হঠাৎ করে বাজারে ইলিশ মাছের হাহাকার লেগে গেছে। একেবারে উধাও। দুয়েকটা যা দেখা যাচ্ছে তাকে জাটকা বৈ আর কিছুই বলতে পারছিনা। কিন্তু এই জাটকার দামটাই আকাশ ছুঁয়েছে ইতিমধ্যে। মধ্যবিত্তের ধরাছোঁয়ার অনেক বাইরে। কিছু কিছু বড় ‘ওয়ান স্টপ’ মলে এই জাটকাটিও নাই। কিন্তু আমার কেন জানি দৃঢ় বিশ্বাস, পহেলা বৈশাখের দুই একদিন আগে ঐ দোকানগুলোতে ঢু মারলে দেখা যাবে থরে থরে সাজানো বড় বড় ইলিশ। দোকানের অন্তপুরির কোন হিমঘরের বড় বড় বরফের চাং এর আড়াল থেকে সমহিমায় বের হয়ে, তার রুপোলি ঝিলিকে আকর্ষন করবে ক্রেতাকে। মাছের রাজাকে নিজের কাছে একটু বেশিসময় রেখে একটু বেশি মুনাফা তাদের কাছে নিতান্তই মামুলী ব্যাপার।
আমরা উৎসবপ্রিয় জাতি। উৎসবের অছিলা আমাদের বড়ই কমে যাচ্ছে দিন দিন। পহেলা বৈশাখ টা তাই করা চাই ধুমধাম। পহেলা বৈশাখে আমারও প্রিয় কিন্তু এই উৎসবটা কিভাবে পান্তা-ইলিশের উৎসব হয়ে উঠলো, সেটাই আমার কাছে রহস্য।
মোগল সম্রাট আকবরের সময় বাংলা সন শুরু হওয়ার পর থেকে পহেলা বৈশাখে জমিদাররা খাজনা সংগ্রহ করত। যারা খাজনা দিতে আসত জমিদাররা তাদের মিষ্টি, পান ইত্যাদি দিয়ে আপ্যায়ন করত।
আমার ছোটবেলাটা কেটেছে গ্রামে । কিন্তু গ্রামে কোথাও পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশের প্রচলন দেখেছি বলে মনে পড়ে না। পহেলা বৈশাখে হালখাতার অনুষ্ঠানে অবশ্য বেশ যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। এবং হালখাতার মিষ্টি-মণ্ডা খেয়েছি পেটপুরে। চৈত্রসংক্রান্তির মেলা হয়ত হত, সেখানে যেতাম এবং বিভিন্ন ধরনের খেলনা কেনাটাই ছিল আনন্দ-উৎসব। হয়ত আমার বোঝার ভুল, তবুও মনে হয়, এখনকার বৈশাখী মেলায় কি একটু বেশি বাণিজ্যিকতা ঢুকে গেছে ? নববর্ষের দিনটা যেন উৎসব ছাপিয়ে পান্তা ইলিশের ব্যবসার দিন না হয়ে যায়।
বর্ষাকালের সাথেই ইলিশ মাছের সম্পর্ক বলে আমার জানা। অর্থাৎ আষাঢ় -শ্রাবন। বৈশাখ মাসের মধ্যে যে ইলিশ কিভাবে ঢুকে পড়ল ! বিশেষ করে এই সময়টায় ১ নভেম্বর থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা আছে। আমাদের অতি উৎসাহী ইলিশ উৎসবের কারনেই হোক আর পেটের দায়েই হোক অনেক দরিদ্র জেলে কিন্তু ডিম ওয়ালা মা ইলিশ আর জাটকা শিকার করছে। যে ইলিশ তাদের জিবীকার উৎস, সেটা বাদ দিলে তারা এই সময়টা কিভাবে জিবীকা নির্বাহ করবে সেটার কি পর্যাপ্ত ব্যাবস্থা সরকার করছে ?
আমাদের আর কি দোষ , যত দোষ এই ইলিশের। এর বিস্ময়কর স্বাদ সব্বাইকে পাগল করেছে। শুধু বাঙালিকেই নয়, সারা বিশ্বে এর খ্যাতি ছড়িয়ে আছে। সৈয়দ মুজতবা আলী ইংরেজদের আহারাদি সম্পর্কে দুঃখ করে বলেছিলেন, “আহারাদির ব্যাপারে ইংরেজ নকিষ্যি কুলীনের মত উন্নাসিক, কট্টর স্বপাকে খায়, এ-দেশে এতকাল কাটানোর পরও ইংরেজ সর্ষেবাটা বা কাসুন্দি এবং মাছে মিলিয়ে খেতে শেখেনি, আথচ কে না জানে সর্ষেবাটায় ইলিশমাছ খাদ্য-জগতে অন্যতম কুতুব-মিনার।”
বছরে হঠাৎ একদিন মাটির বাসনে পান্তা সাথে পদ্মার ইলিশের টুকরা খেয়ে বিড়ম্বনার কথাও ঢের শোনা যায়। কাউকে কাউকে ফার্মেসীতে ওরস্যালাইনের খোজে ছুটতে হয়েছে বলে আমার জানা আছে। তারপরেও এতে ঢের আনন্দ। ফার্মেসীগুলো নাহয় এই অছিলায় একটু ব্যাবসা করলো।
জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বলেন, “আজকাল আমরা পহেলা বৈশাখের দিন পান্তাভাতের আয়োজন করি। পান্তাভাত নিয়ে বাড়াবাড়ি কম হচ্ছে না। কবে কোন ফাইভস্টার হোটেল বলে ফেলবে, আমাদের কাছে পাওয়া যাবে স্ট্রবেরি ফ্লেভারড পান্তা— আমি সেই অপেক্ষায় আছি।“
আমাদের বড় একান্নবর্তী পরিবারে প্রতিবেলায় হত অনেক লোকের রান্নার আয়োজন। তাই মাঝে মাঝে সকালে স্কুলে যাবার আগে সকালের রান্না পুরোপুরি শেষ হয়ে উঠতো না। এই অছিলায় মাঝে মাঝে পান্তাভাতের সাথে পাতে পড়ত বিশেষ রকমের জ্বালানো ইলিশ এর টুকরো আর ঝোল। সেটার স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। ইলিশ মাছ ছিল আমার ভয়াবহ রকমের প্রিয়। কোনোরকম একঘেয়েমি লাগা ছাড়াই দিনের পর দিন আমি ইলিশ মাছ খেয়ে নিতাম মহা আনন্দে। এখন কেন জানি পাইনা সেই ইলিশের গন্ধ আর সেই স্বাদ।
ইলিশের যে কতরকম রান্না আর তার কতরকম স্বাদ তা বলে বোঝায় কার সাধ্যি। আমার সবচেয়ে প্রিয় হল ইলিশ পাতুরি । আরও আছে সর্ষে ইলিশ, ভাপা ইলিশ, কড়া ভাজা, দোপেয়াজা এবং ঝোল । কচুর পাতা এবং ইলিশ মাছের কাটা, মাথা ইত্যাদীর ঘন্ট খাদ্যটা কিন্তু দারুন। ইলিশ পোলাও এর তো জবাব নাই। বর্ষাকালের ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে ইলিশ খিচুড়ির অভাববোধ করে না এমন ব্যাঙালি আছে কি ! ইলিশের ডিমও চরম মজাদার।
ইলিশের যে দাম হয়েছে তাতে কি আমাদের দেশে আমজনতা বা কৃষকগন খাওয়ার সামর্থ্য রাখে ? নববর্ষ তাদের কাছে কোনও অন্যরকম প্রভাত নয়। ভাঙা মাটির ঘরের দাওয়ায় বোসে মাটির বাসনে বা টিনের থালায় পান্তা খায়, সেই পান্তার সাথি হয় নুন আর কাঁচামরিচ। মরিচটা শুকনোমরিচও হতে পারে। পান্তা তাদের জন্য বেচেঁ থাকার আহার আর পান্তার সাথে ইলিশ সেটা হয়ত তাদের কাছে স্বপ্নাহার।
দেশে ইলিশের উৎপাদন ক্রমাগত এবং মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। কারন ইলিশের প্রজননক্ষেত্র কমে গেছে। প্রজননকালে ইলিশ অবাধে ও নির্বিঘ্নে ডিম ছাড়ার জন্য উজানের নদীগুলোর মিঠা পানিতে উঠে আসতে পারে না। বিভিন্ন প্রকার বাঁধ এবং মনুষ্যসৃষ্ট প্রতিবন্ধকতার কারণে নদীগুলোর পানির প্রবাহ ও গভীরতা কমে গেছে। প্রজননের ভরা মৌসুমে ইলিশ ধরা সম্পূর্ণ নিষেধ থাকা সত্ত্বেও তা মানা হয় না।
প্রিয় ইলিশ , তোমায় এত তাড়াতাড়ি হারাতে চাইনা আমরা। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে তোমার উত্তরোত্তর বংশবৃদ্ধি কামনা করি।
লেখক –স্বপ্নখুঁজি
মন্তব্য
ইলিশ আমারও খুব প্রিয়, কিন্তু আমার নাগালের বাইরেই সে থাকে আজকাল। শুধু পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করেই যে পরিমান জাটকা নিধন হবে তা ভাবতেই মন খারাপ লাগছে। সরকার ৩১ মে পর্যন্ত ইলিশ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে কিন্তু আমরা সবাই যদি ৩১ মে পর্যন্ত ইলিশ খাওয়া বন্দ রাখি তাহলে কি কমবে জাটকা নিধন? নাকি নিধনকৃত জাটকা প্রতিবেশী দেশে পাচার হয়ে যাবে?
আপনার সন্দেহ খুবই যৌক্তিক। দেশের মানুষকে বঞ্চিত করে অনেক বড় বড় ইলিশের ঝুড়ি উপহার দিয়েও কোনও এক দিদির মনে মমতার উদ্রেক করা যায় নাই।
পড়া এবং মন্তব্য এর জন্য ধন্যবাদ।
আজকে অফিসে যাওয়ার জন্য নিচে নামতেই দেখি ইলিশওয়ালা... সাইজ বেশি বড় না... তবু লোভ হলো। তিনটা কিনে নিলাম
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
কিনেছেন , বেশ করেছেন। এবার আয়েশ করে পেটপূজা করে ফেলেন।
পড়া এবং মন্তব্য এর জন্য ধন্যবাদ।
ঐদিন একজন লিখলো পুরি নিয়ে, আজকে ইলিশ। আমার হিটলিস্ট ক্রমশ বড় হৈতেছে কিন্তুক।
এই তো পরশু সন্ধ্যাতেই অফিসে অরজিনাল ডালপুরি বানিয়ে খেলাম
আর আজ কিনলাম ইলিশ
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আরও বাড়ুক হিটলিস্ট...। ভোজনরসিক না হইলে কি মজা আছে !!
লেখাটা পড়েছেন , মন্তব্য করেছেন এজন্য অনেক ধন্যবাদ।
লেখার সাথে ছবিগুলো এমনভাবে এসেছে মনে হচ্ছে আপনার তোলা। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে অভিনন্দন। আর না হয়ে থাকলে দয়া করে ছবিগুলোর আসল শিল্পীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। বিশেষ করে দ্বিতীয় ছবিটি বহুল পরিচিত মনে হচ্ছে।
ছবিগুলো, উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে নেয়া। এই তথ্যটা আসলে দেয়া উচিত ছিল। দুঃখিত। তবে ছবিগুলো জিভে জল আনে।
লেখাটা পড়েছেন , মন্তব্য করেছেন এজন্য অনেক ধন্যবাদ।
লিখতে থাকুন।
কড়কড়ে ইলিশ ভাজার মত বেহেশতি স্বাদ আর কোথাও মনে হয়না পাওয়া যাবে।
আফসুস, দেশে ইলিশের বড়ই আকাল।
কড়কড়ে ইলিশ ভাজা !! আহ কি শুনাইলেন।।।
মন্তব্য করেছেন এজন্য অনেক ধন্যবাদ।
আপনার পোষ্ট পড়ে বিপন্ন ইলিশের ঝাঁক যেন বলে উঠল, মিঠে পানিতে এসে আমাদের স্বচ্ছন্দে ডিম পারতে দিস, আমাদের কচি কচি শিশু জাটকাগুলো ছেলেধরার মতো ধরে নিয়ে যাস নে, দেখিস আসছে পয়লা বৈশাখে আমরা দ্বিগুণ হবো।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
দারুন বলেছেন।।। মন্তব্য করেছেন এজন্য অনেক ধন্যবাদ।
জেলেদের, লোভী শিকারীদের, রসনাপূজারীদের কেবল দোষ দিয়ে লাভ নেই। মেঘনা-পদ্মা সহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলোতে নাব্যতা না বাড়লে, জলপ্রবাহ স্বাভাবিক না হলে আর নদীদূষণ বন্ধ না হলে যতোই "মাছ ধরা বন্ধ" সপ্তাহ/মাস পালন করা হোক ইলিশ আর ডিম পাড়তে বাংলাদেশে আসবে না।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
সহমত। পড়েছেন আর মন্তব্য করেছেন এজন্য অনেক ধন্যবাদ।
আচ্ছা এই খাওয়া-দাওয়া নিয়ে পোস্টগুলো কি মড়ুমামাকে বলে বন্ধ করা যায় না!!
আর দিলেও ছবিগুলো ঘ্যাচাং করা যায় না?
মনের ভেতর কেমন যেন হু হু করে
মনের ভেতর কেমন যেন হু হু জাগ্রত করে বলেই মনে হয় ঘ্যাচাং হয় না। কথায় আছে , ঘ্রানে অর্ধভোজন , তাইলে লোলুপ দৃষ্টিতেও তো কিছু একটা হইতে পারে ।।।।
কষ্ট করে পড়েছেন, দেখেছেন আর মন্তব্য করেছেন এজন্য অনেক ধন্যবাদ।
অর্ধভোজনে আমার আবার খিদে বাশি পায়।
লেখা ভাল লেগেছে।
এই পোস্টটা বুকমার্কে রেখে দিই। আজ থেকে বছর বিশেক পরে নূতন প্রজন্মকে ইলিশ নামক বিলুপ্ত প্রজাতির মাছের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে কাজে লাগবে।
পোস্টটা বুকমার্কে রেখেছেন জেনে বড়ই প্রীত হলাম। লেখাটা পড়েছেন , মন্তব্য করেছেন এজন্য অনেক ধন্যবাদ।
লেখাটা এতো দেরী করে দেখলাম, এখন আফসোস হচ্ছে । ছবিগুলো এত জীবন্ত কি আর বলবো, লেখার সাথে দারুণ মানানসই । মজার লেখা মজার ছবি । সব মনে হয় একসাথে খেয়ে ফেলি
পান্তা ইলিশ খাওয়া হয়নি এখনো । এই ফ্যাশন এখন এমন আকার ধারণ করেছে যে অনেক সময় মনে হয় পয়লা বৈশাখ মানে পান্তা ইলিশ খাওয়া ! গ্রাম বাংলার অভাবী মানুষেরা এই খাদ্য কখনও খেয়েছে কি না আমার সন্দেহ আছে ।
লেখাটা দেরীতে হলেও তো দেখেছেন। লেখাটা সার্থক হইছে। ভালো কিছু লেখার জন্য উৎসাহটা বড় জরুরি। লেখাটা পড়েছেন , মন্তব্য করেছেন এজন্য অনেক ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন