জায়গাটা প্রথম থেকেই একদম পছন্দ হয়নি আমার। সারাজীবন শুনে এসেছি, সুইজারল্যান্ড হচ্ছে পৃথিবীর বুকে স্বর্গের নমুনাবিশেষ। আশা ছিল, না জানি কি দেখব। মোটামুটি হতাশই হলাম। দীর্ঘ বিমানযাত্রা অবশ্য একটা কারন হতে পারে। জোহানেসবার্গ থেকে জুরিখ পর্যন্ত সাড়ে এগারো ঘন্টা, তারপর একঘন্টার বিরতিতে জেনেভার দিকে উলটোপথে আরেকটা ফ্লাইট, জেনেভা থেকে পৌণে একঘন্টার ট্রেন জার্নি, সবমিলিয়ে ক্লান্তির চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গিয়েছিলাম। তার ওপর সামনে পুরো দিনটি পড়ে রয়েছে, কাজে যোগ দিতে এসে প্রথমদিনেই নিশ্চয়ই চেহারা দেখিয়ে চলে যেতে পারি না। এরকম অবস্থায় কিছু ভালো লাগার কথা নয়। তারপরও, চোখে লেগে থাকবে এমন কিছু দেখি নি, যতটুকু দেখেছি আর দশটা জায়গার মতই সাধারন লেগেছে।
লুজান রেল স্টেশন থেকে বেরিয়ে তিন নম্বর বাসে চড়ার কথা, এই বাস আমাকে সরাসরি অফিসের কাছে নিয়ে যাবে। তারপর হাঁটা পথে তিন-চার মিনিট, এমনটিই লেখা আছে আমার সহকর্মীর এসএমএসে। ইনি নিজে আমাকে রিসিভ করতে থাকতে পারবেন না, কারন তার বাস ভিয়েনায়, সপ্তাহে দুদিন এখানে এসে অফিস করে থাকেন। ফুল টাইম কাজ করতে পারছেন না দেখেই আমাকে বদলি হিসেবে আনা হয়েছে। এবারই পুরো চার দিনের জন্য আসছেন, আমাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবেন বলে। সাড়ে বারোটার আগে তার পৌঁছুবার কোন সম্ভাবনা নেই, এদিকে মাত্র দশটা বাজে এখন। আল্লাহ্র নাম নিয়ে বাসে উঠে পড়লাম, দেখি কোন বিপদ না ঘটিয়ে নির্বিঘ্নে অফিসে চলে যেতে পারি কিনা। বেশ অসহায় বোধ করছি ইতিমধ্যেই, কারন আবিস্কার করেছি ফরাসী ভাষা না জানলে এখানে চলাফেরা করা প্রায় অসম্ভব। “এক্সকিউজ মি, ডু ইউ স্পীক ইংলিশ” এর জবাবে একজন লোক শূন্য দৃষ্টিতে আর একজন অবজ্ঞাভরে তাকিয়েছে, “নো” বলে পাশ কাটিয়ে গেছে অপেক্ষা না করে।
যে পথ দিয়ে বাসটা যাচ্ছে তার আশে পাশের প্রায় সব ভবনই পুরনো, সমতল ছাদ থাকলে অনায়াসে পুরনো ঢাকা বলে চালিয়ে দেয়া যেত। রাস্তায় সংস্কার কাজ চলছে, পানির ধারা বেরিয়ে এসেছে একটা কাটা জায়গা থেকে, রাস্তায় জ্যাম সব মিলিয়ে বেশ পরিচিত দৃশ্য। তবে পরে জেনেছি খুবই বিরল কম্বিনেশনের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম, সাধারনত ঝকঝকে তকতকে থাকে সব, আর জ্যাম অত বাধে না।
বাস থেকে নামার সাথে সাথেই পথ হারিয়ে ফেললাম। মেসেজে যেরকম লিখা রয়েছে তার সাথে ডান, বাম এবং সোজাসুজি তিনটা দিকের কমবেশি মিল পাওয়া যাচ্ছিল, মধ্যপন্থী না হয়ে ডানপন্থী হওয়াতেই যত বিপত্তি। মিনিট দশেক এলোমেলো ঘোরাঘুরির পরে ছোট্ট করে একটা সাইনবোর্ডের দেখা মিলল, তাতে ইপ্সিত ঠিকানার কাছাকাছি নম্বর পেলাম। পায়ে পায়ে কিছুদুর এগিয়ে পেয়ে গেলাম যা খুঁজছিলাম, সমতল ছাদওয়ালা চার তলা আবাসিক ভবন।
রিসেপশনিস্ট আমাকে দেখে খুবই অবাক হল, কারন নতুন কেউ জয়েন করতে আসছে এরকম কোন খবর সে পায় নি। জুরিখের হেড অফিসে ফোন করেও সে নিশ্চিত হতে পারল না, কারন আমাকে চেনে একমাত্র কান্ট্রি এইচআর ম্যানেজার, আর ভদ্রমহিলা ছুটিতে। কিছুক্ষন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে কাটিয়ে একসময় অ্যাকসেস কার্ড ইস্যু করল সে, আমাকে অধৈর্য হয়ে উঠতে দেখে। খুব তাড়াহুড়ায় এসেছি, হোটেল বুক করবার সময় ছিল না। রিসেপশনিস্ট সে কথা শুনে চোখ কপালে তুলে বলল, “তুমি জানো না এখন ফেস্টিভ্যাল চলছে? পুরো শহরে কোন হোটেল খালি নেই।” আমি অনেকটা জোর করে তাকে হোটেল খুঁজে বের করার দায়িত্ব দিয়ে কাজে লেগে পড়লাম, কিছুই চিনি না এখানে, পরিশ্রমটাই সার হবে।
বিকাল পাঁচটার দিকে খবর পেলাম একটা রুম পাওয়া গিয়েছে, ভাড়া প্রায় দুইশ ফ্রাঙ্ক। যেহেতু অফিস দেবে, আমি না করার কে! যেভাবেই হোক আমার একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেই চলে। আরো জানা গেল, রুমটা মাত্র দুই রাতের জন্য পাওয়া গেছে, তৃতীয় দিন থেকে আবার বদলাতে হবে। তখনো জানতাম না, আমার দীর্ঘমায়াদী আবাসন সমস্যার সেটা ছিল শুরু।
পাঁচ দিন লুজানে কাটিয়ে আবার দক্ষিন আফ্রিকায় ফেরত গেলাম এক সপ্তাহের জন্য, সেখানে আমাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে হবে নতুন সহকর্মীর কাছে। আমার অধীনস্ত যাকে এতদিন শিখিয়ে পড়িয়ে পথে আনছিলাম, সে শেষ মুহুর্তে বেঁকে বসেছে, জানিয়েছে দায়িত্ব নেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। শ্বেতাঙ্গিনী বলেই এরকম সাহস সে দেখাতে পারল, কালো কেউ হলে চাকরি চলে যেত নির্ঘাত। যেহেতু আগের ট্রিপটা মাত্র পাঁচ দিনের ছিল, তাই স্ত্রী আর পুত্রকে এখানেই রেখে গিয়েছিলাম, হ্যান্ডওভার শেষ হলে বাড়ি-গাড়ি বুঝিয়ে দিয়ে সপরিবারে আফ্রিকাকে বিদায় জানাব বলে।
নতুন চাকরির শর্তানুযায়ী আমাকে দুই মাসের জন্য একটা ফার্নিশড ফ্ল্যাট দেবার কথা, সেটা নিয়ে লাগলো ক্যাচাল। মাত্র দুটো নমিনেটেড রেন্টাল কম্পানী আছে যাদের থেকে ফ্ল্যাট নেয়া যাবে, এবং এই মুহুর্তে মাত্র একটি ফ্ল্যাট খালি আছে। রেল স্টেশনের পাশে পুরনো ছয় তলা বিল্ডিঙয়ের টপ ফ্লোরে দুই কামরার বাসা, যার জানালা সিলিং এ লাগানো বলে ওপর দিকে খোলে (ত্রিকোন ছাদ আর কি)। জানালা খোলা রাখলে অনবরত ট্রেন যাওয়া আসার শব্দ পাই, বলাই বাহুল্য স্টেশনের লাগোয়া বলে ট্রেনের ব্রেক কষার শব্দ দাঁত, আলজিহ্বা, ঘিলু সবই নাড়িয়ে দেয়। আর যদি বন্ধ রাখি প্রচন্ড গরমে অস্থির হয়ে যাই। সুইজারল্যান্ড মানেই বরফে ঢাকা শীতের দেশ এই মর্মে যে ভুল ধারণা ছিল একদিনেই তা দূর হয়ে গেল, জুলাই মাসের শুরু বলে চরম গরম, দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা পঁয়ত্রিশ ডিগ্রী সেলসিয়াসে গিয়ে ঠেকেছে। এদিকে কোন এক বিচিত্র কারণে প্রতিদিন গভীর রাতে বৃষ্টি হওয়া শুরু করেছে, উল্লম্ব ভাবে খোলা জানালা দিয়ে অনায়াসে গ্যালন খানিক পানি ভেতরে চলে আসে ঘুম থেকে উঠে জানালা বন্ধ করার আগেই। গরম ঠান্ডার যুগপৎ চক্করের সাথে যোগ হলো অজানা ভাইরাসের আক্রমন, দুই তিন দিনেই আমার ছেলে প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়ল। মুখের ভেতরটা, জিহবা ছড়ে গিয়ে কিছু খেতে পারত না, আবার দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত গড়াতো, পানি খেতে দিলেও বলে ঝাল লাগছে, আমরা দিশেহারা হয়ে পড়লাম। না খেলে বাঁচবে কি করে?
এই দেশে ডাক্তার নামে এক অদ্ভুত সম্প্রদায় আছে, যারা রোগীকে ওষুধ না দিতে পারলে কৃতার্থ হয়। আমরা যখন প্রথমবার ছেলেকে নিয়ে গেলাম, ডাক্তার বেশ অনেকক্ষন সময় বসিয়ে রেখে (ইমার্জেন্সী পেশেন্ট হিসেবে গিয়েছিলাম) এবং আরো অনেক সময় নিয়ে রোগী দেখে ঘোষনা করলেন, রোগীর কিছু হয় নি, কয়েকদিন গেলেই ঠিক হয়ে যাবে। দুটি ওষুধের নাম করে বললেন, জ্বর আসলে কিংবা গলায় ব্যাথা করলে খাওয়াতে। ছড়ে যাওয়া মুখ আর রক্তক্ষরণের কোন ওষুধ নাকি প্রয়োজন নেই। এক সপ্তাহ পর অবস্থার উন্নতি না দেখে আবার নিয়ে গেলাম, একই কাহিনী শুনলাম। পরের সপ্তাহে আবার গেলাম, এবার ডাক্তার বেশ রেগে গিয়ে বললেন, এইবারই শেষ, নতুন কোন সমস্যা না হলে আমাদের কাছে আসবে না। আমি তাকে মনে করিয়ে দিলাম যে চার থেকে সাত দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবার কথা বলেছিলেন, ষোল দিন পার হয়ে গেছে তাও অবস্থা ভালো হয় নি, তিনি কি মনে করেন না আগের ডায়াগনোসিস ভুল ছিল? ওনার জবাব, “না”। দেখতে থাকো। হাসপাতালের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে করতে আরো এক সপ্তাহ পার করলাম, এবং লক্ষ্য করলাম ধীরে ধীরে ঘা গুলো শুকিয়ে আসছে, মাড়ি থেকে রক্তও পড়ছে না তেমন। আমি নিশ্চিত উপযুক্ত ওষুধ পেলে আরো আগে পরিস্থিতি ভালো হতো, কিন্তু সে কথা তাদেরকে বলে সাধ্যি কার?
(চলবে)
ইয়াসির
মন্তব্য
ইংরেজীতে কথা বলতে না জানলেই যে আনস্মার্ট হয়ে যায় না, এইটা যদি আমাদের দেশের লোকজনও বুঝতো
ডাক্তাররে পছন্দ হইছে।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
যা বলেছেন নজরুল ভাই, এটা কিছু বাংলিশ পোলাপানের মাথায় পিটিয়ে ঢুকাতে পারলে বেশ হতো।
ডাক্তাররে পছন্দ হয় নাই, মহিলা বলে মেজাজ দেখাই নাই, চুপচাপ শুনে গেছি।
কোথায় থাকেন আপনি?
আমি জেনেভা আছি। সুইজারল্যান্ড নিয়ে অনেক গুলা লেখা আছে আমার ব্লগেঃ [এখানে দেখেন]
আসেন একদিন জেনেভা, আড্ডা দেই আমি ডাউন টাউনে থাকি রেল ষ্টেশন থেকে পায়ে হাটা পথ
আরে আপনাকেই তো খুঁজছি। আপনার লেখা পড়েছি চারটা। আপনি তো বেশ জমিয়ে ফেলেছেন, আর আমি এখনো অভিযোজিত হতে পারি নি। তাই মনের দুঃখে লিখে ফেললাম কাহিনীটা।
আমি থাকি লুজানে। জেনেভা আসার প্ল্যান আছে কাছাকাছি সময়ে। কাউকে চিনি না দেখে যাওয়া হয় না এমনিতে। ঠিকানা এসএমএস করে দিয়েন, ফোন নম্বরটাও পেয়ে যাব (০৭৯৭৯২৬৪০১)।
ইয়াসির
ভালো লাগলো।
------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল
অসংখ্য ধন্যবাদ
পড়ছি।
খুবই উৎসাহ পেলাম!
আমারও আগে আম্রিকা নাম শুনলে একটু শীত শীত ভাব হতো। অগাস্ট মাসের গরমে ডালাস নেমে প্রথম হয়েছিলো, কই আইলাম! এতো পুরাই সাহারা মরুভূমি
টপ ফ্লোর বলে বাসার রুমগুলো ওভেনের মতো হয়ে থাকতো সময় সময়। অফিসের ঠিক করা অ্যাপার্টমেন্ট, ওদেরকে জানাতে ওরা বলল, এখন চেঞ্জ করা সম্ভব নয়, এখানে এক মাসের কমে বাসা ভাড়া পাওয়া যায় না (ভুল কথা, আমাকে নতুন পেয়ে যা খুশি তাই বুঝিয়েছে), তুমি আগামী মাসে আরেকটা বাসা দেখো। কি বাজে সময়ই না গিয়েছে।
পড়া এবং মন্তব্যের জন্য
দারুণ লাগলো। চলতে থাকুক। মাহমুদ ভাই-এর মাধ্যমে ইতিমধ্যে সুইজারল্যান্ড সম্পর্কে জানতে শুরু করেছি বাঙালির চোখে। আপনারটা অভিজ্ঞতা যুক্ত হলে আরো ভালো লাগবে।
টুইটার
এইরকম উৎসাহ পেতে থাকলে লেখা চালিয়ে যাব কোন সন্দেহ নেই। ষোল আনা বাঙালি দৃষ্টিভঙ্গী আমার, তাই নিয়ে কত কি ঘটে গেল! অসংখ্য ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
চলুক । চলুক।
একটা নতুন দেশ দেখা হোক।
লেখা ভাল লাগছে।
ভারমুক্ত হলাম। সংশয়ে সংকল্প সদা টলে, পাছে লোকে কিছু……….
আপনার ভালো লেগেছে জেনে আমারও ভালো লাগছে। আশা রাখি পরের অংশ নিয়ে দ্রুতই হাজির হব।
আপনার অভিজ্ঞতা তো ব্যাপক খারাপ দেখছি, আমি ঠান্ডার সময় গিয়েছিলাম অসাধারন লেগেছিল।পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
আপনার সাথে একমত, ঠান্ডার সময়ে বেশ ভালো লাগে জায়গাটা, কিছু কিছু জায়গা তো সব সময় সুন্দর। পরের পর্বটাতে কিছু ক্ষোভের কথা এসে গিয়েছে, জানি না কেমন লাগবে আপনার। পাঠক যদি গ্রহন করে, চালিয়ে যাব। পড়ার জন্য
পড়ছি, দৌড়ে চলুক। অপেক্ষাইলাম।
অসংখ্য ধন্যবাদ
আমি সুইজারল্যান্ডে আছি চার বছর। আপনার প্রথম দিকের তিক্ততা সময়ের সাথে চলে যাবে বলে আশা করছি। থাকুন,দেখবেন চমৎকার দেশ এটি !
চার বছর টিকতে পারলে মনে হয় যাবে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে না চলে গিয়ে আরো বাড়ছে, সবে দশ মাস হলো কিনা। আপনার অভিজ্ঞতা সুখের বলে আমি আনন্দিত। দেয়ার মাস্ট বি সাম লাইট অ্যাট দি এন্ড অফ দা টানেল
আপনি কি টেলিকমে চাকরি করছেন নাকি অন্য কোথাও? আমি তো জানতাম ইউরোপে ওয়ার্ক পারমিট ভিসা পাওয়া খুব কঠিন ।
আমি একটা টেলিকম কম্পানিতে আছি, পারমিট ওরাই যোগাড় করে দিয়েছে।
স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় শরীর কে সুস্থ হতে দিলে তার শক্তি সামর্থ যাচাই করার সুযোগ মিলে। যেমন ব্যাটরি তে চার্য দেয়ার আগে তার অন্তত ৮০% শেষ করে দিতে হয় তা না হলে তার চার্য নেয়ার ক্ষমতা দিনে দিনে কমতে থাকে।
হুমমম। আমাদের ডাক্তারদের হাতে কলমের কালি শুকায় কিন্তু ঔষধের পরিমান কমানো যায় না।
মন্তব্য ভালো লেগেছে
নতুন মন্তব্য করুন