একজন মানুষের গড় আয়ুর অর্ধেক এর বেশি পার হয়ে এসে আজ যদি হিসেব মিলাতে বসি, তাহলে দেখি পুরোটা সময় জুড়েই কে এক শুভঙ্কর শুধু ফাঁকিই দিয়ে গেছে। অনেকগুলো এলোমেলো পৃষ্ঠার তৈরী জীবন খাতাটাতে খুঁজে পাইনা গোছানো একটা বাক্যও যা আমাকে একটুকু সান্ত্বনা দিতে পারে এই বলে যে – ‘না, তুমিও পেরেছিলে’।
আশা ছাড়া, স্বপ্ন ছাড়া - মানুষ বাঁচেনা। বেঁচে যেহেতু আছি সেহেতু যুক্তিবিদরা বলতেই পারেন যে আমি আশাবাদী / স্বপ্নবাজদের একজন। কিন্তু সত্যি হলো এখন আমি শুধু নিরাশাবাদীদের একজনই নই, আমি কট্টরপন্থীও বটে। অর্ধেক পানি ভরা গ্লাসকে আমি অর্ধেক খালিই বলি না শুধু, এইটাও জোর গলায় দাবী করি যে কেউ একজন সেটা থেকে অর্ধেক খেয়ে এঁটো করে দিয়ে গেছে।
তবে হ্যাঁ। স্বপ্ন আমিও দেখতাম। আমার স্বপ্নগুলো বোধহয় খুব বেশি রকম অবাস্তব ঘেষা বরাবরই। সেই কবে ছোট থাকতে মফঃস্বল শহরে বড় হওয়ার সুবাদে দেখে এসেছিলাম অনেক যৌথ পরিবার এবং তাঁদের আণ্ডা-বাচ্চাদের দুরন্তপনা। সবটা হয়তো ভাল ছিল না; কিন্তু শৈশবের সেই সময় তা বোঝার উপায়ও ছিলনা। সেই যৌথ পরিবারের আবহাওয়ায় এখনো স্বপ্নদেখি আমার বাচ্চারা বড় হবে। সবাই মিলে একসাথে সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে দাঁপিয়ে বেরাবে। ঈদের আনন্দে যেমন থাকবে তারা, তেমনি থাকবে ১২ মাসের ১৩ পার্বণে; থাকবে পূজোয়; থাকবে বড়দিনের উৎসবে, থাকবে বৌদ্ধমঠের ফানুষ ওড়ানোয়।
আরো স্বপ্ন ছিল আশে-পাশের সকলে যার যতটুকু সাধ্য আছে দিয়ে সমবায়ের আদলে একটা বিশাল যৌথ-খামারের। যেখানে বপন করা হবে মানবিকতার বীজ এবং উৎপন্ন হবে কৃষ্টি, স্নেহ, ভালবাসা। যেখানকার মানুষগুলো হবে কুসংস্কারমুক্ত। সুখে থাকতে যে আসলে অর্থ নয়, একটি ভালো আত্মার প্রয়োজন তা অন্যরা শিখবে আমাদের দেখে। সবাই গলা মিলিয়ে গাইব – ‘মরব দেখে বিশ্বজুড়ে যৌথখামার’।
স্বপ্নগুলোর জন্ম অবশ্যই একদিনে হয়নি। আমাকে প্রথম স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিলেন আমার মা। হয়তো তা ছিল একটু সেকেলে ভাবে, হয়তো ছিলো ধর্মীয় চেতনায় সমৃদ্ধ। দাদা-দাদী-র কাছে গল্প শুনেছি তেমনটা মনে করতে পারিনা। নানা বাড়ি যখন কালে ভদ্রে যাওয়া হতো তখন মৌলানা নানার কাছ থেকে দুয়েকটা কাহিনী যে শুনিনি তা নয়; তবে থাকা হতোনা কখনই বেশিদিন সে আমার জন্যই। ইলেক্ট্রিসিটি ছাড়াও যে বেঁচে থাকা যায় তখন সেটা ছিল চিন্তার বাইরের ব্যাপার।
আমার ৯ অথবা ১০ বছর বয়স পর্যন্ত আমার কাছে শুয়ে জ্বীন-পরী, দৈত্য-দানো, নবী-রসুল, পীর-দরবেশদের গল্প বলা মার জন্য ছিল বাধ্যতামূলক। এই দীর্ঘ সময়ে খুব কম গল্পই মাকে একাধিক বার বলতে শুনেছি। এমনকি যখন আমি আবিষ্কার করে ফেলেছি যে আমাদের বাসাতেই আছে তিন হাজারেরও বেশি বইয়ের এক বিশাল জগত তারপরের অনেকদিনও মায়ের বলা সেই সব গল্পের নেশা থেকে বের হয়ে আসতে পারিনি। কতরাতে বাথরুমে যাওয়ার সময় বিড়াল দেখে ভয়ে চিৎকার করেছি যে দুষ্টু জ্বীন এসেছে আমাকে ভয় দেখাতে। রাতে মার কাছে গল্প শুনলেও দিনের বেলা আমার টার্গেট ছিল আমাদের সাত ভাইবোনের সবচেয়ে বড় দুজন। আমাদের দুই-বোন। তাঁরা অবশ্য আমাকে কোনও একটা বই থেকেই পড়ে শোনাত। মনে পড়ে যখন পড়া শিখে নিজে পড়তে গিয়েছি তখন আবিষ্কার করি যে প্রগতি প্রকাশনার প্রায় সব গল্পই যে আমার শুধু জানা তা নয়; বেশীরভাগ আমি মুখস্তই বলতে পারি। এভাবেই আমার কল্পনার জগতের সাথে পরিচয়।
সেই শুরু আমার স্বপ্নদের তৈরি হওয়া এবং একে একে ভেঙ্গে পড়া। কৈশোরে আমার প্রধান দুঃখছিল এই সময়ে, এই দেশে জন্ম নাওয়াটা। মনে হত, কীবা ক্ষতি হতো সৃষ্টিকর্তার, যদি তিনি আমাকে জন্ম নিতে দিতেন সেই ভাইকিংদের সময়ে একজন গল হিসেবে বা বুনো-পশ্চিমে অথবা সেই তখন যখন বাংলাদেশ তথা বৃহত্তর ভারতের সোনালী দিন ছিল অথবা এমন একটা সময় যাতে অংশ নিতে পারতাম আমাদের সেই গৌরবের ভাষা আন্দোলনে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে, অথবা নিদেন পক্ষে কিশোর-মুসা- রবিনদের একজন তো করতেই পারতেন কারও কোনো ক্ষতি না করেই।
আমাদের ছোটবেলায় নানা ধরনের নীতিকথা শেখানো হতো। ঈশপের গল্পছিল অবশ্যপাঠ্য। তখনি আমি জানতাম যে - 'মানুষের পোষাক দেখে তাকে বিচার করতে হয়না'। 'সুখী মানুষের জামা থাকে না'। 'দশের লাঠি একের বোঝা'। 'সকল জীবের ভিতরেই সৃষ্টিকর্তা থাকেন। তাই কাউকেই কষ্ট দিতে হয় না, মানুষকে তো অবশ্যই নয়'। সেই পাঁচ বছুরে ভালুক ছানার মতোন আমিও সভ্য হওয়া শিখেছিলাম।
আমার স্বপ্নর শুরুটা যেমন আমার পরিবারেই, সেগুলোর ভাঙ্গনের শুরুও সেখান থেকেই। একটু বড় হতেই দেখলাম যে সেই সব নীতিবাক্য শুধুমাত্র শেখার জন্যই। মানার জন্য নয়। আরেকটু বড় হয়ে আরো অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম যে আসলে মানতে চাইলেও সেগুলো মানা সম্ভবই নয়। আমার চিন্তা চেতনার পরিবর্তন ঘটা শুরু হলো বাস্তব থেকে পাঠ নিয়ে। কী নিদারুন হতাশা, নিজের এবং আশে পাশের মানুষদের জন্য করুণা নিয়ে যে সেই সময়টা পার হয়েছে। হতাশাটা তার সরবোচ্চ পরযায়ে পৌঁছে থমকে গেলেও আমার সেই অবাক হয়ে কিংকর্তব্য ভাব এখনও কাটেনি। মাঝথেকে আমি হয়ে উঠলাম চরম স্বার্থপর, লোভী, হিংসুকে এবং হিংস্র। যখন একা থাকি তখন সেই সব নীতিকথা আমাকে ভাবায় এবং কাঁদায় বটে কিন্তু বাইরের জগত যখন আমার স্বার্থে হাত দেয় তখন কী অবলীলায় আমি হয়ে উঠি তাদেরই একজন। আমার এই দ্বৈত (নাকি দৈত্য?) স্বত্বার উপস্থিতি আমাকে অস্থির করে, আরও এলোমেলো হয়ে যায় আমার সবকিছু।
আজীবন বলে এসেছি যে আমার সব কিছুর দায় দায়িত্বই আমার। আমি যা হয়েছি নিজের ইচ্ছায় হয়েছি। খারাপ ভাল এই জন্য অন্য কেউ দায়ী নয়। কিন্তু নিজেকেই বিশ্বাস করাতে পারিনা কেন কথাগুলো? কেন মনে হয় আমাকে আমার সেই শৈশবেই ঠকানো হয়েছে চরম ভাবে। আর এখন আমিই আমাকে ঠকাচ্ছি প্রতিনিয়ত।
আমি কোন শিক্ষাটা দিয়ে যাব আমার বাচ্চাকে? তাকেও এরকম একটা জীবনের ভিতরে ফেলার কী অধিকার আছে আমার? তাকেতো আমার শেখানো উচিৎ যে – ‘মা, পৃথিবীতে সবচেয়ে জঘণ্য প্রানী হচ্ছে মানুষ। তুমিও তাদেরই একজন। এখন তোমাকে শিখতে হবে সবচেয়ে খারাপদের একজন হওয়া; নাহলে টিকতে পারবে না এইখানে। এরা তোমাকে শিখাবে পোষাক দেখে মানুষ বিচার না করতে; কিন্তু তোমাকে এদের অফিসে-বাসায়-অনুষ্ঠানে ঢুকতে দেবেনা ড্রেসকোড মেনে না চললে। এরা তোমাকে বলবে জীবে দয়া করো; কিন্তু দেখবে কি অবলীলায় এরা নিজেরা একে অপরকে হত্যা করে সেই লাশ নিয়ে শুরু করে কুৎসিত এক প্রতিযোগিতা। যা দেখে জংলী নরখাদকদেরকেও মনে হবে ফেরেস্তা। সবাই তোমাকে উদাত্ত্ব কন্ঠে আহ্ববান জানাবে যে আসো, আমাদের সাথে থাকো, আমরা সুখে-দুঃখে একসাথে থাকব। তারপর তুমি দেখবে হয় তোমার গলায় ছুরি চালিয়ে চলে গেছে তারা না হয় তোমাকে সর্বস্বান্ত করে গেছে। কাজেই তোমাকে শিখতে হবে কীভাবে তারা তোমার ক্ষতি করার আগেই তুমি তাদের শেষ করে দিতে পারো। ভয় পেয়োনা; এটাকে আমরা অন্যায় বা খারাপ বলবনা, আমরা ভদ্রলোকেরা এটাকে আত্মরক্ষা হিসাবেই দেখব।’
আমি মাকড়শা প্রজাতির মতো এতোকিছুর পরেও বুনে যাই আমার সেই পূরণ না হওয়া স্বপ্নের জালটিকে। অদক্ষতায় বোনা এবং অপুষ্টিতে ভোগা আমার সেই সব সুতোর জাল অবলীলায় ছিড়ে বেরিয়ে যায় স্বপ্নের হন্তারকরা। আবারও জোড়া লাগাই জালে। এখন আর নতুন সুতো পাইনা সেই জুড়ে দেয়ার কাজে। কোনওভাবে পুরনো সুতোগুলোতেই দিই আবার নতুন গিঁট। কী করব? এটাই যে আমার বাড়ি। আমার খাদ্য যোগনোর একমাত্র অবলম্বন।
-তদানিন্তন পাঁঠা
মন্তব্য
আপনার মেয়ের জন্যে শুভকামনা। বাবা হিসেবে আপনার দুঃচিন্তা হওয়া স্বাভাবিক। আমার মনে হয় আপনি আপনার শৈশব দ্বারা প্রতারিত হননি। নীতি-কথা গুলা মানুষের বিবেক তৈরি করতে সাহায্য করে। খারাপ কাজে যদি হ্যাঁ-না ডিলেমা কাজ না করে তাহলে তো সমাধান সহজ হয়ে গেল। তবে হালকা-পলকা ঢালটা সকলের অধিকার মনে করি। নিরাশ হবেন না।
শাফি।
ধন্যবাদ শাফি ভাই। নিরাশ হই না তো। আশার অনুপস্থিতিকে কী নিরাশা বলে?
লেখাটা মন ছুয়ে গেল। নিজের সাথে অনেক জায়গায় অনেক মিল খুঁজে পেলাম ।
মন খারাপ হলো।
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
দুঃখিত মন খারাপ করিয়ে দেয়ার জন্য। ভাল থাকবেন।
হেমিংওয়ের জেলে বুড়ো সান্তিয়াগোর সংলাপটিই আমাদের ভরসা-----
facebook
নতুন মন্তব্য করুন