বাবু সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘পালামৌ’তে লিখে গেছেন- ‘‘বরাকর হইতে দুই-একটি ক্ষুদ্র পাহাড় দেখা যায়। বঙ্গবাসীদের কেবল মাঠ দেখা অভ্যাস, মৃত্তিকার সামান্য স্তূপ দেখিলেই তাহাদের আনন্দ হয়। অতএব সেই ক্ষুদ্র পাহাড়গুলি দেখিয়া যে তৎকালে আমার যথেষ্ট আনন্দ হইবে তাহা আর আশ্চর্য কী?’’ আমিও আপাদমস্তক মাঠ দেখা লোক। মাঝে দু-একবার বুড়ি ছোঁয়ার মতন বাইরের দু একটা পাহাড় অপেক্ষা উঁচু পর্বত পদবাচ্যর ভূমিরুপ দেখেছি মাত্র। সেইসব পাহাড় আর পর্বতের সারি কেবলই প্রস্তরাকীর্ণ। রাজস্থানের উঁচু পাহাড়ের গাঢ় তামাটে রঙে যেন কোন প্রাণ নেই। বড় বড় কালো পাথরগুলো ঊর্ধ্বপানে বিকটভাবে চেয়ে থাকে যেন। সে রুক্ষভূমিতে তৃণ জন্মানোও দুস্কর। আর অস্ট্রেলিয়ার ব্লু মাউনটেইনের থ্রি সিস্টার্স রেঞ্জকে ঠিক কি কারণে লোকে এতো নমস্য আর অবশ্য দ্রষ্টব্যর তালিকাভুক্ত করে রেখেছে, তা আমার কাছে এক বিস্ময়। একদিন খুব ভোরবেলা সিডনী থেকে কাটুম্বা শহরের ওধারে থ্রি সিস্টার্স রেঞ্জে গিয়েছিলাম। তখন শীত নামছে কেবল। প্রায় ৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় প্রায় জমে যাবার জোগাড় নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের বাসিন্দা আমাদের। অল্প অল্প কুয়াশা মাখা স্নিগ্ধ সকালে দাঁড়িয়েছিলাম থ্রি সিস্টার্সের নীচে জেমিসন উপত্যকার উলটো দিকের অব্জারভেসন পয়েন্টে। দূরে তিনটা পর্বতের চূড়া। যেন তিনটি বোন হাতে হাত রেখে সমুদ্রের ধারে হেঁটে বেড়াতে যাচ্ছে। চূড়া তিনটির সামনে ছড়ানো উপত্যকা। সেখানে পেঁজা তুলোর মতন মেঘ ঝুলে আছে। এতটুকুই।
ঐসব পাহাড় পর্বতমালার তুলনায় আকারে কাপ্তাইয়ের জল ছুঁয়ে ভেসে থাকা বরকল রেঞ্জ আর মাইনি উপত্যকার পাহাড়গুলো নিতান্তই টিলা বৈ অন্য কিছু নয়। কিন্তু সৌন্দর্য জিনিসটা বুঝিবা অন্য কোন মানে বয়ে বেড়ায়। মেরজরি কিনান রলিংসের লেখায় জেনেছিলাম সেই অতি বিখ্যাত লাইনটি- Size does not matter!. আজ বুঝলাম, কথাটা বুঝি পাহাড়ের সৌন্দর্যের বেলাতেও খাটে। লঞ্চ এগিয়ে যেতে যেতে আমি যেই টিলা সদৃশ পাহাড় অথবা পর্বতের ছায়াগুলো পেরিয়ে গেলাম, তাদের সুষম পারম্পর্যহীন বিচিত্র গাছগাছালির পাতায় আবৃত আদিম সৌন্দর্য কেবল আমার বিগত সকল দিনের জমানো আনন্দের অনুভুতিকে ছাপিয়ে যাচ্ছিল। আর মনে পড়ছিল রবি গুরুর চোখ পাকানো- “দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া”--
সূর্য তখন পশ্চিমে হেলে বাম দিকের পাহাড়ের মাথার উপর থেকে উঁকি দিচ্ছে। মাঝে মাঝে মন্দ মধুর হাওয়ায় ভেসে আসছে দূরের পথের লঞ্চ আর বোটের শব্দ। নীচে কাপ্তাইয়ের কাকচক্ষু জলের ওপর বিলি কেটে স্বচ্ছ ফেনা তুলে এগিয়ে চলেছে আমাদের লঞ্চটি। ছবি তোলার জন্য আগেই আমি ডেকের উপর উঠে এসেছিলাম। সামনে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল ঐ পাহাড়ের আড়ালে শেষ হয়ে গেছে হ্রদের ব্যাপ্তি। কিন্তু আমায় অবাক করে দিয়ে পাহাড় একেএকে খুলে দিচ্ছিল তার শরীরের মায়াবী ভাঁজ। আর তার আড়াল হতে উছলে পড়ছিল যেন অজস্র অসমাপ্ত সুন্দর।
ছোট ছোট টিলা আর পাহাড়গুলো বসন্তর আগেভাগেই খুব মনোরম সেজেছে নতুন পাতায়। পুরনো বয়েসি পাতা ঝরেও গেছে কোথাও কোথাও। তাই বলে প্রকৃতি এখানে কোথাও রুক্ষতাকে মূর্ত হতে দেয়নি। নানা জাতের গাছের হরেক বর্ণের বাহারি কচি পাতারা যেন কল্পনার সব রঙ মেখে বাতাসে দোল খাচ্ছে। প্লাইস্তসিন কালের পাথরের কাঠামো ফুঁড়ে বেড়ে উঠা বিরাট হিজলের ঢেউ খেলানো ডালপালা হ্রদের একেবারে নীল জল ছুঁয়ে যেন আকণ্ঠ পিপাসা মিটাচ্ছে কোথাও কোথাও।
পাহাড় কেনার শখটা আমার অনেক পুরনো। সেই সে কবে বালকবেলায় সুনীল গাঙ্গুলির কবিতায় পড়েছিলাম কবির একটা পাহাড় কেনার শখ। সেই থেকে এই শখটা আমার ভেতর প্রবলভাবে সংক্রামিত হয়ে আছে। কাপ্তাই হ্রদের জলে ভেসে ভেসে আমার সেই বহু পুরনো আকাঙ্ক্ষাটা যেন পালে বাতাস পেয়ে বেশ ফুলে ফেঁপে উঠল। পাহাড় না হোক নিদেনপক্ষে একটা টিলা জুটলেও ঢের হতো আমার। ভাবতে ভাবতেই একটু দূরে একটা পাহাড়ের মাথায় পরীদের মতন সাদা রঙের পলেস্তারায় মোড়ানো আর টালির ছাদে ঢাকা এক নাগরিক কাঠামো নজরে এলো। একটা ইউনিয়ন পরিষদ। এইরকম একটা পরিষদের চেয়ারম্যান নিশ্চয়ই রোজ রোজ অফিসের ছলে হ্রদের ধারে এসে বসে থাকেন! আহা! এমন একটা পাহাড় যদি জুটত!
লংগদু যেতে হয় বরকল উপজেলা পেরিয়ে। স্থলপথে সীমানা চেনাতে হয়ত একটা স্তম্ভ গড়া থাকে পথের ধারে। এখানে নৌপথে সে সুযোগ কোথায়? তবে পাহাড় বুঝি আরও সুন্দর একটা প্রচ্ছদ একে দিয়েছে বরকল উপজেলার পক্ষ থেকে স্বাগতম জানাতে। দেখুন না, প্লাইস্তসিন কালের এই পাহাড়ের তোরণটি কেমন সুন্দর মানিয়েছে উপজেলার প্রবেশ দ্বার হিসেবে!
দেখতে দেখতে সুবলং বাজার এসে গেলো। বাঁশের খুঁটির উপর জেগে থাকা মাচার মত ঘরগুলো পাশাপাশি দাড়িয়ে আছে। এর ভেতর আবার দুচারটি ঘর দ্বিতলও আছে। দোকানপাটগুলো দেখে সাহস এলো মনে। এদেশের লোকেরাও বাজারঘাট ভালই করে। আমাদের লঞ্চ সুবলং ঘাটে ভিড়লে অনেকেই নেমে গেলো। উঠলও কেউ কেউ। ওরা যাবে আরও দূরের পথ। ঐ দূরে-- যেখানে হ্রদের নীলচে জলের বাষ্প ছুঁয়ে ছেনে পাহাড়ের গাঢ় চূড়ার রঙ গিয়ে মিশেছে উদার আকাশের অপার নীলিমায়---
ওগো মা তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফেরে
পথিক পরাণ
-----------------------------
pavel352 এট yahoo.com
মন্তব্য
------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ---
-------------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ---
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
--------------------------------------------------------------------------------
বেশ চমৎকার। আরো ঝাড়ুন।
..................................................................
#Banshibir.
পীর দাদা
ঝোলাতো প্রায় গুটাইয়া আনছি---
দেশের ভীতরের ভ্রমন স্পট গুলো নিয়ে লেখা সুন্দর একটি ধারাবাহিক পোস্টের জন্য ধন্যবাদ।
বর্নণ উত্তম। ছবিগুলিও মনমুগ্ধকর। সব মিলিয়ে ভাল লেগেছে। ভাল হয়েছে।
আপনার অনুভূতি জেনে ভালো লাগছে খুব।
অনেক ভালো থাকুন-- সুস্থ থাকুন।
--------------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ---
খুব সুন্দর ।
অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যর জন্য--
----------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ---
অনেক ধন্যবাদ ইমো সম্রাট--
ভালো থাকবেন।
-----------------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ---
লেখা বেশ হচ্ছে, আরও লিখতে থাকুন।
কয়েকটা ছবির হরাইজন অল্প বাঁকা এসেছে, ঠিক করে নিয়েন।
facebook
অণুদা
আপনার অসাধারণ সব ঈর্ষা জাগানো ভ্রমণ বর্ণনা পড়ে পড়ে একটু সাহস করলাম নিজের দেশের কিছু লিখে দেখার।
কয়েকটি ছবি আসলেই দিগন্তের দিকে বেঁকে গেছে। এবেলায় আর শুধরে নেবার কোন উপায় যে নেই-
-----------------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ---
ছবি গুলো দেখে আমার ইচ্ছে হচ্ছে এখনই ডানা মেলে সেখানে উড়ে যেতে।ধন্যবাদ এত সুন্দর সুন্দর ছবি উপহার দেয়ার জন্য।
বেরিয়ে আসুন না একটিবার! বর্ষায় কাপ্তাই লেক দেখার মতন হয়।
পড়ে সুন্দর মন্তব্য করবার জন্য কৃতজ্ঞতা।
-----------------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ---
অসাধারণ!!
সত্যিই---
ছবিগুলো খুব সুন্দর৷
আমিও পাহাড় খুব ভালবাসি৷ তবে মূলত: কুমায়ুন হিমালয়৷ গাড়োয়াল হিমালয়ের রুক্ষ ধর?ণের জন্য ততটা ভাল লাগে না৷
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
ধন্যবাদ দিদি।
আমি ইদানিং হিমালয়ের প্রায় কোল ঘেঁষে থাকি বটে। কিন্তু কি দুর্ভাগা আমি-- কাঁটাতার পেরিয়ে ওধারে দার্জিলিং বা নিদেনপক্ষে শিলিগুড়ি যাওয়া জুটল না। এপাশে পঞ্চগড় শহর থেকে মাঝে মাঝে গরমের সময় দূর থেকে চাঁদের বুড়ি দেখার মত কাঞ্চনজঙ্ঘার শুভ্রতা নজরে আসে আবছা মতন। ঐ দেখেই এখনো তৃপ্ত আছি--
-----------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ---
জুড়িয়ে দিল চোখ আমার ……
ছবিগুলো চমৎকার। ভাল্লাগছে।
অনেক ধন্যবাদ।
জোশ হৈছে।
ডাকঘর | ছবিঘর
তাপস দা
অনেক ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন