[ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা ১৯৬৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। ‘স্নো কান্ট্রি’, ‘থাউজ্যান্ড ক্রেনস’, ‘দ্যা সাউন্ড অফ দ্যা মাউন্টেন’ উপন্যাসগুলোর জন্য বিখ্যাত হ’লেও কাওয়াবাতা নিজে বলতেন তাঁর শিল্পকে সত্যিকারভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে হাতের পাতায় এঁটে যাওয়া কিছু ছোট,ছোট গল্পে। ১৯২৩ থেকে শুরু করে ১৯৭২-এ আত্মহত্যা করবার কিছু আগে পর্যন্ত তিনি লিখে গেছেন হীরের কুচির মত এমন অনেক গল্প। এই গল্পগুলো স্বপ্নের মত, কুয়াশার মত। সময়ের মত, মৃত্যুর মত।...একাকীত্ব,ভালোবাসা আর অনুভূতির সূক্ষ্ণতায় কবিতার মত।]
[ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা ১৯৬৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। ‘স্নো কান্ট্রি’, ‘থাউজ্যান্ড ক্রেনস’, ‘দ্যা সাউন্ড অফ দ্যা মাউন্টেন’ উপন্যাসগুলোর জন্য বিখ্যাত হ’লেও কাওয়াবাতা নিজে বলতেন তাঁর শিল্পকে সত্যিকারভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে হাতের পাতায় এঁটে যাওয়া কিছু ছোট,ছোট গল্পে। ১৯২৩ থেকে শুরু করে ১৯৭২-এ আত্মহত্যা করবার কিছু আগে পর্যন্ত তিনি লিখে গেছেন হীরের কুচির মত এমন অনেক গল্প। এই গল্পগুলো স্বপ্নের মত, কুয়াশার মত। সময়ের মত, মৃত্যুর মত।...একাকীত্ব,ভালোবাসা আর অনুভূতির সূক্ষ্ণতায় কবিতার মত।]
সংসার
মূলঃ ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা
যে অন্ধত্বের কথা বলছি এখানে, তা শুধু চোখের অন্ধত্ব নয়।
ভাড়া নেওয়ার জন্য বাড়ি দেখাতে এনে লোকটি অন্ধ স্ত্রীর হাত ধরে ধরে তাকে পাহাড়ের উপরে নিয়ে গেল।
“কিসের শব্দ?”
“বাঁশবনে বাতাসের।”
“হ্যাঁ, ঠিক তাই। আসলে সে আজ কত বছর যে হয়ে গেছে আমি বাড়ি থেকে বের হইনি। ভুলেই গেছি বাঁশপাতার খসখস শব্দ কেমন হয়...জানো, আমরা এখন যে বাড়িটায় থাকি, তার সিঁড়িগুলো এত সরু। যখন প্রথম ওই বাড়িটায় এসেছিলাম, কিভাবে যে সিঁড়ি বেয়ে উঠানামা করব সে কায়দাটাই বুঝে উঠতে পারতাম না। কিন্তু এখন যেই ওই সিঁড়িগুলোতে অভ্যস্ত হ’য়ে উঠেছি, তুমি আবার একটা নতুন বাড়ি দেখতে যাচ্ছ। যে অন্ধ সে তো নিজের বাড়ির সব কোণাকাণাগুলোই জানে। ঠিক নিজের শরীরকে যেভাবে চেনে। যারা দেখতে পায়, তাদের কাছে একটা বাড়ি মৃত। কিন্তু অন্ধের কাছে তো তা জীবন্ত। যেন বাড়িটার একটা নাড়ির স্পন্দন আছে।কিন্তু এখন নতুন বাড়িতে গেলে সদর দরজার মুখে, থাম্বা, খুঁটিতে আবার তো আমি হোঁচট খেয়ে পড়ব।”
স্ত্রীর হাত ছেড়ে দিয়ে, লোকটি চুনকাম করা শাদা দরজাটা খুলল।
“অন্ধকার লাগছে, বাগানে গাছগুলো যেন বড় বেশি বেড়ে গেছে। এখন থেকে শীতকালগুলো ঠান্ডা হ’বে,” মেয়েটি বলল।
“পাশ্চাত্য কায়দার বাড়ি এটা। দেয়াল আর জানালাগুলো বিষন্ন। নিশ্চয়ই আগে জার্মানরা এখানে থাকত। বাড়ির ফলকে দেখছি লেখা আছে,‘লিডারম্যান।’”
সদর দরজা ঠেলে খুলতেই, লোকটি কয়েক পা পিছিয়ে গেল, এক তীব্র আলোর চোখ ঝলসানিতে।
“আহ্, অপূর্ব!কি উজ্জ্বল!হয়ত বাগানে এখন রাত, কিন্তু বাড়ির ভিতরে তো দেখছি ভরদুপুর।”
হলুদ আর সিঁদুর রঙের ডোরাকাটা ওয়্যালপেপার চোখ ধাঁধিয়ে দিল। ঠিক উৎসবের শাদা আর টকটকে লাল পর্দার মত। উজ্জ্বল লাল পর্দাগুলো রঙিন বৈদ্যুতিক বাতির মত ঝলমল করছিলো।
“সোফা, ফায়ারপ্লেস, টেবিল, চেয়ার, লেখার টেবিল, একটা সৌখিন ল্যাম্প। দেখ, দেখ সব আসবাবপত্রই এখানে আছে!” লোকটি মেয়েটিকে জোর করে সোফায় বসাতে গিয়ে ওকে প্রায় উল্টে ফেলে দিল। এক আনাড়ি আইস স্কেটারের মত মেয়েটি হাতদু’টো দুই পাশে চিৎ করে ছড়িয়ে দিয়ে একটা স্প্রিঙের মত লাফিয়ে উঠল।
““ইস্ রে, একটা পিয়ানো পর্যন্ত আছে।” লোকটি ওর হাত ধরে প্রায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসল। ফায়ারপ্লেসের পাশে ছোট পিয়ানোটার সামনে মেয়েটি বসল। খুব আলতো করে পিয়ানোর কি-গুলো ছুঁয়ে দেখতে গেল। যেন ওগুলো ভয়ংকর একটা কিছু।
“আরে আরে, বাজছে দেখ!” একটা খুব সহজ সুর বাজাতে শুরু করল মেয়েটি। কে জানে হয়ত এই গানটা ও শিখেছিলো যখন ও খুব ছোট ছিল। কি জানি হয়ত তখন ও চোখেও দেখতে পেত।
লোকটি পড়বার ঘরে গিয়ে দেখে একটা বড় ডেস্ক সেখানে। আর পড়বার ঘরের পাশেই শোওয়ার ঘর। দুই জনের বড় বিছানা সেখানে। এখানেও আবার সেই শাদা আর সিঁদুরে ডোরাকাটা দাগ – এবার জাজিমের উপর পাতা খসখসে কম্বলটায় সেই রঙ। লোকটি লাফ দিয়ে গদির উপর উঠে বসল। নরম আর স্প্রিং দেওয়া গদি। লোকটির স্ত্রীর পিয়ানোর সুর আরো আনন্দময় হ’য়ে উঠল। অবশ্য মাঝে মাঝে ওকে বাচ্চা মেয়ের মত খিলখিল করে হেসে উঠতেও শোনা গেল। হঠাৎ করে যখন কোন একটা সুর ভুল হ’য়ে গেল – অন্ধত্বের দুঃখ।
“এই যে, এ ঘরে এসে বড় বিছানাটা দেখে যাও।”
আশ্চর্য, যেন চোখে দেখতে পাচ্ছে! মেয়েটি ওই অদ্ভুত বাড়ির ভিতর দিয়ে দ্রুত হেঁটে সোজা শোওয়ার ঘরে এসে হাজির হ’ল।
ওরা একজন আর একজনকে জড়িয়ে ধরল। বিছানায় বসতে যেতেই লোকটি এমন কান্ড করল যে মেয়েটি জ্যাক-ইন-দা-বক্সের মত লাফিয়ে উঠল। আস্তে আস্তে শিস দিতে শুরু করল ও। সময় ভুলে গেল ওরা।
“এই জায়গাটা কোথায়?”
“আসলে...”
“সত্যি, কোথায় এ জায়গাটা?
“তা যেখানেই হোক না কেন, কোনভাবেই এটা তোমার বাড়ি নয়।”
“কি ভালোই যে হ’ত যদি এমন অনেক, অনেক জায়গা থাকত!”
(জে. মারটিন হলম্যান-এর ইংরেজী অনুবাদ থেকে)
যে মেয়েটি আগুন ছুঁতে গিয়েছিলো
মূলঃ ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা
দূরে হ্রদের জল ঝিলমিল করে উঠলো। এক জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া সন্ধ্যায়, এক পুরানো বাগানে, এক থমকে যাওয়া বসন্তের রঙ ছিল সেটা।
হ্রদের দূর তীরে জঙ্গলটা নিঃশব্দে জ্বলছিলো। চোখের সামনে দাউ দাউ করে আগুনের শিখা ছড়িয়ে পড়ছিলো। বনের আগুন।
আগুন নেভানোর ট্রাকটা একটা খেলনা গাড়ীর মত হ্রদের পার ধরে দ্রুত ছুটে যাচ্ছিলো। জলের উপর তার খুব স্পষ্ট ছায়া পড়েছিলো। অসংখ্য মানুষ নীচ থেকে ঢাল বেয়ে পিলপিল করে উপরে উঠছিলো, পাহাড় কালো করে ফেলেছিলো ওরা।
নিজের কাছে এসে দেখি আমার চারপাশের বাতাস স্তব্ধ আর উজ্জ্বল। যেন বৃষ্টিহীন।
ঢালের নীচে শহরের ফালি - এক আগুনের সমুদ্র।
একটি মেয়ে ভিড় সরিয়ে ঢাল বেয়ে নেমে আসছিলো - একা। একমাত্র সে-ই পাহাড়টা বেয়ে নীচে যাচ্ছিলো।
বিস্ময়করভাবে, ওই পৃথিবী ছিলো শব্দহীন।
মেয়েটিকে যখন সোজা আগুনের সমুদ্রের দিকে হেঁটে যেতে দেখলাম, সহ্য করতে পারলাম না আমি।
একটাও শব্দ উচ্চারণ না করে, তখন মেয়েটির অনুভূতির সাথেই কথা বললাম। সত্যি, সত্যি।
“তুমি একা পাহাড় বেয়ে নেমে যাচ্ছ কেন? আগুনে মরবে নাকি?”
“মরতে চাই না, কিন্তু তোমার ঘর পশ্চিমে, তাই আমি পূবদিকে যাচ্ছি।”
মেয়েটির ছবি – আগুনের শিখার সামনে আমার স্বপ্ন ভরে দেওয়া একটা কালো দাগের মত। সেই ছবি চোখ চিরে দিল। ঘুম ভেঙ্গে গেল।
আমার চোখের কোণে জল।
মেয়েটি বলেছিলো সে আমার বাড়ির দিকে যেতে চায় না। আমি তা আগেই বুঝেছিলাম। ও যা কিছুই ভেবেছিলো, সবই তো ঠিক। জোর করে নিজেকে বোঝাতে গেলাম, উপর উপর মেনেও নিলাম যে আমার জন্য ওর সব অনুভূতিই মরে গেছে। তবু মেয়েটির হৃৎপিন্ডের কোথাও এক ফোঁটা হলেও যেন কিছুটা ভালোবাসা আছে – এমন ভাবতে ইচ্ছে করল। সত্যিকারের মেয়েটির সাথে এই আবেগের কোন যোগাযোগ যদিও নেই। নিজেকে বিদ্রূপ করতে করতে তবু গোপনে এই অনুভূতিকেই জীবন্ত করতে চাইলাম।
আচ্ছা, এই স্বপ্নের মানে কি এমন যে মনের একদম গভীরে আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম - আমার জন্য মেয়েটির কোন ভালোবাসাই আসলে নেই?
স্বপ্নটি ছিল আমার আবেগের একটি ছবি । আর স্বপ্নের ভিতর মেয়েটির আবেগগুলো ছিলো যা কিছু আমি ওর জন্য সৃষ্টি করেছিলাম – ঠিক তাই। সেগুলো আমার ছিলো। স্বপ্নে তো প্রতারণা করা যায় না, কোন ছলনা নেই।
অমন করে ভাবতে গিয়ে বড় বিধ্বস্ত আর একা লাগল নিজেকে।
(জে. মারটিন হলম্যান-এর ইংরেজী অনুবাদ থেকে)
বাংলা অনুবাদঃ কল্যাণী রমা
মন্তব্য
লেখা ভাল হয়েছে। তবে শিরোনামে অনুবাদকের নামটা একটু চড়া লাগছে।
হ্যাঁ, বড় চড়া। আসলে আমি এখানে নতুন। ভালো বুঝতেই পারছি না কোন বক্সে যে কি দিতে হ’বে। মুছে দিলাম।
অনুবাদ ভালই লাগল।
তবে, পোস্টের শিরোনামে অনুবাদকের নামখানা দৃষ্টিকটু লাগছে।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
অনুবাদ গল্প পড়বার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
দারুণ হয়েছে রমা দি, সচলে স্বাগতম।
তোমার নিজের লেখাগুলোও দিও, খুব ভাল হবে।
আর নামটা লেখার শেষেই লিখ আপাতত, পরে হাচল হলে এমনিতেই নাম চলে আসবে
facebook
আপাততঃ, শুধু অনুবাদ রে, অণু। লিখতে শিখলে নিজের লেখা নিয়ে ঢাক ঢোল পেটানো যাবে। আর ঘটনা হ’ল নিজের নাম কোথাও না দিলেও কিছু যায় আসে না তো। আসলে অতিথি অবস্থায় ভালো বুঝতেই পারছি না এখানে কোথায় যে কি গুঁজে দিতে হবে। অনুবাদটা পড়েছিস ব’লে বড় খুশী হয়েছি। কাওয়াবাতা বড় প্রিয়। কিন্তু কোন কিছুর তো আসলে অনুবাদ হয় না। তবু এ যুদ্ধ!
বেশ লাগল---আরো লিখুন।
শুভেচ্ছা নিরন্তর
অনেক ধন্যবাদ!
অনুবাদ ভালো লেগেছে
-------------------------------------------------
ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
অনুবাদ গল্প পড়বার জন্য অনেক ধন্যবাদ!
ভালো লাগলো, আরো লিখুন।
অনেক ধন্যবাদ অনুবাদ পড়বার জন্য।
নতুন মন্তব্য করুন