বোশেখ এসে কড়া নাড়ছে স্মৃতির দরজাটা একটু খুলি? যখন দেশটাও ভিন্ন ছিল, সেই সময়ের কথা। মানুষ জন ছিল কম। গাছ-গাছালি, পাখ-পাখালি ছিল অনেক। কোকিলের ডাক ছিল, পাতাবিহীন ফুলে ফুলে রঙ্গীন সাজের শিমুল গাছ ছিল, বাবুই পাখির বাসা ঝোলানো তাল গাছ ছিল অনেক। আম, জাম, কাঁঠালের বাগান আর টল টলে পুকুর ছিল। পুকুর ঘাটের খসখসে বাঁধানো শানে ঘসা ধাঁরালো ঝিনুক ছিল আমাদের টিফিন পিরিয়ডে কাঁচা আম, মরিচের গুড়ো, লবন দিয়ে মাখানোর জন্য, এমনকি ছুটির দিনেও মা-চাচীদের ব্যাস্ত হাত, ধারালো বটির ফুরসতের অপেক্ষা না করলেও চলতো আমাদের।
ঐ সব চৈত্র দিনে স্কুল খোলা থাকতো। মাগরেবের আযানের সাথে সাথে মাঠের খেলা ফেলে ঘরে ঢুকে পড়তে বসতে হোত। ব্যাতিক্রম, মেলার দিন। সকাল থেকেই পয়সার ধান্দায় থাকতাম। শীতলা বাড়ীর পাশে বুড়ো বটতলায় বিকেল থেকেই যদিও মেলা বসতো, সন্ধ্যায় হ্যাজাকের ঝলমলে আলোয় হোত জমজমাট, লোকজনের ভীড়ে গম গম করতো। প্যান্ডেলে অনেক রাত পর্যন্ত যাত্রা হোত। স্কুলে মেলার ঢের আগেই আমরা ঐসব খবর পেয়ে যেতাম।
জ্বীন-ভুতের মত ছেলে ধরার ভয়ও ছিলো। স্কুলে যাবার পথে শেওরা আর বৈচিগাছের মোড় পার হতাম দল বেধেঁ। যদিও কোন দিন ছেলেধরা দেখিনি, তবুও ভয়েই অচেনা পথে বা দলে যেতাম না। চৈত্রের এই মেলায় সন্ধ্যার পরে এশার আজান পর্যন্ত থাকার জন্য খুব কস্ট করেই অনুমতি মিলতো শর্ত সাপেক্ষে।
লাল নীল কাগজে সাজানো মেলা প্রাঙ্গনে চাটাই, মাদুর বিছিয়ে দূর দুরান্ত থেকে আসা কামার, কুমোর, ছুতোর দোকান সাজিয়ে বসতো। গৃহস্থালির ডালা, কুলো, ডাল ঘুটনি, দা, বটি, খুন্তি, ঝাজরি চামচ, মাটির হাড়ি, ঢাকনা, মালসা, পিঠের খোলা, পয়সা জমানোর ব্যাংক, ছোটদের জন্য খেলনা হাড়ি, কড়াই। মাটির তৈরি চমৎকার রঙ করা খেলনা পুতুল, হাতী, ঘোড়া, হাঁস, মুরগী, আর অবাক করা খেলনা, মাথা নাড়ানো থুরথুরে বুড়ো যা একটুতেই তির তির করে মাথা নাড়তে থাকে।
তেলে ভাজার দোকানে বিরাট লোহার কড়াইএ ভাজা, জিভে পানি আনা পেয়াজি, বেগুনি, জিলেপি। মেলায় মিলতো বাতাসা, কদমা, হাওয়াই মেঠাই, মোয়া মুড়কি আরো কত কি!
সবচেয়ে ভীড় হোত লটারি আর বায়োস্কপের দোকানে। কৌতুহলি দর্শকদের টান টান উত্তেজনা থাকতো হারজিতের ফলাফলে। বেলুনওয়ালা আর বায়োস্কপ ওয়ালার সুরেলা গলার ছড়া আমাদের মন্ত্রমুগদ্ধের মত আশে পাশে দাড় করিয়ে রাখতো ঘন্টার পর ঘন্টা।
আকাশের ঝিকি মিকি তারার আলোয় দল বেঁধে বাসায় ফেরার পথ, মন পরে থাকতো মেলার উৎসবে। মাইকে তখোন হয়তো বাজছে ‘আমার সাধ না মিটিলো, আশা না পুরিলো’ বা ‘একবার বিদায় দে মা---‘
পরদিন পহেলা বৈশাখে মেলা থেকে কেনা খেলনা মাটির হাড়ি কড়াই এ সত্যিকারের চাল ডাল দিয়ে চড়ুইভাতি ছিল আমাদের মেলার আর নুতন বছরের মধুরতম স্মৃতি। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে চাল, ডাল, আলু, ডিম, পেয়াজ, তেল, মশলার যোগার, উঠোনের কোনায় তিনটে ইট দিয়ে বানানো উনুনে সত্যিকারের আগুনে কাঁচা হাতের প্রথম রান্নার আনন্দ ভোলা যায় না।
বাজারের দোকানে দোকানে হালখাতার মানে বুঝতামনা, তবে সাজানো দোকানে মাইকে বাজানো গানে আর মিস্টি বিতরনে উৎসবের আমেজ থাকতো। আব্বা মালসার মুখে কলাপাতা দিয়ে ঢাকা দই নিয়ে আসতেন। ভাতঘুম থেকে উঠে বিকেলে খেলতে যাবার আগেই টের পেতাম প্রবল বিক্রমে কাল বোশেখি ধেয়ে আসছে। চরাচর আঁধার হয়ে, আকাশে মত্ত হাতীর মত মেঘের মাতামাতি, চোখ ধাঁধানো বিদ্যুৎ, কান ফাটানো আওয়াজে আমাদের পীলে চমকে উঠতো। শন শনে তীব্র বাতাশে ক্ষয় ক্ষতির পরিমান কিন্তু কম থাকতো না। আম বাগানে গাছের নীচে পড়ে বিছিয়ে থাকা আম কুড়ানো ছিল আমাদের ছোটবেলার আর একটি আনন্দময় স্মৃতি।
পহেলা বৈশাখ, বছর শুরুর মোহন সুর,
স্বপ্ন দেখায় সামনে আছে,
আগামীর ঐ অচিনপুর।
গুপ্তধনে থাকেই কিছু আনন্দেরই রঙ্গীন স্মৃতি
অনুভবেই ছড়িয়ে থাকে পরিতৃপ্তির ঐ পরিচিতি।
কত্ত মানুষ, ঢাকের বাদ্য, হ্যাজাক জ্বলা,
গম গমা গম চৈত্র মেলা,
সদল বলে অবাক হওয়া,
কৌতুহলের কিশোর বেলা।
পাঁচটা সিকি মুঠোয় ছিল,
ইচ্ছে ছিল, স্বপ্ন ছিল কল্পনাতে,
চাওয়া পাওয়ার অনুপাতে,
অমিলও সেই সূচনাতে।
তখন থেকেই সঙ্গী হোল অবুঝ অভিমান,
শাষন আদর সীমানাতেই
হোল শুরু জীবন মেলার গান।
চড়ুইভাতি, মেলা এবং জোনাক রাতের,
অনেক আপন ছোট্ট শহর,
স্মৃতির মোহর ঝকমকিয়ে
ফেরত আনে সেদিনের সেই চৈত্র প্রহর।
আসমা খান, অটোয়া।
মন্তব্য
......... সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি ......
অনেক ধন্যবাদ, নববর্ষের অগ্রিম শুভেচ্ছা।
দিন গুলো সেই সোনার খাচায় রইলোনা রইলো নাআআআ !
ধন্যবাদ। সোনার খাচার দিনগুলিতো সোনার খাচাতেই থাকে!
আমার গ্রামে কাটানো পুরোন সেই দিন গুলোর কথা মনে করিয়ে দিলেন। আমাদের গ্রামে আর একটা জিনিস হত, সন্ন্যাসী, হনুমান, রাম, কালী , মহাদেব সেজে আসতো।
শুভ চৈত্র সংক্রান্তি
লেখাটি সময় নিয়ে পড়ে মন্তব্য করার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।
শুভ নববর্ষ!!!
চমৎকার!সোনার খঁচার বনধ দরজাটা একটু খুলে দেখা গেল। তবে এখন যদি ঢাকায় থাকতেন দেখতে পেতেন পহেলা বৈশাখ উযযাপন কী বিপুল সমারোহে! মিনু ভাবী।
অশেষ ধন্যবাদ। গতকাল রাত থেকেই এটিএন বাংলা আর এনটিভির কল্যানে ঢাকার বর্ষ বরনের উতসবের ছোঁয়া পাচ্ছি।
ষুভ নববর্ষ!!!
আপনার লেখা বিষয়গুলোর সাথে আমার শৈশব কৈশোরের স্মৃতি মেশানো। খুব ভালো লাগলো।
নতুন মন্তব্য করুন