১.
ধড়ফড় করে মাঝরাতে বিছানা থেকে উঠলেন আমজাদ সাহেব। সেই একই দুঃস্বপ্ন। আবারো। প্রকাণ্ড একটা মাঠে তিনি দমবন্ধ করে পাগলের মত দৌড়াচ্ছেন; দুই কোলে দুটো বাচ্চাকে নিয়ে। পেছন পেছন অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় ধেয়ে আসছে ভয়ালদর্শন একটা কালো গুইসাপ। কোলের বাচ্চা দুটোর কালো চোখ, কালো রঙ। দুইজনে অলটার্নেট করে করে নিয়মিত বিরতি দিয়ে বলে যাচ্ছে- ইয়াক, বাবা, তোমার গায়ে ঘামের গন্ধ।
আমজাদ আলীর গুইসাপ ভীতির শুরুটা একেবারে বাচ্চাবয়সে। যে বয়সে মানুষ জোনাকি দেখে মুগ্ধ হয়, ইঁদুর দেখে মুগ্ধ হয়,
সেই বয়সে তার গুইসাপ দেখা হয়েছিল। অন্য সবকিছুর মত এটার কথাও হয়তো ভুলে যেতেন তিনি। ভুলতে পারেননি। ভুলতে দেয়নি নরেশ কাকুর ছোঁড়া থান ইটের আঘাতে চোখের সামনে গুইসাপের থেতলে যাওয়া মাথার অমানুষিক ওই দৃশ্যটুকু।
খুব সাহসী ছিল নরেশ কাকু। আমজাদ আলী সাহসী হতে পারেননি। তার শৈশব কেটেছে ব্যাখ্যাতীত ভয়ের স্মৃতি নিয়ে।
এই স্বপ্নের ব্যাপারটা বাদ দিলে আমজাদ সাহেবের জীবনটা ভীষণ রকমের ম্যাড়মেড়ে। পঞ্চাশের উপর বয়স, একটা ছাপাখানায় কাজ করছেন আজ সাতাশ বছর হলো। প্রেসের মালিক প্রতিদিন তাকে চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন- আমজাদ সাহেব, আপনি অনুগ্রহ করে কাল থেকে আর আসবেন না। বাড়িতে বসে থাকবেন। একটা বিয়ে করবেন। নতুন করে ঘর সংসার শুরু করবেন। সুখিতা ভবন্তু। সুখের জীবন হবে আপনার।
আমজাদ সাহেব শুকনা মুখে ঘাড় কাত করেন। সাতাশ বছর ধরে ঘাড় কাত করতে করতে তার ঘাড়ে ব্যথা হয়ে গেছে।
ছাপোষা জীবনে আমজাদ সাহেবের একমাত্র আনন্দঘন মুহুর্ত হচ্ছে রাতের খাওয়ার পর ঘুমুতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সময়টুকু। এইসময় উনি তার দুই যমজ কন্যাকে নিয়ে গল্প বলার প্রতিযোগিতা আয়োজন করেন। তিনজন পার্টিসিপেন্ট- রানু, রুনু, আর আমজাদ সাহেব নিজে। রানু-রুনু অবশ্য গল্প বলে না। বলতেও চায় না। আমজাদ সাহেবকেই তিনটা গল্প শোনাতে হয়। একবার গল্প বলেন রানুর পক্ষ হয়ে, আরেকবার রুনুর, শেষটা তার নিজের। গল্পের স্টক শেষ হয়ে গেলে উনি বিপদে পড়েন। তখন শূর্পণখার জায়গায় হিড়িম্বা রাক্ষসী, ডালিমকুমারের জায়গায় মলমকুমার সাবস্টিটিউট করে একই গল্প চালিয়ে দিতে হয়। রানু রুনু তাতেই খুশি।
গল্প শেষে সবার গোপন ভোটের মাধ্যমে প্রতিযোগিতার বিজয়ী নির্ধারিত হয়। একজন একজন করে গিয়ে জুলেখার মার কানে ফিসফিস করে সেরা কথকের নাম বলে আসে। জুলেখার মা গম্ভীর গলায় ঘোষণা করে- ‘আইজকের পতিযুগিতায় ফাস্ট হয়েছেন রানু আফা। সবাই রানু আফার জন্য তালি দেন।’ বুয়াকে শিখিয়ে পড়িয়ে দেয়া আছে সবকিছু। পরদিন রুনু আফার জন্য তালিয়া হবে।
একদিন আমজাদ সাহেব ওদের দৈত্যের গল্প শোনান। আলাদীনের আশ্চর্য দৈত্যের গল্প। ইয়া গোঁফ, ইয়া ভুরু, ইয়া শিং। রানু-রুনু হা করে শোনে।
পরদিন সকালে দাঁত মাজতে গিয়ে আয়নায় চোখ পড়লে ভূত দেখার মত চমকে উঠেন আমজাদ আলী। তার ঠোঁটের উপর কালো কালি দিয়ে মস্ত বড় করে গোঁফ আঁকা, চোখের ভুরুর অবস্থাও ঐরকমই।
আমজাদ সাহেব মুখ ধুলেন না। দুই মেয়ের শিল্পকর্মের পরিচয় মুখে নিয়ে মহা আনন্দে প্রেসে গেলেন। সারাদিন মুখে রঙ মাখা অবস্থায় কাজ করলেন। কেউ কিচ্ছু জিজ্ঞেসও করল না। উশখুশ করতে করতে আমজাদ আলীর দিন গেল। অফিস ছুটির সময় নিজেই মালিকের কাছে গিয়ে বললেন, স্যার বোধহয় আমার উপর রাগ করে আছেন। হয়েছে কি, আমার দুই মেয়ে... । মালিক হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমজাদ সাহেব, আপনি প্লিজ কাল থেকে আর আসবেন না। ঘরে বসে থাকবেন। আপনার চিকিৎসা দরকার।
প্রেসের মালিকের চোখ তখন সদ্য ছাপা হওয়া বইয়ের মলাটে আটকে না থাকলে দেখতে পেতেন- সাতাশ বছরের পুরনো মানুষটা জীবনে আজ প্রথমবারের মত ঘাড় কাত করল না।
২.
সেদিন রাতে সেই স্বপ্নটা আবার ফিরে এল। ঐ একই প্রকাণ্ড মাঠ, ঐ দুটো বাচ্চা, ঐ গা ঘিনঘিনে গুইসাপ। আমজাদ সাহেব হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়াচ্ছেন। নিজের জন্য না, বাচ্চাদুটির জন্য। কিন্তু আজকে উনি পারছেন না। কিছুতেই পারছেন না।
হঠাৎ একটা অদ্ভুত কাজ করলেন আমজাদ আলী। একটা মস্ত থান ইট কুড়িয়ে নিয়ে উনি তেড়ে গেলেন গুইসাপটার দিকে, ঠিক নরেশ কাকুর মত। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে আমজাদ আলী উন্মাদের মত গুইটাকে মারতেই থাকলেন, মারতেই থাকলেন। আঘাতে আঘাতে প্রাণীটার মাথা থেতলে থেতলে যেতে লাগলো, তবু মরছে না ওটা। আহ, কী কষ্ট, কী কষ্ট। এত কষ্ট হচ্ছে কেন আমজাদ আলীর?
৩.
পুলিশের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মদিনা প্রিন্টার্সের কর্মচারী অখিলবাবু প্রথমবারের মত উপলব্ধি করলেন, ইস্কুলজীবন থেকে দেখে আসা আমজাদ আলী সম্পর্কে আসলে উনি প্রায় কিছুই জানেন না। লোকটা নিঃসঙ্গ, একলা একলা বিড়বিড় করে, মাঝে মাঝে মুখে কালি মেখে দৈত্যের মত সেজে রাস্তায় ঘুরার খেয়ালিপনার ব্যাপারটুকুও তার জানা আছে ঠিক, কিন্তু তার অপ্রকৃতিস্থতার মাত্রা এমন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়াটা আর সবার মত অখিলবাবুর কাছেও প্রায় ব্যাখ্যার অতীত।
নিজেই নিজের মাথা থেতলে মরা একটা পাগল-ছাগল লোকের লাশের রিপোর্ট লিখতে হবে; সেটা মনে পড়তেই পুলিশ ইন্সপেক্টর মোবারক মৃধা বহুদিনের অভ্যাসমত তার স্টকের সবচেয়ে কুৎসিততম গালিটি আরেকবার উচ্চারণ করলেন। কার উদ্দেশ্যে, কে জানে !
৪.
আর রানু-রুনু? কি হল ওদের? জানি না। হয়তো ওরা এতক্ষণে ধরা পড়ে গেছে নরেশ কাকুর হাতে, হয়তো পড়েনি।
শুধু জানি, ওদের কালো কালো দুই চোখ ভরে ছিল টলটলে জলে। তোমরা কেউ বিশ্বাস করবে না, জানি। বলবে, গুইয়ের বাচ্চা কি কখনো মানুষের জন্যে কাঁদে ?
------------------
সাত্যকি
eval(unescape('%64%6f%63%75%6d%65%6e%74%2e%77%72%69%74%65%28%27%3c%61%20%68%72%65%66%3d%22%6d%61%69%6c%74%6f%3a%6a%6f%79%2e%73%6f%75%6d%69%74%72%61%40%67%6d%61%69%6c%2e%63%6f%6d%22%3e%6a%6f%79%2e%73%6f%75%6d%69%74%72%61%40%67%6d%61%69%6c%2e%63%6f%6d%3c%2f%61%3e%27%29%3b'))
------------------
মন্তব্য
বাহ!
আচ্ছা, নিচের লিঙ্কটা জুড়েছেন কেন?
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ধন্যবাদ তিথী। লিংকের ব্যাপারটা মুর্শেদ ভাইয়ের কারসাজি। ইমেইল আইডি দিলে সেটা পাবলিশের পর এইরকম ভয়ানক চেহারা প্রাপ্ত হয়।
দারুণ দারুণ! শেষটা বেশি দারুণ! পাঁচতারা।
কয়েকটা ইংরেজি শব্দ পছন্দ হয়নি। পার্টিসিপেন্ট, অল্টার্নেট, সাবস্টিটিউট...!
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
ইংরেজি শব্দগুলোর ব্যাপারে অবশ্য সেই ক্লিশে অজুহাতই দেখাতে হচ্ছে- "লাগসই বাংলা প্রতিশব্দ মাথায় আসেনি"
আর রতনদার মন্তব্য পাওয়া অবশ্যই স্পেশাল কিছু।
চমত্কার!
ধন্যবাদ স্যার। ধনেপাতার ইমো হবে।
পাঠকের ভালো লাগাতেই তো সব। একশটা ধন্যবাদ।
দারুণ ! খুব ভালো লাগলো
আপনার গল্পের হাত আসলেই দারুণ
সর্বনাশ। জগাখিচুড়ি পাচক এই কথা বলেছে। আনন্দে তো সাতদিন আমার ঘুম হবে না।
অসাধারন লাগল, কিন্তু শেষের দিকটা বুঝলাম না ভালোভাবে !
বর্ণনাভঙি অসাধারন। আরো লেখা চাই।
পাঠক যতটুকু বুঝেছে ততটুকুই হলো গল্প। যেটুকু বোঝা যায়নি সেটুকু লেখকের সীমাহীন ব্যর্থতা।
পড়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ
অনেক ধন্যবাদ সবুজ রাজা।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
বাহ, বেশ গল্প
সাত্যকি মনে হয় আগেও কিছু গল্প লিখেছিলেন, তাই না ?? আরো নিয়মিত আসুক ভবিষ্যতে।
তোমার মনে আছে দেখি ! অনেক ধন্যবাদ।
আর তোমার বাংলাদেশ দলকে নিয়ে লিখাটার মোহে এখনো আবিষ্ট হয়ে আছি। নেট প্রবলেমের কারণে ঐ লিখায় মন্তব্য প্রকাশ হয়নি মনে হচ্ছে।
চমৎকার। পোস্টে পাঁচতারা না দাগিয়ে উপায় নাই। গল্পটা অসাধারণ ভাবে সাধারণ। কিপ ইট আপ ভাই, গল্প লেখা জারি থাকুক।
ডাকঘর | ছবিঘর
পড়ার জন্য ধন্যবাদ তাপস শর্মা। ভালো থাকবেন
দারুণ।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
ঠাম্মিকে ধন্যবাদ
পুরোন দিনের হুমায়ুন আহমেদের গল্পের মতন গন্ধ। প্রেসের কেরানী প্রতিদিন মালিকের অপমান যমজ মেয়ে রানু আর রুনা জুলেখার মার গম্ভীর গলায় কম্পিটিশনের রায় ঘোষনা। সহজ জীবনের কথামালা। ভারি ভাল লাগল ভাই। আগে গল্প লিখেছিলেন শুনলাম, লিঙ্ক দেওয়া যায়?
..................................................................
#Banshibir.
হুমায়ূন আহমেদের ব্যাপারটা ঠিক ধরেছেন।
এরপর কোন গল্প লিখলে আগের গল্পগুলোর লিঙ্ক দেয়ার কথা মনে রাখব। অনেক অনেক ধন্যবাদ।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
কবিকে ধন্যবাদ
বাহ!
বাহ এর জন্য থ্যাংক্স
খুব ভাল লাগল।
আমারো ভাল্লাগলো
চমৎকার একটা গল্প এগোচ্ছিল। কিছু ইংরেজী শব্দ মাঝে ঝামেলা করল। শেষ টা কী আসলে? শৈশব থেকে লালন করে আসা ভয়, ভীত সাধারণ মানুষের জীবন, অসহায়ত্ব। গল্পটা কী আরো বড় হতে পারত না?
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
-------------------------------------------------
ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
দারুণ লাগলো গল্পকার!!!
_____________________
Give Her Freedom!
নতুন মন্তব্য করুন