আমার গ্রামের নাম "ক" (ছদ্ম নাম)। পাবনা জেলার সুজানগর থানার সাতবাড়িয়া ইউনিয়নে পদ্মার পাড়ে অবস্থিত নিভৃত এক পল্লীগ্রাম। জেলা শহর থেকে ৩০ কিঃমিঃ আর থানা সদর থেকে ১০ কিঃমিঃ দক্ষিণপূর্ব দিকে। (এই কথা শোনার পর অনেক বন্ধু তখন হঠাৎ অনেক সিরিয়াস হয়ে বলে “হ, তোরে দেখলেই সেইডা টের পাওয়া যায়” )।
ছোটো বেলায় যখন ঈদ বা অন্য যেকোন উপলক্ষে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার সু্যোগ পেতাম তখন কমপক্ষে এক সপ্তহ আগে থেকে দিনক্ষণ গোনা শুরু হতো কবে গ্রামে যাব। তখন গ্রাম মানেই ছিল নির্মল আনন্দে সারাদিন ছুটে বেড়ানো।
তখন (ঠিক কবে তা খেয়াল নাই তবে আজ থেকে প্রায় ১৫-১৬ বছর আগে হবে হয়তো) গ্রামের সবচেয়ে ভাল দিক ছিল প্রভাব-প্রতিপত্তি ও রাজনৈতিক হানাহানি ছিলনা বললেই চলে। গ্রামের মানুষগুলোর একতা ছিল গ্রামভিত্তিক এবং প্রায় সব কর্মকাণ্ড ও আচার-অনুষ্ঠান পরিচালিত হতো ওই একই ভিত্তিতে। সহজ কথায় তখন কে কোন রাজনৈতিক মতাদর্শের সেটা মুখ্য ছিল না, আমরা কোন গ্রামের সেটাই মুখ্য ছিল। ঈদের সময়কে টার্গেট করে হাডুডু, ফুটবল ও পরের দিকে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হতো, বিভিন্ন গ্রাম থেকে টিম থাকতো। এলাকার গণ্যমান্য আর সম্মানিত ব্যাক্তিরা তাতে পৃষ্ঠপোষকতা করতো। খেলাধূলাকে কেন্দ্র করে রীতিমতো উৎসব উৎসব একটা ভাব বিরাজ করত। আর এখন আমাদের গ্রাম কেন আশেপাশের দুই-চারটা ইউনিয়নে কোন খেলার টুর্নামেন্ট হয়েছে বলে গত ৫-৭ বছর শুনি নাই। কিছু উদ্দ্যোকের কথা শুনেছি, তবে সেইগুলো শুরুতেই বিনষ্ট হয়েছে হয় ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের গুতাগুতির জন্য অথবা একাই রাজনৈতিক দলের ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপের ঠ্যালাঠ্যালির জন্য। আমাদের গ্রামের হাটে আগে পাশাপাশি বাংলাদেশের দুইটা বৃহৎ রাজনৈতিক দলের ক্লাব ঘর ছিল। তাদের সহাবস্থান ছিল শান্তিপূর্ণ ও পেশীশক্তি বিহীন। আর এখন তাদের গুতাগুতির জন্য ক্লাব দুইটা তো বটেই পুরা হাট-বাজারটাই উধাউ হয়ে গেছে। গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলো দিন দিন কেমন যেন সহিংস হয়ে যাচ্ছে।
গ্রামের দিগিন্তজোড়া ধান ক্ষেত আর দেখি না। মাঠের আশেপাশে বিছিন্ন দ্বীপের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঘরবাড়ি গুলো এখন বড়সড় পাড়ায় পরিণত হয়েছে। উত্তাল পদ্মা, প্রমত্তা পদ্মা এখন শুধু বইপত্রে পাওয়া যায়। বর্ষার ২-৩ মাস বাদে বছরের বাকি সময়ে পদ্মার বুকে থাকে ধুধু বালুচর। অনেক ছোট বেলায় আমার নানা ভাই (পরলোক গমন করেছেন ২০০২ সালে) এর সাথে ভোর বেলা যেতাম পদ্মার পাড়ে যেখানে জেলে নৌকা গুলো সারা রাত মাছ ধরে (প্রধানত ইলিশ মাছ) ঘাটে ফিরত। ১.৫-২.০ কেজি ওজনের ইলিশ খুব সহজলভ্য না হলেও পকেটে পাত্তি থাকলে অন্তত কিনতে পাওয়া যেত। আর এখন ১.৫-২.০ কেজি ওজনের ইলিশ পদ্মা কেন পুরা বাঙ্গোপসাগর খুঁজলেও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে।
আমার বাবা-মার কাছে শুনেছি আমাদের গ্রামের পরে বিশাল বড় একটা ফসলের মাঠ ছিল (গ্রামের ভাষায় যাকে বলে “চখ”), এর পরে ছিল একটা গ্রাম, এর পরে ছিল পদ্মা নদী। পদ্মার ভাঙ্গনে ওই গ্রাম গেছে অনেক আগে যা আমি দেখি নাই। তবে এটা মনে আছে ছোটবেলা পদ্মাতে গোসল করে ফিরতে ফিরতে পরনের ভেজা কাপড়চোপড় আর ভেজা থাকতো না, শুঁকিয়ে যেত। আর এখন সেই পদ্মা আমাদের গ্রামের ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে। তবে আশার কথা নদীর “এ কূল ভাঙ্গে, ও কূল গড়ে” সুত্র অনুযায়ী পদ্মা এখন ও কূল (কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী জেলা) এলাকায় ভাংতেছে। আমাদের গ্রাম আপাতত রক্ষা পেল বলে মনে হচ্ছে।
এতসব হতাশার মধ্যে আশার কথাও আছে। গ্রামে অভাবগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল আগে। ফলে গ্রামে কাজ করার জন্য মানুষের অভাব ছিল না। চাষাবাদ ও বিভিন্ন গৃহস্হলির কাজের শ্রম ছিল অতি সস্তা। এ কারনে নিম্নবৃত্ত মানুষের জীবনের মানও ছিল রীতিমতো করুনদশা। কিন্তু এখন ঢাকার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি আর ক্ষুদ্রঋণের কল্যাণে তাদের অবস্থা অনেক অনেক ভাল। গ্রামের মানুষেরা এখন ঢাকামুখী, লেখাপড়া না জানা লোকজন কাজ করে গার্মেন্টস কর্মী আর নির্মান শ্রমিক হিসাবে, অল্প বিস্তর লেখাপড়া জানা লোকজন কাজ করে বিভিন্ন কোম্পানিতে। ঢাকামুখী প্রবণতা সার্বিক ভাবে হয়তো ভাল না তবে ওই গরিব মানুষগুলোর দারিদ্রতা কমছে অনেকাংশে। তার জন্য গ্রামে এখন চাষাবাদ ও বিভিন্ন গৃহস্হলির কাজের লোক পাওয়া এখন দুষ্কর।
এলাকায় ব্রাকের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চোখে পরার মত। আমরা যারা ঢাকাতে বন্ধুদের নিয়ে কোন একটা ভাল রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ বা ডিনার করে ২০০০ টাকা হরহামেশাতে খরচ করতে পারি তাদের পক্ষে গ্রামের ওই নিম্নবৃত্ত মানুষের (যাদের শখ করে ২ টাকা দিয়ে একটা মিনিপ্যাক শ্যাম্পু কেনার সামর্থ্য নাই) নিকট ২০০০ টাকার মূল্য কত তা বোঝা সত্যি অসম্ভব।
সব মিলিয়ে গ্রামের অবস্থ আগে ভাল ছিল নাকি এখন ভাল সেই সিদ্ধান্তে আসা মুশকিল। আগে প্রকট দারিদ্রতা ছিল আবার একটা শান্তি শান্তি ভাব ছিল, আর এখন দারিদ্রতা কমেছে সেই সাথে কমেছে শান্তি। আগামী ২০ বছরে পল্লীগ্রামের ঐতিহ্য হয়তো আরো ক্ষয়ে যাবে, তার পরও গ্রাম গ্রামই............আমার বাপ-দাদার ভিটে।
মন্তব্য
গ্রাম শব্দটি প্রকৃতির সাথে এমন ভাবে জড়িয়ে কিন্তু দিনে দিনে শব্দ দুটি কেবলে একে অন্যের কাছে কার্যকারিতায় অনেক দূরে সরে যাচ্ছে।
পোস্টের জন্য শুভেচ্ছা।
১.৫-২.০ কেজির মাছ এখন ও আছে । লিংক দিতে পারছিনা কয়েকদিন আগে আমাদের এখানে(বরিশাল) এক কেজি সাতশ গ্রামের এক ইলিশ বিক্রি হয়েছে সাড়ে ছয় হাজারে যা খবরের কাগজে পড়েছিলাম।
লেখকের নাম কোথায়? ছদ্মনাম হলেও দিতে পারেন।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
লেখকের নাম পালাশ।
লেখকের নাম পালাশ।
পালাশ?
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
আপনি আমি প্রতিবেশী - আমার বাড়ি মাজপাড়া গ্রামে।
জেনে ভালো লাগলো।
লিখাটাতে কেমন একটা আপন আপন ভাব আছে। গ্রামের সত্যিকার অভিজ্ঞতা নিয়ে আরও লিখুন
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আসা করি পরবর্তীতে চেষ্টা করব।
ভাল লাগলো। অনেক ভালো। আমাদের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের জীবনের চালচিত্র আমরাতো খেয়ালই করি না। আমরা মানে যারা নাগরিক জীবনের মধ্যে ভূলে গেছি আমাদের ...
ধন্যবাদ।
মন খারাপী লেখা
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ
লেখাটা খুব ভালো লাগল ।
এখন সব গ্রামেই আট-দশটা বদমাশ আছে, যেগুলা এর ওর মাঝে সঙ্ঘাত জিইয়ে রেখে মধ্যস্বত্ত ভোগ করে। টাকা না দিলে শালিসে আসে না। সে কারণে শান্তিও ভেগে গেছে।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
"গ্রাম" শুনলেই যে ছবিটা মনে ভেসে ওঠে, সেটা আস্তে-আস্তে বদলে যাচ্ছে। এটা ভালো না খারাপ, সে তর্ক বা বিতর্কে না যাই। তবে গ্রাম থেকে সবুজ আর সারল্য, এই দুইটা বিষয় না হারাক, সেটাই চাই।
নতুন মন্তব্য করুন