শিমুল গাছের গল্প, অন্ধ সাপের গল্প

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ১২/০৩/২০১২ - ১০:১৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শিমুল গাছের গল্প, অন্ধ সাপের গল্প

তখন আমি কী করছিলাম? আমার কি ভয় হচ্ছিল ভীষণ? কান্না আটকে রাখছিলাম ঠোঁট চেপে ধরে? নাকি থরথর কাঁপছিলাম রাগে? শুধু মনে আছে, দু’হাত দিয়ে মা’কে জড়িয়ে ধরে ছিলাম আমি। আমার যা বয়স, তার চাইতেও অনেক ছোট হয়ে যেতে চাইছিলাম, অনেক নিচু হয়ে যেতে, লুকিয়ে যেতে চাইছিলাম মনে মনে। চাইছিলাম আগের দিনে ফিরে যেতে, কিংবা পরের দিনে। জমজমাট আড্ডায় চোবানো ‘লাভলি’ হেটেলের ডিমকারির ভেতর হয়তো ডুবে যেতে চাইছিলাম, কিংবা আধচেনা মেয়েটির বিদ্রূপময় প্রত্যাখ্যানের মধ্যে। সাদামাটা তোবড়ানো অস্বাভাবিকরকম স্বাভাবিক দিনগুলোতে হারিয়ে যেতে চাইছিলাম বারবার। দাঁতে দাঁত চেপে, চোয়াল শক্ত করে, অনেকটা গায়ের জোরে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইছিলাম সেই মুহূর্তের বর্তমানকে। আর হয়তো ভাবছিলাম, মুছে যাবে, মুছে যাবে, মুছে যাবে সব…

একটা অদ্ভুত, ভীষণ রকম অদ্ভুত; শান্তির মতো, নির্ভাবনার মতো সুতীব্র ঝিমধরা গন্ধ মা’র শরীর থেকে আমার মাথার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল সরাসরি আর মাথার ভেতর ঘুরছিল অন্তহীন ঘুমের মতো। আমি দু’হাত দিয়ে মা’কে আঁকড়ে ধরে ছিলাম শক্ত করে, খুব শক্ত করে। বারবার মনে হচ্ছিল এই বুঝি আমার শেষ অবলম্বনটুকু, একমাত্র শ্রেষ্ঠ অবলম্বনটুকুও কেড়ে নিয়ে যাবে কেউ। হয়তো সেজন্যও না, হয়তো সেইমুহূর্তে আমার অনুভূতি বলছিল, এর চাইতে লুকোবার মোক্ষম জায়গা পৃথিবীতে খুঁজে পাবো না আর।

এলোমেলো ছোট ছোট কিছু ঝোপঝাড়ের মধ্যে একটি শিমুল গাছ; একটা নিঃসঙ্গ পাহাড়ের চূড়ায় একা’ই দাঁড়িয়েছিল। আমাদের ঘরের, আমাদের জানালার ঠিক মুখোমুখি ছিল সেটা। তার ডালগুলো চারদিকে এতোটা ছড়িয়ে ছিল যে, আমার মনে হোত, আমি যদি গ্রিলের বাইরে আরেকটু হাত বাড়াতে পারতাম বিশাল সেই গাছটাকে হয়তো ছুঁয়ে দিতে পারতাম হাত দিয়ে।

এলাকার সবাই ডাকতো বলে আমরা ছোটরাও পাহাড়টাকে লালিয়ার বাপের পাহাড় বলেই ডাকতাম। আমরা জানতাম না লালিয়া কে, তার বাবা কে, তবে আমরা একটা বুড়োকে দেখতাম সেখানে। আমরা ধারণা করতাম সেই বুড়ো’ই লালিয়া কিংবা তার বাবা। অনেক পরে, যখন আমরা ভাড়া নিয়ে সাইকেল চালাতে শুরু করলাম তখন একদিন হঠাৎ করে খেয়াল করলাম, পাহাড়টাকে ঢেকে দিয়ে বড় বড় সাইনবোর্ড উঠে গেছে চারদিকে। সাইনবোর্ডের গা’য়ে বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা ‘গ্রিনলেস ব্যাংক কলোনি’।

শিমুল গাছটাকে আমরা জন্মাতে দেখিনি কখনো। বরং নিজেদের জন্মের পর থেকেই দেখেছি গাছটা একইরকম বিশাল, একই রকম উঁচু। তাই, ছোটরা যখন এসে আমাদের জিজ্ঞেস করতো, শিমুল গাছটাও ঠিক সাইনবোর্ডগুলোর মতো এভাবে জন্মেছে কিনা, আমরা তখন আমাদের নবমশ্রেণির বিজ্ঞান-পাঠকে অগ্রাহ্য করে উপরে নিচে মাথা নাড়তাম। আমাদেরও খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হোত সাইনবোর্ডগুলোর মতো শিমুল গাছটাও ঠিক এভাবেই কোনো এক ভয়াবহ অন্ধকার রাতে আপনা থেকেই জেগে উঠেছে, নিজে নিজেই তার ডালগুলো ছড়িয়ে দিয়েছে আমাদের প্রত্যেকের জানালার বাইরে।

মা’র গায়ের অদ্ভুত সেই পরিচিত-অপরিচিত গন্ধটাকে আমার শিমুল গাছের গন্ধ বলেই মনে হচ্ছিল। আমার খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছিল শিমুল গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আমি ঠিক এরকমই আঁকড়ে ধরার মতো গন্ধটাই পেয়েছিলাম। আমার মা’ই তো সেই শিমুল গাছ, শীত এলেই যার পাতা ঝরে যায় আর বসন্তের শুরুতে শাদা তুলোর বরফ জানালা বেয়ে আমার পড়ার টেবিলে এসে গলতে থাকে।

মা যদি শিমুল গাছ হয়, আমি তবে কী! আমার বড় ভাই কী! আর আমার মেজো ভাই! আমি তবে ভীরু কাঠবিড়ালী, বড়দা বিলুপ্তপ্রায় টিয়া আর মেজো ভাই বহুবর্ণিল গোখরা। শুধু আমার বোনটিই কেবল গাছের ডাল হয়েছে, পাতা হয়েছে, আর বসন্তের শেষে শুভ্র তুলা।

আমার পড়ার টেবিলের উপর মৃদু চক্কর দিয়ে রুনাদি’দের বাসার টেলিফোনের আওয়াজটা মিলিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ঘরের দরোজায় কে যেন ঘা মারতে থাকে জোরে জোরে। ক্লান্তির মতো ছায়া ছায়া মুখ নিয়ে ভেতরের ঘর থেকে মা বেরিয়ে আসেন, আমার উৎকর্ণ কানে দরজা খোলার খুট খুট শব্দ এসে বাড়ি খায়। তখনো সন্ধ্যা নামেনি। শিমুল গাছের ডালে আটকে ঝুলছিল ছেঁড়া ছেঁড়া বিকেলটা। তারপর আর কিছুই মনে পড়ে না আমার। আমি নিজেকে আবিষ্কার করি মা’র ঘরে, মা’র বিছানার পাশে, মা’কে জড়িয়ে ধরা অবস্থায়। মা’র শরীরটাকে নিথর সেই গাছটার মতো মনে হয় হঠাৎ। আমি মা’র দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারি না। আমার মনে হয়, তাকালেও মা’র মুখটা দেখতে পাবো না আমি।

শিমুল গাছটার পেছনে অনেকগুলো উঁচু উঁচু গাছ ছিলো। তাদের কোনো কোনোটা হয়তো উচ্চতায় ওই গাছটাকেও ছাড়িয়ে গিয়ে থাকবে। কিন্তু আমরা সেসব দেখতে পেতাম না, এমনকি শীতকালে যখন পাতা-বিহীন শুষ্ক গাছটার পেছনে অন্য গাছগুলো উঁকি মারার চেষ্টা করতো তখনো আমরা সেইসব বড় বড় বট-অশত্থ-পাকুড় গাছগুলোকে অনায়াসে অগ্রাহ্য করতে পারতাম। কেননা, তাদের কেউই আমাদের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে পড়া মুখস্থ নিতো না, শাদা শাদা তুলোর মেঘ উড়িয়ে আমাদের পিছু ধাওয়া করতো না, কাটা পড়া ঘুড়িগুলো আটকে নিয়ে আমাদের ফেরত দিতো না, এমনকি বয়সের আগেই পেকে যাওয়া ধোপাপাড়ার ছেলেগুলোর কাঁচা হাতে ‘রিংকু প্লাস শিরিন’ লেখার জন্য বুক পেতে দিতো না। এ কারণেই হয়তো লালিয়ার বাবার পাহাড় ‘গ্রিনলেস ব্যাংক কলোনি’ হয়ে গেলেও পাঁচতলা–ছয়তলা বারান্দা দেয়া বাড়িগুলোর পেছনে তখনো গাছটার চূড়াটা দেখা যেত আর তখনো আমার এবং অন্যান্যদের জানালার ঠিক সামনেই আলতো বাতাসে তার কোনো একটা ডাল এসে দুলতো।

পাড়ার লোকেরা বড় বড় সাইনবোর্ডগুলোর নিচে দাঁড়িয়েই লালিয়ার বাবার পাহাড়কে লালিয়ার বাবার পাহাড় বলেই ডাকতো। তারা মনে মনে কলোনিবাসীদের বিদ্রূপ করতো এবং তাদের মেয়েদের নিয়ে বাজে বাজে কথা বলতো্। তারা যা বলতো তা তারা বিশ্বাস করতো এবং অন্যান্যদেরও বিশ্বাস করতে বলতো। আমরাও কলোনির ছেলেপেলেগুলোকে হিংসা করতাম; যতোটা না তারা পড়াশোনায় ভালো ছিল বলে তার চাইতেও বেশি আমাদের নিজস্ব গাছটাকে অধিকার করে নিয়েছিল বলে। শুধু আমার বড় ভাই তাদের হিংসে করতো না, কেননা সে হিংসে করার বয়সের চাইতেও বড় হয়ে গিয়েছিল এবং প্রতিদিনই তাকে কলোনিতে যেতে হতো টিউশনি করতে। এই উছিলায় সে শিমুল গাছটার কাছে যাবার সুযোগ পেত প্রতিদিন, যদিও গাছটার প্রতি তার কোনো আগ্রহ ছিল না বলেই মনে হোত আমার।

ততোক্ষণে সারা ঘর অন্ধকার হয়ে এসেছে। গাছটাও তার বিশাল শরীর দিয়ে আটকে রাখতে পারেনি সন্ধ্যার শেষ আলোটুকুকে। একতাল ছোপ ছোপ অন্ধকারের ভেতরে আমার ভয়-হতাশা-কান্না-রাগ সবকিছু মিলে মিশে একাকার হয়ে ফুলে ফেঁপে উঠছিল আর আমার কাঁপতে থাকা শরীর থেকে ঠিকরে বের হয়ে আসতে চাইছিল জান্তব চিৎকার।

একবার আমি একটা সাপ দেখেছিলাম শিমুল গাছটার নিচে। সাপটা জবুথবু হয়ে শুয়ে ছিল হলদে ঘাসের আড়ালে, পাশে ছেঁড়াখোড়া রংচটা প্লাস্টিকের মতো পড়ে ছিল তার খোসাটা। প্রথমে আমি খোসাটাই দেখেছিলাম, তাই বুঝতে পারিনি ওটা কী। মেজো ভাই আমাকে টেনে ধরেছিল, বলেছিল সাপটার কাছাকাছি না যেতে। সাপটা দেখেই আমি বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছিলাম, বুঝতে পারছিলাম না কী করবো। আমি এমনই ভীতু ছিলাম তখন, আমি এমনই ভীতু আছি এখনো ।
আমার মেজো ভাই দূর থেকে পাথর ছুঁড়ে মারছিল সাপটার দিকে। আগেও সে বহুবার সাপ মেরেছে বন্ধুদের সাথে মিলে। যতবারই সে সাপ মারতো ততোবারই আমাকে শোনাত সেই কাহিনী। তার অন্যান্য সত্য-মিথ্যায় মেলানো গল্পগুলোর মতো সেগুলো আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মধ্যে মিলিয়ে যেত মা’র সেলাই মেশিনের শব্দের সাথে। তাই সে অনেকটা আমাকে দেখাবার জন্যই বড় বড় পাথর তুলে সাপটাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিচ্ছিল। দূর থেকে সাপ মারার এই লক্ষ্যভেদী কৌশল তাকে কেউ শিখিয়ে দেয়নি কখনো। তবু সে জানতো, এটাই নিয়ম। এভাবেই মারতে হয়।

আমি বড় দা’কে জিজ্ঞেস করেছিলাম সব সাপের মাথায় মণি থাকে কি না। বড়দা হেসে এড়িয়ে গিয়েছিল উত্তর। আমি সেদিন সাপটার মাথায় কোনো মণি দেখতে পাইনি। হয়তো অহেতুক আতংক ঝাপসা করে দিয়েছিল চোখের দৃষ্টি। কিন্তু আমার সেই সময়ের বিশ্বাসের ভেতরে তখনো লাল-নীল-হলুদ রঙের মণি জ্বলজ্বল করছিল সাপের মাথায়।

আমি আর মেজো ভাই সিঁড়িতে বসে থাকতাম কোনো কোনো সন্ধ্যেবেলা। ঘরের দরজা বন্ধ থাকতো ভেতর থেকে। একটু পরপর মেজোভাই উঠে গিয়ে নিচে নেমে যেত। ফিরে এলে সিগারেটের উৎকট গন্ধ বের হতো তার গা দিয়ে। ঘরের ভেতর থেকে তখন বড়দা’র একটানা ঘরঘর পড়বার আওয়াজ টেলিভিশনের আওয়াজকে ছাপিয়ে যেত। তবু আমি কান পেতে রাখতাম। যখন টিভিতে “আমরা তোমাদের ভুলবো না” বাজতে শুরু হতো তখন আমি আনন্দিত হয়ে উঠতাম। একটু পর মা দরজা খুলে এগিয়ে আসতেন আমাদের দিকে। আমার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিয়ে যেতেন ঘরের ভেতর। কখনো কখনো কিল-ঘুষি-চড়-থাপ্পড় মারতে থাকতেন আর চেঁচাতেন অদ্ভুত স্বরে। মেজো ভাই ঠায় বসে থাকতো একই জায়গায়। মা তাকে ডাকতেন না, সেও আসতো না। সে জানতো, তার সময় এখনো আসে নি।

আমরা জানতাম গাছটা হাঁটতে পারে। রাতের বেলা ঘুমের ঘোরে আমাদের বুজে আসা চোখের পাপড়ির শাদা আলোর মধ্যে হাঁটত সে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মধ্যবর্তী একটা অদৃশ্য রাস্তা দিয়ে সরে যেত এদিক-ওদিক। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ সে রাস্তাটা চিনতো বলেই ব্যাপারটা আমাদের কাছে আজব মনে হয় নি। তবু আমরা গাছটার চারদিকে ভাঙা চারা দিয়ে বেড় দিতাম। গাছটা বোধহয় মনে মনে হাসতো তখন। কারণ, আমরা দেখতাম গাছটা তার পাতার ঝাপটায় ভেঙে দিতো আলোর টুকরো টুকরো কণাগুলোকে।

বড়দা চলে যাবার সময় শুকনো রুটির মতো একদলা কান্না আমার গলায় আটকে গিয়েছিল। ততোদিনে আমি অনেক বড় হয়ে গিয়েছি বলেই বুঝতে পারছিলাম আমার কান্না মা’কে কাঁদিয়ে দিবে আরও । বড়দা সবসময় বড় হতে চেয়েছে, ছোট হয়ে থাকতে সে অপমানিত বোধ করতো। ছোট থাকবার সময়ও আমরা দেখতাম সে বড়দের মতো ভাব ধরে থাকতো আর বড় হয়ে যাবার উপায় খুঁজে বের করতো পড়ার বইয়ের মধ্যে। তাই সে যখন বৃত্তি নিয়ে পড়ালেখা করতে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছিল তখন নিজের ভাই বলে তার প্রতি গর্ব হচ্ছিল আমার। পাড়ার লোকগুলোর অবাক চোখের সামনে দিয়ে তার ভারি ব্যাগটা হেঁচড়ে নিয়ে কলোনির মুখের বড় রাস্তায় আসতেই আমার উচ্ছ্বাস বাঁধভাঙা রূপ নিয়েছিল সমবয়েসী কলোনির ছেলেগুলোর সামনে। তখনো হয়তো আমি বিশ্বাস করতে চাইছিলাম না এই উচ্ছ্বাসের ফুলকিগুলো বারুদের মতো দাগ কেটে বসে যাবে আমার শরীরে। তাই দাদা যখন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়বার আগে বললো “মা’কে দেখিস” তখন নিজেকেই পরাজিত মনে হচ্ছিল আমার। তাই, ফিরবার সময় কারো দিকে না তাকিয়ে এক দৌড়ে বাসায় ঢুকে পড়তে হয়েছিল আমাকে।

একরাতে দরজা খুলে আর পাওয়া গেল না মেজো ভাইকে। সে-রাতে মা সারারাত জেগে রইলেন, সাথে আমিও। তিনদিন পর কোথা থেকে জানি মা ধরে এনেছিলেন তাকে। এরপর থেকে আর কথায় কথায় বের করে দিতেন না ঘর থেকে। তবু সে থাকলো না ঘরে। একবার যা হারিয়ে যায়, বারবার তা হারিয়ে যায়; নানী জানতেন। মেজো ভাইয়ের চোখের মণি হাতড়ে নানী বুঝেছিলেন সেটা।

খুব দ্রুত একটা পরিবর্তন ঘটছিল সবখানে। বড়দা চলে গেল। সেই সাথে মেজো ভাইও। কখনো কখনো রাতে সে ফিরতো, কখনো ফিরতো না। যেসব রাতে সে ফিরতো সেসব রাতে আমি টের পেতাম মেজো ভাই আসলে ফিরে নি। এটা অন্য কেউ। গাছের ছায়া থেকে অনেক দূরে সরে যাওয়া কোনো ঘোর লাগা যাত্রী। দুপুরের খররোদে চামড়া পুড়িয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছিল সে। তাতে কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না তার।

মা’ও ঠিক বুঝতে পেরেছিলেন একটা অদৃশ্য হলকা পুড়িয়ে দিচ্ছে সবকিছু। মনোযোগের ফুটো ঢাল দিয়ে কিছুতেই আটকানো যাচ্ছিল না সেটা।

আমি প্রায়ই শুনতে পেতাম নির্মল বাবুর সিঁড়িঘরের লাইট চুরি করে নিয়েছে মেজোভাই, কিংবা জুয়েল স্টোর থেকে টাকা কেড়ে নিয়েছে জোর করে। জিকো মেডিকো থেকে ঘুমের ওষুধ সরানো, লাভলি হোটেলে তিনশো টাকা বাকি, সেলিমের বোনের গয়না ছিনতাই ইত্যাদি সব অভিযোগের পাথরের নিচে মা চাপা পড়ছিলেন ধীরে ধীরে। বড়দা’র সাফল্য, মা’র আত্মসম্মান সবকিছু যেন উত্তপ্ত বাতাসের ঘূর্ণিতে ছাইয়ের মতো উড়ে যাচ্ছিল।

মা ছেলেটার গলার স্বর শুনে চিনতে পারেন নি। আমি না শুনেই চিনেছিলাম। ভোলা, মেজো ভাইয়ের বন্ধু। মা হয়তো খেয়ালই করেননি কে ছিল টেলিফোনের অন্যপাশে। উনি শুধু শব্দগুলো চিনতে চাইছিলেন। কিন্তু শব্দগুলোও চিনতে পারছিলেন না ভালো করে। রুনাদি’র মা ঠিকই চিনেছিলেন। আমাকে এসে বললেন “রাসেলকে কলোনির লোকেরা মারছে, তুমি তাড়াতাড়ি যাও”। কেন মারছে আমাকে বলেননি তিনি।

আমি প্রায়ই খুঁজতাম মেজোভাইকে। আমার সেই মেজোভাই, যে একই বিছানায় আমার পাশে শুয়ে ঘুমাতো, সিঁড়ির উপরের ধাপে বসে নিচের ধাপে আকিঁবুকি কাটতো পায়ের আঙুল দিয়ে, আমাকে পেছনে বসিয়ে সাইকেল নিয়ে উড়ে যেত গলির রাস্তায় কিংবা নষ্ট হয়ে যাওয়া টেলিভিশনটা ঠিক করে দিতো জাদুমন্ত্রবলে।

মেজো ভাইয়ের মতো ঢুলু ঢুলু চেহারার একটা ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসতো মাঝেমাঝে। তার বসে যাওয়া চোখের চাউনিতে পরিচিত আলো ঠিকরে উঠতো হঠাৎ। আমার তাকানো নিষেধ ছিল। আমি চোখ নিচু করে ঘরে চলে আসতাম। মা কখনো জিজ্ঞেস করতেন না তার কথা। আমিও কখনো কিছু বলিনি মা’কে।
মা আমাকে যেতে দিতে চান নি। আমিও চাইনি যেতে। আমি মা’র শরীরের আড়ালে লুকিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। আমি লুকোতে পারিনি। ওরা আমাকে ধরে নিয়ে গেল খোড়ল থেকে। আমি ছোট থাকতে চেয়েছিলাম। তবু আমাকে বড় হয়ে যেতে হয়েছিল। থানা-পুলিশ-মর্গ-দাফন সব সামাজিক কার্যক্রমের গলি ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে ধাঁই ধাঁই করে বড় হচ্ছিলাম আমি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, না চাইলেও আমাকে বড় হতে হবে। হানিফ-নির্মল-মাশরাখা সুলতানারা তাদের দাঁত দিয়ে টেনে লম্বা করে দেবে আমাকে।

সে-রাতে অনেকেই এসেছিল সমবেদনা জানাতে। মা তাঁর ঘর ছেড়ে বের হননি। আমার বোবা দৃষ্টির সামনে মা’র রুমের দরোজায় সমবেদনার স্তূপ জমা করে তারা ফিরে গিয়েছিল।

লাশ সনাক্ত করতে পরদিন সকালে আমি গিয়েছিলাম সেখানে। শত শত সামাজিক মানুষের ভীড় মাড়িয়ে আমি শিমুল গাছটার নিচে এসে দাঁড়াতে পেরেছিলাম।। আমার ভাই পিছমোড়া করে বাঁধা ছিল গাছটার নিচে। মুখ হা হয়ে ছিল, চোখে অজানা আতংক। একটুকরো রোদ গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে এসে তার থ্যাঁতলানো বুকের উপর বসেছিল। আমার হঠাৎ মনে হয়েছিল, সাপের মণি আসলে মাথায় থাকে না, বুকে থাকে।

লেখক: সঙ কিংবা সন্ত


মন্তব্য

প্যাপিরাস এর ছবি

কোন জায়টায় কষ্টটা ধরে আসছে, বলতে পারব না।

চমৎকার লাগল শেষটায় এসে।
আরো লিখুন।পড়ার জন্য বসে আছি।

কুমার এর ছবি

চমৎকার হয়েছে গল্পটা।

সঙ কিংবা সন্ত এর ছবি

ধন্যবাদ কুমার এবং প্যাপিরাসকে।

পথিক পরাণ এর ছবি

দুর্দান্ত----
একটানা পড়ে ফেললাম। গল্পটা আমায় একবারে শেষ অক্ষরটি পর্যন্ত নিয়ে ছাড়ল---

-------------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ---

সঙ কিংবা সন্ত এর ছবি

ধন্যবাদ পথিক পরাণ। আমিও চাইছিলাম পাঠক শেষ অক্ষরটি পর্যন্ত পড়ুক।

দীপ্ত এর ছবি

খুবই ভালো হয়েছে। আপনার বর্ণনাভঙ্গি, শব্দচয়ন, উপমা সবই ভালো লেগেছে। গল্পটা কি যে সুন্দর করে জমিয়ে রাখলেন শেষ পর্যন্ত।

সঙ কিংবা সন্ত এর ছবি

ধন্যবাদ দীপ্ত।

অন্যকেউ এর ছবি

অনন্য বর্ণনাভঙ্গি আর শব্দের বুনোটে গড়ে তোলা চমৎকার একটা গল্প পড়লাম। লেখকের আরও লেখা পাবার আশা করি। চলুক চলুক

_____________________________________________________________________

বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।

সঙ কিংবা সন্ত এর ছবি

ধন্যবাদ অন্যকেউ।

ফাহিম হাসান এর ছবি

সাপ আসলে মোটেই ভয়ংকর কোন প্রাণী না - মানুষ কোন বাছবিছার না করে ভয় পেয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে। কাজটা ঠিক না।

সঙ কিংবা সন্ত এর ছবি

শুধু ভয়ে কি! আমার ধারণা আনন্দেও মারে। মানুষ হত্যা করতে আনন্দ পায়। অপার্থিব, অমানুষিক আনন্দ।

ব্যাঙের ছাতা এর ছবি

হৃদয়স্পর্শী। চলুক

সঙ কিংবা সন্ত এর ছবি

ধন্যবাদ লেখাটি পড়ার জন্য।

সঙ কিংবা সন্ত এর ছবি

হৃদয় স্পর্শ করতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি।

বন্দনা এর ছবি

খুব করে ছুঁয়ে করে গেলো আপনার লেখাটা, আপনার বর্ণনাভঙ্গী অসাধারন।

সঙ কিংবা সন্ত এর ছবি

আপনার প্রশংসার ভঙ্গিও তাই। ধন্যবাদ।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

মুগ্ধতা জানবেন। চলুক

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

পরিবর্তনশীল এর ছবি

কিছু কিছু জায়গায় বর্ণনা পড়ে মুগ্ধ হতেই হয়। চলুক লেখালেখি।

প্রীনন এর ছবি

এক নিমিষে পড়ে ফেললাম।সাহিত্যবোদ্ধা হয়ত কখনোই ছিলাম না,কিন্তু কিছু কিছু লেখা পড়ে বুকের গভীরে কোথায় জানি ভীষণ ব্যাথা অনুভব করি,সেরকমই একটি লেখা,চালিয়ে যান

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।