এখন সারা বাংলাদেশ জুড়ে চলছে বৈশাখকে বরণের প্রস্তুতি। ইতিমধ্যেই কালবৈশাখী ঝড় নতুনের কেতন ওড়াতে শুরু করেছে। সব ধর্মের, সব গোত্রের, সব শ্রেণীর মানুষের ভিতর বয়ে যাচ্ছে উতল আনন্দ হিল্লোল, শুরু হয়েছে নববর্ষ উদযাপনের মন মাতানো মহড়া। আস্তে আস্তে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে পান্তা-ইলিশ-ঢাক-ঢোল-নাচ-গানে মাতোয়ারা হওয়ার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
পহেলা বৈশাখের অনুষঙ্গগুলোর ভিতর পান্তা বরাবরই আমার আগ্রহের বিষয়। এখন বোধহয় একটা বাড়িও পাওয়া যাবে না, যেখানে নববর্ষের দিন পান্তার আয়োজন হয় না। কিন্তু আমাদের বাড়িতে পহেলা বৈশাখে পান্তা খাওয়ার চল শুরু হয়েছে অনেক পরে অনেকটা বাইরের প্রভাবে। তাহলে কি আমাদের পরিবারে পহেলা বৈশাখ উদযাপনও শুরু হয়েছে বাহিরের প্রভাবে? না, তা কিন্তু নয়। জ্ঞান হবার পর থেকেই বাড়িতে পহেলা বৈশাখের দিন দেখে আসছি বিভিন্ন ফল, মিষ্টি, ইলিশ মাছ প্রভৃতির ব্যাপক আয়োজন। তাহলে পান্তা কেন অনুপস্থিত ছিল সেখানে? তবে কি পান্তা নামক খাদ্যটির সাথে পরিচিত ছিল না আমাদের পরিবার? না, তাও নয়। আমার মনে আছে বার্ষিক পরীক্ষার পর যখন শীতে গ্রামের বাড়ি যেতাম, পান্তাভাত খাওয়া ছিল দাদী-নানীর কাছে অনেকগুলো আবদারের একটি।
আসলে পান্তার সাথে পহেলা বৈশাখের সংযোগটি অন্যদের দেখে শেখে আমাদের পরিবার। কিন্তু এই যে সংযোগের কথা বলা হল, তা কি তাহলে আরোপিত? শহুরে আবিষ্কার? পহেলা বৈশাখের দিন পান্তা খাওয়া নিয়ে অনেক কথাবার্তা চালু রয়েছে সমাজে; অনেক নেতিবাচক কথাও রয়েছে তার মধ্যে যার কিছু তুলে ধরছি নীচে:
(১)পান্তা বাঙ্গালির পয়লা বৈশাখের ঐতিহ্য নয়। আবহমানকাল থেকেই পয়লা বৈশাখের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
(২)পান্তা বাংলার কৃষকের দারিদ্রের প্রতীক। রাতে খাবার পর অতিরিক্ত ভাত পচে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতেই তারা তা পানির ভিতর ভিজিয়ে রাখত এবং পরের দিন শুকনো মরিচ দিয়ে ঐ ভাতের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করত।
(৩)বাঙালি রমণীরা তাদের পরিবারের জন্য এইদিন অন্তত তাদের নিত্যনৈমিত্তিক খাবারটির পরিবর্তে বরং সামর্থ্য অনুযায়ী কিছুটা ভাল খাবারের ব্যবস্থা করত। খই, মুড়ি, খিচুড়ি, রুই, কই প্রভৃতির আয়োজন থাকত ঘরে ঘরে।
(৪) গ্রামের মানুষ কখনো ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা খায় না। শহরে যারা এমন খাবারে খায়, তারা গ্রামীণ সংস্কৃতি ও কৃষকের জীবনযাত্রা সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ।
(৩)পয়লা বৈশাখের মূল উৎসব পূন্যাহ, হালখাতা প্রভৃতিতে উন্নতমানের খাবার খাওয়া হয়, পান্তা নয়।
(৪) পান্তা উৎসব শহুরে বাঙ্গালির (অন্য কথায় পেটি বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত বাঙালি) নব্য আবিষ্কার, তাদের ফ্যাশন।
(৫)পান্তার মাধ্যমে আমাদের দারিদ্র্যকে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে।
(৬)বাণিজ্য করার জন্য বৈশাখের অনুষ্ঠানে পান্তা ঢোকানো হয়েছে।
উপরের কথাগুলোর সারসংক্ষেপ করলে যা দাঁড়ায়, তা হলো, প্রথমত: পান্তার সাথে পহেলা বৈশাখের কোন সম্পর্ক নেই, দ্বিতীয়ত: শহুরে ধনী মধ্যবিত্ত সমাজের আবিষ্কার, যাতে ব্যবসায়িক অনুষঙ্গ ঢোকানো আছে সযত্নে। এখন এই বিষয়গুলো নিয়ে একটু নেড়েচেড়ে দেখা যাক।
প্রথম কথা হচ্ছে, পান্তার সাথে সত্যি কি নববর্ষের সম্পর্ক নেই? বইপত্র ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, কথাটা সত্য নয়। পান্তার সাথে বেশ ভাল রকম সম্পর্কই আছে পহেলা বৈশাখের। এক সময় ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল ‘আমানি’, তবে তা ছিল সমারোহহীণ। আমানি সম্পর্কে ডক্টর মহম্মদ এনামুল হক তার মনীষা মঞ্জুষা গ্রন্থের তৃতীয় খন্ডে বিশিষ্ট চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক খান আতাউর রহমান প্রদত্ত একটি বর্ণনা তুলে ধরেন, যা আবার ১৯৭০ সনের ২রা মে তারিখের ‘পাকিস্তান অবজারভার’ নামক ঢাকার ইংরেজী দৈনিকে ‘জয় বাংলা’ শীর্ষক পত্রে প্রকাশিত হয়। বর্ণনাটি নিম্নরূপ:
‘’চৈত্রি-মাসের শেষ দিনের (অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তির শেষ দিনগত রাত্রে) সন্ধ্যায় গৃহিণীরা এক হাঁড়ি পানিতে স্বল্প পরিমাণ অপক্ক (আম) চাউল ছে’ড়ে দিয়ে সারাটি রাত ভিজতে দেন এবং তার মধ্যে একটা কচি আমের ডাল বসিয়ে রাখেন। ‘পয়লা বৈশাখের’ ভোর বেলায় সূর্যোদয়ের পূর্বে ঘুম থেকে উঠে তারা (গৃহিণীরা) ভিজা চাল গৃহের সকলকে খেতে দেন। ঘরের সবাই মিলে অথবা একে একে তা খেতে থাকে; আর হাঁড়িতে ডোবা আমের শাখা দিয়ে গৃহিণীরা সকলের গায়ে পানি ছিটাতে থাকেন। তাঁদের ধারণা - এতে ক’রে গৃহে নতুন বছরের শান্তি নেমে আসবে।‘’
এনামুল হকের লেখা থেকে আরও জানা যায় যে, শ্রদ্ধেয় খান আতা সাহেব নাকি অতি ধার্মিক পরিবারেও এই পান্তা পর্ব পালিত হতে দেখেছেন। এনামুল হক নিজেও বাংলার কয়েক জেলার চাষিকে বৈশাখ মাসে পান্তা খেয়ে মাঠে যেতে দেখেছেন। এমনকি চট্টগ্রামের অনেক চাষি নাকি বৈশাখ মাসের সকালে এক মুঠো চাল ও ঠাণ্ডা পানি খেয়ে চাষবাসে বেরোয়, যাকে এনামুল হক ‘আমানির’ অন্য আরেক সংস্করণ মনে করেন। এই চাষীরা নাকি জানিয়েছেন, এরকম খাবারে তাদের শরীর ঠান্ডা থাকে। আতোয়ার রহমানের ‘লোককৃতি কথাগুচ্ছ’ গ্রন্থেও উল্লেখ রয়েছে আমানি সম্পর্কে:
‘’বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে আমানি নামে একটি উৎসব প্রচলিত আছে। তারও শুরু বিষুব সংক্রান্তিতে। কিন্তু মূল উৎসবটি হয় বৈশাখ মাসে, বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি পান্তা খেয়ে মাঠে চাষ শুরু করবার মাধ্যমে। এ-উৎসব পুরোপুরিই কৃষিভিত্তিক।‘’
তাহলে দেখা যাচ্ছে, পান্তা বাঙ্গালির পয়লা বৈশাখেরই ঐতিহ্য আবহমানকাল থেকেই। এটি শুধু দারিদ্র্যের অনুষঙ্গ নয়, সংস্কারগত আখ্যানও এখানে প্রবলভাবে অস্তিত্তমান। তবে এটা ঠিক যে, শহুরে বাঙ্গালির পান্তা খেয়ে বৈশাখ বরণ করাটা একটি নতুন সংযোজন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রমনার পান্তা উৎসবের (যা অনেক পরে আমাদের পরিবারের মত আরও অনেক পরিবারকে উদ্বুদ্ধ করেছিল) মূল উদ্যোক্তা হলেন দৈনিক জনকণ্ঠের সাংবাদিক বোরহান আহমেদ। সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল এ সম্পর্কে জানাচ্ছেন,
‘’১৯৮৩ সাল। চৈত্রের শেষ। চারিদিকে বৈশাখের আয়োজন চলছে। আমরা আড্ডা দিতে পান্তা-ইলিশের কথা তুলি। বোরহান ভাই রমনা বটমূলে পান্তা-ইলিশ চালুর প্রস্তাব দিলেন, আমি সমর্থন দিলাম। ফারুক মাহমুদ পুরো আয়োজনের ব্যবস্থা করলেন। সম্ভবত ৫ টাকা করে চাঁদা ধরলেন। বাজার করা আর রান্না-বান্নার দায়িত্ব দিলেন বিপ্লব পত্রিকার পিয়নকে। রাতে ভাত রেঁধে পান্তা তৈরি করে, কাঁচামরিচ-শুকনো মরিচ, পেঁয়াজ, ইলিশ ভাঁজা নিয়ে পর দিন ‘এসো হে বৈশাখে’র আগেই ভোরে আমরা হাজির হলাম বটমূলের রমনা রেস্টুরেন্টের সামনে। মুহূর্তের মধ্যে শেষ হলো পান্তা-ইলিশ। এভাবে যাত্রা শুরু হলো পান্তা ইলিশের।‘’
উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, কোন ব্যবসায়িক মতলবে বা দারিদ্যকে ব্যঙ্গ করার মানসিকতা নিয়ে পান্তা উৎসবের সূচনা হয়নি, বরং প্রাণের তাগিদে, ভালবাসার টানে আর শেকড়ের সন্ধানে এমন নাগরিক উদ্যোগ বিরল নয় এবং অযৌক্তিকও নয়। আমরা আমাদের সংস্কৃতির অনেক হারিয়ে যাওয়া উপাদানকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছি না? আমাদের যাত্রা শিল্প, পুতুল নাচ, বিভিন্ন মেলা প্রভৃতি এখন পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় ও অনেক ধনাঢ্য নাগরিকদের অর্থানুকূল্যে। একে ক্ষতিকর ভাবার আপাত কোন যুক্তি নেই আমার মতে।
সবচেয়ে বড় কথা, পহেলা বৈশাখে নববর্ষ উদযাপনের রীতিতেও কিন্তু বিদেশী ছায়া আছে। কারণ বৈশাখ সর্বদাই বছরের প্রথম ঋতু ছিল না, বছরের শুরুতে, মাঝামাঝি এবং কখনো কখনো বছরের শেষেও এটি অবস্থান নিয়েছে। তাই বলে আবার এটা কিন্তু নয় যে, বাংলাদেশে নববর্ষের কোন দেশজ রেওয়াজ নেই। মহাব্রত, বৈশাখী ব্রতসহ অনেক লৌকিক অনুষ্ঠানের কথা জানা যায় যেগুলো নববর্ষের অনুষ্ঠান এবং বিষুব সংক্রান্তিতে শুরু হলেও শেষ হত বৈশাখে। আজকের পহেলা বৈশাখ পরিবর্তিত, এখানে যোগ হয়েছে দূরের আর কাছের অতীতের অনেক অনুষঙ্গ। আজকের পহেলা বৈশাখ একুশে ফেব্রুয়ারির মতই আমদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম দান। আমাদের দেশজ মাটির স্বাদ এতে রয়েছে, সঙ্গে রয়েছে আমাদের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। তাই আজকের পহেলা বৈশাখ একান্তই আমাদের, এর অনুষঙ্গগুলোও।
সুতরাং, আসুন পান্তা নিয়ে আমাদের সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলি। আমাদের বৈশাখের এই অনবদ্য অনুষঙ্গকে মনের তৃপ্তি মিটিয়ে উপভোগ করি। দেশের সংস্কৃতিতে আপাদমস্তক নিমজ্জিত করি নিজেদের এবং এক স্বাস্থ্যকর বাতাবরণে বিকশিত করি নিজেদের দেহ ও মনকে।
কাজি মামুন
০৭.০৪.২০১২
ইমেইল আইডিঃmdkazimamun@yahoo.com (প্রদর্শনে অনিচ্ছুক)
তথ্যসূত্র:
১.বাংলা নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ, ডক্টর মহম্মদ এনামুল হক, মনীষা মঞ্জুষা (৩য় খণ্ড)
২.বৈশাখ, লোককৃতি কথাগুচ্ছ, আতোয়ার রহমান
৩.রমনা বটমূলে পান্তা-ইলিশের সূচনা, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, arts.bdnews24.com
৪.পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশ শহুরে বাঙ্গালির আবিষ্কার, বাস্তব, www.bdtodaynews.com
৫.পান্তা, বৈশাখ এবং দারিদ্র্যের উদযাপন, অমিয় উজ্জ্বল
৬. উইকি
মন্তব্য
খাওয়া হয়নি কখনো,একবার অন্তত খেয়ে দেখতে হবে
বৈশাখের পান্তা উৎসব নিয়ে অনেক নেতিবাচক (আমার মতে পানসেমি ) কথা শোনা যায়, যেমনঃ বৈশাখের সাথে পান্তার সম্পর্ক কোনকালে ছিল না, এর মাধ্যমে আমাদের কৃষকদের দারিদ্র্যকে অপমান করা হয় ইত্যাদি। কিন্তু বই-পথ ঘেঁটে দেখলাম বৈশাখে পান্তার বেশ ভাল রকমের ঐতিহ্যই রয়েছে, যা অন্য অনেক বিলীন হওয়া সাংস্কৃতিক উপাদানের মতই আদর করে বরণ করে নিয়ে আজকের নাগরিক সমাজ, যার ভিতরে দারিদ্র্যকে অপমান নয়, বরং নিজের মাটির প্রতি সংবেদনশীলতার বহিঃপ্রকাশই দেখতে পাওয়া যায়।
মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ। পান্তা খেয়ে দেখুন, বেশ অন্য ধরণের এক স্বাদ পাবেন। তপ্ত বৈশাখে দেহ-মন শীতল করা এক অনুভূতির সন্ধান পেতে পারেন। ভাল থাকবেন।
বড়লোকদের বাড়ির কথা বলছেন? যারা বছরে একবার শখ করে পান্তা খায়? নাকি দেশের ৯০% মানুষ যারা সারা বছরই সকালে পান্তা খেয়ে দিন শুরু করে তারা?
আমি প্রত্যেক পহেলা বৈশাখে গ্রামে যাই। ওখানে শহুরে পহেলা বৈশাখের উৎসবের কোন ছোঁয়া দেখিনি। পান্তা তো অনেকরই সকালের খাবার। কিন্তু পহেলা বৈশাখে আলাদা করে পান্তা খাবার কথা শুনলে ওরা শহুরে মানুষের বোকামিতে হাসে। আর ইলিশ এমনিতেই দূর্মূল্য বহুবছর থেকে, সাধারণ মানুষের নাগালের অনেক বাইরে। এপ্রিল মাস আসলে তো সেই দাম আকাশ ছুয়ে যায়। দরিদ্রদের তাই পান্তা ইলিশের উৎসবে কোন স্থান নেই। পার্কে গিয়ে পান্তা ইলিশ দিয়ে নববর্ষ বরণ করার যে সংস্কৃতি সেটা কেবলই শহুরে বড়লোকী সংস্কৃতি।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
লেখাটা পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া।
আসলে নববর্ষের পান্তার কথা বলেছি, গ্রাম-বাংলার দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত মানুষের পান্তা খাওয়ার কথা বলা হয়নি এখানে। আমি দেখাতে চেয়েছি পহেলা বৈশাখের সাথে পান্তার যে ঐতিহ্যগত সম্পর্ক ছিল তার কথা। আমার উদ্ধৃত ব্লগগুলিতে দেখবেন,তারা সরাসরি অস্বীকার করেছে যে পহেলা বৈশাখের সাথে পান্তার কোন ন্যুনতম সম্পর্কের কথা। অথচ লোক ও সমাজ গবেষকরা কিন্তু বলছেন, সম্পর্ক ছিল।
এখন হয়ত দরিদ্র পরিবারগুলোই পান্তা খায়; তাও বৈশাখ উপলক্ষে নয়, প্রতিদিনই। কিন্তু আমার লেখাটিতে দেখিয়েছি, দারিদ্র্যের কারণে নয়, সংস্কার-গত কারণে বৈশাখে পান্তার চল ছিল। এমনকি অনেক কৃষক পরিবার দেহ ঠাণ্ডা রাখার জন্য পান্তা খেয়ে চাষাবাদে যেত। এটি তখন দারিদ্র্যের অনুষঙ্গই ছিল কেবল, তা বলা ভুল হবে। এটির সাথে সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক সংস্কার জড়িত ছিল।
আমি শুধু পান্তার কথা বলেছি, কারণ ইলিশ মিশ্রিত পান্তার সাথে বৈশাখের ঐতিহ্যগত সংযোগ বা ইতিহাস আমি কোথাও পাইনি। তবে এটি আমার একান্তই ব্যক্তিগত অনুমান- যে অতীত যুগের ঐতিহ্যের কথা বলা হচ্ছে, সে সময় হয়ত ইলিশ এত দুর্লভ ছিল না কৃষকদের জন্য।
আমি আগেই বলেছি, পহেলা বৈশাখে শুধু সংস্কার-গত কারণে পান্তা খাওয়ার ঐতিহ্য ছিল বাংলায়। হয়ত এখন সেটি নেই, এখন শুধু দরিদ্র হলেই মানুষ পান্তা খায়, দারিদ্র দূর হলে পান্তাকে এমনকি বৈশাখেও আর খায় না গ্রামের মানুষ। কিন্তু আমরা কি আমাদের হারানো ঐতিহ্য, সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের কথা বলি না? আর এতে দোষই বা কোথায়? প্রত্যেকটা জাতিই এটি করে, কারণ প্রত্যেক জাতিরই রয়েছে শেকড়ের টান, শেকড় সন্ধান একটি অতি স্বাভাবিক মানবিয় ব্যাপার। আপনি যদি বৈশাখের সাথে জড়িত পান্তার আদি ঐতিহ্যকে নাগরিক সমাজের বরণ করে নেওয়াকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেন, তাহলে আপনার বা আমার আর উচিত হবে না টিএসসি চত্বরে বা শহরের অন্য কোন প্রান্তে জারি, সারি আর বাউল গান শোনা; উচিত হবে না নাগরদোলায় চড়া, উচিত হবে না যাত্রা উপভোগ করা, কি বলেন?
আমি নিজে কোনদিন খেয়ে দেখিনি।
দেখতে হবে।
আমাদের এখানে পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার চল নেই।
হালখাতা মানে আমাদের এখানে অনেক অনেক মিষ্টি।
আর গ্রামের মানুষের কাছে ইলিশ এমনিতেই দূর্লভ। সেক্ষেত্রে তাঁরা কোনদিন ইলিশ খেলে তা সরষে ইলিশ বা ওরকম কিছু হওয়াটাই স্বাভাবিক বলে মনে হয়।
অনেকদিন পর এই গরিবের ব্লগে আপনাকে দেখে অসম্ভব ভাল লাগছে, প্রদীপ্তদা।
পহেলা বৈশাখে পান্তা খাওয়ার ঐতিহ্য ছিল; কিন্তু পান্তা-ইলিশ একেবারেই নাগরিক সংস্কৃতি, যেখানে পান্তার ঐতিহ্যের কিছু পরিবর্ধন ঘটেছে এবং ঘটতেই পারে। কারণ এভাবেই সংস্কৃতি পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও বিবর্তিত হয়।
ছোটবেলায় আমার ধারণা ছিল, পহেলা বৈশাখে ভারতের বাঙালি সমাজ আমাদের দেশের চেয়ে বেশী সাড়ম্বরে পালন করে, যেহেতু এর সাথে সেখানে যুক্ত হয়ে থাকে ধর্মিয় অনুষঙ্গ। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের টিভি চ্যানেলগুলোর খবরে যা পাই, তা হলো এমনকি দোল উৎসব সেখানে অনেক বেশী সাড়ম্বরে পালিত হয়, যেখানে পহেলা বৈশাখ একটি নির্ভেজাল ছুটির দিন ছাড়া তেমন কিছু নয়। তাই জানতে মন চাইছে, আপনাদের প্রদেশে কিভাবে পালিত হয় বাংলা নববর্ষ? কেমন উৎসাহ দেখা যায় মানুষের মাঝে? আপনাদের পহেলা বৈশাখ উদযাপন নিয়ে একটা লেখা দিন না, প্রদীপ্তদা ! অনুরোধ থাকল।
আসলে আমার সিরিজ নিয়ে আমি এমন চাপে যে অন্য লেখা ভাবার সময়ই পাচ্ছি না।
কতরকম পোষ্ট ছাড়ার যে প্ল্যান করি, আর হয়ে উঠছে না।
আর আমাদের এখানে পয়লা বৈশাখ বাংলাদেশের চেয়ে বড় করে পালন হয় না। এটা ঠিক। আসলে ধর্মের চাইতেও ভাষা এখানে অনেকটা বেশি গুরূত্বপূর্ণ। বাঙালী হসেবে গর্বিত হবার ব্যাপারটা এখানে অনেকাংশে কমে গেছে। এটা দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি।
তবে আমাদের গ্রামবাংলা আর মফস্বলগুলো এখনও ধরে রেখেছে হালখাতার সংস্কৃতি।
যেমন আমাদের পরিবারে দূর্গাপুজো বাদে যে সময়টাতে অবশ্যই বাড়িতে যাওয়া, নতুন জামা-কাপড় কেনা, ভাল খাওয়া-দাওয়া করা এসব হয় তা এই পয়লা বৈশাখ। দোকানে দোকানে গিয়ে মিষ্টি খাওয়া, মন্দিরে পুজো দেওয়া, নতুন জামা-কাপড় পরা, গুরুজনদের প্রণাম করা, এসব মিলিয়ে বেশ ভালই কাটে পয়লা বৈশাখ। আর এই উপলক্ষ্যে চৈত্র মাসে চলে সবজায়গায় চৈত্র-সেল। যেমন আমি এই শুক্রবার অফিস ছুটি নিয়ে কোচবিহারের তুফানগঞ্জে আমার বাড়িতে যাচ্ছি। সোমবার ফিরব। এটা কিন্তু এই উপলক্ষেই।
আর আমি এত ঝামেলাতে ছিলাম যে আপনার লেখাগুলো মিস করে গেছি। তাই বলে নিজেকে গরীব বলে আমাকে লজ্জা দেবেন না।
একবার লিঙ্কগুলো দিন না আমার মেইল এ। অবশ্যই পড়ব। কথা দিলাম।
pradiptamay1 অ্যাট জিমেইল ডট কম্ ।
কিন্তু মামুন, আপনার সূত্র আপনার বক্তব্যের সপক্ষে দাঁড়াচ্ছে না তো !
চৈত্র সংক্রান্তিতে চাল থেকে তৈরি খাবার (যেমন পিঠা) খাওয়ার সংস্কৃতি রয়েছে বাঙালি সমাজে।
চৈত্রের শেষ রাতে কাঁচা চাল ভিজিয়ে খাওয়া আর পান্তা ভাত খাওয়া এক কথা মনে হচ্ছে কি?
হতে পারে '৮৩ সাল থেকে রমনায় পান্তা-ইলিশ খাওয়ার চল শুরু হয়েছে। আমি বালকবেলায় '৮৬/'৮৭-তে
রমনায় গিয়ে তেমন হুজুগ দেখিনি। হুলুস্থুল শুরু হয় মধ্য '৯০-তে এসে।
মোক্ষম যুক্তি, নিলয়দা। তবে বৈশাখে পান্তার আদি ঐতিহ্য যা 'আমানি' নামে পরিচিত তা যে শুধু কাঁচা চাল ভিজিয়ে খাওয়া থেকে উদ্ভব হয়েছে, তা নিয়ে কিন্তু বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত নন। ডক্টর এনামুল হকের মতে 'আমানি' শব্দের উদ্ভব হয়েছে 'আমপানীয়' (যার অর্থ অসিদ্ধ চাউল জাত জল) হতে অথবা 'অম্লপানীয়' (যার অর্থ সিদ্ধ চাউলজাত টক পানীয় বা পান্তাভাতের পানি বা কাঁজি) হতে। দ্বিতীয় অর্থটি সম্পর্কে এনামুল হক লিখেছেনঃ
সুতরাং, বৈশাখে পান্তা ভাতের ঐতিহ্যকে একেবারেই উড়িয়ে দেয়া সম্ভব নয়।
কিন্তু এই চলটা কি খুব ক্ষতিকর হয়েছে আমাদের সমাজের জন্য অথবা গ্রাম-বাংলার দারিদ্র্যকে উপহাস করা ছাড়া এখানে কি আর কোন ভালবাসা বা টান খুঁজে পাওয়া সম্ভব না? নগর বাউল কি তাহলে অগ্রহণযোগ্য? ধরুন আমি মনের সুখে একটা একতারা নিয়ে বাউলের পোশাক পরে গান গেয়ে বেড়ালাম পহেলা বৈশাখে। এখন আমরা তো সবাই জানি, গ্রাম-বাংলার সঙ্গীত সাধকদের একমাত্র বাদ্যযন্ত্র ছিল এই সহজ একতারা, এরচেয়ে জটিল ও খরুচে বাদ্য যন্ত্র যোগাড় করা তাদের পক্ষে হয়ত সম্ভব ছিল না। এবং এখনো হয়ত সেই আর্থিক সামর্থ্য গড়ে উঠেনি এবং তা নিয়ে তারা চিন্তিতও নন যেহেতু তাদের রয়েছে অফুরন্ত সঙ্গীত সম্পদ। এখন আপনারা কি বলবেন, আমি একতারা হাতে নিয়ে গান গেয়ে বাংলার বাউলের দারিদ্র্যকে ব্যঙ্গ করেছি? আমি কিন্তু বাংলার বাউল, ঐতিহ্য আর শেকড়কে ভালবেসেই হাতে তুলে নিয়েছি একতারা।
মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ নিলয়দা।
আমাদের বাড়িতে বৈশাখের প্রথম দিন ঘটা করে পান্তার আয়োজন করা হয় না। কিন্তু আমরা কি পান্তা খাই না? খাই। একটা সময় ছিলো যখন আমাদের বাড়িতে ফ্রিজ ছিলো না। তখন মাঝে মধ্যেই পানি দেওয়া রাতের বেঁচে যাওয়া ভাত খেতাম সকালে। টালা শুকনো কড়কড়ে মরিচ আর কুচিকুচি করা লাল পেঁয়াজ দিয়ে মাখিয়ে।
নববর্ষও পালিত হতো আমাদের বাড়িতে। সেদিন ভালো মন্দ খাওয়া চলতো। পিঠা-ল্যাঠা, ক্ষীর-পায়েস এগুলো থাকতো। নববর্ষ যে, সেটা টের পেতাম মায়ের 'বছরের প্রথম দিন, আজকা কিছু কমু না' ঘোষণায়! বছরে গুনে গুনে চারটা দিন এইরকম ঘোষণা দেয়া ইনডেমনিটি পেতাম। বাংলা নতুন বছরের দিন, আংরেজী নতুন বছরের দিন আর দুই ঈদের দিন। এর বাইরে জন্মদিন-মৃত্যুদিন কিছুই বুঝার উপায় ছিলো না। পান্তা যেমন পৌষ, আশ্বিন, চৈত্র আর শ্রাবণ মাসের যেকোনো দিনে কোনো আয়োজন ছাড়াই খেতাম, তেমনি মায়ের হাতের কিটি সাইজও খেতাম বছর জুড়েই।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
আমাদের বাড়িতেও হতো না; বরং ভাল খাবারের আয়োজন থাকত। কিন্তু এখন নববর্ষের সকালে বাড়িতেই পান্তা খেতে পারি; যেহেতু অন্য অনেক বাড়ির মত আমাদের পরিবারেও এই নাগরিক সংস্কৃতিটির প্রবেশ ঘটেছে এবং যাতে আমি মন্দ কিছু খুঁজে পাই না।
ইংরেজী নবববর্ষের দিনটি ছাড়া বাকী দিনগুলো আপনার সাথে মিলে গেছে গোধূলি ভাই।
মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ! ভাল থাকবেন।
নতুন মন্তব্য করুন