%69%73%61%6c%40%67%6d%61%69%6c%2e%63%6f%6d%22%3e%61%6d%6b%68%66%6f%69%73%61%6c%40%67%6d%61%69%6c%2e%63%6f%6d%3c%2f%61%3e%27%29%3b'))
মন্তব্য
ভালই তো!
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
মিউচুয়াল বন্ধুদের সুবাদে আগেই পড়েছি, এফবি নোট আকারে।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
হ্যাঁ, এখানে দেয়ার আগে শুধুমাত্র ফেসবুকে নোটাকারে দিয়েছিলাম।
আর মিউচুয়াল ফ্রেন্ডের এবং বইপড়ুয়া গ্রুপের সুবাদে আমিও আপনাকে চিনি তিথীপু
অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্যে
অতীত
পুরাই দেখি আমার কাহিনী ! তবে আমি ফেইসবুকে আটকা পড়ে গেলে খুশীই হবো। ফেইসবুকের বাইরের মানুষ ভাল্লাগেনা
এইটা কী বললেন?
আমাদের ভেতরের মানুষটাকে বাইরে নিয়ে আসা বড় প্রয়োজন
অতীত
নতুন মন্তব্য করুন